জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৮/ রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে 
রোশেনারা খান
পর্ব ৮

বরাবরই আমি কল্পনাপ্রবণ। ছোট পিসির(শিউলি)বড় মেয়ের নাম ছিল পরি। আমি ভেবে বসলাম পরির নিশ্চয় ডানা আছে! আমাকে তো তাহলে দেখতে যেতে হয়। বাবার কাছে গিয়ে আবদার করলাম, বাবা আমি পরি দেখতে যাব। পিসিদের বাড়ি খুব একটা আসাযাওয়া ছিল না। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থ্যার এত উন্নতি হয়নি। তো একদিন সকালে বাবা আমাকে সাইকেলে সামনে বসিয়ে(সামনে বাচ্চাদের বসার সীট লাগান ছিল) ছোটপিসির বাড়ি রওনা দিলেন। কিন্তু ওখানে গিয়ে জানলাম, পরি কলকাতা গেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। দুপুরে খেয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। তবে ছোটপিসির বাড়িতে কাচের আলমারি ভরা খেলনা দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম। ছোট ছোট চেয়ার-টেবিল, আলমারি, সারি সারি ছোট ছোট জুতো, দম দেওয়া ভালুক, আরও অনেককিছু। পরে জেনেছিলাম ওগুলো পিসেমশায়ের শখের জিনিস।
      মেজ কাকিমার সঙ্গে ছোটপিসের সম্পর্কটা ছিল খুব গোলমেলে। পিসেমশাই ছিলেন মেজকাকিমার আপন মামা। তাই উনি কাকিমাকে নাম ধরে দোলেনা বলে ডাকতেন। এই সম্পর্ক পুরনো। তারপরে মেজকাকার সঙ্গে কাকিমার বিয়ে হয়। মেজকাকিমা আর সেজকাকিমা ছোটথেকেই বন্ধু ছিলেন। দুজন দুজনকে ‘বন্ধু’ বলে সম্বোধন করতে শুনেছি। স্বভাবতই আমাদের থেকে মেজকাকার পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কটা গভীর ছিল। পিসেমশাই যেখানে যেতেন, দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। পরিকে, মানে পরিদিকে দেখার সুযোগ পেলাম, পিসেমসাই দুই মেয়েকে নিয়ে মেজকাকার বাড়ি এলে। না, পরির ডানা নেই, আমাদেরই মত দেখতে। ছোট পিসির বড় আর মেজমেয়ে পিঠোপিঠি। মেজমেয়ের নাম সুফিয়া। পরির ডানা না থাকলেও দুজনের সাজগোজ সিনেমার নায়িকাদের মত, খুব সুন্দর। দুজনের পায়ের স্যান্ডেল থেকে চুলের ক্লিপ, সবকিছু একইরকম। তবে একজন বেঁটে আর একজন অনেকটা ছোট পিসির মত।
                  কিছুদিন পর মেজকাকিমা সব ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে মামার বাড়ি বেড়াতে গেলেন। ফিরে আসতে দেখলাম ওঁরা সবাইকে দামি দামি নতুন জামাকাপড় দিয়েছেন। মিরার ফ্রকখানা খুব সুন্দর। এর মাসদুই পরে ছোটপিসির বড়ছেলে আবুহেনা সরকার মামাবাড়ি এলেন এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে। তার একদিন পরেই মোল্লা ডেকে শোভানারাদির সঙ্গে আবুদার বিয়ে হয়ে গেল। ছোটপিসির বাড়িতে কেউ কিছু জানল না। প্রসঙ্গত জানাই দক্ষিণভারতে(হিন্দুদের) যেমন মামার সঙ্গে ভাগ্নির বিয়ে বৈধ, ঠিক তেমনি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মাসতুতো, পিসতুতো, মামাতো, খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে বৈধ। তবে ইদানিং এই ধরণের বিয়ে খুব একটা হয় না। শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা করতে রাজি হয়না। ইসলামে এই বিয়েকে বৈধতার স্বীকৃতি দেওয়া হলেও এও বলা হয়েছে রক্তের সম্পর্কের মধ্যে বিয়ে হলে সন্তান দুর্বল হয়। আমার দেখা এই রকম বিয়েতে দেখেছি, তাঁদের একাধিক শিশু সন্তানের মৃত্যু হয়েছে দুরারোগ্য রোগে।
      সে যাইহোক  এই বিয়ের হোতা ছিলেন আবুকাকা। মেজকাকার সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। পিসেমশায়ের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক ছিল। তাই সাহস পেয়েছিলেন এই বিয়ে দেওয়ার। বিয়ের পর আবুদা এখানেই থেকে গেলেন। বাবার  ভয়ে বাড়ি ফিরতে পারছিলেন না। আবুকাকা গিয়ে পিসেমশাইকে বুঝিয়ে শান্ত করার পর আবুদা  বাড়ি ফিরে গেলেন। কিছুদিন পর পালকি এল শোভানারাদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। নিতে এসেছিল পিসির ছোটমেয়ে আনারকলিদি। ওর ভাল নাম ছিল হাসনুহেনা। শোভানারাদিকে আমার সেজ ও ছোটকাকিমার মা, সিরাজুদ্দিন সরকারের স্ত্রী খুব সুন্দর একখানা সোনার নেকলেস দিয়েছিলেন। বিবাহিত জীবনে শোভানারাদি কতটা সুখি হয়েছিলেন জানিনা। আর ছোটপিসির বিবাহিত জীবন সমন্ধে যা শুনেছি, তা বিশ্বাস করতে মন চায় না। তবে  পিসেমশাই দরাজ মনের মানুষ ছিলেন বলে শুনেছি। উনি খুব ফুটবল খেলা ভাল  বাসতেন। যে সমস্ত খেলোয়াড়রা ওই গ্রামে খেলতে আসতেন তাঁদের জন্য এলাহি খাবারের আয়োজন করতেন। প্রত্যেকের জন্য একটা করে গোটা মুরগি রান্না করে খেতে দেওয়া হত।
      দ্বিতীয়বার ছোটপিসির বাড়ি গেছলাম আমি আর মিরা গরুরগাড়ি চড়ে শোভানারাদিকে নিতে। এর একবছর পরে জামাইবাবু, মেজদি দুই ছেলে আর  ভাইঝি মিনুকে নিয়ে গরুরগাড়ি চড়ে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে মামাবাড়ি যাচ্ছিলেন। গাড়ি থামিয়ে নেমে এসে মেজদি মাকে বলল আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। মা প্রথমে না করলেও শেষে রাজি হন। তখন সবে নতুন ক্লাস শুরু হয়েছে। সবার বই কেনা হয়নি। তাই পড়াও শুরু হয়নি সেভাবে। আমি মহা আনন্দে  গরুগাড়িতে  উঠে পড়লাম। গাড়ি চলছে দুলকিচালে। গাড়োয়ান মাঝে মাঝে গরুর ল্যাজকে মুড়ে পিঠে হালবাড়ি( জমিতে হাল দেওয়ার সময় যে লাঠি দিয়ে গরুকে মারা হয়)মারলে গাড়ি জোরে ছোটে। এভাবে কত গ্রাম, জনপদ, জঙ্গল পার হয়ে চলেছি। মাঝে তেষ্টা পাওয়াতে এক আদিবাসী গ্রামে কাঁসার ঘটি ও দড়ি চেয়ে নিয়ে কুয়ো থেকে জল তুলে সবাই মিলে খেলাম। আবার যাত্রা শুরু হল। প্রায় বিকেলের দিকে পলাশচাপড়ি গ্রামে পৌঁছালাম। এখানে তখন শিলবতীর তীরে মস্ত মেলা বসেছে। আমরা গাড়ি থেকে নেমে জিলিপি পাঁপড়ভাজা খেলাম। জামাইবাবু আমাকে আর  মিনুকে চুড়ি, চুলেরক্লিপ, ফিতে কিনে দিলেন। নদী পার হয়ে গরুরগাড়ি আবার চলতে শুরু করল। নদী সংলগ্ন দু’দিকের ক্ষেতগুলি আলু, মুলো,  পালং ইত্যাদি সবজীতে সবুজ হয়ে রয়েছে। তারই মাঝে বা ক্ষেতের আলে হলুদ রঙের সর্ষেফুল চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। সন্ধ্যায় আমরা জামাইবাবুর মামাবাড়ি পৌঁছালম। গ্রামের নাম সঠিক মনে নেই, তবে ধাইখণ্ড বা এইরকম কিছু হতে পারে। এখানে সব বাড়িগুলো উঁচু ঢিবির ওপর। পরে জেনেছিলাম বর্ষায় শিলাবতী নদীর জল উঠোনে চলে আসে, তাই এই ব্যবস্থা। 
    সবাই ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম, রাতে মুরগির ঝোল ভাত খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে শুনলাম এখান থেকে ছোটপিসিদের বাড়ি কৃষ্ণপুর খুব কাছে। ওখানে এঁদের আত্মীয়বাড়ি আছে। যেই না শোনা, শোভানারাদিকে খুব দেখতে ইচ্ছে হল। পরদিন একটু বেলাতে এই বাড়ির একটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আমি আর মিনু পায়ে হেঁটে ছোটপিসির বাড়ি রওনা দিলাম। প্রায় দুপুরে কৃষ্ণপুর পৌঁছালাম। মেয়েটির আত্মীয়বাড়ি পিসিদের খিড়কি পুকুরের ওপাড়ে। ওই বাড়ি থেকে পুকুর পাড়ের নিচ দিয়ে পিসিদের দাওয়াতে এসে দাঁড়ালাম। পিসি আমাদের চিনতে না পেরে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কাকে যেন বলে উঠলেন,  দ্যাখ, একেবারে আমাদের বেবির মত দেখতে! আমি লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে  দাঁড়িয়ে থাকলাম। শোভানারাদি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বেবির মত কেন হতে যাবে? এ তো আমাদের বেবিই। তারপর শুরু হল জেরা। কার সঙ্গে এসেছিস? কোথায় এসেছিস? কবে এসেছিস? আর কে এসেছে? ইত্যাদি।
      সব শুনে পিসেমশাই গরুরগাড়ি পাঠালেন মেজদিদের নিতে। কৃষ্ণপুরে পিসিদের বাড়িতে সেটাই আমার শেষ যাওয়া। অনেকদিন ছিলাম, বাড়ি আসার কথা বললেই, পিসেমশাই আসতে দিতে চাইতেন না। এক উঠোনে পিসিরা ছাড়াও  পিসেমশাইয়ের জ্ঞাতিরাও থাকতেন। সিরাজুদ্দিন সরকারের স্ত্রী ও এক ছেলে সপরিবারে থাকতেন। ওনার বড়ছেলে পাশে বাড়ি করে বেরিয়ে গেছেন, কয়েকজন ছেলে কলকাতায় থাকতেন। ওনার মেজ মেয়ে সইওদামাসির বাড়িও এই গ্রামে।মনে হয় বাবা সিরাজুদ্দিন সরকার বানিয়ে দিয়েছিলেন। ওঁদের বাড়িটা আমার খুব ভাল লাগত। লাল রঙের মেঝেগুলো এত মসৃণ যে আয়নার মত ছায়া পড়ত। সাইদামাসির মেয়ে  ডলিদির ভাল নাম ছিল সায়রাবানু। দেখতেও অপূর্ব সুন্দরী, সেইরকম  সাজগোজ করত। কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় সাজপোশাকে এদের আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল। ছোটপিসির মেয়ে আনারকলিদি আমার থেকে বছর আড়ায়ের বড়। ডলিদি আর একটু বড়। আমি আর ডলিদি অসমবয়স্ক হওয়া স্বত্বেও দুজনে অল্পদিনেই খুব ভাল বন্ধু হয়ে উঠলাম। স্কুলের সময়টুকু বাদ দিয়ে সারাক্ষণ দুজনে একসাথে থাকতাম। বাড়ির কাছে দাদু সিরাজুদ্দিন সরকারের প্রতিষ্ঠিত স্কুলেই পড়ত ডলিদি। এদিকে আমরা ফিরছিনা দেখে মিনুর বাবা লোক পাঠিয়েছিলেন, ও চলে গেছে।
      একদিন দেখলাম পিসেমশাই আমাদের জন্য জামাকাপড় আনিয়েছেন। আমার আর মিনুর জন্য সবুজা আর হলুদ রঙের দুটি সূতির ফ্রক কেনা হয়েছে। একেবারেই সাধারণ ফ্রকদুটির বুকে প্রজাপতি আঁকা রয়েছে। যেমনই হোক, এটা নিয়ে কিছু মনে হয়নি। মনে হল তখন, যখন আনারকলিদি ও ছোটপিসির মেজছেলে আমাকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই এই ফ্রকটা পরবি না তুলে রাখবি? প্রশ্ন শুনে ওই বয়সেই অপমানে লজ্জায় মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ফ্রকদুটি সাইজে এতটাই ছোট ছিল যে আমাদের গায়ে হয়নি। মিনু ওর মামাতো বোনকে দিয়ে দিয়েছিল। আর আমারটা কী হয়েছিল জানিনা, তবে সেই ফ্রক আমি কোনোদিন পরিনি।
                                              (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments