জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৭২

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৭২


সম্পাদকীয়,
ঋতু পরিবর্তন শুধু কি আমরাই বুঝি নাকি? পাখিরাও তো বোঝে। না হলে শীতের দেশের পাখিগুলো শীত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গরমের দেশে আসে কি করে? আবার শীত শেষ হলেই ফিরে যায় কিন্তু। এদের বলে পরিয়াযী পাখি। এবারের সংখ্যায় পরিযায়ী পাখিদের ছবি উপহার দিয়েছে সোহম দাদা। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল। শীতের দেশের এই যাযাবর পাখিগুলো গরমের দেশে আসে কোথায়? আরে এত ভাববার কি আছে। বাসবদত্তা আন্টি এবার সেইসব পাখিরালয়ে আমাদের বেড়াতে নিয়ে যাবে। কি দারুণ ব্যাপার না? শুধু কি পাখিরা, তোমরাও তো একটু বড়ো হলেই পড়া লেখা বা চাকরির নাম করে মা বাবাদের ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেবে, সে কি আর আমি জানিনা ভেবেছো। এ মা মিথ্যে হবে কেন? দীপাঞ্জনের বিদেশে পড়তে যাবার গল্পটা পড়েই  তো এতসব জানলাম। যে গল্পটা তপশ্রী আন্টি আগের সপ্তাহে শুরু করেছে। দীপাঞ্জন কে? যে খেতে খুব ভালবাসে। সবাই কি আর একরকম হয়? এই যেমন জয়াবতী নতুন নতুন কিছু জানতে ভালোবাসে। জানার তো শেষ নেই। যত জানবে তত বিদ্বান হবে। কালীপ্রসন্ন সিংহের মতো বিদ্বান। তাঁর কথা পীযূষ আঙ্কেল বলেছেন। আরে না প্রথম থেকে শেষ অব্ধি ছোটবেলায় খালি জ্ঞানের কথা থাকে এমন বদনাম শত্রুতেও দিতে পারবে না। এবারের সংখ্যাতেই তো বিনোদ আঙ্কেলের ছড়া আর ছোটোদের মন ভালো করা আঁকা আছে। সবশেষে আর একটুস জ্ঞান দিই। কালীপ্রসন্ন সিংহ আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় মহাভারত রচনা করেছিলেন। হ্যাঁ, সম্প্রতি ২১ শে ফেব্রুয়ারী গেল মাতৃভাষা দিবস। আর সেই দিবসকে স্মরণ করে  তোমাদের বন্ধু সমাদৃতা অপূর্ব একটা কবিতা লিখে পাঠিয়েছে। অনেক ভালোবাসা তোমায় সমাদৃতা। - মৌসুমী ঘোষ


ধারাবাহিক উপন্যাস
জয়াবতীর জয়যাত্রা
চতুর্থ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
 
সোনাটিকরিতে দুই সই
সোনাটিকরি গ্রামটি প্রথম দর্শনে খুবই চমৎকার মনে হল জয়াবতীর। এখানে রাস্তাঘাট বেশ চওড়া ও পরিষ্কার। বাড়িগুলো যেমন ইচ্ছে করা হয় নি, দেখে মনে হয় একজন যেন খুব ভাবনা চিন্তা করে বাড়িগুলি তয়ের করেছেন। পুকুরের জল স্বচ্ছ, একটিও কচুরিপানা ভর্তি পচা ডোবা দেখল না সে। পুকুরের সুন্দর বাঁধানো ঘাট। কোন বাড়ির পেছনেই ঝোপঝাড় নেই, যে গাছপালাগুলি আছে, নিয়মিত তাদের যত্ন করা হয়। সোনাটিকরি গ্রামটা তাই সারাক্ষণ আলো ঝলমল করে।
এর তুলনায় নিজের গ্রাম বোলসিদ্ধির কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার। সারা গ্রামটায় যেন জঙ্গলের মধ্যে কোনমতে কয়েকটা বাড়ি ঘেঁষাঘঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে। পোকা মাকড় মাছি মশা সবজায়গায় ভনভন করছে। কোথাও খাবার আঢাকা রাখার যো নেই। অমনি মাছি এসে বসবে। জয়াবতী খেয়াল করেছে তাদের নতুন রাঁধনি রাঁধে ভালো, কিন্তু হুঁশ জ্ঞান বড় কম, খাবার খোলা রেখে সে প্রায়ই এদিক ওদিক যায়। জয়াবতীর ধারণা ফাল্গুন মাসে সবার যে জ্বরটি হল, তা এই খোলা খাবারে মাছি থেকেই কোন বিষ ঢুকেছে শরীরে, ভাই দুগগা এইসব খাবার খায় না, কেবল মার দুধ খায়, তাই তার কিছু হয়নি।
পুণ্যি এ কথা শুনে গম্ভীর মুখে বলে ‘কিন্তু তুই তো আর মার দুধ খাস না, রাঁধনির রাঁধা খাবারই খেয়েছিলি, তবে তোর ব্যামো হল না কেন?’
জয়াবতী যেন জানতই পুণ্যি এই প্রশ্ন করবে। সে টকাস করে বলল ‘আমি যে সারাদিন মাঠে ঘাটে ছুটে বেড়াই, নদীতে নাই, রোদ বাতাস লেগে লেগে আমার শরীর কেমন তাগড়াই হয়েছে দেখ না, কোন ব্যামো ঘেঁষতেই পায় না।’
 
পুণ্যি ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে ‘আহা কী আমার পালোয়ান রে। নে নে, মেলা বাজে না বকে পড়া কেমন শিখছিস দেখি’
অমনি জয়াবতী অন্য কথা পাড়ে। পুণ্যি যেমন সারাক্ষণ দুলে দুলে পুথি মুখস্থ করে, অমন করতে তার বয়েই গেছে। তার মাথায় সর্বক্ষণ নতুন নতুন চিন্তা ঘুরছে, আর সেটা যতক্ষণ না করতে পারছে, সে ছটফট করে মরে।
সে বলল ‘পড়া কি পালিয়ে যাচ্ছে? তারচে একখানা পত্তর লেক দিকি পিতাঠাকুরের কাছে, সেনমশাইয়ের লোক কাল যাবে বোলসিদ্ধি, লতাপাতা আনতে, অমনি পত্তরটা দে আসবে’
‘এই তো সেদিন পত্তর লিকলাম। এত ঘন ঘন লেকার  আচেটা কী?’
‘আচে আচে, তুই লেক না। লেক, পিতাঠাকুর আমরা দুইজনে একপ্রকার আচি। কিন্তু আপনাদের জন্যে বড় চিন্তা হয়। রাঁধনিটির হুঁশ বড় কম, রান্নার পর কোন খাবারে ঢাকনা দ্যায় না, এলো রাকে। আমার, না না লেক, আমাদের মনে হয়, খাবারে মাছি বসেই আপনাদের ব্যামো হয়েছিল।
আর কী? আপনারা আমাদের পেন্নাম নিবেন। দুগগাকে  শত সহস্র স্নেহ, কী বলে রে পুণ্যি, হ্যাঁ স্নেহচুম্বন দিবেন।
আর পিতাঠাকুর, বাড়ির পিছনের জঙ্গল অতি সত্বর কাটাইবার ব্যবস্থা করিবেন’
চিঠিটি শেষ হতে না হতেই তার মাথায় নতুন চিন্তা চলে আসে।
‘ভালো কতা মনে পড়েচে পুণ্যি, আর একখানা পত্তর লিকতে হবে রে’
‘ভালো জ্বালা। সেনমশাই কত পাঠ তৈয়ারি করতে দিয়েচেন, আর আমি বসে বসে খালি পত্তর লিখি আর কি! কেন, তুই লেখ না, তুই তো আর মুখখু মেয়েমানুষ নোস’
‘আমি যদি লিকব, তবে চিন্তা কে করবে শুনি। এখুনি কী ভাবলাম শোন। জমিদারমশাইকেও একখানা পত্তর লিকতে হবে’
জমিদারমশাই! হকচকিয়ে যায় পুণ্যি! বাপের জন্মে কে কবে শুনেচে মেয়েমানুষে জমিদারমশাইকে পত্তর লেকে!
‘কতা না বাড়িয়ে লেক দেকি। পিতাঠাকুর নয় নিজের বাড়ির পেছনের জঙ্গল পরিষ্কার করলেন, গোটা গ্রামের কি ছিরি দেকেচিস? দিনমানেও যেন সুযযির আলো ঢোকে না, সে কাজ তো জমিদারমশাইয়েরই, নাকি? তিনি হুকুম দিলে তবে না কাজ হবে। যাই বলিস পুণ্যি, এই সোনাটিকরি 
গাঁয়ে আসা ইস্তক মনে বড দুক্ষু রে। কি পোস্কের বলতো এ গাঁখানা, রাস্তায় সিঁদুর পড়লে তুলে নেওয়া যায়।’
সিঁদুরের কথায় এক মুহূর্তের জন্যে পুণ্যির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল, সেটা জয়াবতীর চোখ এড়াল না। সে পুণ্যির গলা জড়িয়ে বলল ‘গঙ্গাজল, রাগ কললি? দু পয়সার সিঁদুর তো হাটে কিনতে পাওয়া যায়, তার জন্যে দুক্ষু করিস কেন? এখন দেক, তোতে আমাতে কত ভালো আচি। তুই তাকে কদিন  দেকেচিস? বিয়ের রাতে এক পলকের জন্যে বই তো নয়, আর আমার সঙ্গে কতদিনের ভাব বল’!

বড়োগল্প

দীপাঞ্জন ইন এ স্যুপ
তপশ্রী পাল
পর্ব ২

কিন্তু এহেন দীপাঞ্জনকেও শেষে বাইরের ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করতে হলো। কেন সেটা ভারী গোলমেলে। ক্লাস টেন থেকেই দীপাঞ্জনের স্পেশাল বন্ধু মুনিয়া – বন্ধু বলো বন্ধু, গার্লফ্রেন্ড বলো তো তাই। ওদের পাড়াতেই মুনিয়াদের বাড়ি। ওর বাবার মস্ত ব্যাবসা। অন্ততঃ চার পাঁচখানা গাড়ি ওদের। ওর মতো মুনিয়াও খেতে ভারী ভালোবাসে। পাড়ার সৌরভসেই ওর সঙ্গে দেখা। একদিন সৌরভসে দাঁড়িয়ে চাইনীজ খাচ্ছিলো দীপাঞ্জন। হঠাত শোনে একটা মোটা গলা “অ্যাই, মোমোর সঙ্গে স্যুপ দিস নি! ঝাল লাল লঙ্কার সস দিস নি! কি বোদা বোদা লাগছে! দে শীগগিরি –“ প্লেট থেকে চোখ তুলে দীপাঞ্জন দেখে একটা গোলগাল  মেয়ে! মুখখানা ভারী মিষ্টি। একটা লাল স্কার্ট আর টপ পরে দাঁড়িয়ে। দোকানের ছেলেটা তাড়াতাড়ি স্যুপ আর সস নিয়ে দৌড়ে এলো। একখানা প্লাস্টিক চেয়ার টেনে নিয়ে সামনের টেবিলটায় এক প্লেট মোমো রেখে তারিয়ে তারিয়ে এমন খেতে লাগলো মেয়েটা যে দেখে দীপাঞ্জনের আবার খিদে পেয়ে গেলো। হঠাত মেয়েটা চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললো “হ্যাংলা! হাঁ করে খাওয়া দেখছে দেখো – কোনদিন মোমো খাওনি বুঝি?” দীপাঞ্জন তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে বলে “আমি প্রায়ই আসি এখানে। সবই খাই, কিন্তু তোমাকে তো দেখিনি আগে –“ “আমি বেশীরভাগ বাড়িতে আনিয়ে খাই। আজ নেহাত নাচের ক্লাস থেকে ফেরার সময় খেতে ইচ্ছে হলো তাই।“ বলে মেয়েটা। তারপর টিউশনের ফাঁকে ফাঁকে দেখা হতেই লাগলো। আর শীগগিরি দীপাঞ্জন বুঝলো, এবার সে ঠিক তার মতোই খাদ্য রসিক একজনকে পেয়ে গেছে। মুনিয়া ক্লাস এইটে পড়তো তখন আর এখন ক্লাস টেনের লেডি! 
রেজাল্ট বেরোনোর পর আস্ত একখানা বড়ো চকোলেট নিয়ে দীপাঞ্জন গিয়েছিলো সৌরভসে। মুনিয়ারও আসার কথা। মুনিয়া আসতেই দীপাঞ্জন ক্যাডবেরীটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো “ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করে গেছি! কি খাওয়াবে বলো!” “ও তো সবাই পাশ করে – জয়েন্টে কি করলে? আর জি আর ই তে? বাইরে যাবে নিশ্চই!” কটকট করে বলে উঠলো মেয়েটা। ও বাবা! এখানেও রক্ষা নেই? বাধ্য হয়ে দীপাঞ্জন প্যাঁচার মতো মুখ করে বলে “আমি ফিজিক্স ভালোবাসি। ফিজিক্স নিয়ে বি এস সি পড়বো কলকাতায় ।“ “তুমি তো সারাজীবন এই সৌরভসের চাইনীজ খেয়েই কাটাবে! আমাকে ইতালীর আসল ইতালীয়ান অথবা চায়নার আসল চাইনীজ খাওয়াবে না? ধুর, তুমি কোন কাজের নও!” বলে মুখ বেঁকিয়ে বেণী দুলিয়ে চলে গেলো মুনিয়া। ভারী অপমান লাগলো দীপাঞ্জনের। মেয়েটা তাকে অমন হ্যাটা দিয়ে গেলো? ওকে দেখিয়ে দিতে হবে যে দীপাঞ্জনও পারে, হুঃ। 
কিন্তু ভাবলেই তো আর হয় না – ততদিনে তো বিদেশের বেশীরভাগ ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করার দিন শেষ আর জি আর ই পরীক্ষাও দেওয়া সম্ভব নয়। তবে কি সামনের বছর? উঁহু, অতদিন অপেক্ষা করবে না মুনিয়া – তার আগেই বন্ধুত্বের দফা রফা হবে। সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে মরিয়া হয়ে ব্রাউজ করতে লাগলো দীপাঞ্জন। যে কোন দেশ, যে কোন ইউনিভার্সিটি এমনকি যে কোন সাবজেক্ট! উঁহু, মুনিয়ার বন্ধুত্ব কোন শর্তেই হারাতে চায় না দীপঞ্জন। মুখচোখ শুকনো দেখে মা বললেন “হ্যাঁ রে কি ব্যাপার বলতো? কাল তালের বড়া বানালুম, খেলিনা। আজ ছানার পায়েস বানিয়ে বসে আছি তোর দেখা নেই – “ বাবা বললেন “যা পড়বে সেটার ফর্ম তুলবে তো কলেজ থেকে, নাকি এমন বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে ঘুরে বেড়াবে? তোমার তো চব্বিশ মাসে বছর হবে মনে হচ্ছে!” “উঃ তোমাদের শুধু ঐ এক প্রশ্ন! কাল রাতে খাওয়ার পর থেকে আমার পেটটা ভীষণ কামড়াচ্ছে!” বলে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে গেছিলো দীপাঞ্জন।    

প্রায় দু সপ্তাহ চোখ লাল করে সাইবার ক্যাফেতে বসে ওয়েব খুঁজে খুঁজে শেষে চীন দেশের বেজিং এর সিংহুয়া ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্সের জন্য অ্যাপ্লাই করবে ঠিক করলো দীপাঞ্জন। ফর্ম ফিল আপ করে রেজাল্ট টেজাল্ট সব পাঠিয়ে দিলো যেমন যেমন দরকার। তারপর আশা ছেড়ে দিয়ে কলকাতার কলেজগুলো থেকেও ফর্ম তুলতে লাগলো। কিন্তু মোমোর দোকানে আর ঘেঁষে না দীপাঞ্জন, পাছে মুনিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! কিছু একটা হিল্লে না হলে আর চলছে না। এই সব চাপে খিদে অবধি কমে গেলো দীপাঞ্জনের। আগে পাঁঠার মাংস হলে কিলোখানেক ও একাই খেয়ে ফেলতো, কিন্তু গত রবিবার মাকে বিস্মিত করে প্রায় আধ হাঁড়ি মাংস ফেলে রেখে উঠে গেলো দীপাঞ্জন। 
যাক শেষ অবধি সব সমস্যার সমাধান ঘটিয়ে একটা মোটাসোটা খাম এসে গেলো বাড়িতে প্রায় হপ্তাখানেক পর! খুলে দেখে ইউনিভার্সিটি ফি জমা দিয়ে ভর্তি হতে বলে চিঠি পাঠিয়েছে । সঙ্গে ব্রোসিওর! কি সুন্দর রংচঙে! ফি-এর অর্ধেক ডিসকাউন্ট দেবে বলেছে। দীপাঞ্জনের হৃদপিন্ডটা খুশীতে কয়েকটা বিট মিস করে গেলো। কিন্তু বাবাকে বলতে হবে। ভেবে আবার বুকটা ধুকপুক করে উঠলো। বাবা চান ও কলকাতাতেই পড়ুক। যা থাকে কপালে ভেবে বাবার কাছে গুটিগুটি গিয়ে দাঁড়ালো দীপাঞ্জন। ঢোঁক টোক গিলে বললো “আ-আ-আ-আমি ফরেন ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়ে গেছি।“ বাবার চোখ গোলগোল হয়ে গেলো “দেশী ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনীয়ারিং এ পেলে না – আবার ফরেন! কোথায় শুনি!” “চীনদেশে” মিনমিন করে বলে দীপাঞ্জন। “কী! চীনে! ওখানে কেউ সাধ করে পড়তে যায়? আমেরিকা কি নিদেন ইউরোপ হলে তাও কথা ছিলো – কী না চীন? কেন কলকাতায় কি কলেজ কম পড়েছে নাকি?” গমগম করে উঠলো বাবার গলা। “ভালো ইউনিভার্সিটি। অর্ধেক ফি মকুব। আমি ওখানেই পড়বো। ফিজিক্স।“ ঘাড় কাত করে বলে দীপাঞ্জন। এই তার প্রেস্টিজ বাঁচানোর শেষ পথ। “অঃ ঐ অপদার্থ বিদ্যে? তাই বলো – ইঞ্জিনীয়ারিং-এ আর কে তোমায় চান্স দেবে?” বলে বেগুন বেচা মুখ করে চলে গেলেন বাবা।

যা হোক দিনকতক দরাদরি করে বাবাকে প্রায় রাজী করিয়ে ফেললো দীপাঞ্জন। আর মা তো শুনে থেকে কেঁদে চলেছে। অবশেষে বীরদর্পে দীপাঞ্জন চললো মোমোর দোকানে। যদি মুনিয়ার দেখা পাওয়া যায় । মেয়েটা ওখানে বসে বসে এক মস্ত বাউলে থুকপা খাচ্ছিলো। দীপাঞ্জনকে দেখে চোখের কোণা দিয়ে অবহেলাভরে তাকালো। দীপাঞ্জন গরম দু প্লেট ফ্রায়েড মোমো নিয়ে এক প্লেট মুনিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো “বিদেশ যাচ্ছি সামনের মাসের দু তারিখ!” মুনিয়ার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। মুখ হাঁ! জিভের ওপর আস্ত একটা চিংড়িমাছ। “কী হলো? খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো?” গর্বিত হেসে বলে দীপাঞ্জন। তাড়াতাড়ি স্যুপটা গিলে ফেলে মুনিয়া বললো “কোথায় যাচ্ছ?” “চীন!” ঝটপট উত্তর দিলো দীপাঞ্জন। ও মা! কোথায় একটু মানসম্মান দেবে তা না মেয়েটা খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলো। বেশ বিব্রত হয়ে দীপাঞ্জন বললো “হাসলে যে? চীন দেশ কি ফ্যালনা না কি? জানো না হিউ-এন-সাং ফা-হিয়েন এঁরা সব ওখান থেকেই এসেছিলেন সেই অতযুগ আগে? ওখানে শিক্ষাব্যবস্থা খুবই প্রাচীন। খুবই উচ্চদরের! তা ছাড়া ওখানে একবার যেতে পারলে আর এই সৌরভের চিলি চিকেন খেতে হবে না! হু হু বাবা – সে হলো গিয়ে একেবারে আসল চায়নার চাইনীজ! রোজ দুবেলা খাবো! আ-আ-আহঃ” মেয়েটা আবার ফ্যাক করে হেসে বললো “ওখানে পড়বে কী ভাষায়? ওখানে তো কেউ ইংরাজী জানেও না, বলেও না। চাইনীজ ভাষা শেখা শুরু করো আজ থেকে! হি হি! চীনাম্যান চ্যাং চুং মালাই কা ভ্যাট!” বলে ছুটে পালিয়ে গেলো মেয়েটা। মুখটা ছোট হয়ে গেলো দীপাঞ্জনের। 
পরদিন সেই সৌরভসেই বসে বসে এক প্লেট চাউমিন নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো দীপাঞ্জন। সব কেমন বিস্বাদ লাগছে। এমন সময় হঠাত গোটা দশেক বান্ধবী নিয়ে মুনিয়া এসে হাজির! সব কজন ওকে অভিনন্দন জানালো! সবাই একসঙ্গে বেস্ট উইশেস কার্ড আর কেক দিলো! বললো “তুমি আমাদের হিরো! মুনিয়া বলেছে তুমি অনেক বড়ো বিজ্ঞানী হয়ে ফিরবে চীন থেকে! অটোগ্রাফ দাও দেখি!” এ তো দীপাঞ্জনের চিন্তার অতীত! সে রাত্রে খুশীতে মায়ের বানানো গোটা আষ্টেক ফিশ ফ্রাই বিনা বাক্যব্যায়ে খেয়ে ফেললো দীপাঞ্জন। তবে আসল মজা শুরু হলো এর পর।
 মরিয়া হয়ে ইউনিভার্সিটি খোঁজার সময় ভাষার কথা ভুলেই গেছিলো দীপাঞ্জন! এখন বেশ ভয় লাগতে শুরু করলো। সত্যি যদি হারিয়ে যায় ওখানে, কি করে রাস্তা খুঁজে পাবে? ইউনিভার্সিটিতে পড়া বুঝতে পারবে? লোকের সঙ্গে কথাই বা বলবে কি করে? থাকবে কোথায়? একশো প্রশ্ন মাথায় গিজগিজ করতে লাগলো। কিন্তু গুগলবাবু থাকতে ভয় কি? সাইবার ক্যাফেতে বসে একখানা ইংলিশ টুঁ চাইনীজ লার্নিং এর ই-বুক নামিয়ে নিলো দীপাঞ্জন। যেন ওটা সঙ্গে থাকলেই গড়গড় করে চাইনীজ বলা যায়। থুড়ি ও ততদিনে জেনেছে এ ভাষাকে আসলে ম্যান্ডারিন বলে! শেষমেশ চেষ্টা করে ইউনিভার্সিটিতেই হোস্টেল জুটে গেলো আর দিনকতক মা কাঁদতে কাঁদতে দীপাঞ্জনকে এতো খাওয়ালেন যে যাবার আগের দিন অন্ততঃ এগারোবার পটি করে, একসাথে হজম, অম্বল আর আমাশার সব রকম ওষুধ খেয়ে পরদিন চিঁ চিঁ করতে করতে প্লেনে উঠলো দীপাঞ্জন। যাওয়ার আগে মুনিয়ার হোয়াটস অ্যাপ নম্বরটা কোনরকমে জোগাড় করে নিলো। (ক্রমশ)


দেয়ালা
বিনোদ মন্ডল 

চোয়াল ধরে চালাও ঘুসি
চিমটি কাটো তলপেটে
তবুও আমি সঙ্গী তোমার 
বেঁচে থাকার বল পেতে। 

চ্যাংদোলানো, ঠ্যাংঝোলানো 
এসব আমার অভ্যাসে
আদর খেতে হাজির হেসে
কবিতা বা উপন্যাসে। 

কাতুকুতু কিংবা হামায়
সারা শরীর দাও ভরিয়ে
ঘুমপাড়ানি গান শোনাও
প্রাণ ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে। 

আমার জন্য হাজার নাম
দেয়ালার দাম চার দিনার
ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর 
চকের মাথায় চারমিনার।


ভাষা
সমাদৃতা রায়
 দশম শ্রেণী
উত্তরপাড়া গার্লস হাই স্কুলহুগলি


আমি বাঙালি , বাংলা আমার মা।।
বাংলা আমার মাতৃদুগ্ধ
শৈশবে মায়ের মুখে শুনে শুনে শিখে নিই যা।।

ভোরের আলো ফোটার মত শুদ্ধ হবে সবার মন।।
এবার ভাষা আন্দোলনের পথে নামবে দেশের লক্ষ জন।। 
 বাংলার মাটি বাংলার জল
পূর্ণ হোক সবাই বল।।

বাংলা আমার মনের সুখ।
বাংলা ভোলায় মনের যত দুঃখ
স্বেছায়  বলতে পারি
বাংলা আমার ভালোবাসার নারী।।


স্মরণীয়
(কালীপ্রসন্ন সিংহ)
কলমে - পীযূষ প্রতিহার
     
১৮৪০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত সিংহ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। তাঁর পিতা ছিলেন নন্দলাল সিংহ, মাতা ছিলেন বিম্ববতী দেবী। পিতামহ জয়কৃষ্ণ সিংহ হিন্দু কলেজের একজন পরিচালক ছিলেন। কালীপ্রসন্ন যখন মাত্র ছয় বৎসরের তখন পিতার মৃত্যু হলে নিম্ন আদালতের বিচারক বাবু হরচন্দ্র ঘোষ নাবালক কালীপ্রসন্নের অভিভাবক নিযুক্ত হয়েছিলেন। তৎকালীন হিন্দু কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন কালীপ্রসন্ন যদিও পড়াশোনা শেষ করেননি। ১৮৫৭ সালে কলেজ ছেড়ে বাড়িতেই ইংরেজি,বাংলা ও সংস্কৃত শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। কালীপ্রসন্ন অদ্ভুত স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন, একবার মাত্র দেখে বা শুনে তিনি হুবহু মনে রাখতে পারতেন। জীবনকাল সংক্ষিপ্ত হলেও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে 'বিদ্যোৎসাহিনী সভা' প্রতিষ্ঠা সেরকমই একটি উদাহরণ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ও কালীপ্রসন্ন সিংহের কাজকর্মের গুনমুগ্ধ ছিলেন। সনাতনপন্থী সমাজের কুসংস্কার ও গোঁড়ামির প্রতি আঘাত হানতে, মুক্তমনা সমাজ গড়তে, দেশবাসীর মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে বিদ্যোৎসাহিনী সভার মুখপত্র হিসেবে প্রকাশ করেন বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা(১৮৫৫) ও গড়ে তোলেন বিদ্যোৎসাহিনী থিয়েটার (১৮৫৬)। দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণ' মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংরেজি অনুবাদ করলে তা বই হিসেবে প্রকাশ করেন পাদ্রী লঙ সাহেব। এই কারণে লঙ সাহেবের জরিমানা হলে জরিমানার একহাজার টাকা জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ কালীপ্রসন্ন সিংহ দিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়াও নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন অনেক সমাজ হিতৈষী মানুষকে ও পত্রিকার উদ্যোগকে। তিনি বিদ্যাসাগরের বাল্যবিবাহ বন্ধ ও বিধবাবিবাহের সমর্থনে নানাভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি সম্পাদক হিসেবেও ছিলেন অনন্য, 'পরিদর্শক' পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে বলেছেন সত্যপথ থেকে বিচলিত না হওয়া, কোনো বিষয়ের অতিবর্ণনা না করা ও পক্ষপাতদোষ বাঁচিয়ে চলাই তাঁর লক্ষ্য।
     সাহিত্যে তাঁর প্রথম আগ্রহ ছিল নাটক। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে তাঁর রচিত 'বাবু' নাটকটি প্রকাশিত হয় ১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দে। তারপর পরপর প্রকাশিত হয় 'বিক্রমোর্বশী'(১৮৫৭), 'সাবিত্রী সত্যবান'(১৮৫৭) ও 'মালতীমাধব'(১৮৫৯)। তিনি নাটক রচনার পাশাপাশি অভিনয়েও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু কালীপ্রসন্ন সিংহের নাম বাংলা সাহিত্যে যে কারণে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় তা হল তাঁর বিদ্রুপাত্মক রচনা 'হুতোম প্যাঁচার নক্সা', ১৮৬২খ্রীষ্টাব্দে। এখানে তিনি তৎকালীন বাবু সম্প্রদায়ের রুচিহীনতা ও ফাঁপা ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থার প্রতি কটাক্ষ করেছেন। এই গ্রন্থটিতে প্রথম বাংলা সাহিত্যে কথ্য ভাষার প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া আর যে কারণে তিনি চিরস্মরণীয় তা হল মূল সংস্কৃত মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করে নিজ খরচে তা প্রকাশ(১৮৫৮-৬৬) করা। একাজে তাঁকে বিদ্যাসাগর নিজে উৎসাহিত করেছিলেন এবং সাহায্য করেছিলেন হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য, ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নবীনকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো পন্ডিতরা। মহাভারত অনুবাদ করে প্রকাশ ও বিনামূল্যে বিতরণের জন্য বিপুল খরচ(আড়াই লক্ষ টাকা) করেছিলেন তিনি, ফলে জমিদারির অংশ ও বেঙ্গল ক্লাব বিক্রি করতে হয়েছিল তাঁকে। তিনি 'শ্রীমদ্ভাগবদগীতা' বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন যা তাঁর মৃত্যুর পর ১৯০২সালে প্রকাশিত হয়। শেষ জীবনে পরিকল্পনা করেছিলেন একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস 'বঙ্গেশ বিজয়' লেখার, যেটি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি।
      ১৮৬৩সালে তাঁকে ইংরেজ সরকার কর্তৃক অবৈতনিক শাসক ও ন্যায়পাল রূপে নিয়োগ করা হয়েছিল। কিছু সময়ের জন্য তিনি কলকাতার মুখ্য পুরশাসক ও পুরাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
      ২৪শে জুলাই ১৮৭০ সালে মাত্র তিরিশ বছর বয়সে এই ক্ষণজন্মা প্রতিভা পরলোক গমন করেন।


চলো যাই 
(পাখিদের কাছে )  
পর্ব - ১
কলমে - বাসবদত্তা কদম

তোমাদের সবার স্কুল খুলে গেছে তাই তো? উফফ যা একখানা লম্বা ছুটি দিয়েছিল কোভিড ১৯ তোমাদের। অবশ্য শুধু তোমাদেরই বা বলছি কেন! আমাদেরও তো বটে! 
ছুটিতে ছুটিতেও যে বিরক্ত ধরে যায় সেটা কোভিড বুঝিয়ে দিয়েছে, কি বল? লম্বা ছুটি বলতে গরমের ছুটি। সে তো গরমে হাঁসফাঁস করেই কেটে যায়। কেউ কেউ অবশ্য বাবা মায়ের সঙ্গে গরম ভুলতে পাহাড়ে যাও। পাহাড়ে গেলেই ঠান্ডা। গরমের সময়ও কি সুন্দর সোয়েটার আর জ্যাকেট পরে ঘুরে বেড়ানো যায়! 
আমরা যারা গরম দেশের মানুষ তাদের কাছে গরম খুব কষ্টের। এত রোদ, এত গরম। তবে ঠান্ডার দেশের ঠান্ডা তার থেকেও অনেক বেশি কষ্টের। ঠান্ডার জায়গায় যখন শীত আসে আর বরফ পরে প্রায় রোজ! চারিদিক সাদা হয়ে যায়! তখন ছবি তুললে দেখতে ভালো, কিন্তু সে ঠান্ডা যে কি ভয়ানক কষ্ট; যারা সেখানে থাকে তারা সেটা বুঝতে পারে। বিশেষত বোঝে সেখানকার জঙ্গলের প্রাণী আর পাখিরা। 
শীতের আগেই যে পাহাড়ের মাথায় বরফ ছিল; এখন তার ওপর আরো আরো অনেকগুলো বরফের কম্বল চাপা পড়ল। সেই সব পাহাড়ি গ্রামের বাড়িগুলোর মাথায় বরফ। গাছেদের মাথা আর ডাল সব বরফে সাদা। একটা পাতা নেই কোনো গাছে। পাতা ঝরিয়ে গাছেরা তখন শীতঘুমে চলে গেছে। আবার সে ঘুম ভাঙবে বরফ পড়া বন্ধ হলে। ঠান্ডা কমলে। বরফে চতুর্দিক সাদা। ফল নেই, ফুল নেই, শষ্য নেই সে দেশে। দেখতে অপূর্ব সুন্দর। কিন্তু খাবার নেই তখন কোথাও। তাই যেসব প্রানীর শীতঘুমে যাবার, তারা চলে যায় তাদের গর্তের ভিতর শীতঘুমে। শীত কমলে তবেই ভাঙবে তাদের ঘুম। তখন আবার তারা বেরোবে, খাবারের খোঁজে। যারা নীচে নেমে আসতে পারে তারা তখন নেমে আসে নীচের দিকে। যেখানে তারা পাবে খাবার। 
আর শীতের দেশের পাখিরা পাড়ি দেয় হাজার হাজার মাইল। পাখিদের ভারী মজা। তাদের আছে ডানা। তাই খাবার নেই তো কুছপরোয়া নেহি। তারা তাদের ডানায় ভর করে চলে আসে অপেক্ষাকৃত গরমের জায়গায়। সে হাজার মাইল উড়ে আসা, অবশ্যই বেশ কষ্টের। অনেকসময় দিনের পর দিন খাবার পায়না কখনো কখনো। তবে এরা মোটেও একা আসেনা। ভাই, বোন, মা, বাবা, বন্ধু, বন্ধুর বন্ধু সবাই একসঙ্গে পাড়ি জমায় গরমের দেশের দিকে।  
বরফের দেশের সেইসব পখিরা হাজার হাজার মাইল উড়ে, চলে আসে গরমের দেশে। গরমের দেশে তখন হালকা শীত। খাল বিলে ভর্তি মাছ। ধানক্ষেতে পোকা। মানে সোজা কথায় সেই সব অতিথি পাখিদের জন্য ভুরিভোজ সাজানো। 
এই পাখিরা প্রতিবছর শীত আসবার আগেই, দলে দলে উড়তে শুরু করে। বহু হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ওরা পৌঁছায় গরমের দেশে। যেখানে তাদের খাবারের অভাব নেই। বাসা বানিয়ে ডিম পাড়তে পারবে। তারপর ছোট্ট ছোট্ট ছানাগুলোকে খাইয়ে, খাইয়ে, হোঁতকা কোঁতকা বানিয়ে উড়তে শিখিয়ে, ফিরে যাবে নিজেদের দেশে। আবার আসবে পরের বছর সেই জায়গায়। 
ওদের মধ্যেও নিশ্চয় কথাবার্তা হয়। মিটিং হয়। হবেই। এত দূরের পথের যাত্রা। আমার মনে হয় মিটিং ঠিক এরকমটাই হয়। দেখ তো তোমাদের কি মনে হয়। তোমরা কখনো এমন মিটিং শুনলে আমাকে জানিও কিন্তু.. 
সেই দূরের দেশে যখন একটু একটু করে সূর্যের রোদ্দুর বেঁকছে আর তার তেজ কমছে। হালকা হাওয়ায় পাতাগুলো কাঁপছে তিরতির। কোনো কোনো গাছ ঝরিয়ে দিচ্ছে পাতা। তখন সেদেশের পাখিরা দলে দলে মিটিং-এ বসে যায়। মিটিং এর আলোচনা? বলছি বলছি... একটু ধৈর্য্য ধরো। 
সেই যে চলছিল পাখিদের মিটিং, সেখানে তখন চলছে জরুরী আলোচনা।
-শীত কিন্তু আসছে। একটু আধটু উত্তরের হাওয়া ডানায় যেন কাঁপন দিয়ে গেল আজ।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ। এবার একটা জরুরী মিটিং করতে হবে। বেরিয়ে পড়ার সময় হয়েছে। এরপর আর খাবার পাওয়া যাবে না।
-চিন্তা কিসের, আমাদের তো মানুষদের মত পাসপোর্ট ভিসা কিছুই লাগেনা। বেরিয়ে পড়লেই হয়, বুড়ো সর্দার পাখি বলল। 
-মালপত্রও বাঁধা ছাঁদা করতে হয় না। 
এক বুড়ো পাখি বলল, -আর কথা না বাড়িয়ে ঘুমিয়ে পড় সবাই। কাল ভোর ভোর রওনা  হতে হবে। 
-ইয়ে...। বলে আওয়াজ তুলল নতুন পাখির দল। তাদের ডানায় এখন খুব জোর।
এই পরিযায়ী পাখিরা তাদের ডানায় ভর করে পাড়ি দেয় হাজার হাজার মাইল। এর মধ্যে যে কত রকমের পাখি আছে।
সাইবেরিয়ান সারস, সেই দূর সাইবেরিয়া থেকে এরা উড়তে শুরু করে।
আমুর ফ্যালকন বা আমুর বাজ। এরা হাজার হাজার মাইল পেরোনোতে সব থেকে পটু।
গ্রেটার ফ্লেমিংগো এদের বলা যায় লম্বা গলার সুন্দরী রাজ হাঁস। এরাও খারাপ ওড়ে না কিন্তু অত বড় শরীরখানা নিয়ে।
ডিমইসেল ক্রেন বা কুঁজ সারস, 
কালো ডানার স্টিল্ট
পেইন্টেড স্টর্ক
বিশাল সাদা পেলিকান 
কালো লেজের গডউইট
কত রকমের মাছরাঙা(পরিযায়ী নয় যদিও)
প্রচুর পানকৌড়ি হাঁস
রুডিসেল হাঁস এদের পরিবারের এক সদস্য ব্রাহ্মিনী হাঁস প্রচুর দেখা যায় আমাদের দেশে। 
মাথায় দাগ হাঁস, যাদের ইংরেজি নাম বার হেডেড গুজ এদের দেখা পাওয়া যায় আমাদের দেশের প্রায় সবকটি রাজ্যেই। খাল বিলে মাছ আর পরিবেশটা একটু বন্ধু হলেই হয়। এরা ফিরে ফিরে আসে। তবে এরা অনেক সময়ই মানুষের লোভের শিকার হয় এদের নরম মাংসের জন্য। 
এরকম আরো যে কত । ( ক্রমশ)

পাঠ প্রতিক্রিয়া
(জ্বলদর্চি ছোটোবেলা ৭১ পড়ে সুদীপ্তা আদিত্য যা লিখল) 


"কারা যে ডাকিল পিছু বসন্ত এসে গেছে " 
শিল্পী লগ্নজিতার কন্ঠে এই গানের মাদকতায় মাতেননি এমন জন পাওয়া দুস্কর।বসন্ত এলেই যেন মনটা প্রেমের দোসরের জায়গা নেয়।ঠিক যেমন চিত্রগ্রাহক মহাশয় খিচিক করে বন্দী করলেন বসন্ত আসতে না আসতেই।
"ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত"- কোথায় ফুল?কোথায় পাখি?কোথায় কলতান? যান্ত্রিক ষড়যন্ত্রে ওরা আর নেই।

স্কুল খুলবে।পড়াশোনা হবে।বাড়িতে অনলাইনে  সবকিছু চালানোর মত সাধ‍্য সরঞ্জাম হয়তো সবার বাড়িতে নেই যেখানে পেট চালানোই তাদের রোজনামচা।কিন্তু ভাবো!আগে বাড়িতে পুথি নথি দিয়ে বিদ‍্যাপাঠের প্রচলন ছিল।পুণ‍্যিও তোহ সংস্কৃতে নিদারুণ পটু।সে জয়াবতীকে তার মায়ের অসুখের জন‍্য বনৌষধি মধুলতার খোঁজ  দেয়।এবার দুই সহচরী পাড়ি দেবে বুড়োশিব মন্দির প্রাঙ্গণে।মেয়েমানুষের আবার ভয়ডর কিসে?তারা তো মায়ের জাত।

ছোট থেকেই জানি যে  বিড়াল আর বাঘের রক্তের  সম্পর্ক।সত‍্যি বলতে বায়োলজিক‍্যালিভাবে ওদের গোত্র এক।তাইতো কবি মহাশয় এ যাত্রায় বিড়াল বাবাজীবনকে বাঁচিয়ে দিলেন।

"দীপাঞ্জন ইন দ‍্যা সুপ" নামকরনের সার্থকতা নিপুন ভাবে বের করতে গেলে চোখ রাখতে হবে শেষের ক্রমশ প্রকাশ‍্য তে।গচ্ছায় গচ্ছায় টাকা,এত এত পরীক্ষা দিয়ে ভিনদেশী হবার দরকার কি?যদি সেই সুবিধা এ দেশেই মেলে!পড়াশোনা কম।লোকদেখানি চলে বেশী।পাতি বাংলায় ফুটানি।এত বহর যে সুদূর সাইবেরিয়ার মাইনাস ঠান্ডাতেও...ভাবলেই নাকগলা কাটা যায়। দীপাঞ্জন কি পারবে শেষরক্ষা করতে?ও কি পারবে দেশের মান বাঁচাতে?দিল্লী বম্বে ছেড়ে কোলকাতাতেই কি নিজের গুঁটি সাজাবে?না কি বিদেশী তকমা লাগাতেই স্বচ্ছন্দ সে?

আমাদের ইস্কুলের রঙটাও নীল।মানে সিগ্রীন টাইপ একটু।ইউনিফর্মটা নিটোল নীল আর সাদা।নীল বাড়িটাকে ভীষন ভালোবাসি।কলেজে গেলেও  নীল সবকিছু গায়ে জড়াতে পারি না বলে  ভীষন ক্লান্ত লাগে।গল্পটা পড়ে ভিতরটা যেন হাহাকার করে উঠল।

আমি চাইনা মনখারাপ নিয়ে শেষ হোক।মন ভাল রাখার একটাই উপায় ভ্রমণ করা।কেরালা তো এখন হাতের মুঠোয়।রোজ রবিবার এ সামিল হওয়া যায় ওনম এর অনুষ্ঠানে।ওনম ছেড়ে একটু ম‍্যানগ্রোভ অরন‍্য আর জলাভূমির গল্প শোনা যাক।সুন্দরবনে  কে কে গেছ জানি না তবে আমি  যাইনি।আমিও ওই ছোটবেলাতেই ভূগোল বইতে ছবি দেখে ঠাওর করতাম একটু আধটু।আমার আবার কল্পনাশক্তি ভীষন দুর্বল।চটে গেছে।যাই হোক পাহাড় প্রেমী হওয়া সত্ত্বেও কখন সে জলের উপর মায়া পড়ে যাচ্ছে বোঝা দায়।পরের ছুটিতে কেরালা হোক না হোক সুন্দরবন যাবই।

সাহিত‍্যিক লীলা মজুমদার এর লেখা বেশ খানিক পড়েছি।বুদবুদের মতন ফুরফুরে শব্দ চলাচল।পীযূষ প্রতিহার মহাশয়ের লেখনী পড়ে ওনার জীবনী জানলাম।সুন্দর লেখা।

ছবির কথা আর কি বলব!যত দেখি তত অবাক হয়ে যাই।মাতৃসম প্রকৃতি,হাতি,বেলুন হাতে বালিকা আবার একটা মুখ "ভাঙ্গা আয়নাতে মুখ দেখতে নেই" তবে সব ভাঙ্গনে ভাঙ্গন থাকে না।

এত লেখা,এত আঁকা সবকিছুর জন্য ধন‍্যবাদ সম্পাদিকা মহাশয়া এবং  টিম কে।একশো ছেড়ে এক হাজারী হোক।সকল লেখক মন্ডলীর জন‍্য প্রণাম ও কচিকাচাদের জন‍্য ভালবাসা আর আদর।


আরও পড়ুন 
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments