জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৬ /রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৬

বাবা মা খেমাশুলি গ্রামে থাকা কালে আমাদের এক দাদার জন্ম হয়, কিন্তু ৬মাস বয়সে মারা যায়। এইসময় এক জ্যোতিষী মাকে বলেছিলেন, আরও বড় বিপদ আসছে। মা এসব লোকের কথা খুব যে বিশ্বাস করতেন, তা কিন্তু নয়। তবে সন্তান হারিয়ে মনের দিক থেকে খুব দুর্বল হয়ে পড়ে ছিলেন। ভয়ে বাবাকে কোথাও বেরতে দিতে চাইতেন না। তবে কাকতালীয়ভাবে অঘটন ঘটেছিল।  ঠাকুরদা তখন চিল্কিগড় থানার দারোগা। ওখানকার রাজপরিবারের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ছোটপিসিকে শ্বশুরবাড়ি থেকে নিতে রাজবাড়ির গাড়ি যেত। সময়টা ১৯৪০/৪১ সাল হবে। মেজকাকা চাকরির চেষ্টা করছেন। সেজকাকা সবে স্কুল পাশ  করেছেন। কলেজে ভর্তির জন্য টাকা লাগবে। টাকাপয়সা ঠাকুমার কাছে থাকত, তিনি কিছুতেই টাকা দিতে রাজি হলেন না। বললেন, ওকে টাকা দিলে আমার নিজের ছেলেমেয়েদের কী হবে? ঠাকুরদা অনেক বোঝানোর পর টাকা দিতে রাজি হলেন। ঠাকুরদা তখন সেজকাকার হাতের ওপর ঠাকুমার হাত রেখে বললেন, আজ থেকে তোর মা আর ছোট ভাইবোনেদের ভবিষ্যতের ভার তোর হাতে দিলাম(সেজকাকা আজীবন সে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।পরবর্তী কালে তাঁর একমাত্র ছেলে সে দায়িত্ব পালন করে চলেছে)। এর কিছুদিন পর চাকরিরত  অবস্থায় ঠাকুরদার অকালমৃত্যু ঘটে। ঘাড়ে একটা ফোঁড়া হয়েছিল। নাপিতের কাছে চুল কাটার সময় ক্ষুর লেগে বিষিয়ে গিয়ে এই অঘটন  ঘটে। তখনও ঠাকুরদার মা বেঁচে ছিলেন। তিনি চোখে দেখতে পেতেন না। গ্রামের বাড়িতে সেজছেলের কাছে থাকতেন। তাঁকে কিছু জানতে দেওয়া হয়নি। মেদিনীপুরে ঠাকুরদাকে দাফন করা হয়। ঠাকুমাকেও এখানে দাফন করা হয়েছিল। তবে ভিন্ন কবরস্থানে।

      এরপরেই সংসারে সর্বনাশের ঘণ্টা বেজে ওঠে। ঠাকুমা টাকাপয়সা কিছুই রাখতে পারেননি। মেদিনীপুরের বাড়িটি ওনারই দখলে। সেজ ও ছোটকাকা অকূল পাথারে পড়লেন, কি করে পড়াশোনার খরচ যোগাবেন? বাবা বা মেজকাকা কারও  পক্ষেই দুইভায়ের খরচ বহন করা সম্ভব ছিলনা। দুইকাকাই খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলান। সেজকাকা প্রেসিডেন্সি কলেজে বি এ পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু কাকার এক বন্ধু ভয় দেখিয়ে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হলে ব্রিটিশদের লাথি খেতে হবে। তাই সেজকাকা স্কটিসচার্চ কলেজে বি এ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন।তার পরেই বিনামেঘে বজ্রপাতার মত ঠাকুরদার অকালমৃত্যু ভবিষ্যতের সব স্বপ্নকে ভেঙ্গে  দিয়ে মস্তবড় একটা প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, এরপর কী হবে?                                            সেইসময় এই জেলারই কৃষ্ণপুর গ্রামের সিরাজুদ্দিন সরকার একজন রাজনীতিবিদ ও  সমাজসেবী হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। হোসেন শহিদ সোহরাবরদির সঙ্গে তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি গান্ধীজীর লবন সত্যাগ্রহ আন্দলনে যোগ দিয়ে ছিলেন। মুসলিম লীগ থেকে একবার মেদিনীপুরের বিধায়কও হয়েছিলেন। কলকাতার নারকেলডাঙ্গায় ওনার একটি ছাগলের আড়ত ছিল। এখানে থেকে ওনার আর্থিক  সাহায্যে অনেকেই উচ্চশিক্ষা লাভ করে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে ছিলেন। তিনি  আমার দুই  কাকার দায়িত্ব নেন এবং পরবর্তী কালে তাঁর বড়মেয়ে আনুয়ারা সরকারের সঙ্গে সেজকাকার আর ছোট মেয়ে সামেদা সরকারের সঙ্গে ছোটকাকার বিয়ে দিয়ে জামাই করেন। সেজকাকার মেদিনীপুরে দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, বিজয়কুমার সাহা(সাহা অলঙ্কার ভবনের মালিক) ও সিপাই বাজারের পটল রায়। 
      ঠাকুরদার মৃত্যুর আগেই দুই পিসির বিয়ে হয়ে গেছল। বড়পিসির শ্বশুরবাড়ি বোম্বেরোডের ধারে রূপনারায়ণপুর গ্রামে। ছোটপিসির বিয়ে হয়েছিল কৃষ্ণপুরে সিরাজুদ্দিন সরকারেরই ভাইপো আনোয়ার সরকারের সঙ্গে। দুটিই বনেদি  পরিবার ছিল। বড়পিসির চারছেলে তিনমেয়ে। ছোটপিসির পাঁচছেলে চারমেয়ে। ক্ষেমাশুলিতে থাকাকালে বড়দি জাহানারা, মেজদি মনোআরার জন্ম হয়। মাহাতোরা ওদের ভাষায় বড়দিকে বড়বুড়ি, মেজদিকে চুনুবুড়ি বলত। ‘চুনু’ মানে ছোট। পরে  বড়দির ডাকনাম বুড়ি আর মেজদির চুনু হয়ে যায়। এখানে বাবা ভালোই ছিলেন নিজের আয়ে দিব্যি সংসার চলে যেত। শান্তিতেই ছিলেন। এই শান্তি বেশিদিন স্থায়ী হলনা। দুর্ভাগ্য বাবাকে সারাজীবন তাড়া করে ফিরেছে। স্বাধীনতার  পরবর্তীকালের দাঙ্গার সময় রাতের অন্ধকারে কারা যেন ঘরে আগুন দিয়ে দেয়। সর্বস্ব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কোনও রকমে প্রাণে বেঁচে বাবা সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। 
      ঠাকুরদার জীবদ্দশায় তাঁর ভাইয়েরা চাষের সমস্ত জমিই শেষ করে দিয়ে  ছিলেন। জমি বন্ধক দিয়ে নির্দিষ্ট দিনে টাকা দিতে না পারায় একদিনেই প্রায় সমস্ত  জমি হাতছাড়া হয়ে যায়। ঠাকুরদার ভাগের বাড়িটিও ঝড়ে পড়ে গেছল। মস্তবড়  মাটির বারান্দাআলা দোতলা বাড়ি ছিল। বাবা জ্ঞাতিদের থেকে অনেকটা জায়গাসহ একটি মাটির বাড়ি কিনে বসবাস শুরু করেন। ভাঙ্গা বাড়ির টিন, কাঠ, দরজা, জানালা দিয়ে আর একটি বাড়ি বানিয়ে নেন। বাবার কাকা, পিসিরা বাবাকে খুব ভালো বাসতেন ।‘তুমি’ করে সম্বোধন করতেন।  একবার সেজ ঠাকুরদা গ্রামের বাড়ি থেকে চালগুঁড়ির রুটি আর হাঁসের মাংস নিয়ে গেছলেন। ঠাকুরদের বাড়িতে তখন বাবার এক পিসি থাকতেন, তিনি বাবাকে আগে ওই মাংস রুটি খেতে দিয়েছিলেন বলে ঠাকুমা খুব অশান্তি করেছিলেন। তা দেখে সেজঠাকুরদা বাবাকে বলেছিলেন, আমার সঙ্গে চল, তোমাকে খাসি জবাই করে রুটি খাওয়াব।  সেজঠাকুরদা বাবাকে নদীরপাড়ে কয়েকবিঘা কৃষিজমি কেনার ব্যবস্থা করে দেন। এই এলাকার জমি খুবই উর্বরা। তিনটে করে ফসল হয়। বাবার চাষবাসের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল না। শীতকালে ভাগ চাষিদের দিয়ে সরষে, গম, ছোলা চাষ করাতেন। আলু অনেক বেশি লাভজনক বলে চাষিরাই বাবাকে আলু চাষের জন্য বলেন। তখন আলুর জমির ধারে ধারে যব, কুসুম ইত্যাদির বীজ বোনা হত ছাতুর জন্য। যব, গম, ছোলা ভেজে ঢেঁকিতে কুটে বাড়িতেই ছাতু বানানো হত। তখন সবার বাড়িতে নয়, পাড়ায় ২/৩ জনের বাড়িতে ঢেঁকি থাকত। এখন আর ঢেঁকি খুব একটা দেখা যায় না। এই অঞ্চলে ফাল্গুন, চৈত্র মাসে জামাইকে ডেকে ছাতুমুড়ি খাইয়ে ধূতি-গামছা দিয়ে বিদায় করা আঞ্চলিক রীতি ছিল, এখন আছে  কিনা জানা নেই। দুর্ভাগ্য কিন্তু বাবার সঙ্গ ছা্ড়ল না। গ্রামে আসার পর বড়দা শামসুর রহমান খানের জন্ম হয় সম্ভবত ১৯৫১ সালে। বড়দার জন্মের পরেই মা মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মা যখন মারা গেলেন বড়দার বয়স বছর ২/৩ হবে। বাবাও দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধ্য হলেন। আমরা পাঁচ ভাইবোন দ্বিতীয় মায়ের সন্তান।
    আমাদের মামাবাড়িও মেদিনীপুরে। দাদু শেখ খলিলুদ্দিন জীবনের বেশ  কিছুটা সময় মুম্বাই এ কাটিয়ে ছিলেন। স্থায়ীভাবে থাকা মনস্থ করে ওখানেই বিয়ে করে সংসারও পেতে ছিলেন। কিন্তু কেন জানিনা স্ত্রীকে ওখানে রেখে গ্রামে এসে  আর ফিরে যাননি। এখানে আমার দিদিমাকে বিয়ে করে নতুন সংসার পাতেন।  মায়েরা চারবোন দুইভাই। মা পঞ্চম, তার পর ছোটমাসি। গ্রাম থেকে দাদু সপরিবারে মেদিনীপুর শহরে চলে আসেন। সম্ভবত ছোট মাসির জন্ম মেদিনীপুরেই। মাসি তখন খুবই ছোট, তিনদিনের জ্বরে দিদিমা মাকরুমা বিবি মারা গেলেন।  ভাইবোনেদের মধ্যে বড়মাসি সবার বড়। ১৩ বছর বয়সে পিড়াকাটার গোমস্তাদের বাড়িতে মাসির বিয়ে হয়। সেই কালে গোমস্তাদের আর্থিক অবস্থা খুব ভাল ছিল।নামডাকও ছিল। কিন্তু মাসির কপালে এ সুখ সয়নি। মাত্র ১৬ বছর বয়সে  বড়মাসি বিধবা হয়ে বাবার সংসারে ফিরে আসেন। মাসির শ্বশুরবাড়ির রীতি রেওয়াজ কিছুটা হিন্দুদের মত ছিল। মেসোর পারলৌকিক কাজের দিন দাদু তাঁর সদ্য বিধবা যুবতী মেয়ের জন্য ইঞ্চিপাড়ের একটি সাদাশাড়ি কিনে নিয়ে গেলে মাসির শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বলেন, এই শাড়ি চলবে না। আজ আপনার মেয়েকে সাদাথান পরতে হবে। দাদু চোখ মুছতে মুছতে সেই শাড়ি ফেরৎ দিয়ে সাদাথান কিনে আনেন। ওঁরা মাসিকে রাখতে চেয়েছিলেন, দাদু তাঁর যুবতি মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে রাখতে ভরসা পাননি, যদি কেউ মেয়ের নামে কোনো কলঙ্ক রটিয়ে দেয়? এই ভয়ে। দাদুর বাড়িতে মাসির  খুব প্রয়োজনও ছিল। মা মরা ছোট ভাইবোনদের কে আগলে রাখবে?
    বড়মাসি প্রথমে ভাই-বোনেদের, পরে তাঁদের ছেলে-মেয়েদের মায়ের মমতা দিয়ে বড় করেছিলেন। তবুও মাসির শেষ জীবনটা খুব কষ্টে কেটেছিল। এরজন্য দাদু অনেকাংশে দায়ি ছিলেন। বড়মাসিকে শ্বশুর বাড়িথেকে সোনার ভারি ভারি গহনা দিয়েছিল। মাসি সেগুলো সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। দাদু সেই গহনা বিক্রি করে বাড়ির পাশে মাসির নামে না কিনে ছোটছেলে সিরাজুদ্দিনের নামে কাঠা চারেক          জমি কিনেছিলেন। ছোটমামা পরে সেই জমিতে বাড়ি করেছিলেন এবং বড়মাসিকে নিজের কাছে রেখেছিলেন। মেজমাসির দায়িত্ব বর্তে ছিল বড়মামা নাসিরুদ্দিনের ওপর। কথায় আছে, ‘অতি সুন্দরী না পায় বর/ অতি ঘরণী না পায় ঘর’। দুই  মাসির ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছিল। মেজমাসিরও স্বামীর ঘর করা হয়নি। অথচ দুজনেই দেখতে সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, রান্না ও অন্যান্য কাজে পারদর্শী ছিলেন। বড়মাসির হাতের রান্না ছিল অপূর্ব। বিরিয়ানি, পোলাও, কালিয়া, কোরমা সবই রান্না করতে পারতেন। বড়মাসির কাছে মায়ের রান্না শেখা, আমার শেখা মায়ের কাছে। মেজমাসি খুব বুদ্ধিমতী ছিলেন। বৈষয়িক ও সাংসারিক বুদ্ধি ছিল প্রখর, কিন্তু তা  কাজে লাগানোর সুযোগ পাননি।
                                            (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments