জ্বলদর্চি

এশিয়া (ভিয়েতনাম)-র লোকগল্প /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প
এশিয়া (ভিয়েতনাম)

চিন্ময় দাশ 
 

আকাশের খুড়োমশাই

অনেক কাল আগের ঘটনা এটি। ব্যাঙেরা আজ যেমন আকারে ছোট্ট আর কদাকার, তখনও ছিল ঠিক তেমনটি। তবে কি না, সেসময় সাহসী আর বেপরোয়া হিসাবে সবাই মান্য করতো তাকে। কেন এমন মান্যতা ছিল ব্যাঙের? তা নিয়ে হাজারো গল্প আছে পৃথিবীর দেশে দেশে। আমরা এখানে শোনাবো ভিয়েতনামের কাহিনী। আজও যা সে দেশের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। 

কতদিনের কথা, সময়ের হিসাব মনে রাখেনি কেউ।  হাজার হাজার বছর পার হয়ে গিয়েছে তার পর। কিন্তু ঘটনাটা স্মরণে আছে সকলের।

সে বছর দেশে খরা। মাসের পর মাস একফোঁটা বৃষ্টি নাই। নদী-নালা খাল-বিল শুকিয়ে ফুটিফাটা। ফসলের খেত তো কবেই পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে। ছোট ছোট ঝোপঝাড়ও পুড়ে ছাই। বড় গাছপালার কঙ্কালগুলিই দেখা যায় কেবল। পাতা নাই একটাতেও। 

এক ফোঁটা জলের জন্য হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে বনের প্রাণীরা। বড় চেহারার হাতি-গণ্ডার থেকে মাংসাশী বাঘ-সিংহ, কিংবা ছোট্ট আর সুন্দর হরিণ বা খরগোশ—যারা বেঁচে আছে, সকলেরই ভারি কাহিল অবস্থা। কঙ্কালসার চেহারা সকলেরই।

কতজন যে মারা পড়ছে টুপ টুপ করে, বা মারা পড়তে যাচ্ছে কতজন-- তারও ঠিক নাই। আস্ত বনটাই শুকিয়ে মারা পড়ছে দিন দিন। প্রাণীরা তো কোন ছার!
কী ভাগ্যি, কী ভাগ্যি! একটা পুঁচকে কোলাব্যাঙ এসে হাজির হোল একদিন। না খেয়েদেয়ে, মাসের পর মাস শীতঘুমে কাটাবার অভ্যেস আছে ব্যাঙেদের। গর্তের মধ্যে ঘাপটি মেরে দিন কাটিয়ে দিচ্ছিল পুঁচকেটা। কিন্তু সকলের এই দুর্দশা দেখে, আর চুপ করে থাকতে পারল না সে। 

কদাকার চেহারা ব্যাঙের। মাথা বলতে প্রায় কিছুই নাই। আর সকল জীব মুণ্ডু ঘোরাতে পারে। ব্যাঙ সেটি পারে না। চোখ দুটো একেবারে মাথার একেবারে দুই প্রান্তে। নদী, পাহাড় বা বনের প্রায় কেউই তাকে পছন্দ করে না। পছন্দ তো অনেক দূরের কথা। তার সাথে মেশেই না প্রায় কেউ।

কিন্তু এখন বিপদের সময়। এসব কথা মাথায় না রেখে, খোঁদল ছেড়ে বেরিয়েছে ব্যাঙ। এই দুর্ভোগের একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বে না সে। 

যেতে যেতে একটা গ্রামের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। নদীর ধারের গ্রাম। সারা বছর স্যাঁতসেঁতে আর ছায়ায় ঢাকা থাকে। এবার কী অবস্থাই না হয়েছে গ্রামটার! গাছগুলো মরা। চারদিক শুকনো খটখটে। ধুলো উড়ছে বাতাসে। 
একটা মরা গাছের শেকড়ের তলায় ছিল একটা বুড়ো কাঁকড়া। ব্যাঙকে দেখে, বেরিয়ে এসে বলল—আরে, রোদের এই তাতে বাইরে বেরিয়েছ কেন? পুড়ে মরবার সাধ হয়েছে? কোথায় চললে অমন হন্তদন্ত হয়ে?
ব্যাঙ বলল—কোথায় আবার যাবো? আকাশের বাড়ি যাচ্ছি। বৃষ্টি হচ্ছে না কেন, এর একটা বোঝাপড়া করা দরকার। এখানে পুড়ে মরছি আমরা। একটা ফয়সালা করে, তবেই ফিরব আজ। তা ভাই, তুমিও চলো না কেন সাথে। 

উপহাস করা কাঁকড়ার স্বভাব। সে বলল— এখানে মরে যাই, সেও ভাল। কারও দয়া ভিক্ষা করতে যাব না আমি।
--দয়া ভিক্ষা কীসের? ব্যাঙ তেজ দেখিয়ে বলল—প্রতিবাদ করব গিয়ে। দাবী করব বৃষ্টি দেওয়ার জন্য। একে কি দয়া ভিক্ষা বলো তুমি?   
দুজনের কথাবার্তা কানে যেতে, কয়েকজন পাড়া-পড়শি বেরিয়ে পড়েছে। ব্যাঙের বাহাদুরির কথা শুনে টিটকিরি দিতে লাগল সবাই। সামনে-পিছনে, ডাইনে-বাঁয়ে সবাই হাসাহাসি করতে লাগল। 

কিন্তু ব্যাঙকে টলানো গেল না। সে যাবেই। বলল—থাকো তোমরা ঘরে বসে। এখানেই পড়ে পড়ে মরো সবাই। আমি ভয় পাওয়ার লোক নই। 
হোল কী, কাঁকড়ার মন বদলে গেল, ব্যাঙের সাহস আর জেদ দেখে। সকলের ভালোর জন্যই তো যাচ্ছে সে। তার একার জন্য তো নয়। ওর সাথে যাওয়াটাই উচিত কাজ। 

যাত্রাপথের প্রথম বন্ধু পেয়ে গেল ব্যাঙ। 
খানিক দূর গিয়েছে দু’জনে। এবার অন্য দুজনের সাথে দেখা। এক বাঘিনী। কোন রকমে শ্বাস নিচ্ছে নাক টেনে টেনে। আর একটা ভালুক। চেহারা শুকিয়ে একেবারে পাটকাঠি, রোদের তাতে জ্বলে যাওয়া নাক চুলকাচ্ছে বসে বসে। 
বাঘিনী বলল— কোথায় চললি রে পুঁচকেটা? পেছনেও একজন জুটেছে দেখছি। 
নিজের উদ্দেশ্য খুলে বলল ব্যাঙ। জানতে চাইল, তারা দুজনও সাথে যাবে কি না। ভালুক বলল—এখানে পড়ে পড়ে মরবার চেয়ে, একবার চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী? তাছাড়া এই হতচ্ছাড়া কাঁকড়াকে যখন বোঝাতে পেরেছ, আমিও যাব তোমার সাথে। 
কী আর করে? তর্ক করবে, সেই ক্ষমতাটুকুও নাই বাঘিনীর। সেও রাজি হয়ে গেল। দুই থেকে চার হয়ে গেল অভিযাত্রীর সংখ্যা।

সংখ্যাটা চার থেকে ছয় হয়ে উঠল, যখন একটা ভীমরুলের চাক আর খেঁকশিয়াল দলে যোগ দিল। ভীমরুলের বাচ্চাগুলো কবেই শুকিয়ে গিয়েছে। আর, শেয়ালের চামড়াটাই কেবল শরীরে জড়ানো। লোমগুলো পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে অনেক দিন আগে। হাড়-পাঁজরাগুলো ঠেলে বেরিয়ে আসছে বাইরে।   
এইভাবে কত দূরের পথ চলতে চলতে, একদিন সত্যিই স্বর্গের ফটকে এসে পৌঁছল তারা। 

বিশাল তোরণ। তাতে ইয়া মোটা আর ভারি দরজা। দেখেই তো তাদের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। 
কিন্তু ভয় পেলে তো চলবে না। একটা পাকাপাকি ফয়সালা করে, তবেই ফিরব এখান থেকে। এই ভেবে, ব্যাঙ বলল—শোন বন্ধুরা, কাজ উদ্ধার করে, তবেই ঘরে ফেরা—এই একমাত্র উদ্দেশ্য। এখন মগজ খাটিয়ে, সফল হতে হবে আমাদের। 
বাঘিনী বলল—কী করতে হবে, তাই বলো। 
ব্যাঙ বলল-- একটা ছক কষেছি। যাকে যা বলব, ঠিক সেইমতো কাজ করবে সবাই। কমও নয়, বেশিও নয়। কোন নড়চড় হলে চলবে না। 

সবাই রাজী। সবাই বলল—অবশ্যই শুনব তোমার কথা। 
ব্যাঙ তার কাজের ছক কষে ফেলল—ঐখানে একটা জলের কলসি দেখতে পাচ্ছো? কাঁকড়া গিয়ে ওটাতে সেঁধিয়ে যাও। আর, এই যে বিশাল দেউড়ি, কপাট খুললেই ভীমরুল গিয়ে তার পিছনে লুকিয়ে পড়বে। শেয়াল লুকোবে আমার ডাইনে, আর ভালুক বাঁয়ে। আর, বাঘিনী, তুমি আমার পিছন বরাবর কোথাও ঘাপটি মেরে থাকবে।

সবাই নিজের নিজের জায়গায় চলে গেল। তখন লম্বা একখানা লাফ ব্যাঙের। দেউড়ির পাশেই ছিল বিশাল আকারের একখানা ঢাক। তার মাথায় চড়ে বসল ব্যাঙ। বসেই পরপর তিনখানা ঘা। সে কী আওয়াজ ঢাকের! যেন ভয়ঙ্কর বজ্রপাত হচ্ছে। 

স্বর্গের দেবতা তখন ঘুমোচ্ছিল নাক ডাকিয়ে। বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল দেবতার। বিরক্ত হয়ে বজ্রকে ডেকে বলল—ব্যাপারটা কী, দেখে এসো তো।
ব্জ্র নিজেও কম বিরক্ত নয়। কত দিন নড়াচড়া নাই তার। হাত-পায়ের ধুলো ঝেড়ে, উঠে দাঁড়াল। গদাটা তুলতে গিয়ে দেখল, মাকড়শার জাল ঢেকেই ফেলেছে বিরাট গদাখানাকে। ঝাড়াঝাড়ি করে, গদা ঘাড়ে তুলে নিল বজ্র। ধুপধাপ করে পা ফেলতে ফেলতে, এসে হাজির হোল দেউড়িতে। কিন্তু কেউ তো কোথাও নাই। একটা পিঁপড়েও চোখে পড়ছে না কোথাও। 
ব্যাঙটা লাফ দিয়ে এসে ড্রামের উপর বসে পড়ল যখন, তখন দেখতে পেল ব্জ্র। গদাটা হাতে তুলে নিয়েও থমকে গেল সে। এই গদার এক ঘায়েই স্বর্গ মর্ত পাতাল তো বটেই, নরকও ধ্বংস হয়ে যায়। এই পুঁচকেটা কি আমার গদার যোগ্য? 
দোনামনা করে, ফটক থেকে দেবতার কাছে ফিরে গিয়ে সব বিবরণ জানাল তাঁকে। একটা মোরগ ছিল স্বর্গে। সকাল হলেই আকাশের দিকে গলা উঁচিয়ে দেব-দেবীদের ঘুম ভাঙায় সে। দেবতা তাকে ডেকে বলল—ফটকে একটা ব্যাঙ উদয় হয়েছে, গিলে খেয়ে আয় হতভাগাকে। 

স্বর্গের ফটকে ব্যাঙ! রাগে গরগর করতে করতে ফটকের দিকে চলল মোরগটা। রাগে আরও লাল হয়ে উঠেছে তার মাথার ঝুঁটি, কানের লতি দুটোও। 
ফটকে পৌঁছে, ব্যাঙটাকে গিলতে যাচ্ছে মোরগ, বামদিক থেকে শেয়াল ঝাঁপিয়ে পড়ল বিদ্যুতের বেগে। টুঁটি কামড়ে ধরল মোরগের। মূহুর্তেই দফারফা বাবাজীর। 

আবার ঢাকে ঘা বসাল ব্যাঙ। দেবতা রুষ্ট হয়ে তাঁর শিকারী কুকুরকে পাঠালেন, শেয়ালকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার জন্য। ফটক তো খোলাই ছিল। কুকুর সবে ফটকে পৌঁছেছে, কিছু বুঝে উঠবার আগেই, ভালুক ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। সামান্য সময়ের লড়াই। চিত চিৎপটাঙ হয়ে পড়ে রইল কুকুরটা।
আবারও একবার ঢাকে ঘা লাগাল ব্যাঙ। 
দেবতার একেবারে বিব্রত অবস্থা। মাথা চুলকাতে চুলকাতে, বজ্রকে ডেকে বললেন—তোমার সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে যাও। তোমার গদার সামনে দাঁড়ায়, এমন কে আছে তিন ভূবনে? ব্যাঙ বলে তাচ্ছিল্য করাটা ঠিক হয়নি তোমার। এবারে ব্যাপারটা একেবারে মিটিয়ে, তবে আসবে। 
আবার গড়িয়ে নিতে গেলেন দেবতা। 
শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। ফটক খুলে সবে এক পা রেখেছে বাইরে, বোঁ-ও-ও-ও করে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ভীমরুল। সোজা ব্জ্রের ডান নাকের ফুটো দিয়ে ভিতরে সেঁধিয়ে গেল। যতটা পারল ভিতরে ঢুকে, এক কামড়। ভীমরুলের কামড় মানে মৃত্যু যন্ত্রনা। প্রথমে বুক, তারপর মাথা, সারা শরীর অসহ্য যন্ত্রনায় পুড়ে যেতে লাগল বজ্রের। 

হঠাৎই তার মনে পড়ে গেল, একটা জল ভর্তি জালা রাখা থাকে স্বর্গের ফটকে। হাতের গদা ছুঁড়ে ফেলে, ছুটে গিয়ে  দু’হাতে জালা ধরে নাক মুখ ডুবিয়ে দিল জলে। এতক্ষণ ওত পেতে বসেছিল কাঁকড়াটা। এবার মওকা পাওয়া গেছে। দুই দাঁড়ার জোর এক কামড় বসিয়ে দিল বজ্রের মুখে।   
আরও এক আচমকা আক্রমণে, ভয়াণক গর্জন করে উঠল বজ্র। জালাটা পড়ে গিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো। ভড়কে গিয়ে, ফটকের দিকে দু’পা পিছিয়ে গেছে বজ্র, অমনি এক লাফে তার ঘাড়ে এসে পড়ল বাঘিনী। সামান্য একটু সময়ের লড়াই। কেটে দু’টুকরো করে ফেলল বজ্রকে।

এবার ভয়ই পেয়ে গেলেন স্বর্গের দেবতা। আর লড়াই নয়। একটা সমঝোতার রাস্তায় যাওয়াটাই বুদ্ধির কাজ হবে। এই ভেবে, লোক পাঠিয়ে ব্যাঙকে স্বর্গের ভেতরে ডেকে আনলেন। বললেন—আর লড়াই, দাঙা নয়। এসো, আমরা একটা চুক্তি করি। তোমরা আমার এই সেনাপতির দেহ ফেরত দাও। তার বদলে তোমরা কী চাও, বলতে পারো। 
ব্যাঙ ভারি খুশি। এটাই সে চায়। তার চ্যাপ্টা মাথার মগজ তাকে বলে দিল-- প্রতিপক্ষ মাথা নোয়ালে, লড়াই চালাতে নাই। লাভ হয় না তাতে। 
বজ্রের দেহটা দু’টুকরো হয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে ধুলোয়। বাঘিনী আর ভালুক টানাটানি করে সেগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করে দিল। দেবতা হাত বুলিয়ে, সেগুলোকে জুড়ে, জীবন ফিরিয়ে আনলেন। 

বজ্র চোখ মেলে চেয়েছে । কিন্তু কিছুই যেন বিশ্বাস হছে না তার। তিন ভূবন কেঁপে ওঠে তার ভয়ে। আর, সে কি না এই পুঁচকেগুলোর কাছে হেরে ভূত? শেষে মারা পড়ে, ধুলোয় গড়াগড়ি? আসলে, যতই ক্ষুদ্র হোক, একজোট হতে পারলে, ছোটরাও অনেক বড় কাজ করতে পারে। এরা সবাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীব। কিন্তু ভীমরুলের হুল, কাঁকড়ার দুটো দাঁড়া, বাঘিনীর দু’পাটি দাঁত আর ভালুকের শক্তি। এতেই স্বর্গ জিতে নিয়েছে এরা।  
লজ্জায় ধিক্কারে মরমে মরে যেতে লাগল বেচারা বজ্র। এদিক ওদিক চেয়ে দেখে নিয়ে, সুড়সুড় করে সরে পড়ল সেখান থেকে। সোজা গিয়ে দেবতার সিংহাসনের পিছনে লুকিয়ে পড়ল। 

সেনাপতি বজ্রকে এভাবে হামাগুড়ি দিয়ে লুকিয়ে পড়তে দেখে, দেবতার সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ। যে যেদিকে পারল, সরে পড়ল। কেউ আর দেউড়ির দিকে তাকিয়েও দেখল না।
দেবতার বুঝতে সুময় লাগল না, তিনি হেরে গেছেন। বললেন—চলো, দরবারে বসা যাক। তোমাদের কী কথা, শুনি।
দরবারে পৌঁছে ভারি মজা লাগল ব্যাঙের। একটু বেইজ্জত করা দরকার ঠাকুরকে। নইলে দাবী আদায় হবে না। ছোট্ট একটা লাফ। সোজা তাঁর সিংহাসনের হাতলে গিয়ে বসে পড়ল ব্যাঙ। 
ব্যাঙের এমন কাণ্ড দেখে, দু’পক্ষের সবাই অবাক। এত সাহস, এত ধৃষ্টতা একটা নগন্য ব্যাঙের! কী কুরুক্ষেত্রই না বেধে যায় এবার।

কিন্তু কিছুই হোল না। বিধাতা পুরুষ শান্ত নির্বিকার। ব্যাঙও অচঞ্চল। নিজের যায়গায় বসে থেকেই ব্যাঙ বলতে শুরু করল—প্রথমেই একটা কথা বলি। এই যে আকাশে স্বর্গরাজ্য সাজিয়ে বাস করো তোমরা, সেই আকাশ হোল আমার বহুদিনের বন্ধু। সেই অর্থে, আমি হোলাম তোমাদের খুড়োর মতো। আর সেই দাবীতেই আমার পড়শিদের নিয়ে তোমাদের এখানে আসা। সঙ্কটে পড়লে, নিজের লোকের কাছেই তো যেতে হয়, তাই না? 
বিধাতা বললেন—সেটা অবশ্য তুমি ঠিকই বলেছ, বাপু। তা বলো তো, কিসের সঙ্কট তোমার? পড়শিদের নিয়ে এতদূর আসবার কারণটা কী? 
ব্যাঙ বলল—চার-চারটে বছর ধরে ভয়াণক খরায় ভুগছি আমরা। এক ফোঁটা বৃষ্টির নাম নাই। নদী-নালা শুকিয়ে কাঠ। তেষ্টায় ছাতি ফেটে মরে যাচ্ছে জীব-জন্তুরা। আমি ভেবেছিলাম, বিধাতাপুরুষ নিশ্চয় জরুরী কাজে ব্যস্ত। আর, নয়তো কোন কারণে বিরূপ হয়েছেন আমাদের উপর। কিন্তু এটা কি কেউ জানতো যে, স্বয়ং বিধাতাও স্রেফ ঘুমিয়ে দিন কাটাচ্ছেন? সাগরেদদের কথা না হয় বাদই দিলাম। নিজেদের দায়িত্বের কথা ভুলে গেছে সকলে। এমন কি, জীব-জন্তুতে ভরা একটা পৃথিবী আছে নীচে, সেকথাটাও মনে নেই কারও! তাহলেই বলো, কেউ যদি আমাদের দুর্ভোগের কথা না বোঝে, দল বেঁধে এখানে চলে আসা ছাড়া, আর কী আছে আমাদের? সেজন্যই তোমাদের ঘুম ভাঙাতেই আমাদের এখানে আসা। দয়া করে দু’ফোঁটা বৃষ্টি দাও আমাদের। অন্ততঃ প্রাণে বেঁচে থাকি আমরা। বেশি কিছু তো চাই না।

সব অভিযোগই সত্যি। কথা জোগাচ্ছে না বিধাতার মুখে। পর পর দুটো ঢোঁক গিললেন তিনি। পরে বললেন—যা হয়নি, সেসব ভেবে আর লাভ নাই। এবার থেকে সামনের দিকে তাকাব আমরা। হোলই বা ছোট্ট একটা জীব। কিন্তু আজ থেকে ব্যাঙ আমার বন্ধু। তার অভিযোগের সব রকম সুরাহা হয়ে যাবে এবার থেকে। 
একটু থেমে বললেন—বায়ুর দেবতা পবন আর বৃষ্টির দেবতা বরুণকে বলে দিচ্ছি। এখনই তারা মর্তে পৌঁছে যাবে। ঝড় আর বৃষ্টি শুরু  হয়ে যাবে, তোমরা ঘরে ফেরার আগেই। এবার নিশ্চয়ই তোমরা খুশি? 
নিশ্চিত ধ্বংশের মুখ থেকে বেঁচে গেলাম আমরা। ব্যাঙ বলল—আমরা আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আমি কথা দিচ্ছি, যদি কখনও আবার এমন দুঃসময় আসে, দল বেঁধে সোজা আপনারই কাছে চলে আসবো আমরা আর্জি জানাতে। 

বিধাতা আঁতকে উঠলেন এ কথা শুলেন। বললেন—আরে, না না। বললাম না, আজ থেকে তুমি হলে আমার বন্ধু। অত দূরের পথ আসবার কষ্ট করতে হবে না কোনদিন। বৃষ্টির দরকার হলে, তুমি শুধু গলা ছেড়ে ডাক দিও আমাকে। আমি বুঝে যাবো ব্যাপারটা। বৃষ্টি নেমে যাবে সাথে সাথে। এতখানি পথ পাড়ি দেওয়া সোজা কথা নাকি? শুধু শুধু হয়রান হতে যাবে কেন?
বলেই, কালো দৈত্যকে ডেকে পাঠালেন বিধাতা। তাকে বললেন—ঝড় আর বৃষ্টিকে মর্তে নিয়ে যাও। আর হ্যাঁ, এই ছ’জনকে তোমার কাঁধে তুলে নিও। অতটা পথ ফিরে যাবার কষ্ট যেন সইতে না হয় এদের। 
টানা চার বছর বাদে বৃষ্টি নেমেছে মাটিতে। গা পুড়িয়ে দেওয়া ল্যু (গরম বাতাস) কোথায় উধাও। শরীর মন জুড়ানো ঠাণ্ডা বাতাস বইছে আবার। খাল-বিল, নদী-নালা সব জলে টইটুম্বুর। গাছে গাছে সবুজ পাতার সমারোহ। ফুলে-ফলে ভরে উঠেছে গাছপালা। সুখের সীমা নাই কারও। 

একদিন ঘটা করে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছে ব্যাঙকে। তার জন্যই বেঁচেছে সকলের জীবন। সভার শেষে ব্যাঙ বলেছে—এবার থেকে আর বৃষ্টির অভাবে ভুগতে হবে না কাউকে। আমি চিরকাল থাকব না। তবে আমার বংশধররা থাকবে। যখনই বাতাসের গরম আর সহ্য হবে না, আমরা গলা ছেড়ে হাঁক ছাড়ব বিধাতাকে। তাতেই ঝরঝরিয়ে বৃষ্টি নামবে আকাশ থেকে। বিধাতা পুরুষের সাথে পাকা কথা হয়ে গিয়েছে আমার। 
তার পর কেটে গিয়েছে হাজার হাজার বছর। কিন্তু ব্যাঙের সাথে বিধাতা পুরুষের চুক্তি ভেঙে যায়নি। এখনও দেখা যায়, গ্রীষ্মকাল যখন অসহ্য হয়ে ওঠে, গলা ছেড়ে ডাকতে শুরু করে ব্যাঙেরা। ঝোড়ো বাতাস বইতে থাকে গাছপালার মাথা ঝাঁকিয়ে। একটু বাদেই টুপ-টুপ করে ঝরতে থাকে বৃষ্টির ফোঁটাও। 
তা থেকেই তো ছড়া লিখলেন কবিরা :

ব্যাঙ আকাশের খুড়োমশাই। 
নইলে হোত যে কী দুর্দশাই।। 
গ্রীষ্ম বাড়লে বেরুবে ব্যাঙ। 
গলা ছাড়বে—ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ।। 
বৃষ্টি নামবে আকাশ থেকে। 
খুড়ো নাইবে সে জল মেখে।।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments