জ্বলদর্চি

শিবচতুর্দশী /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব ৯
শিবচতুর্দশী

ভাস্করব্রত পতি

সে বহুদিন আগের কথা। সেসময় বারাণসীতে এক ব্যাধ থাকতো। একদিন শিকার করতে বেরিয়ে চারিদিকে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন রকম পশুপাখি মেরে সেগুলো কাঁধে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিল। শিকারের পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পথের ধারে একটা গাছের তলায় বিশ্রাম নিতে লাগলো সে। সারা দিন তাঁর খুব খাটাখাটনি হয়েছে। ফলে সে ঐ গাছতলায় একটু শুয়ে বিশ্রাম নিতে চাইলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লো। ঠিক সন্ধ্যের সময় তাঁর ঘুম ভাঙলো। তখন তো আর বাড়ি যেতে পারবেনা বুঝে ঐ গাছের উপর উঠেই বাকি রাতটা কাটাবে বলে ঠিক করল। ঐ গাছের ডালে মরা জন্তুগুলো বেঁধে নিজে রাত জেগে বসে থাকলো। আসলে ঘুমোলে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। আর সেই গাছটা ছিল একটা বেলগাছ। 

কাকতালীয় ভাবে ঐ বেলগাছের তলাতেই একটা শিবলিঙ্গ ছিল। বামনপুরাণের ষষ্ঠ অধ্যায় অনুসারে এই শিবলিঙ্গ আসলে শিবের লিঙ্গমূর্ত্তি। বিনিদ্র ব্যাধের গা লেগে একটা বেলপাতা রাতের শিশিরে ভেজা অবস্থায় ঐ শিবলিঙ্গের ওপর পড়ে। অর্থাৎ শিবের গায়েই পড়ে। পুরাণ মতে লক্ষ্মীদেবীর অঙ্গ থেকেই নাকি বেলগাছের জন্ম। বৈশাখের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথিতে ফলপত্র সহ বেলগাছের জন্ম হয়। এই বেলগাছের তিনটি পাতা আসলে তিন দেবতা। উর্দ্ধপত্র স্বয়ং দেবাদিদেব, ডানদিকে বিষ্ণু এবং বামদিকে ব্রম্ভা অধিষ্ঠান করেন। এই বেলপাতা যে পায়ে দলবে সে লক্ষ্মীহীন হবে। হাজার পদ্মফুলে শিবপূজো করলে যে ফললাভ হয়, তাঁর সেই ফললাভ হবে একটিমাত্র বেলপাতায় পূজো করলে।

কাকতালীয় ভাবে সেদিনই ছিল শিবরাত্রি, যেদিনে শিব তাঁর প্রতীক লিঙ্গকে 'শিবলিঙ্গ' রূপে প্রকাশিত করে জীবকূলের যাবতীয় পাপনাশ এবং মুক্তির পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। এদিকে সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়নি ব্যাধের। সারাটা দিনই উপোস সহ নিদ্রাহীন রাত্রিযাপন। ব্যাধের গায়ে লেগেই বেলপাতা শিবলিঙ্গের মাথায় পড়াতে তাঁর অজ্ঞানেই 'শিবচতুর্দশী ব্রত' পালন হয়ে যায়।

মৃত জন্তুগুলো সকালবেলা কাঁধে করে বাড়িতে নিয়ে গেল ব্যাধ। এদিকে খিদেয় পেট চুঁই চুঁই। কিছু না খেলে তে আর চলছে না। কোনও মতে স্নান সেরে খেতে বসার মুহূর্তেই বাড়িতে হাজির এক অনাহুত অতিথি। খেতে চাইলো ব্যাধের কাছে। তৎক্ষণাৎ খাওয়ার আসন থেকে উঠে অতিথিকে নিজের জন্য রাখা খাওয়ার পেট ভরে খাওয়ালো ব্যাধ। এরপর অবশিষ্ট খাবার নিজে খেল। এভাবে অতিথিকে খাওয়ানোর ফলে ব্যাধ শিবরাত্রি ব্রতের সম্পূর্ণতা করতে সুযোগ পেল।

একটা সময় ব্যাধ মারা গেল। তখন যমদূত হাজির ব্যাধকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সারা জীবন অসংখ্য প্রাণীহত্যা যে করেছে মৃত্যুর পরে তাঁর স্থান হবে যমলোকেই। এদিকে শিবের অনুচরেরাও হাজির ব্যাধকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ফলে লেগে গেল তুমুল লড়াই। সেই যুদ্ধে শিবানুচররা জয়ী হয়ে ব্যাধকে নিয়ে কৈলাশে যখন পৌঁছালো, তখন নন্দী যমরাজের সাগরেদদের জানালো ব্যাধের অজান্তেই তাঁর শিবচতুর্দশী পালনের কাহিনী। যমের অনুচররা যমকে গিয়ে জানালো যে, মহাপাতক হয়েও ব্যাধের স্থান হয়েছে কৈলাশে। এ তো অনাসৃষ্টি! তখন যমরাজ মৃদু হেসে বললো, "যাঁদের উপাস্য দেবতা শিব এবং যে শিবচতুর্দশী ব্রত পালন করে, তাঁদের ওপর যমরাজের কোনো অধিকার নেই।" ব্যাধের এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই মর্তে শিবচতুর্দশী পালনের রেওয়াজ শুরু হয়ে যায়।

'শিব' অর্থে কল্যানকর তথা শুভকর বোঝায়। ঋগ্বেদে আছে "শিবা ন সখ্যা সন্তু"। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'সংকল্প ও স্বদেশ' তে লিখেছেন, "ভারতের পরিচয় শান্ত শিব অদ্বৈতের সনে"। সেই শিবের ব্রতেই মেলে মুক্তি। মনের যাবতীয় কামনার পূরণ হয় অচিরেই। 

"সংসারক্লেশদগ্ধস্য ব্রতেনানেন শংকর
প্রসীদ সুমুখো নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভব।।"

মহিলাদের পালিত লোকব্রতগুলির মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হল মহাশিবরাত্রি। শিবমহাপুরাণ অনুসারে এই রাতেই নাকি শিব সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের মহা তান্ডব করেছিলেন। আর এটাই ছিল শিব ও পার্বতীর বিবাহের রাত। অর্থাৎ শিব ও শক্তি তথা পুরুষ ও আদিশক্তির মিলন দিবস। তবে নারী পুরুষ উভয়েই করতে পারেন তা। দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে নিজের আর্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, পূজা জ্ঞাপন করা হয় সারারাত ধরে। নিবিষ্ট মনে, নিবিড়ভাবে এবং হৃদয়ের নিরবচ্ছিন্ন কামনায় সারারাত ধরে ভোলানাথের চরণাশ্রিত হয়ে থাকার এ এক অনন্য লৌকিক উৎসব। 

মূলতঃ পতি কামনা, সন্তান কামনা, বৈধব্য খণ্ডন, মানসিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধি, সংসারের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য কামনায় শিবরাত্রি উদযাপন করেন মহিলারা। এর সাথে যাবতীয় অন্ধকার আর অজ্ঞতা দূর করার জন্য এই ব্রত তথা উৎসব পালিত হয়। সর্বজনপ্রিয় মহাশিবরাত্রি ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথির ভয়ানক অন্ধকার রাতে পালিত হয় সর্বত্র। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে চৈত্র মাসে শিবরাত্রি পালিত হয়। আর রাজস্থানে পালিত হয় মাঘ মাসে। তবে শিবচতুর্দশী উৎসবে ভারতের ১২ টি এলাকায় জ্যোতির্লিঙ্গের পূজা আয়োজিত হয়। এগুলি হল বৈদ্যনাথ, সোমনাথ, ওঙ্কারেশ্বর, কেদারনাথ, মল্লিকার্জুন, বিশ্বেশ্বর, ঘুশ্মেশ্বর, রামেশ্বর, ভীমশঙ্কর, মহাকালেশ্বর, ত্র্যম্বকেশ্বর এবং নাগেশ্বর।
কুমারী মহিলা এবং সধবা, বিধবার যৌথ ব্রত এই শিবরাত্রি। এই লৌকিক উৎসবে ব্রতিনীরা আগের দিন থেকেই নিরামিষ আহার করে। হবিষ্যিও পালন করেন অনেকে। সেদিন চিরাচরিত বিছানা ত্যাগ করে সাত্বিক ভাবে থেকে ভুঁয়ে তথা মাটিতে মহাদেবের নাম স্মরণ করে খড়ের বিছানায় শোওয়ার নিদান রয়েছে। আর মহাশিবরাত্রির দিন সকালে স্নান আহ্ণিক সেরে প্রথমেই তুলতে হয় বেলপাতা। এই বেলপাতাতেই মহাদেব তুষ্ট হন। সারাদিন সম্পূর্ণ উপবাসী থেকে রাত্রি জাগরণ করার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয় ব্রত।

এইসব ভক্তগণ শিব মন্দিরে গিয়ে রাত্রীকালীন চারপ্রহরে শিবলিঙ্গের গায়ে গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করিয়ে দুধ, দই, ঘি, মধু মাখিয়ে সন্তুষ্ট করে দেবাদিদেবকে। তারপর শিবলিঙ্গের উপর ডাবের জল, কাঁচা দুধ, আখ, আতপ চাল, বেলপাতা, অপরাজিতা ফুল, আকন্দ ফুলের মালা, নীলকন্ঠ ফুল, ধুতুরা ফুল ও ফল সহ অন্যান্য নানা ফুল দিয়ে পূজা করে। আসলে চার প্রহরে চারটি গঙ্গামাটির শিব গড়ে পূজা করা হয়। প্রথম প্রহরে কাঁচা দুধ দিয়ে, দ্বিতীয় প্রহরে দই দিয়ে, তৃতীয় প্রহরে ঘি দিয়ে এবং চতুর্থ প্রহরে মধু দিয়ে শিবলিঙ্গকে স্নান করিয়ে পূজা করা হয়। এদিন সারারাত জাগরণ। ঘুমোলেই ব্রত ব্যার্থ। পূজোর পরে সকালবেলায় বাড়ির কাছাকাছি কোনো ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা সহ খাওয়াতে হয়। সব মিটে গেলে ব্রতিনী খাবে। অত্যন্ত নিষ্ঠা এবং সংযমের মিলিত ফলাফল এই শিবচতুর্দশী।

বিভিন্ন শিবমন্দিরে এদিন ব্রতিনীদের ভিড় উপচে পড়ে। মন্দির কর্তৃপক্ষ আলোকময় করে সাজিয়ে তোলেন মন্দির। রাত্রী জাগরণের লক্ষ্যে সারারাত ধরে ব্যাবস্থা থাকে নানা অনুষ্ঠানের। একসময় রামায়ণ গান, ভিডিও প্রদর্শনী, বাউল গানের আসরের আয়োজন করা হত। এখন আর এসব হয়না তেমন। মানুষ আজ ব্যাস্ত হয়ে উঠেছে। গড়পড়তা লৌকিক উৎসবগুলো সময়ের তালে তালে পা মেলাতে না পেরে জৌলুস হারিয়ে মুসড়ে পড়ছে নিয়মরক্ষার যাঁতাকলে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments