কবিতা অ্যাভিনিউ
পর্ব – ৯
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় প্রেম বহুমাত্রিক। ভালোবাসাকে তিনি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন।কখনও শরীরের আশ্লেষে জড়িয়ে নিয়েছেন আকণ্ঠ- “ শরীর ছেলেমানুষ কত তার টুকিটাকি লোভ’। আবার কখনও শরীরের উর্ধ্বে গভীর মননশীললতায় ধরতে চেয়েছেন প্রেমের প্রাচুর্য- ‘ ভালোবাসা ঘুম শরীর-বিস্মৃত পাশাপাশি/ ঘুমোবার মতো ভালোবাসা’ কামনাবাসনা রঞ্জিত জীবনে প্রেমকে বাস্তবের আধারের স্নায়ুকোষে তিনি যেমন ব্যক্ত করেছেন পাশাপাশি দেহকোষেও সঞ্চারিত হয়েছে তার উষ্ণ শিহরণ। এসব নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা হয়েছে। আগামীতেও হবে। আমি সুনীলের কবিতায় অন্বেষণ করব দেশকাল মনুষ্যত্বের প্রতি ভালোবাসা। দেশভাগ তাঁর কবিতায় ও মনে মিশে গিয়ে তাঁর অস্তিত্বের সাথে এক এবং অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেছে। কীভাবে চেতনার আশ্রয়ে তা রূপায়িত হয়েছে বর্ণমালায়। তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে এসব প্রশ্ন অনিবার্য ভাবে ছুঁয়ে যায় আমাদের স্নায়ুপথ। সুনীলের কবিতায় দেশবিভাগের বিভিন্ন পরিসর অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছি। দেখবার চেষ্টা করেছি দেশভাগ তাঁর কবিতায় কীভাবে এসেছে এবং কতখানি জায়গা জুড়ে আছে।দেশবিভাগ এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের যন্ত্রণা পঞ্চাশের অজস্র কবিতায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে। এ শুধু ভৌগোলিক সীমারেখার পরিবর্তন নয়, পরিবর্তন ঘটেছে সমাজের , মূল্যবোধের, রাজনৈতিক চেহারার এমনকি মানুষের নিত্যদিনের জীবনযাত্রারও । নতুন সমাজ, নতুন সম্পর্ক, ভাঙাচোরা দেশ আত্ম উন্মোচনের এক নতুন আলেখ্য নিয়ে হাজির হয়েছিল কবিতার ভাষায়। একদিকে মধ্যবিত্তের স্বার্থপরতা, অন্যদিকে উদ্বাস্তুর মিছিল। বারো ঘর , এক উঠোন এর সমবায়িক পরিসর থেকে বিচ্ছিন্ন আত্মকেন্দ্রিকতার সুখী পরিবার। সুনীলের গদ্যে দেশভাগের যন্ত্রণা অস্থিরতা যেভাবে তাঁর বোধবিশ্বে এসেছে কবিতায় হয়তো ততখানি প্রকট হয়নি। কবিতার জন্য তিনি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করতে পারেন এই স্পর্ধা তিনি দেখিয়েছেন তাঁর কবিতায়। কিন্তু বাস্তবে তিনি নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন- “ কবিতা দিয়ে শুরু করলেও গদ্যের দাপাদাপিতে কবিতা অনেকটাই পিছিয়ে গেছে। আমি লিখেছি বটে কবিতার জন্য আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়/ মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, শুধু কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি’ তবে এ কথা আমার চেয়ে শক্তিকেই বেশি মানায়।” দেশভাগ এবং শিকড়বিচ্ছিন্নতার যে যন্ত্রণা , এই যন্ত্রণা গদ্যের মতো বাস্তব এবং ঋজু। তাই তাঁর প্রথম উপন্যাস “ আত্মপ্রকাশ’ এ দেশভাগ এবং দেশত্যাগের প্রসঙ্গ অনিবার্য ভাবে এসেছে। এসেছে মানুষের শিকড়হীনতার ভয়ংকর বাস্তবের প্রতিলিপি হয়ে। পূর্ব- পশ্চিম এ ছিন্নমূল মানুষের গল্পকৃতির পাশাপাশি দুই বাংলার সমান্তরাল জীবনযাপনের দুই বৃত্ত এঁকে তিনি এক পূর্ণ বাংলাকে বিকশিত করতে চেয়েছেন।
কবিতায় তিনি প্রেমকেই প্রাধান্য দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। তবু সমকালীন চিন্তাচেতনার বিভিন্ন অনুষঙ্গ তাঁকে ছুঁয়ে গেছে। এই মুহূর্তে কবিতাটির কয়েকটি লাইন মনে আসছে যেখানে তিনি যন্ত্রণাকে যন্ত্রণার রঙেই লিপিবদ্ধ করেছেন-
মা, তোমার লাবণ্যকে খুঁজেছি প্রান্তরময় , বাঙ্কারে ফক্সহোলে
ছেঁড়া ব্রা, রক্তাক্ত শাড়ি – লুণ্ঠিত সীতার মতো চিহ্ন
পড়ে আছে
ধপধপে হাড়ে কোথাও একটি হাত মাটি খিমচে ধরতে চেয়েছিল।
যে যায় সে চলে যায়, যারা আছে তারাই জেনেছে
বাঁ হাতের উল্টোপিঠে কান্না মুছে হাসি আনন্তে হয়
কবরে লুকিয়ে ঢোকে ফুলচোর , মধ্যরাত্রে ভেঙে যায় ঘুম
শিশুরা খেলার মধ্যে হাততালি দিয়ে ওঠে, পাখিরাও এবার ফিরেছে।
সুনীলের মৃত্তিকাসন্ধানী মন আলোড়িত হয় মানুষের সংকটে, অস্তিত্বের সহযাত্রী শূন্যতার অভিব্যক্তি অনুসন্ধান করে। তাঁর শিল্পীসত্তায় সেই মানবিক পরিসরের উদ্ভাসন আমরা দেখতে পাই। অবচেতনের দোলায় উথালপাথাল হয় তার মন। দেশভাগ মানে তো শুধু শিকড়ের বিচ্ছিন্নতা নয়। দেশভাগ ক্ষতবিক্ষত করে দেয় মানচিত্র ও নারীর শরীর। এ তো শুধু কবিতা নয়।হৃদয়ের রক্তক্ষরণের অমোঘ উপস্থাপনা।
‘মনে পড়ে সেই সুপুরি গাছের সারি/ তার পাশে মৃদু জ্যোৎস্না মাখানো গ্রাম/ মাটির দেওয়ালে গাঁথা আমাদের বাড়ি/ ছোট ছোট সুখে স্নিগ্ধ মনস্কাম। / উরু ডোবা জলে সারাদিন খুনসুটি/ বাঁশের সাঁকোটি শিশুশিল্পীর আঁকা/ হেলানো বটের ডালে দোল খায় ছুটি।’ দেশ তো শুধু নিসর্গ নিয়ে নয়। নিসর্গ ছুঁয়ে থাকে মানুষের হাত। বন্ধুত্বের অমল স্পর্শে যা ভালোবাসার বীজ বুনে যায়-‘ আমার বন্ধু আজানের সুরে জাগে/আমার দুচোখে তখনো স্বপ্নলতা/ ভোরের কুসুম ওপারে ফুটেছে আগে/ এপারের শিশির পতনের নীরবতা।/ আমার বন্ধু বহু ঝগড়ার সাথী/কথায় কথায় এই ভাব এই আড়ি/ মার কাছে গিয়ে পাশাপাশি হাত পাতি / গাবপগাছে উঠে সে হাতেই কাড়াকাড়ি/ আমার বন্ধু দুনিয়াদারীর রাজা / মিথ্যেকথায় জগতসভায় সেরা/ দোষ না করেও পিঠ পেতে নেয় সাজা/ আমি দেখি তার সহাস্য মুখ ফেরা।
দেশভাগের কবিতা শুধুমাত্র অতীতের খোঁজ নয়, তা সম্প্রীতির তা প্রতিবাদের কবিতাও। দ্বিখণ্ডিত মানচিত্রের ভেতর ভালোবাসার অখণ্ড সেতুনির্মাণের প্রয়াস।
‘ বন্ধু হারালে দুনিয়াটা খাঁ খাঁ করে
ভেঙে যায় গ্রাম, নদীও শুকনো ধূধূ
খেলার বয়স পেরোলেও একা ঘরে
বারবার দেখি বন্ধুরই মুখ শুধু
সাঁকোটির কথা মনে আছে আনোয়ার?
এত কিছু গেল সাঁকোটি এখনো আছে
এপার ওপার স্মৃতিময় একাকার
সাঁকোটা দুলছে এই আমি তোর কাছে’
স্মৃতি জুড়ে থেকে যায় পুরোনো পথের রেখা। ১৯৪৭ এর দেশভাগ , যা মূলত ক্ষমতা হস্তান্তর মূলক স্বাধীনতা, এই স্বাধীনতায় আপামর জনগণের ডাল ভাত রুটির যে জীবন নুন পান্তার যে সংগ্রাম তা কতখানি উত্তরণের আলোক সংকেত লাভ করেছিল, অনিবার্যভাবে এসে যায় এই প্রশ্ন। সব ঝুট হ্যায় বলে সেই ভুল পথ কি সংশোধন করা যেতে পারে। সমসাময়িক সমাজজীবনের ক্লেদ, আধিপত্যকামীদের আদর্শহীন লালসার নীরন্ধ্র কথকতা থেকে বিদ্যুৎ চমকের রাস্তা খুঁজে স্মৃতির কাছেই কি ফিরে আসতে চাননি কবি? কোন স্মৃতি? যে স্মৃতিতে জড়িয়ে আছে কামরাঙা গাছ, জড়িয়ে আছে নীল বর্ণের ফুল।
‘একটুখানি ভুল পথ, অনায়াসে ফিরে যাওয়া যেত
আকাশে বিদ্যুৎদীপ্ত, বুক কাঁপানো হাতছানি
সেই কামরাঙা গাছ, নীল-রঙা ফুল, সবই ভুল
হে কিশোর , তবু তাই হল এত প্রিয়? ( সোনার মুকুট থেকে)’
মর্মবিদারী হাহাকারের মতো উঠে আসে এই উচ্চারণ।জীবনের উজ্জ্বল বিন্যাসে অস্তিত্বের কোষে কোষে যেসব স্মৃতি ও প্রকল্পনা, মুগ্ধতা ও আবেশ, যন্ত্রণা ও বিষাদ, বাস্তব এবং অধিবাস্তবের সঞ্চারপথ কবিমনে এভাবেই এক ছায়াতপের পরিমণ্ডল রচনা করে- ‘স্মৃতি এসে বলে- পূর্ব দিকে যাও, তোমার নিয়তি প্রতীক্ষায় আছে।’
নম্র এবং প্রায় নিরুচ্চার আত্মমগ্ন ভঙ্গিতে হারিয়ে যাওয়া জীবনের মহিমা খোঁজেন কবি। যে জীবনের মর্মমূলে রয়েছে আস্তিত্বিক মাধুর্য, রয়েছে প্রেম প্রণয় । ব্যক্ত এবং অব্যক্তের এই দ্বিরালাপ যেন দুটো দেশ, মাঝে কাঁটাতারের নির্মমতা।
‘লুকানো রক্তের মতো মধ্যরাতে জেগে ওঠে
রক্তমাখা বাল্যের প্রেমিকা
ফেটে পড়ে সহস্র শব্দের ভাণ্ড, আমি পাশ ফিরে
দেখি, ততক্ষণে ,
গুপ্তচর স্মৃতি পেয়ে গেছে অ্যাকিলিসের গোড়ালি।’
অ্যাকিলিসের গোড়ালি শব্দটির চমৎকার প্রয়োগ আমাকে মুগ্ধ করে।গ্রিক পুরাণের ‘অ্যাকিলিস’ অন্যতম অপরাজেয় বীর।সমুদ্রের গ্রিক দেবী পেলিয়াস এবং থেটিসের পুত্র। অ্যাকিলিসের যখন জন্ম হয় তখন তার মা তাকে স্টাইক্স নদীর জলে ডুবিয়ে তাকে অমর করার চেষ্টা করেছিলেন। স্রোতে নিমজ্জিত করার সময় তার মা তার ডান পায়ের গোড়ালি ধরেছিল। ফলে সারা শরীর অপরাজেয় হয়ে উঠলেও গোড়ালি অঞ্চলে থেকে যায় দুর্বলতার চিহ্ন। ট্রয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ সুদর্শন যোদ্ধা। তাঁর পরাজয় ও মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাঁর গোড়ালি। শরীরের ক্ষুদ্র এই অংশটিকে ঘিরে জটিলতা তৈরি হওয়ায় তিনি মারা যান। অ্যাকিলিস হিল- একটি প্রবাদ যা দুর্বলতা এবং দুর্ভাগ্যের অন্য এক নাম। সামগ্রিক শক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এমন একটি দুর্বলতা, যা পতনের দিকে নিয়ে যায় , পরাজয়ের দিকে।
কবি এখানে নিজস্ব মাটির প্রতি মানুষের ব্যক্তিগত যে দুর্বলতা তাকে অ্যাকিলিস হিলের সাথে তুলনা করেছেন। এ যেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সেই কথারই প্রতিধ্বনি- আমি যত দূরেই যাই/ আমার সঙ্গে যায় /ঢেউয়ের মালা গাঁথা /এক নদীর নাম/ আমি যতদূরেই যাই।/ আমার চোখের পাতায় লেগে থাকে/ নিকোনো উঠোন / সারি সারি/ লক্ষ্মীর পা/ আমি যত দূরেই যাই/
জন্মভূমি, নিজের ছেড়ে আসা গ্রাম ও নদী , এ তো চাইলেই ফেলে আসা যায় না। মনের গভীরে থেকে যায় উজ্জ্বল স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। এর দহন ও উত্তাপ, দেশভাগ, জন্মভিটে, ছেড়ে আসা নদীটির কথা, উদ্বাস্তুজীবনের মর্মবেদনা, নির্বাসিতের যন্ত্রণা নিয়ে মাইলস্টোন হয়ে আছে যে কবিতা-
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো।
বিষণ্ণ আলোয় এই বাংলাদেশ
নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ
প্রান্তরের দিগন্ত নির্নিমেষ
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো!
তিনি দেখতে পান সেই বিগত শৈশবের ছবি, স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতার পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে নিজস্ব পথের অনুসন্ধান। এই স্মৃতিই মানুষের প্রাণবায়ু। অতীতপাঠের এক নতুন সমীকরণের মধ্য দিয়ে ফিরে দেখা সেই ইতিহাসের পাতাগুলি।
কুয়াশার মধ্যে এক শিশু যায় ভোরের ইস্কুলে
নিথর দীঘির পাড়ে বসে আছে বক
আমি কি ভুলেছি সব
স্মৃতি, তুমি এত প্রতারক?
আমি কি দেখিনি কোন মন্থর বিকেলে
শিমূল তুলোর ওড়াউড়ি?
মোষের ঘাড়ের মতো পরিশ্রমী মানুষের পাশে
শিউলি ফুলের মতো বালিকার হাসি।
বিষণ্ণ আলোর মধ্যে তিনি অনুভব করেন ফেলে আসা স্মৃতি-
বিষণ্ণ আলোয় এই বাংলাদেশ…
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো।
( চলবে)
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
0 Comments