জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -পর্ব--৩৮ /সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম --পর্ব-৩৮

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ভারতবর্ষ ও ধর্ম


ব্রহ্মর্ষি 'আমি কে?' এই প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিয়েছেন- 'আমিই ব্রহ্ম' এই উচ্চারণে। এই জাগতিক আবির্ভাবে সেই পরম একই বিদ্যমান। কারণ এক ব্রহ্ম ছাড়া দ্বিতীয় আর কিছুই নেই। তার উপলব্ধি হল, 'এই যে আমি বেঁচে আছি, সে কি আমি?' উত্তরে তিনিই বললেন 'না, ঈশ্বরই আমার মধ্যে বাস করেছেন।" 

ভারতবর্ষের মহান্ত পুরুষগণ আধ্যাত্মিকতার ঔদার্যে অতন্দ্র জীবনের অধিকারী ছিলেন শুধু নয়, মননের অনুশীলনে ও নিত্যসেবায় অভিরঞ্জিত ছিলেন। যেখানে বিরোধ বিভ্রান্তি ব্যাকুলতা অশান্তি দ্বন্দ্ব, সেখানে সহমর্মিতার অবকাশ নেই যেখানে সহমর্মিতা নেই সেখানে সত্যের অবস্থান নেই;  আধ্যাত্মিক মুক্তির ভেতর দিয়েই সব দ্বন্দ্বের অবসান সম্ভব, অন্য কোনভাবে তা সম্ভব নয়। 

ভারতবর্ষের সংস্কৃতি ও ধর্ম বহুবর্ণরঞ্জিত ও বহুবর্ণের বৈচিত্র্যময়  সংরাগ ও সংবদ্ধতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভারতবর্ষের মহাকাব্যগুলিতে সমগ্র মানব সংস্কৃতির আদর্শ প্রতিফলিত। স্বামী বিবেকানন্দর ভাষায় বিষয়টি প্রাঞ্জল হয়েছে- "In fact the Ramayana and tha Mahabharata are,the two encyclopedias of the ancient Aryan life and wisdom, portraying an ideal civilization,which humanity has yet to aspire after" একইভাবে দার্শনিক শিক্ষাবিদ Macdonell এর মত হল, "Probably no work of world literature,secular in it's origin, has never produced so profound an influence on the life and thought of a people as the Ramayana" ভারতবর্ষের ধর্মীয় মতবাদ চিন্তন ও মনন সংস্কৃতি ও সাহিত্য- যা কিছুই গড়ে উঠেছে বা প্রকাশ পেয়েছে, তার উৎসে রয়েছে বেদ উপনিষদ মহাকাব্য ও পুরাণগুলি। রামায়ণ ভারতীয়দের জীবনচর্চার ক্ষেত্রে যুগ যুগ ধরে যে প্রভাব ফেলেছে রবীন্দ্রনাথ তার কারণ বিশ্লেষণ করেছেন- "রামায়ণের প্রধান বিশেষত্ব এই যে তাহা ঘরের কথাকেই অত্যন্ত বৃহৎ করিয়া দেখাইয়াছে। পিতা-পুত্রে ভ্রাতায়-ভ্রাতায়, স্বামী-স্ত্রীতে যে ধরনের বন্ধন, যে প্রতি প্রীতি ভক্তি সম্বন্ধ, রামায়ণ তাহাকেই এত মহৎ করিয়া তুলিয়াছে যে, তাহা অতি সহজেই মহাকাব্যের উপযুক্ত হইয়াছে। আমাদের দেশে গার্হস্থ্য আশ্রমের যে অত্যন্ত উচ্চস্থান ছিল- এই কাব্য তাহা সপ্রমাণ করিতেছে। গৃহাশ্রম আমাদের নিজের সুখের জন্য, সুবিধার জন্য ছিল না- গৃহাশ্রম সমস্ত সমাজকে ধারণ করিয়া রাখিত ও মানুষকে যথার্থভাবে মানুষ করিয়া তুলিত। গৃহাশ্রম ভারতবর্ষীয় আর্যসমাজের ভিত্তি। রামায়ণ সেই গৃহশ্রমের মহাকাব্য।" 

পৃথিবীর বহু দেশে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রামায়ণের প্রভাব মানুষের জীবনচর্চার ক্ষেত্রগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে। বৌদ্ধধর্মে এই রাম অবতাররূপে বুদ্ধদেবের জন্মান্তর সূচিত করেছে। বৌদ্ধ ধর্মে ও জৈন ধর্মে সমভাবেই মহাভারতের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বাল্মিকী রামায়ণের সূচনাপর্বের মানুষটি রবীন্দ্রনাথের কবিতায় অসাধারণ দ্যোতনায় ফুটে উঠেছে- 

ভগবান ত্রিভুবন তোমাদের প্রত্যক্ষে বিরাজ  
কহ মোরে কার নাম অমর বীণার ছন্দে বাজে। 
কহ মোরে বীর্যকার ক্ষমারে করে না অতিক্রম 
কাহার চরিত্র ঘেরি সুকঠিন ধর্মের নিয়ম 
ধরেছে সুন্দর কান্তি মানিক্যের অঙ্গদের মতো, 
মহৈশ্বর্যে আছে নম্র, মহাদৈন্যে কে হয়নি নত, 
 কে থাকে ভয়ে, বিপদে, কে একান্ত নির্ভীক, 
কে পেয়েছে সব চেয়ে, কে দিয়েছে তাহার অধিক, 
কে লয়েছে নিজ শিরে রাজভালে মুকুটের সম 
সবিনয়ে সগৌরবে ধরামাঝে দুঃখ মহত্তম, -
কহ মোরে সর্বদর্শী হে দেবর্ষি তার পূণ্য নাম। 
নারদ কহিলা ধীরে, 'অযোধ্যার রঘুপতি রাম। 

নারদের উত্তর শুনে ও বাল্মীকির সংশয় কাটেনি। তিনি বললেন- 
'তবু নাহি জানি সমগ্র বারতা, 
সকল ঘটনা তাঁর- ইতিবৃত্ত রচিব কেমনে। 
পাচ্ছে সত্যভ্রষ্ট হই, এই ভয়ে জাগে মোর মনে।' রবীন্দ্রনাথের নারদের অভিব্যক্তিতে নিজের ভাবনা প্রকাশ করলেন-
'সেই সত্য যা রচিবে তুমি, 
ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি 
রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।" 

স্বামী বিবেকানন্দ রামায়ণের সীতা সম্পর্কে তাঁর অন্তলোকের শ্রদ্ধা যে ভাষায় প্রকাশ করেছেন তা হল- "ভারতীয় নারীগণের সর্বাপেক্ষা উচ্চাকাঙ্ক্ষা- পরম  শুদ্ধস্বভাবা, পতিপরায়ণা, সর্বংসহা সীতার মত হওয়া। সমগ্র ভারতবাসীর সমক্ষে সীতা যেন সহিষ্ণুতার উচ্চতম আদর্শরূপে আজও বর্তমান। সীতা যে ভারতীয় ভাবের প্রতিনিধিস্বরূপা, যে মূর্তিমতী ভারতমাতা।" অন্যত্র তিনি "ভারতীয় নারীগণ সকলেই সীতার সন্তান"- এই শ্রদ্ধাপূর্ণ বাক্যটি প্রকাশ করে ভারতীয় নারীদের বিচার করেছেন। নিবেদিতা তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের পড়াবার সময় ভারতবর্ষের রানী কে? এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে ছাত্রীরা "ভিক্টোরিয়া" উত্তর দিলে, তিনি ধিক্কার জানিয়ে তাদের বলেন- ছিঃ ছিঃ, তোমরা ভারতের রানীর নাম জানো না! তোমাদের রানীর নাম সীতা। সীতা ভারতের চিরকালের রানী।"

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments