জ্বলদর্চি

বৃত্ত /পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়


বৃত্ত

পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

(১)
অক্টোবরের বারো তারিখ আজ। গত তিনদিন থেকে প্রায় গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে শুরু হয়েছে প্রবল নিম্নচাপ ও লাগাতার ঝড়বৃষ্টির দাপট। এখন রাত আটটা। এর মধ্যে ভি.আই.পি রোড শুনশান। ইতিউতি রাস্তার উপর হুমড়ি খেয়ে আছে দু একটা ভেঙে পড়া গাছ, ছিঁড়ে যাওয়া ইলেকট্রিকের তার।
এর মধ্যে অশীতিপর রাধামধব মুখার্জি একটা সাদা হাফশার্ট আর হাঁটু পর্যন্ত হাফপ্যান্ট পরে বিড়বিড় করে  বকতে বকতে হলদিরামের মুখ থেকে তেঘড়িয়ার দিকে  হেঁটে চলেছেন। রাধামাধব স্থানীয় একটি হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত জাঁদরেল হেডমাস্টার। গত চার বছর ধরে অ্যালজাইমার রোগে আক্রান্ত। প্রথমে সাম্প্রতিক স্মৃতিগুলো লোপ পেতে শুরু করেছিল। এখন আর স্থান, কাল,  পাত্র, এমন কি নিজের নাম, বাড়ির ঠিকানা এসব কিছুই মনে থাকে না। এ রোগটাতে এমনই হয়। এমনিতে এ সময় ভি.আই.পি রোড জেগে থাকে। এখন প্রকৃতির অবসাদের কারণে সে ও তার পাশের নগরজীবন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শুধু দু-একটা রাস্তার কুকুর পাশের নোংরা গাড়িবারান্দাগুলোয় গুটিসুটি মেরে হাই তুলছে। কতকগুলো মশা  অকারণে জ্বালাতন করছে তাদের। কুকুরের রক্ত তাদের বোধহয় রোচে না। জ্বালাতন করাটা তাদের অভ্যাস।
রাধামাধববাবুর মাথায় ছাতা নেই। চোখের পুরোনো ফ্রেমের চশমার কাচে অযত্নের কারণে অসংখ্য  স্ক্র্যাচ। সেটি নাক দিয়ে পিছলে নেমে এসেছে ঈষৎ নিচে।  তাতে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁর। অ্যালজাইমার হওয়া মানুষদের ওসব কিছু খেয়াল থাকে না।  থাকে না কোনও অতীত-বর্তমান, ভালো-মন্দের ভেদাভেদ। জীবনের বাকি কয়েকটা দিন পালহীন নৌকার মত নিরুদ্দেশে ভেসে চলেন তাঁরা, যার সাথে  ভেসে চলে মানবিক সত্তা, বর্তমানের দোলাচলের জীবন, ভবিষ্যতের স্বপ্ন, জীবনের পথে পরিকল্পনা মাফিক চলতে চলতে হঠাৎ করে থেমে যাওয়া বিকল যানের মত অচলাবস্থা।
(২)
গোপীবল্লভ রাধামাধবের একমাত্র সন্তান। তিনিও বেশ কিছুদিন আগে প্রৌঢ়ত্ব ছাড়িয়ে এখন পঞ্চাশের কোঠায়। চাকরি ব্যবসা করেন না। সেই অর্থে মাস গেলে আয়- উপার্জন নেই। পড়াশোনাতে  বাবার মত মাথা ও মতি  কোনওদিন ছিল না তাঁর। রাধামাধব প্রথম প্রথম মানতে অসুবিধে হত ছেলের এমন ধারা অবস্থা। ফলত তাঁর ছাত্রজীবনের প্রথম দিকে চেষ্টা করেছিলেন গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করার। পরে নিজের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খ্যান্ত দিয়েছেন প্রচেষ্টায়। তাঁর এতে অতৃপ্তির যন্ত্রণা থাকলেও মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন ছেলে গোপী। তারপর আয়েশে বিলাসে জীবন ভাসিয়ে দিয়েছেন এই আধবুড়ো বয়স পর্যন্ত। বাবার তৈরি করা বিষয় সম্পত্তি ভেঙে খেতে খেতে চল্লিশের কোঠায়  এসে বিয়েও করেছেন একটা।তাঁর অসময়ের সন্তান জিজ্ঞাসা'র বয়স এখন বয়স দশ বছর। গোপীবল্লভের অপদার্থতায় প্রতিবেশী পরিজনেরা ছি ছি করলেও তাতে তাঁর আসে যায়নি কিছু। বরং সে কারণে যত না অখ্যাতি জুটেছে ছেলের, তার থেকে বেশি দুর্নাম জুটেছে বাবার। মানুষ রাধামাধবকে বাউন্ডুলে ছেলের দায়-দায়িত্বহীন বাবা বলে অভিহিত করেছেন অনেকে। গোপীবল্লভের অবশ্য এসবে কিছু যায় আসে না। যেমন যায় আসে না তাঁর বাবার অতীত সুখ্যাতি বা অধুনা বিপন্নতা নিয়ে।  তিনি দু'বেলা দু'মুঠো খেতে পেলে এবং ঘুমোতে পারলেই নিজেকে ধন্য মানেন।  নিজের ছেলেকে নিয়েও গোপীর স্বপ্ন উচ্চাশা কোনওটাই নেই। যেমন নেই তাঁর বাবাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা বা উৎকণ্ঠা। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে রাধামাধব মাঝে মাঝেই কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে যেতেন বাড়ি থেকে। গোপীবল্লভ প্রথম প্রথম তাতে একট অসহায় বোধ করত, যত না বাবার হারিয়ে যাওয়ার কারণে দুশ্চিন্তায়, তার থেকে ঢের বেশি ছেলে হিসেবে তার অপদার্থতার সমালোচনার ভয়ে। এখন অবশ্য কোনও কিছুর পরোয়া নেই তাঁর। ফলে রাত বারোটা নাগাদ পাশের পাড়ার  পরিচিত চায়ের দোকানি হরিমোহন সাহা যখন রাধামাধবকে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে খুশি খুশি গলায় বললেন, 'আমার দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বসে বসে পা দোলাচ্ছিলেন, আমি চিনতে পেরে পৌঁছে দিলাম'। তখন গোপীবল্লভ তার দিয়ে নিরাসক্ত ভাবে তাকিয়ে কেবল বললেন, 'অ!'
(৩)
জিজ্ঞাসা শান্ত চুপচাপ স্বভাবের ছেলে। ফরসা, রোগা, লম্বা। বড় বড় চোখ। ঠাকুরদার বড় ন্যাওটা  সে। বাড়ির মধ্যে যখন যেখানে যান ঠাকুরদা,  এখনও সে সেখানে তাঁর পিছু পিছু ঘুরঘুর করে । আগে আবোলতাবোল প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলত তাঁকে। তিনি প্রশ্রয়ের হাসি হেসে উত্তর দিতেন সব প্রশ্নের। শিশুর মনে সীমাহীন কৌতূহল, অনন্ত জিজ্ঞাসা। এই পৃথিবী, তার জল, মাটি ,হাওয়া, জন্ম, মৃত্যু, আনন্দ, দুঃখ সব কিছু খেলার ছলে ঘুরে ঘুরে আসত জিজ্ঞাসার প্রশ্নে। ঠাকুরদা শিশুর মত করে আগল খুলে দিতেন তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডারের। তারপর যখন তিনি নিজেই একসময় এক জিজ্ঞাসা চিহ্ন হয়ে গেলেন নাতির সামনে তখন ধীরে ধীরে তা বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা তার মায়াময় গভীর চোখ দিয়ে নিজের সামর্থ্যমত শিশু ভরসায় ভরিয়ে দিতে শুরু করল ঠাকুরদার বিপন্নতা ও অসহায়ত্বকে।
তাঁর ভাষাহীন চোখ, বোধহীন মন আর মৃত হয়ে যাওয়া স্মৃতির মধ্যেই শিশু খুঁজে ফিরতে থাকল তাঁর রঙিন ফুলের মত ঠাকুরদার সঙ্গে কাটানো অতীতকে।

        সেদিন ভোর রাতেই রাধামাধবের মৃত্যু হয়েছিল নিজের বাড়িতে, ছেলের থেকে মানসিক দূরত্বে ও এক বুদ্ধি না হওয়া অপরিণত শিশুর নৈকট্যে। শিশুর বাস্তবজ্ঞানহীন ছোট হাত তখন ঠাকুরদার মাথায়। পরিণতমনস্কতার বোধ কি এমনই, যা প্রিয়জনকে দূরে ঠেলে দেয় স্বার্থের সংঘাতে? একই প্রাপ্তি কি ভবিষ্যতে অপেক্ষা করে আছে গোপীবল্লভের অদৃষ্টেও?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇





Post a Comment

0 Comments