জ্বলদর্চি

ভাষা দিবস: ২১-শে ফেব্রুয়ারী /গৌতম বাড়ই

ভাষা দিবস: ২১-শে ফেব্রুয়ারী

গৌতম বাড়ই 


খেতে দাও কিংবা না দাও, আমার মুখ থেকে মায়ের ভাষা কেড়ে নিও না। রাষ্ট্রকে হুঙ্কারে হুঙ্কারে সচকিত করলেন আপামর দেশবাসী। দেশটি ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা এখনকার বাংলাদেশ। বাংলা শব্দটি শুনতে পেলে আমাদের বুকের ভেতরটি কেমন জেগে উঠে না! খুব স্বাভাবিক আমাদের যে মাতৃভাষা বাংলা। "মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি! বাংলা ভাষা।" 

১৯৫২তে গর্জে উঠলেন আর ১৯৭২ সালের  মধ্যে, মাত্র কুড়ি বছরে ব্যবধানে শুধুমাত্র ভাষার জন্য আন্দোলনে এক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হল তার নাম --- বাংলাদেশ। 

কী ছিল সেদিন সেই ১৯৫২ সালের ২১-শে ফেব্রুয়ারি


“ পূর্ব পাকিস্তান তথা তামাম পাকিস্তানে সর্বস্তরে উর্দু ভাষা চালু হবে। এ স্থানে কেবলমাত্র একটি সাধারণ ভাষাই সরকারি ভাষা রূপে গৃহীত হবে। উর্দু হলো মুসলিম সংস্কৃতির ভাষা, কোনো দুশমন এর বিরোধিতা করতে পারবেনা।" ―তৎকালীন ওয়াজির-এ-আজ্ম এর এই হুঙ্কার এক মাস অতিক্রম করতে না করতেই ঢাকার পল্টন ময়দান থেকে উঠে এসেছিলো অসন্তোষে ভরা জনগণের বিক্ষুব্ধ পাল্টা গর্জন। দিনটা ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, খুব উল্লেখযোগ্য এবং বিশেষভাবে দেখবার মতন, শাসকের অভিসন্ধি সেদিন ছিল অন্যান্য ঘটনার মতন ধর্মকে ভাষার সাথে গুলিয়ে দিয়ে নিজেদের কায়েমী স্বার্থকে চরিতার্থ করা। ( খুব স্মরণীয় পাঠকগণ, আমাদের দেশেও রাষ্ট্রের শাসকদের ভাষা নিয়ে কিছু চাপান উতোর মাঝেমধ্যে থাকে।) তবে ধর্ম যে এখানে গৌণ সেদিন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ভাইবোনেরা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বুকের রক্ত দিয়ে শপথ করে মাতৃভাষা বাংলার জন্য, উর্দু নয়, বাংলা চাই। বাংলা আমার দেশের ভাষা, বাংলা আমার মায়ের মুখের ভাষা। যে ভাষায় প্রথম কথা বলে স্নেহচুম্বন এঁকেছেন 'মা'। 

তারপর একের পর এক প্রতিবাদের তরঙ্গে ভূলুন্ঠিত হয়েছিলো শাসকের সেই অহংকার, মানুষের মুখ থেকে তার ভাষা কেড়ে নেওয়ার দুঃসাহস মুখ থুবড়ে পড়েছিলো ওই ঢাকার রাজপথে। সেদিন দাবানলের মতো প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ে শহরের অলিতে গলিতে, আন্দোলনরত নিরীহ ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলি চালনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন রফিক , জব্বার, শফিউর সালাম, বরকত প্রভৃতি জনের এবং আরো অগুনতি তাজা, তরুণ প্রাণ। 

এমনও তো দেখতে পাই কখনও কখনও বিভিন্ন দেশের এখানে ওখানে। তবে মায়ের মুখের ভাষা যায়না কাড়া। সেখানে জড়িয়ে থাকে মায়ের রক্তস্রোত, যা সমস্ত জীবন- মরণের ওপরে। কেউ রোধ করতে পারেনি বা পারবে না। বহু ভাষাভাষীদের, বহু কৃষ্টি সংস্কৃতির এই ভারতবর্ষ। এখানে প্রতিটি আঞ্চলিক ভাষাই খুব সমৃদ্ধ, তবুও এখানে দেখি কখনও এমন করাল ছায়া। তাই একটু উল্লেখ করলাম ভাষা দিবসের প্রাক্কালে। 

"নাৎসিরা বলেছিলো জার্মান বলো, জার্মান বলো 

ইহুদিরা সব পর, 

কখনও  বলে কেউ  আজ "এক ভাষা এক দেশ 

হিন্দি সবসে উপর"


তারপর আন্তর্জাতিকতা পেল সেই ভাষা দিবস 

ইতিহাস সবসময় রক্তাক্ত হয়। পৃথিবীর যে কোন আন্দোলনের শেষ হয় অনেক রক্তপাতের পর। এ ইতিহাসের এক করুণ দৃষ্টান্ত। তাই রক্তাক্ত  চির স্মরণীয় এই দিনটি আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রপুঞ্জের স্বীকৃতি অর্জন করেছে 2010 সালে। প্রতিবছর 21শে ফেব্রুয়ারি সেই থেকে বিশ্বব্যাপী "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" রূপে পালন করা হয়। পূর্ববঙ্গের সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আজ সমগ্র বিশ্বে ঐতিহাসিক সম্মানে সমাদৃত এবং সারা পৃথিবীর বাঙালির কাছে গর্বের অন্যতম কারণ।আমাদের কাছে  21শে ফেব্রুয়ারি এক মহতী আবেগের দিন, সমগ্র বিশ্বের বাঙালির কাছে বাংলা ভাষার অবক্ষয় আটকানোর অঙ্গীকার গ্রহণের দিন।তবে দুঃখের হলেও এটা সত্যি এবং তা স্বীকার করে নেওয়াই ভালো, বিদ্যাসাগর আর রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান এপার বাংলার পুণ্যভূমিতে আমরা বাংলাভাষা আর সংস্কৃতির বিপন্নতায় যতটা না গণআন্দোলন প্রতিবাদ করেছি রক্ত ঝরিয়েছি,  ওপার বাংলা একটা দেশ গড়ে আর আসামের শিলচরেও বুকের রক্তে ভাসিয়ে দিয়ে প্রমাণ করেছে মাতৃভাষার অস্তিত্বের জন্য তারা কতটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা বইমেলা করি আর এই খোদ কলকাতা শহরের বুকেও বাংলার অবমাননাকে কেমন সুন্দর ভাবে মেনে নি। অবিলম্বে সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে পোস্টার হোর্ডিং ব্যানার সাইনবোর্ড কিমি ফলকে বাংলা বাধ্যতামূলক হোক অন্যভাষার সঙ্গে। এতে আঞ্চলিকতাবাদ নয় , আমাদের মাতৃভাষার বেঁচে থাকবার একটা তো দৃঢ় কাজ হোক তার আপন স্বীয়ভূমে।
আজকের ভাষা দিবসের সাথে এই আমার প্রার্থনা। 

আন্তর্জাল সূত্রে পাওয়া কিছু কবিতার লাইন আজকের এমন স্মরণীয় আর আবেগ মথিত  দিনে না উল্লেখ করে পারলাম না। পরিশেষে তাই নিবেদন রাখলাম। মাকে প্রণাম যে অন্তরে আর মুখে দিয়েছে এই ভাষা আর আমার মাতৃভাষার কাছে প্রণতি।


“আমরা বাংলা বলি, বাংলা বলাই আমার অধিকার,
মাতৃভাষা দিবসে এই হোক মোদের অঙ্গীকার।
বরকত, জব্বার,শফিউর ও রফিক
আবদুল সালাম ও আরো কত সৈনিক,
বুকের রক্ত ঢেলে, দিয়েছিলো যারা প্রাণ
রেখেছিলো সেদিন তারা মাতৃভাষার মান,
দিনটি একুশ ছিল, মাসটি ফেব্রুয়ারি
উনিশশো বাহান্ন সালটি কি কখনো ভুলতে পারি? 

তাই তো ―
একুশ এলে পথ ভরে যায়
হাজার লোকের ভিড়ে,
একুশ এলে..কবিতা গান
মিছিল চলে ধিরে,
একুশ এলে মায়ের বুক
চোখের জলে ভাসে,
একুশ এলে ভরসা আবার
হৃদয় জুড়ে আসে।
একুশ এলে বিভেদ ভুলে,
দুই বাংলা একাকার।
হাত ইশারায় ডাকতে থাকে
আবদুল, জব্বার।

রাষ্ট্রসংঘের স্বীকৃতি দিলো পরিচিতি চিরদিন,
বিশ্বজুড়ে একুশ মানে মাতৃভাষার দিন।" 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments