জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-১১ /সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-১১

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

হিমছোঁয়া রোদ্দুর

এইবার সাহেব কোয়ার্টার থেকে আমরা এলাম পাকাপাকিভাবে জামালপুরের-ই মুঙ্গের রোডের ভাড়া বাড়িতে। কারণ একটাই- বাবা আবার লক্ষ্ণৌ-এ ট্রান্সফার হয়ে গেলেন। আমার তখন বয়স চার। বিহারী লক্ষণ সিং ছিলেন বাড়িওয়ালা। ওনার কাঠের গুদাম ছিল। ঠিক একটা ছোট পাড়ার মতন...বেশ কিছু ভাড়াটে থাকত সেখানে। বড় রাস্তা দিয়ে ঢুকে সরু রাস্তা পড়ত। একদিকে ছিল বিহারীদের মেয়েদের স্কুল। তারপর ছিল ওনাদের বাড়ি। লক্ষণ সিং এর ছিল তিন মেয়ে আর দুই ছেলে। মেজ মেয়ে মঞ্জরী ছিল আমার বয়সী। আর ছোট মেয়ে মিনা আমার চেয়ে দুই বছরের ছোট আমার ছোট ভাই-এর বয়সী ছিল। বড় মেয়ে মিলতি ছিল আমার এক দাদার বয়সী।

--জানো নিশ্চয়-ই! আগে ডাকাতেরা ডাকাতি করতে আসলে চিঠি পাঠাত। আর সেই চিঠি পড়ে সবাইকে সাবধান থাকতে বলতেন বাড়ীওয়ালা। উনি বলে দিয়েছিলেন- “বাড়িতে রাখা গয়না, টাকা যেন ঘুলঘুলিতে রাখা হয়।”

মঞ্জরীদের গুদামে একবার ডাকাতেরা ডাকাতি করতে আসবে বলে চিঠি দিয়েছিল। আমরা খুব ভয় পেয়েছিলাম। কারণ, সেই গুদাম তো আমাদের ভাড়া বাড়ির বাগানের পাশেই থাকত। মঞ্জরীর বাবা তাই খুব কঠোর পাহারা বসিয়েছিলেন। তবে শেষমেশ নাকি আর আসে নি।

আমাদের এক পাশে থাকত গুহ পরিবার। ওনাদের মেয়েরা শেলু আর বেবু ছিলাম ঠিক বোনের মতন। বাথরুমে একটাই কুঁয়ো ছিল মাঝখানে দেওয়াল দিয়ে ভাগ করা থাকত। ওরা ওদের দিক থেকে জল তুলত  আর আমরা আমাদের দিক থেকে। এখন এইসব ভাবলে কি ভালো লাগে। যেন আমরা এক পরিবারের সবাই ছিলাম। ওরা যে আলাদা ফ্যামিলি বুঝতাম না তখন। মাঝখানে ছিল মাঠ মত।

মা-এর আবদার শুনে দিদিয়া ঠিক করল আমাকে বাড়িতেই পড়াশুনা করাবে, কারণ দিদিয়ার বান্ধবীরা তখন প্রাইমারি স্কুল( এম ই স্কুল) এর টিচার। কাজেই সব ক্লাসের প্রশ্নপত্র দিদিয়ার হাতে আসত... তা থেকে আমাকে পরীক্ষা নিত। এইভাবে আমি একে একে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়লাম বাড়িতেই। তারপর দিদিয়া স্কুলে ভর্তি করে দিল। একটা কথা না বলে পারছি না ।

--বলো না, শুনি। পলাশ শিমুলের দিকে মুখ নিয়ে গিয়ে দেখে শিমুলের মুখে মিটি মিটি হাসি। আমি তো শুনছি কান খাড়া করে।

--আমি যখন চতুর্থ শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা দেব, একটা রান্নার ক্লাস হয়েছিল। এক একটা গ্রুপে চার জন করে মেয়ে থাকবে। আমাদের গ্রুপের রান্না ছিল আলু পেঁয়াজ ভাজা, ভাত, মুসুর ডাল, আর চা। টিচাররা দেখে দেখে মেয়ে বিশেষে রান্না দিয়েছিলেন । ওনারা দেখতেন না আমরা করছি... না, বাড়ি থেকে আসছে। যাই হোক, ছোদ্দি এসে মুসুর ডাল দিয়ে গেল আমার হাতে। আর তিনজনের বাড়ি থেকে ভাত, আলু পেঁয়াজ ভাজা আর চা দিয়ে গেল। এইবার মৌখিক এ জিজ্ঞেস করলেন হাসিদি(আমাদের পাড়ায়-ই থাকতেন) দিদিয়ার খুব ভালো বন্ধু, “ শিমুল, ভাত কি ভাবে করে?” একটু জিভ কেটে বললাম, “জল, ভাত, তেল, নুন, হলুদ, লঙ্কা দিয়ে উনুনে বসিয়ে দিলেই ভাত হয়ে যায়।” দারুণ ব্যাপার তাই না? মুখ টিপে একটু হেসে নিল শিমুল। তখন কথায় কথায় দাঁত দিয়ে জিভ কাটতাম।

বাড়িতে এসে হাসি দিদিমণি দিদিয়াকে বললেন, “ও রেখা, শিমুলের ভাত রান্না খেয়ে আজ আমরা খুব খুশি, খুব তৃপ্তি হয়েছি।” আমি তখন বাইরে খেলছিলাম, “ ও বুড়ি তোর জলকে নেমেছি...ই”। বাড়ির মধ্যে হাসির শব্দ বাইরে ভেসে আসলে, ছুটে ঘরে গেছি বন্ধুরা সব। হাসি দিদিমণি আমাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে একটা চকলেট দিয়েছিলেন।

হাসি লাগে জানো নিজের আবার একটা পুতুলের সংসার ছিল। কি না ছিল সেই সংসারে। নিজের বয়সী সবাই যখন স্কুলে আমি তখন আমার পুতুলের সংসার সামালতেই ব্যস্ত ঠিক আজকের দিনের মতই।

--কিন্তু এখন তো তুমি বেশ রাঁধো। শিমুলকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলে উঠল পলাশ। তোমায় আমি পাবো কোনদিন আশা করি নি। বিশ্বাস করো। আমি যে মেয়েটিকে ভালবাসতাম তার নাম ছিল সুমি মুখার্জ্জী। কিন্তু তখন তো নিজের পা-এ দাঁড়াইনি, কাজেই তার বাবা বিয়ে দেবেন কেন ? তাই না ? তবে তোমার মধ্যে ওকে পেয়েছি। বিশ্বাস করো আর নাই করো। তোমরা বোধহয় যমজ ছিলে কোন এক সময়। তাই তোমায় দেখার পরেই আমার সেজমামা বলেছিলেন, “মিন্টু, তোর সুমি হারায় নি, এইবার শিমুল নামে তোর কাছে ধরা দিল। মা-ও তোমার ছবি দেখে তাই বলেছিলেন...”

পলাশ একবার দুচোখ ভরে শিমুলকে দেখেই ওর একটা হাত নিজের দু'হাতের মধ্যে ধরে বলল, রবীন্দ্রনাথের কথায় কি বলব জানো?

--কি বলবে?শিমুল অবাক হয়ে প্রশ্ন করে বসল।

পলাশ তার উদাত্ত কন্ঠে বলে উঠলঃ

'দুঃখের বরষায়

চক্ষের জল যেই নামল

বক্ষের দরজায়

বন্ধুর রথ সেই থামল।'

--অ্যাই ! অ্যাই!থাক হয়েছে। ছাড়ো! সত্যি বাব্বাঃ!

আমি তো রান্না শিখেছিলাম। কলকাতার ওয়াই এম সি এ (Y.M.C.A) -তে। আমার তো লুইজিয়ানা থেকে একটা রান্নার বই, “স্যাফ্রন টু সাসাফ্রাস” প্রকাশ পেয়েছিল। তবে এই বইটা LSU-এর যে ছাত্র/ছাত্রী-রা অসুখ করলে পয়সা দিতে পারত না তাদের জন্য একটা ফান্ড করেছিলেন মহিলা রিটায়ার্ড ইঞ্জিনীয়ার, ডাক্তার এনারা মিলে। আর সবার লেখার সাথে আমার চারটে লেখাও ছিল। এটা ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড -ও পেয়েছিল। পরে বলব, আরও অনেক গল্প আছে। আমার গল্পের শেষ নেই।

--তাই তো বলি লেখো। আমি শুধু কেন, সবাই জানুক কত ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে আজ একটা মেয়ে এখানে। সত্যি ইচ্ছে থাকলে সব হয়... তোমাকে দেখে তাই মনে হয়।

--এটা ঠিক গল্প নয়। শুধু কয়েকটা সত্য ঘটনার কথা তুলে ধরেছি। যে ঘটনাগুলো মনের ডায়েরির পাতায় লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি্লাম মাত্র। কিছু এলেবেলে আছে অবশ্য। দুজন যাদবপুরের বান্ধবীর খুব ইচ্ছে ছিল আমার জীবনী তারা লিখবে। কিন্তু সেটা মনে হয় সম্ভব হতো না কারণ সব বলে বলে লেখা যায় কিনা জানি না।

--তার মানে তুমি বলতে চাইছো কখনও কখনও ফ্যাক্টস আর মোর ইন্টারেস্টিং দ্যান ফিকশন, তাই তো?

--ইন্টারেস্টিং কিনা জানি না, তবে বিশ্বাস করি ভ্রমণ কাহিনীর মত জীবন কাহিনী পড়ার আকর্ষণও কম না। এক একজনের এক এক রকম জীবন কাহিনী।

খারাপ সময়টা কাটিয়ে আমি ঠিক ফিরে আসবই, এই ছিল আমার জীবনের আদর্শ। এ যেন মুখোমুখি দুই জীবন। যেন মুখোমুখি দুই সময়। অস্পষ্ট কিছু মিলিয়ে যাছিল ক্রমশ। ফুটে উঠল এক অসীম ক্যানভাস। তুলির টান পড়ছে ক্যানভাসে। ভারমিলিয়ান রেড, গ্যাম্পজ, ইয়েলো, ক্যাডমিয়াম, অরেঞ্জ, ক্রিমশন, স্কারলেট, পার্পল, মভ, আলট্রামেরিন ইন্ডিগো...বর্ণময় ক্যানভাসে সূর্যাস্ত হচ্ছে আবার। পলাশ সব কিছু শুনছে মনোযোগ নিয়ে। না মিলিয়ে নিচ্ছে নিজের জীবনের খুঁটিনাটি।

হ্যাঁ! অ্যাবস্ট্রাক্টস আর্টিস্ট হবার সাধ ছিল বহুদিনের। বড্ড ইচ্ছে হয় সব ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলি আমার ইচ্ছেদের, আমার না-বলা কথাদের। সাজিয়ে দি আমার স্বপ্নদের। কি বলো মশাই? ইজ ইট ওকে?

আপন মনে দুদিকে মাথা নাড়ল পলাশ।

--না না কোথায় একটা অকোয়ার্ড সিচুয়েশনে নিজেকে ফেলতে চাইছো শিমুল। বেশ তো রেস্পেক্টিভ জব করো। লেখালিখি করছো। ইউ আর আর্টিস্টিক। বাড়ির রিমডলিং এর সময় লাইট ফিক্সচারের লোকটা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “ইজ ইয়োর ওয়াইফ অ্যান ইন্টিরিওর ডেকোরেটর, ইয়েস স্যার?” বোঝো, “আমেরিকানরাও বলছে।”

--আহা! কি মানুষ! ভাবমূর্তি নির্মাণের কি অসীম ক্ষমতা। মানুষের স্বপ্ন দেখতে কোথাও বাধা আছে নাকি? জব আর ড্রিম পাশাপাশি চলতে পারে না বুঝি? শিমুল এবার আর থাকতে না পেরে বলে উঠল। এ যেন অজানা পাতায় আহত দুই চোখ। ভালো মন্দের হিমছোঁয়া রোদ্দুর। কি নিপুণ বাক্যজাল বিছিয়ে অর্ধসত্যের আবরণে নিজেদের আড়াল করে ফেলল দুজনেই। নবীন পাতার মতন একটি শব্দ শুধু 'স্বপ্ন'...? না ক্যানভাস?

আমরা সাত সমুদ্রে বিশ্বাস করি-এক দুধের সাগর, এক মধুর, এক দধির, এক লবণের, এক আখের রসের, এক সুরার, এক মনের সাগর।

(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments