জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব-৪১/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব-৪১

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ভারতবর্ষ ও ধর্ম


হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন নীতিশাস্ত্রে আইনের অনুশাসনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আইনকে অন্য অর্থে 'সত্য' বলে বর্ণনা করা হত। ভারতবর্ষের ইতিহাসে দ্রাবিড় সভ্যতার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। খ্রিঃপূঃ প্রথম শতাব্দে মানুষের নৈতিকতা পালনে ও সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে Tiru-K Kurul এর উপদেশাবলী মানুষের সার্বিক চরিত্র গঠনে ও আধ্যাত্মিক বিকাশে স্মরণীয় হয়ে আছে। বিখ্যাত এই কবির উপদেশগুলির কয়েকটি আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। 
 
১। স্বজন প্রিয়জনদের থেকে যে মানুষ দূরে রাখে নিজেকে সেই মানুষকে দূরেই রাখতে হবে। কারণ তার স্বজন সমাজ কোনো বন্ধন না থাকার ফলে সে যে কোনো অন্যায় কাজ করে নিস্তার পেয়ে যায়। তাকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যায় না। 
২। পরীক্ষা না করে কাউকে কোনো কাজে নিযুক্ত করা উচিত নয়। কিন্তু পরীক্ষা করে নিযুক্ত করার পর, তাকে কখনও অবিশ্বাস করা উচিত নয়। 
৩। রাজার কর্তব্য বহিঃশত্রুর হাত থেকে রাজ্য ও প্রজাদের রক্ষা করা এবং প্রজাদের সার্বিক কল্যাণের দিকগুলির দিকে সব সময় নজর রাখা। 
৪। যারা আইনের অনুশাসন মানবে না বা আইনের পথে চলবে না তাদের সমুচিত দণ্ড দিতেই হবে। 
৫। জমির ফসলকে রক্ষা করার জন্যে আগাছা যেমন তুলে ফেলতে হয়, তেমনি গুরুতর অপরাধের জন্যে অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দিতে হবে। 
৬। তারাই বেশি কথা বলে, যারা অল্প কথায় সঠিক বক্তব্য সুন্দর ভাবে তুলে ধরতে পারে না। 
৭। যে কোন কাজে পরিকল্পনার কথা অনেকেই বলে। কিন্তু সেই মানুষটিই পরিকল্পনার কথা বলার যোগ্য যে উদ্যোগী হয়ে পরিকল্পনাটিকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে। 
৮। সংসারে এমন বহু মানুষ আছে, যাদের চোখ দেখে বোঝাই যায় না যে, তারা অসাধারণ মানসিক শক্তির অধিকারী এবং কাজ কর্মেও ততোধিক উদ্যোগী। অকিঞ্চিৎকর একটি পিন যা রথের চাকাকে সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়ার সহায়ক, এই সব মানুষও তেমনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেখনসই না হলেও কাজের দিক দিয়ে তারা অপরিহার্য, দক্ষ ও মজবুত। দেখতে ভালো নয় বলে কাউকে দূরে সরিয়ে রাখা উচিত নয়। 
৯। ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে পরিকল্পনা করা উচিত। একবার পরিকল্পনা করার পর আর পিছিয়ে যাওয়া চলে না এবং যে কোনো প্রতিবন্ধকতা অপসারিত করে এগিয়ে যাওয়াই কর্তব্য। আর পরিকল্পনা রূপায়নে কোনভাবেই দীর্ঘসূত্রী হওয়া চলে না। 
১০। ভালো লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব, ভালো বইয়ের মতোই অন্তস্পর্শী, যার সজীবতা কখনও হ্রাস পায় না বরং তা আনন্দের উৎস হয়ে প্রতিদিন মনকে উদ্দীপনায় ভরিয়ে রাখে এবং মননের নিত্য অনুষঙ্গী হয়। 

বন্ধুত্বের বৈশিষ্ট্য বিষয়ে Tiru-K Kurul এর উপদেশাবলি তার কাব্যের মূল্যবান অংশ হয়ে আজও মানব সমাজে অত্যন্ত উপযোগী এবং সেগুলি বাস্তব জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে পথ প্রদর্শক হয়ে আছে, যেমন: 

১। সেই বন্ধুত্বই সঠিক যা আচরণিক ক্ষেত্রে হাসি-ঠাট্টার মধ্যেই শেষ হয় না। সঠিক বন্ধুত্ব প্রয়োজনে কঠোর এবং বন্ধুর পথভ্রষ্ট হওয়ার অন্তরায়। 
২। সেই-ই প্রকৃত বন্ধু যে বিপদের সময় বন্ধুর পাশে থাকে এবং আপদে-বিপদে বন্ধুকে রক্ষা করে যাতে বন্ধুটি বিপথগামী না হয়। 
৩। মনের মিলই বন্ধুত্বের আসল পরিচয় বহন করে। বন্ধুর সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ না থাকলেও অন্তরের মিলটি থাকা চাই-ই চাই। 
৪। এমন কিছু ভাবা কখনই উচিত নয়, যা মনকে উজ্জীবিত করে না। কেউ যদি তোমাকে দুঃসময়ে দুর্বলও করে দেয়, তবু তোমার বন্ধুত্ব থেকে তাকে বঞ্চিত করো না। 
৫। বোকা লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব না থাকাই ভালো। তাতে ভালো বই মন্দ হয় না। 
৬। এমন বন্ধুও আছে যে ঘরে এমনকি গোপনেও তোমার বিরুদ্ধাচারণ করতে দ্বিধা করে না; কিন্তু সেই বন্ধু অত্যন্ত ক্ষতিকর ব্যক্তি, যে প্রকাশ্যে বহু মানুষের সমাবেশে তোমাকে আক্রমণ করে। এমন বন্ধুর সঙ্গে কখনও সংযোগ রেখো না। 
৭। ঘৃণা ব্যাপারটাই এমন যে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ওপর তার প্রভাব পড়ে না বা বিদ্বেষ দূর করতেও সে অপারগ। এ কি সত্য, -মনের এমন ক্ষমতা আছে যা অযৌক্তিক ঘৃণাবোধকে স্থায়ীভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে মানুষ যদি শিক্ষিত ও দর্শন অভিজ্ঞও হয়? 
৮। দুশ্চরিত্রের মত খারাপ আর কিছুই হতে পারে না। বস্ত্র দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করলেও কুশ্রী যা তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। দুশ্চরিত্র বিষয়টিও তাই। 
৯। এমন যদি হয়, তোমার সামনে কোন সহযোগী বন্ধু নেই, বরং দু জন শত্রুতা করার জন্য হাজির। এই অবস্থায় এই দুজনের একজনের সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করে বোঝাপড়া করে নাও এবং প্রয়োজনে বন্ধুত্ব স্থাপন করো। 
১০। যদি এমন সময় আসে- তুমি দুঃসময়ের শিকার হয়ে পড়েছো, এমতাবস্থায় নুতন করে অন্য কোনো উদ্যোগে হাত দিয়ো না এবং কে তোমার শত্রু বা মিত্র, এই বিচারে না গিয়ে সাম্য বজায় রেখে সমদর্শী থাকো। 
১১। জুয়া খেলায় জিততে পারো, কিন্তু এই খেলা কখনো খেলো না। মাছের টোপে বঁড়শি থাকে; মাছ টোপ খেতে গিয়ে বঁড়শিতে গাঁথা পড়ে নিজের মৃত্যু নিজে ডেকে আনে। 
১২। যারা হাসতে জানে না, তাদের কাছে এই বিরাট পৃথিবী দিনের আলোতেও অন্ধকারময়। আলোই আনন্দ পৃথিবীকে আলোকিত রাখে। 
১৩। শৌর্যশালী ব্যাক্তিই বহু মানুষের প্রয়োজনে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম, যে নেতৃত্ব শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, শান্তির সময়েও উপযোগী। যার সাহস আছে, অন্যের তুলনায় ক্ষমতাবান, সেই পারে বন্ধুর পাশে দাঁড়াতে এবং সমাজের অগ্রগতির পথে অগ্রণী ভূমিকা নিতে। 
১৪। যে সমাজ কল্যাণে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছে, তার সামনে বহু বিপদ; তাকে বহু ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করেই এগোতে হয়। সে বহু হিতের জন্যে আত্মত্যাগ করতে পিছপা হয় না। পরিবর্তনের প্রাথমিক শর্ত হল, পরিবর্তনকামীর আত্মহত্যা সংকল্প, দুঃখবরণই তার প্রধান শক্তি ও সহায়। তার মধ্যে দিয়েই সে সমাজকল্যাণের কাজে এগিয়ে যায়। (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments