জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ-ছয় /শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ || ছয়
শুভঙ্কর দাস 


"যে আনন্দ দাঁড়ায় আঁখিজলে
দুঃখ-ব্যথার রক্ত শতদলে
যা আছে সব ধূলায় ফেলে দিয়ে 
যে আনন্দে বচন নাহি ফুরে
সেই আনন্দ মেলে তাহার সুরে।"

জমিদার বাড়িটি রাজপ্রাসাদের মতো না হলেও তার ঠাট-বাট রাজরাড়ির একটা ব্যর্থ অনুকরণ লক্ষ্য করা যায়! বৈঠকখানাটি বেশ জমাটি, একটি দামি ঝাড়লন্ঠন ঝোলানো, অবশ্য তার বেশ কয়েকটি কাঁচের গ্লাস ভাঙা।বৈঠকখানায় সারিবদ্ধ কালী-দুর্গা-মহাদেব-গণেশের বাঁধানো ছবি আছে।কবে কোন এককালে এই পরিবারের কোনো এক সদস্য লাটসাহেবের পার্টিতে আমন্ত্রিত ছিল,সেই ছবিটি আঁকা হয়েছিল,তাই বাঁধানো হয়েছে। বৈঠকখানার ডানদিকের পর্দা পেরিয়ে গেলে জমিদারবাড়ির অন্দরমহল।বামদিকের পর্দা সরালে একটি সেরেস্তাখানা। চারটি ছোট ছোট খাট পাতা রয়েছে। তাতে সাদা চাদর পাতা।খাটের প্রান্তে জলচৌকি রাখা। হিসাবপত্র দেখার জন্য। একমাত্র খাজাঞ্চিবাবুর খাটে লম্বা বালিস দেওয়া আছে।সেই স্থানের ওপরে একটি বৃহৎ ছবি রয়েছে, এই গৃহের কুলদেবতার। তাতে প্রতিদিন টাটকা ফুলের মালা চড়ানো হয়। 
এখানেই হিসেবপত্র রাখার কাজ করে দেবেন। সে অতি নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের সঙ্গে কাজ করে।আরও একটি গুণ জমিদারকে মুগ্ধ করে,তা হল দেবেন কোনোদিন নিজে থেকে বেতনের কথা বলে না,যখন যা দেওয়া হয়, তাই হাসিমুখে গ্রহণ করে।
জমিদারের চাকর-বাকর ও কর্মচারীরা শুধু মুখ বুজে শ্রম ও মাথা নিচু করে সম্মান জানিয়ে দিনরাত পার করবে,কোনোরকম দাবী বা প্রতিবাদ মাথার একশো মাইলের মধ্যে আসবে না!এবং এটাই স্বাভাবিক ও চলে আসা প্রথা বলেই সকল জমিদার যেমন মনে করেন,তেমনই  তার অনুগত কর্মচারীরা ধ্রুব সত্য বলে মনে করে।কিন্তু কিছুদিন দেবেন মনের ভেতর ক্ষুন্ন, কারণ সে বেশকিছুদিন ধরেই একটু টাকা ধার করার জন্য চেষ্টা করে চলেছে।
আজ দুপুর পেরিয়ে একটু বেলা গড়িয়েছে, তারপর গৃহ থেকে খেয়ে এসে দেবেন ঢুকতেই খাজাঞ্চিবাবু সুপক্ব দাঁড়িতে চুলকোতে চুলকোতে বাঁকা হেসে বলে উঠল,কী হে,ভাতের পর একটু ভাতঘুম দিয়ে এলে নাকি! এভাবে চললে এই জমিদারি লাটে উঠবে বাপু!
খাজাঞ্চিবাবু কথায় কথায় 'বাপু' শব্দটি কারণে-অকারণে ব্যবহার করেন।

না,এই মাঠ পেরিয়ে ছুট লাগিয়ে এলাম,রাস্তায় একটু হোঁচট খেয়ে গেছিলাম,তাই! 

তাতে কী? হাড়ও ভাঙেনি,পাঁজরও গুঁড়ো হয়নি,ফুলের ঘায়ে মুর্ছো গেলে বাপু?এই তো অল্প বয়েস..

দেবেন পাশেই কাজ করে হারান। সে খাজাঞ্চির স্বরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বলে উঠল,জল চিবিয়ে খাবে,বাতাসের আগে দৌড়ুবে...হাঁটতে বললে দৌড়ে যাবে,ধরে আনতে বললে, একেবারে বেঁধে আনবে!

তুই থামবি বাপু! তোকে কে বাঁয়া হতে বলেছে! তুই সময় তালিকার খাতা বের কর দেখি,দেবেনের নামের পাশে লিখে রাখ একুশ মিনিট লেট!তাহলে বিকেলে ছুটির পরও একুশ মিনিট বেশি কাজ করবে,বুঝেছো বাপু?

দেবেনের কিছু বলার আগে সেই হারান অতি উৎসাহে বলে উঠল, হা, হা,বুঝেছে,ওখানে শব্দটা টিক টিক নয়, হবে ঠিক ঠিক..
বলে সে মুচকি হেসে দেওয়ালে টাঙানো মান্ধাতার আমলের একটি ঘড়ির দিলে আঙুল তুলে দেখাল!
অথচ এদের মধ্যে সবচেয়ে ফাঁকিবাজ ও ধূর্ত এই খাজাঞ্চিবাবুর বাঁয়াটি।ইতিমধ্যে তিনটি বিয়ে করেছে,তার মধ্যে দুটো বউ এর অত্যাচারে একজন গলায় দড়ি দিয়েছে, অপরজন নিরুদ্দেশ। বর্তমানটি সর্বদা নাকি অসুখে ভোগে!সেই অজুহাতে বেশ কয়েকবার টাকা ধার পেয়েছে। এখন খাজাঞ্চিবাবুর সাতটি কন্যার কোনো একটিকে বিবাহ করার তালে আছে...
প্রায় দেরি করে,মিথ্যা বলে এবং হিসেবের কাজে কোনোদিন যোগ মেলাতে পারে না! কিন্তু তার একটি বড় গুণ,সে খাজাঞ্চিবাবুকে তেলিয়ে চলে,এরজন্য সাতখুন মাপ!

দেবেন নীরবে নিজের স্থানে বসে কাজ করতে লাগল,মুখে একটাও কথা বলল না। কারণ সে কিছু টাকা ধার চেয়েছে,এখন মুখে মুখে উত্তর করলে হিতে বিপরীত হতে পারে! বেশ কিছুদিন ধরে তার ভাই আবদার করে কাশীদাসী রামায়ণটি কিনে দিতে,বাজারে খোঁজ করে জেনেছে,তার দাম বারো টাকা। শ্রীরামপুর মিশনের ছাপা। আর বিদ্দেসাগরের আখ্যানমঞ্জরী,তার দাম দেড় টাকা। আরও কিছু টাকা-পয়সা জোগাড় না হলে কুমারের বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে!একটি মাত্র মলিন ধুতি পরেই কাটায় সারাক্ষণ,খালি গা,এবার ওকে একটি ফতুয়া কিনে দিতে হবে।
আর কিছু কেনা হোক না হোক,আখ্যানমঞ্জরীটি কিনতেই হবে।
এই বইটির প্রতি কুমারের কী অদ্ভুত আগ্রহ। জিজ্ঞেস করলে বলেছে, এটা আনতে পারলে সে নাকি বাবাকে একটা জিনিস দেখিয়ে চমকে দেবে। যত দিন যাচ্ছে, ততোবেশি কুমারের পড়াশোনার আগ্রহ বেড়েই চলেছে।
আবার যে বইগুলো এনে দেবে বলেছে,তাকে কিছু বকসিস দিতে হবে!
সারাক্ষণ কিছু না কিছু পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকে,অথচ গরীবের সন্তান ভালো করে খাওয়া-পরার চিন্তায় দিন চলে যায়,বই পড়ার আগ্রহ থাকলে হবে! বই পাবে কোথায়? এ অঞ্চলে পড়াশুনোর ইচ্ছের কথা প্রকাশ করলেই লোকে হাসাহাসি করে এবং ব্যঙ্গ করে বলে ওঠে,ওলে বাবা, চালে কত কাঁকর/ বাছবে কে?/ ছেলে কয়, হতে চায় বিদ্দেসাগর! 
ছোঃ ছোঃ যতসব পাগলের কারবার,বাপ-চোদ্দপুরুষ লোকের ঘরে দিনরাত গতর খেটে,মাঠে মাঠে ঘাম ফেলে সগ্গে চলে গেল,এ আবার কোন্ গাছের কাঁদিরে! পড়াশুনা করবে! যত্তসব!

দেবেন মনে মনে ভাবল,আজ আবার একবার টাকাটা চাইবে,একটু বেশিক্ষণ কাজ করার পর। 
খাজাঞ্চিবাবু বালিশে গা এলিয়ে বেশ আয়েশ করে তামাক টানছিল। সহসা একটা শব্দে নড়ে-চড়ে বসল।একটি লোক সেরেস্তাখানায় ঢুকল।সিল্কের পাঞ্জাবি ও চুনট করা ধুতি।হাতে একটি সিগারেট। চোখ দুটোতে রাত জাগার স্পষ্ট ছাপ। ইনি জমিদারের পুত্র। সবেধন নীলমণি। পাঁচটি কন্যার পর এই পুত্রটি জন্মায়।তাই বংশে বাতি দেওয়ার একমাত্র অবলম্বন আদরে ও আদরের অত্যাধিক আড়ম্বরে এমন একটি ধনুর্ধর তৈরি হয়েছে, এই জমিদারীর লালবাতি জ্বালাতে এ একাই যথেষ্ট। দেবেনের মতোই বসয়।যথারীতি তিনটি বিবাহ হয়ে গেছে।নিয়মিত মদ্যপান এবং এর একটি ভয়ংকর নেশা জুয়া খেলার।এমন কি কলকাতায় গিয়েও নাকি জুয়া খেলে এসেছে। 
লায়েক পুত্রটি আগে বৈঠকখানায় বসেই খাজাঞ্চিবাবুকে ডেকে পাঠাতেন। কিন্তু এই সময় আর ওসবে সময় নষ্ট করতে চায় না।সে সরাসরি সেরেস্তাখানায় আসে।নিজের পিতার বয়সী খাজাঞ্চিবাবুকে তুই-তোকারি করে কথা বলে।দেবেনদের অবশ্য মানুষ বলে জ্ঞান করে না।কথা বলা তো দূরের কথা,তাকিয়ে একবার দেখেও না পর্যন্ত! 
উপস্থিত হওয়া মাত্র বোঝা যায়,যথারীতি মদ্যপান করে আছেন।

কী সনাতন, তোর আবার কবে থেকে পাখনা গজালো? আমার পাঠানো লোককে বলিস কি না,টাকা নেই! এই অঢেল সম্পত্তি, এতো টাকা,এতো বড় জমিদারি, এ তো আমার ভোগেই লাগবে,তাহলে?

খাজাঞ্চিবাবুর নাম সনাতন।তিনি বিগলিত হেসে চশমার ওপর থেকে বলে উঠলেন,সে কি! এসব কি আর বলতে হবে! সব জানি,সব জানি বাপু,থুড়ি, বাপধন আমার,এ সবই তো তোমার,আসলে বুঝতে পারিনি,হঠাৎ রাতের দিকে অপরিচিত লোক এসে উপস্থিত, তাই একটু বাজিয়ে নিয়েছিলাম!

ওহ্ বাজিয়ে নিচ্ছিলি, তা কী বাজাতে জানিস তুই,তবলা নাকি তানপুরা?বলেই নিজেই বাজানোর মুদ্রা দেখিয়ে জমিদার-তনয়টি হো হো হেসে উঠল।

তারপর যা করল,এটি এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, সে এগিয়ে গিয়ে খাজাঞ্চিবাবুর হাত থেকে চাবিটি নিয়ে ছোট কাঠের দেরাজটি খুলে ফেলল।এবং মুঠো মুঠো টাকা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে টলতে টলতে বেরিয়ে গেল!
খাজাঞ্চিবাবু অতি তৎপরতার সঙ্গে সেই দেরাজটি বন্ধ করল।এবং বেশকিছু টাকা যে খাজাঞ্চির পেট-কাপড়ের মধ্যে চালান হল,তাও দেবেনের মতো অনেকের চোখে পড়লেও,কিন্তু টুঁ শব্দ করার জো নেই। কারণ স্বয়ং জমিদার মহাশয় কালেভদ্রে এদিকে আসেন এবং এই জমিদারির হিসেব-নিকেশের দিকটি পুরো ব্যবস্থাটার জন্য খাজাঞ্চিবাবুর ওপর নির্ভর করে থাকেন।
প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে। 
দেবেন উঠে গিয়ে খাজাঞ্চিবাবু সনাতনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

কী হল রে? বাড়তি কাজ করেছিস? নাকি তুইও জুয়ার জলে চরতে যাবি বাপু? 

না,বলছি,আমার সেই টাকাটা ধার দিলে ভালো হত! 

কত?

পঞ্চাশ টাকা

প-ঞ্চা-শ- টা- কা! বলিস কী বাপু? হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাবে,তোর বেতন তো মাত্র সাড়ে ছ'টাকা।এতো টাকা নিলে শুধবি কী করে?

আমি কাজ করে শুধাবো, এই টাকা কটা খুব দরকার।

হে হে হে টাকা দরকার নেই, এমন লোক কি পৃথিবীতে আছে? তা বাপু,একেবারে পঞ্চাশ টাকা,এতো ন্যাড়াগাছে উঠেই এক কাঁদি পাওয়ার ইচ্ছে! 

দিন না,আপনাকে তো সেই গত মাস থেকে বলে রেখেছিলাম!

তাতে কী হয়েছে? তুই বলেছিস,আর আমার মাথাটা অমনি তোর জুতোয় বিক্রি হয়ে গেছে... ওহ্ তুই তো আবার জুতো-টুতো পরিস না! তোকে কী বলি বাপু!

জুতোর প্রয়োজন নেই,একটু রেগে বলল দেবেন।

রাগ হচ্ছে!  তা কী প্রয়োজন শুনি?

বই কিনতে হবে।

কথাটি শুনে খাজাঞ্চিবাবুর ভ্রু কপাল ছাড়িয়ে টাক পর্যন্ত ছুঁয়ে গেল!

পাশের লোকটি গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,ওরে দেবেন, তুই কী শুরু করেছিস বলতো! এইসব উদ্ভট কথা শুনিয়ে এই বুড়ো লোকটার পরানপাখি ওড়ানোর মতলব...  দ্যাখ, দ্যাখ মুখের অবস্থা দ্যাখ।
সে বলেই জলের জন্য কুঁজোর কাছে ছুটে গেল।

জলটা খেয়ে খাজাঞ্চিবাবু একটি কথা উচ্চারণ করল,যাঃ,যাঃ দেবেন,ঘর যা,আর হাসাসনি! তোর শরীর ঠিক নেই, এ দেখছি, মাথা গরমের ফল, যাঃ যাঃ

মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়িয়ে খাজাঞ্চিবাবু সেরেস্তাখানা থেকে বেরিয়ে গেলেন।

দেবেন এইরকম আচরণে বেশ অসন্তুষ্ট হল। সে সাহস ভরে বৈঠকখানার দিকে চলল। আজ জমিদারের সঙ্গে দেখা করবেই।সবকিছু জানাবে।খাজাঞ্চিবাবুর অন্যায়ের প্রতিবাদ সে করতে যাচ্ছে না,তবে টাকাটা সরাসরি বললে যদি পাওয়া যায়,তাই এই শেষ চেষ্টা। 
দীর্ঘক্ষণ বৈঠকখানার একপাশে দাঁড়িয়ে রইল।কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে একজন চাকরের কাছে জানতে পারল,জমিদারবাবু বাইরে গেছেন,একটু পরেই ফিরবে। সে সদর গেটের কাছে এসে দাঁড়াল। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখা গেল একটি পালকি প্রবেশ করছে।তার পাশে পাশে একটি লোক ছাতা মাথায় হেঁটে এসেছে। সেও স্থির হয়ে দাঁড়াল।পালকিটি ঢুকতেই সে সামনে গিয়ে উপস্থিত। 
ভেতর থেকে দুজন দৌড়ে এলো।তারা হাত ধরে পালকি থেকে বের করল জমিদারবাবুকে।
বিশাল বপুর জন্য পালকিকে ঢুকতে ও বেরোতে সাহায্য লাগে।
তিনি বেরিয়ে বলে উঠলেন,কে  দেশ চালাবে, কীভাবে চালাবে,এসব বুঝি না,জগা, শুধু এটাই বুঝি,আমার জমিদারিতে কোনো ঝামেলা চাই না,তার জন্য যদি গোরা সাহেবের পাও চেটে দিতে হয়...

বলেই দেবেনকে দেখে থেমে গেলেন!

সে যে কী বলেন আপনি! অন্নদাতা  কখনো নিচু হয়? জুতো  চাটবেন! আমি আপনার হয়ে জিভ দিয়ে চেটে দেবো,বলে উঠল জগা অর্থাৎ জগমোহন। 
এ অঞ্চলের নামকরা আড়তদার।

থাম, থাম! তারপর জমিদারবাবুটি দেবেনের দিকে চেয়ে বলে উঠলেন, তা কী হল তোর?এখানে?

দেবেন শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল,কিছু টাকা...

তা এখানে কেন? সনাতন কি মরে গেছে? সনাতন?

না মরিনি কর্তা,তবে এইসব অপোগণ্ডের জন্য এবার মরেই যাবো,এইকথা বলতে বলতে খাজাঞ্চিবাবু একটি থামের আড়াল থেকে সহসা দৃশ্যমান হলেন।

কেন? শক্ত ওষ্ঠে বলে উঠলেন জমিদার। 

আর কী বলব বাপু! থুড়ি কর্তা, এই দেবেন টাকা চায়,নাকি বই কিনবে, তার ভাইয়ের প্রচণ্ড পড়াশুনার বেগ!

জমিদারের ভ্রু দুটি জুড়ে গেল!এ অঞ্চলে সচারাচর লোকেরা টাকা চাইতে আসে,হয় তো বীজধান কিনবে না হলে মেয়ের বিয়ে দেবে বলে! আবার অনেকে আসে ম্যালেরিয়া-কলেরার চিকিৎসার জন্য! কিন্তু বই কেনার জন্য টাকা চাইতে এসেছে! 
ভেতরে খুব অবাক হলেন। 
বাইরে বললেন,ঠিক আছে,আমি বড্ড ক্লান্ত, পরে শুনব সব।এখন ঘরে যা..

টাকাটা আজ পেলে বড় ভালো.. মৃদুস্বরে বলে উঠল দেবেন

কী বলিস তুই,কথা পাড়লি,আর সঙ্গে সঙ্গে তামিল করতে হবে,এতো বড় কথা!

না, মানে আমি গত মাস থেকে..

জমিদার পুরো কথাটি শুনলেন না,জুতো মচমচিয়ে বৈঠকখানার দিকে চলতে শুরু করলেন।

দেবেন মুখ কালো করে একটু দাঁড়িয়ে থেকে ধীর গেটের বাইরে চলে এলো...

বারান্দায় এসে জমিদার আবার পেছনে একবার ঘুরলেন।দেবেনের চলে যাওয়াটা এক ঝলক দেখে জিজ্ঞেস করলেন,ছেলেটি কে বলতো সনাতন?

ও তো ঠাকুরদাসের বড় পুত্র।

সঙ্গে সঙ্গে জগমোহন যোগ করল,ওরা বাপ-বেটা দুই পাগল!

বলেই হেসে উঠল।খাজাঞ্চিবাবুও সেই হাসিতে যোগ দিলেন।
কিন্তু জমিদারবাবুটি হাসলেন না।তার ভ্রু কুঁচকেই রইল।

মাঠ পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেবেন ভাবল,এই রকম অভাবের দিন কি কোনোদিন বদলাবে না! সে কি পারবে না, ভাইয়ের ছোট্ট আবদার পূরণ করতে? চারিদিকে এতো অভাব,এতো কষ্ট, এতো ক্ষুধা, তার মধ্যে তার ভাই কুমার সেসবকে গ্রাহ্য করে না,শুধু বই পেলেই সে যেন নতুন প্রাণ ফিরে পায়... কোনো অভাব,দুঃখ স্পর্শ করতে পারে না! কিন্তু সেই বই তো কিনে দিতে পারছে না!
সহসা একটি গাছের আড়াল থেকে একটি গান ভেসে এলো,সে এগিয়ে গিয়ে দেখল,আবদুল ফকির।আপন মনে ধুলোর ওপর বসে একতারা ধরে গাইছে...

"দিল-দরিয়ায় মাঝে দেখলাম আজব কারখানা। 
ডুবলে পরে রতন পাবে ভাসলে পরে পাবে না।
দেহের মাঝে বাড়ি আছে
সেই বাড়িতে চোর লেগেছে 
ছয়জনেতে সিঁদ কাটিছে
চুরি করে একজনা।
দেহের মাঝে নদী আছে
সেই নদীতে নৌকা চলছে
ছয়জনেতে গুণ টানিছে
হাল ধরেছে একজনা।

দিল-দরিয়ায় মাঝে আজব কারখানা 
ডুবলে পরে রতন পাবে ভাসলে পরে পাবে না।

আহ্ কী সুন্দর কথা,ডুবলে পরে রতন পাবে ভাসলে পরে পাবে না!
চোখে জল এসে গেল দেবেনের।সত্যি, তার ভাই কুমার সেই পথের পথিক। সে ডুবে রতন পাওয়ার চেষ্টায় আছে,অথচ তাকে একটু সাহায্য করতে পারছে না!

কী হে দেবেন ঠাকুর, কী হল? কী অত ভাবছ, গান তো শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ! 

না,ফকিরকাকা, তুমি এতো সুন্দর করে গাও,মনটা ভালো হয়ে যায়!

কেন গো খারাপ ছিল বুঝি! আরে এই দুনিয়া ভালো খারাপের মিশেল,সব থাকবে গো, সব,দুষ্টু, দয়াবান আবার উদাস, আলভোলা পথের ধূলা,শুধু মনকে জানতে দিও নি গো

তাহলে?

মনকে বলো,জগতে সবই সুন্দর, কালো এলে আলো করব,আর কান্না এলে পান্না দেখব, এই ভাবেতে বাঁচতে চাই...

কী যে বলো,মাঝেমধ্যে বুঝতেই পারি না! তা কোথায় ছিলে এতদিন? 

অনেক দূর গেছিলাম গো, গুরুকে দরশন করতে..

গুরু!

হ্যাগো,এই যে যার গান শুনালাম,লালন সাঁই! মোর গুরু, কী বলেন জানো সাঁই

কী বলে?

মানুষের মধ্যে পরম রতন আছে,শুধু খুঁজে দেখার চোখ চাই,আমি তো ঘুরে ঘুরে তাই দেখি গো

দেবেন হাসল,চোখ চাই,এখানে সব অন্ধ গো, এই পোড়া দেশে আর কী দেখতে পাবে?

না গো, এখানে একটি রতনের সন্ধান পেয়েছি, তোমাকে দেখাতে পারি,এসো গো...

বলেই ফকির দেবেনের হাত ধরে নিয়ে চলল। বেশ কয়েকটি মাঠ পেরিয়ে ছোট খালের ধারে একটি মাঠের কাছে এসে স্থির হল।সেখানে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে দেখাল।দৃশ্যটি দেবেনকে অবাক করে দিল।

মাঠের রোদ হালকা হয়ে আসছে... গরুগুলি চরে বেড়াচ্ছে... পর পর কয়েকটি ঘন পাতাবহুল বাবলা গাছ...তার মাঝখানে একটি স্থানে একটি বালক একমনে পড়ছে... খালি গা,উন্নত কপাল.. ধুলোই তার আসন..এতো কুমার!
নিজের ভাইটিকে দেখে দেবেন অবাক হয়ে গেল! সে জানতো, তার ভাইটি পড়তে ভালোবাসে,তা বলে এতো আগ্রহ, এতো নিষ্ঠা, এতো একাগ্রতা... 
অন্য ছেলেরা যখন গাছে চড়ছে,খেলাধুলা করছে,মারামারি করছে,গালিগালাজ নিয়ে ব্যস্ত, তখন তার ভাই নিজের ভেতরে ডুবে আছে!

কি গো, দেখলে তো মানুষরূপী রতন!এসে গেছে,গো, সে এসে গেছে, দিনবদলের গন্ধ পাচ্ছি যে...
বলেই ফকির চলে গেল আর ভেসে এলো,"ডুবলে রতন পাবে ভাসলে পরে পাবে না!"

ক্রমশ....

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments