জ্বলদর্চি

আমার মনন, আমার ভাষা /সুগত ত্রিপাঠী

আমার মনন, আমার ভাষা

সুগত ত্রিপাঠী


ভাষা জিনিসটা কী ? এক কথায় বললে, ভাব প্রকাশের মাধ্যম। আকারে-ইঙ্গিতেও অবশ্য ভাব প্রকাশ করা যায়, তবে তা সুচারু হয় না। খানিকটা কাজ চলে, এইমাত্র। আর শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, নানা বিদ্যার গবেষণা— একান্তভাবেই ভাষা নির্ভর। অতএব জীবনে অগ্রগতির ক্ষেত্রে ভাষা অপরিহার্য। সুষ্ঠু জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও তাই।

  কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে এই— পৃথিবীতে সর্বজনবোধ্য বলে কোনও ভাষা তো নেই-ই, উপরন্তু সমগ্র পৃথিবী জুড়ে এত অসংখ্য ভাষা যে, ভাষা উদ্ভাবিত হলেও জটিলতা বেড়েছে বৈ কমেনি। এমনও স্থান আছে পৃথিবীতে, এক গ্রামের মানুষ পাশের গ্রামের মানুষের কথা বুঝতে পারে না। প্রতি পাঁচ-সাত কিলোমিটার অন্তর অন্তর ভাষা সম্পূর্ণরূপে পাল্টে যায়। আবার এমন বহু ভাষা প্রচলিত যার কোনও ব্যাকরণ নেই। কোনও লিখিত রূপ নেই। কেবল কথ্যভাষা হিসেবেই তা ব্যবহৃত হয়।

   পৃথিবীতে বহু ভাষায় পারদর্শী অনেক মানুষ জন্মেছেন, এখনও আছেন। কিন্তু সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন যে— যে ভাষায় আমার বুলি ফুটেছে, অর্থাৎ যা আমার মাতৃভাষা, সে ভাষায় আমি যতখানি স্বচ্ছন্দ, যতখানি দক্ষ— স্ব-চেষ্টায় যতগুলি ভাষাই শিক্ষা করি না কেন, কখনওই মাতৃভাষার সমতুল দক্ষতা কোনও ভাষাতে আসে না। অতএব শিক্ষায় মাতৃভাষার গুরুত্বটা অপরিহার্য। কেবল শিক্ষা-দীক্ষা, পড়াশোনার ক্ষেত্রে নয়, এমনিই প্রতিটি ভাষায় এমন কিছু শব্দ, এমন কিছু বিশেষ ভঙ্গিমা রয়েছে যা কথার সৌন্দর্য নির্মাণে অপরূপ, কিন্ত সেই ভাষাটি যাঁর মাতৃভাষা নয় তিনি শত চেষ্টা করেও সেই সৌন্দর্য মৌখিক বাক্যে, কলমে  আনয়ন করতে পারবেন না। এ কারণেই মাতৃভাষা ছেড়ে ভিন্ন ভাষায় সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে বহু লেখক তলিয়ে গিয়েছেন। ভারতীয়দের কথাই যদি ধরি, বেশ কিছু ভারতীয় লেখক রয়েছেন, যাঁদের মধ্যে বাঙালিও আছেন, তাঁরা ইংরেজিতে গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ লেখেন। কিন্তু সেগুলি একটু পড়লেই তার দুর্বলতা বোঝা যায়। ইংরেজি সাহিত্যের মহারথীদের কথা বলছি না ; যাঁরা ইংরেজি সাহিত্যে অপ্রধান লেখক, কোনও বিদেশী লেখকের রচনা তাঁদেরও রচনার সমতুল হতে পারেনি। অন্তত ভাষার দিক দিয়ে। এ কারণেই সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যাঁরা নিজের ভাষাটি ছেড়ে অন্য ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন, তাঁদের প্রায় কোনও রচনাই ক্লাসিক পর্যায়ে উঠতে পারেনি। মরিস মেটারলিঙ্ক-এর মতো দু-একজনকে ব্যতিক্রম হিসেবে ধরাই ভালো।

   আবার এর ভেতরেও কথা আছে। বহু লেখক আছেন যাঁরা ভাষায় অনাবশ্যক জটিলতার সৃষ্টি করেন। কোথা থেকে এই ধারণা এঁদের মনে চেপেছে, খটোমটো, অপ্রচলিত শব্দ, বাক্যগঠনের প্রচলিত পদ্ধতি না-মেনে তাকে অন্যরকম করা— স্টাইলের পরিচায়ক। আশ্চর্যের বিষয়, এই রকম দুর্বোধ্য বাক্য গঠন করে অন্তত একজন লেখক বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছেন। তবে ওই পর্যন্তই, বিখ্যাতই হয়েছেন। ক্লাসিক হতে পারেননি। একজন ইংরেজ আর একজন ক্রোট যখন কথা বলেন, কথায় যতই সাবলীলতা থাকুক না কেন, ধরা পড়ে যায় দু'জন সমভাষাভাষী মানুষ কথা বলছেন না। ঠিক যেভাবে দুজন বাঙালির কথা, আর একজন বাঙালি এবং অন্যজন উত্তরপ্রদেশীয়, হয়তো অর্ধশতাব্দীকাল পশ্চিমবঙ্গে আছেন, 'জলের মতো' বাংলা বলতে পারেন— তা সত্ত্বেও পার্থক্যটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।

    শিক্ষায়, দৈনন্দিন ব্যবহারে মাতৃভাষার এই অপরিসীম গুরুত্বের মধ্যেই নিহিত আছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উদ্দেশ্য, বিশিষ্টতা। ভেবে দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায় এই দিনটিতে যে-সব বাংলাদেশবাসী তরুণ শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের কথা ভেবে। আপন ভাষার প্রতি কী অপরিসীম ভালোবাসা ! কারণ তাঁরা এই সত্য বুঝেছিলেন, চাপিয়ে-দেওয়া ভাষা নিয়ে খুব বেশি দূর এগোনো যায় না। বড়জোর কাজ চলতে পারে। কিন্তু যেনতেনপ্রকারেণ কাজটুকু হয়ে গেলেই সব ধরনের মানুষ সন্তুষ্ট হন না। তা শিক্ষিত, সুসভ্য মানুষের চিন্তাভাবনার অনুসারীও নয়। তাঁরা চান কাজটিকে যথাসম্ভব শোভনসুন্দর, নিখুঁত করে তুলতে। আর এ কাজে মাতৃভাষার কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই, বর্তমানে বিশ্বের বহু রাষ্ট্রই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাকে প্রধানতম ভাষা কিংবা দেশের একমাত্র ভাষা হিসেবে সংখ্যালঘিষ্ঠ নাগরিকের ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার কুপ্রচেষ্টায় রত। বেশ আশ্চর্য লাগে ব্যাপারটা ভাবলে। যেন, যেহেতু দেশের অধিকাংশ মানুষ উক্ত ভাষাটিতে কথা বলে, তাই বাকিদেরও ওই দলে নাম লেখাতে হবে ! সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনও ভাষার সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি হয়তো অনেক উন্নত— তা সত্ত্বেও তাঁদের তুলনায় একটি অনুন্নত ভাষা শিখতে হবে!

   লেখার ভাষা সম্পর্কে দু-চার কথা বলতে চাই। কথাগুলি সবই মনীষীদের। স্বামীজী বলছেন— কথা বলার সময় তো ঠিকঠাক ভাষাই ব্যবহার করো, তাহলে লেখার সময় ওরকম একটা কিম্ভূতকিমাকার দাঁড় করাও কেন ? কী প্রাগ্রসর ছিল তাঁর চিন্তা ! শুধু বলেই ক্ষান্ত হননি। স্বামীজীর লেখা পড়লেই বোঝা যায় কত সহজ-সরল, অথচ কী উদ্দীপনাময় ! অর্থাৎ লেখার ভাষাটি যখন মুখের কথার অনুসারী হবে, তা হবে অনেক অকৃত্রিম, অনেক আপন। মা তো আমাদের অতি আপনজন, কাজেই মাতৃভাষাকে হতে হবে আপন-ভাষা। দুর্বোধ্যতার বেড়াজাল যেন তাতে না থাকে। বঙ্কিমচন্দ্রও বলেছেন, তুমি যা লিখবে পড়ামাত্রই লোকে যেন তা বুঝতে পারে। আর রবীন্দ্রনাথ তো বলেইছেন, সবারই জানা সে কথা— শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সদৃশ।

   স্বনামধন্য শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী দিল্লিতে কার্যোপলক্ষে দীর্ঘকাল বাস করেছিলেন। কিন্তু সেখানে ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় (যেহেতু ওখানে বাংলা বলা অসঙ্গত, তাই 'সেকেন্ড অপশন' হিসেবে নিজের পছন্দের একটি ভাষা বেছেছিলেন) কোনওদিন কথা বলেননি। ইংল্যান্ডে তাঁকে এক ইংরেজ মহিলা 'নমস্তে' বলায় বেজায় বিরক্ত হয়েছিলেন। সংশোধন করে দিয়েছিলেন।

  যেহেতু আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসটি (দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও বলা হয়, পালন করা হয় প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি, দিনটি জাতিসংঘ দ্বারা স্বীকৃত) বাংলা ভাষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে, তাই বাংলা ভাষা নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন আছে বোধ করি। যে গৌরব বোধ করতেন এক সময় বাঙালিরা তাঁদের ভাষাটি নিয়ে, এখন তাঁদেরই পরবর্তী প্রজন্ম বাংলা ভাষা ভুলে যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। বাংলায় কথা বলাটা 'আনস্মার্ট'-এর লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে 'জেন Y' -এর কাছে। এরা নিজেদের মধ্যে এমন একটা ভাষায় কথা বলে, যাকে পচা লাবড়া ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। না-পারে নির্ভুল ইংরেজি বলতে, না-পারে অন্য কোনও ভারতীয় ভাষা কিংবা বিদেশী কোনও ভাষার শুদ্ধরূপ ব্যবহার করতে। হয়তো বাংলা জলবৎ বলতে পারে, কিন্তু ইচ্ছে করে সে-ভাবে বলবে না, কিছু হিন্দি, কিছু ইংরেজি মিশিয়ে ঠোক্কর-খাওয়া বাংলায় কথা বলে পরম আত্মতৃপ্তি অনুভব করে। ভাবটা এই— "ওই বেঙ্গলিটা না আমার ঠিক আসে না।" অনেক ক্ষেত্রে 'আধুনিক' বাপ-মায়ের 'সস্নেহ' প্রশ্রয় থাকে এতে। কী উন্নত, কী মিষ্টত্বপূর্ণ এই বাংলা ভাষা— কল্পনাই করা যায় না। যাকে সুললিত ভাষা বলা হয়, বাংলা হচ্ছে তাই। বিভূতিভূষণের লেখা পড়লে মনে হয় না কি, কী অপরূপ কাব্যময়তা লুকিয়ে আছে এই ভাষার অন্দরে। শুদ্ধ বাংলা বলতে আজকাল খুব কম মানুষকেই শোনা যায়। যদি বা গ্রামের দিকে কিছু ভালো বাংলা শুনতে পাওয়া যায়, কিন্তু অধিকাংশ তথাকথিত শহুরে মানুষ জগাখিচুড়ি বাংলা বলতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। কলকাতার রাস্তায়-ঘাটে অন্য ভাষার দাপট দেখলে চমকে ভাবতে হয়, এ কি পশ্চিমবঙ্গের কোনও শহর, নাকি ভারতবর্ষের উত্তরাংশের কোনও প্রদেশে এসে পৌঁছেছি ? এমন কণ্ঠস্বর অধিকাংশ বাঙালির নেই যে, বলে—  "কথা বাংলায় বলুন। আপনাদের রাজ্যে গেলে তো আমরা কষ্ট করেও আপনাদের ভাষাটা বলার চেষ্টা করি।" সমগ্র পৃথিবীতে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা তিরিশ কোটিরও বেশি। বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষাগুলির মধ্যে বাংলার স্থান ষষ্ঠ। অতএব বোঝাই যাচ্ছে কতখানি গুরুত্ব রয়েছে এ ভাষার। শিল্প-সাহিত্যে এ ভাষা পৃথিবীর যে কোনও প্রধান ভাষার সাহিত্যের সৎ প্রতিদ্বন্দ্বী। শুধু কিছু নির্বোধ মানুষের হাতে পড়ে অমূল্য এ রত্নের বিকৃতি ঘটে যাচ্ছে। এটা বড় দুঃখের। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি দূরদর্শনে ক'টা বাংলা অনুষ্ঠান দেখে হাতে গুণে বলা যায়। বাংলা সিনেমা তো এক বৃহৎ অংশের কাছে প্রায় ব্রাত্য। অথচ এরাই অতি অখাদ্য ভিন্-ভাষী  সিনেমা দেখার জন্য লাইন দেয়। অতএব বাংলা ছবির অবনমনের ফলে যে তাদের এই প্রবাসযাত্রা, সে কথা ঠিক নয়। বাংলার প্রতি অনীহা থেকেই এই মনোবৃত্তি। অপরদিকে, যে দেশ ভাষা-শহীদের পীঠস্থান, সেই বাংলাদেশ অন্য অন্য ভাষার সঙ্গে বাংলাকেও আঁকড়ে ধরে আছে। আক্ষরিক অর্থেই এই ভাষার প্রতি তাঁদের মাতৃস্নেহ রয়েছে। সমগ্র দেশে বাংলায় অজস্র দোকান-বাজারের সাইনবোর্ড, ব্যাঙ্কের নাম, স্বদেশে উৎপাদিত অসংখ্য বস্তুতে-ভোগ্যপণ্যে বাংলায় লেখা নাম চোখে পড়ে। এয়ারলাইন্সের নাম পর্যন্ত বাংলায় লেখা। এরই পাশাপাশি বহু দেশ এখনও ইংরেজির দাসত্ব করে চলেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে বলেছিলেন, বাংলার মূল কেন্দ্র পরবর্তীকালে ঢাকা (বাংলাদেশের রাজধানী) হবে— তা বোধহয় খুব বেঠিক নয়। কিন্তু এই অবস্থা থেকে বাঙালিকে, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গবাসী বাঙালিকে বেরোতেই হবে। বাঙালি অন্য কোনও ভাষার নিন্দে করবে না, সবাইকেই সে আপন করবে, তবে সেই সঙ্গে নিজের ভাষার মর্যাদার প্রতিও একনিষ্ঠ থাকবে। নচেৎ ভাষা দিবস আসবে-যাবে, কিন্তু এক বৃহত্তর মানুষের কাছে বাংলা ভাষা জনমদুখিনী হয়ে থেকে যাবে। ভাষার অবমাননার চেয়ে তা অধিকতর জাতির অবমাননা।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇




Post a Comment

0 Comments