জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা/পর্ব ১৪/প্রীতম সেনগুপ্ত

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

পর্ব ১৪

প্রীতম সেনগুপ্ত

     অধ্যাত্ম জগতের বেতাজ বাদশা ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ মানসপুত্র। কত সহজভাবে তিনি গূঢ় অধ্যাত্ম ভাবনাসমূহ ব্যাখ্যা করেছেন! প্রশ্নোত্তরের আকারে তার কিছু নমুনা পেশ করা যেতে পারে। ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জিজ্ঞাসুজনের নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন।
    প্রশ্ন-- শুনেছি, মন্ত্রার্থ চিন্তা করতে হয়। মন্ত্রটি কি প্রত্যেক অক্ষর ধরে চিন্তা করতে হয়, না সমগ্র মন্ত্রটি একসঙ্গে চিন্তা করতে হয়?
    উত্তর-- মন্ত্রার্থ কি রকম জানিস? যেমন নাম ধরে ডাকা। তোর নাম অমুক। তোর নাম ধরে তোর রূপটিও আমার মনে জাগবে। সেইরকম মন্ত্র এবং সঙ্গে সঙ্গে উহার রূপ অর্থাৎ ইষ্টমূর্তি ধ্যান করতে হবে।
    প্রশ্ন--জপ কি শব্দ করে করতে হবে, না মনে মনে?
    উত্তর--যখন একলা নির্জনে জপ করবি তখন তুই নিজের কানে যেন শুনতে পাস এইরকমভাবে করবি। আর লোকজন কাছে থাকলে মনে মনে জপ করবি।
    প্রশ্ন--মন কি করে স্থির করব?
    উত্তর--প্রত্যহ ধ্যান-অভ্যাস করা দরকার। ভোরবেলা ধ্যানের খুব প্রশস্ত সময়। ধ্যানের পূর্বে একটু শাস্ত্রাদি পাঠ করে নিলে মন সহজেই একাগ্র হয়। ধ্যানের পর অন্তত আধ ঘন্টা চুপ করে বসে থাকা দরকার। কারণ, ধ্যান করবার সময় তার effect (ফল) নাও হতে পারে; পরেও হতে পারে। সেইজন্য ধ্যান ছেড়েই অন্য কোন সাংসারিক বিষয়ে বা বাজে বিষয়ে মন নিয়োজিত করলে বড় ক্ষতি হয়।
    আবার ১৯১৩ সালের ১০ মে বেলুড় মঠে থাকাকালীন।
    প্রশ্ন--মহারাজ, সংসারে কি রকম থাকতে হবে? নিষ্কামভাবে থাকাই তো উচিত?
     উত্তর--কি জান, নিষ্কাম-টিষ্কাম ও খুব উঁচু কথা। সংসারে থেকে ওসব হয় না। লোকে যতই ভাবুক না যে আমি নিষ্কামভাবে কাজ করছি, কিন্তু বাস্তবিক খতিয়ে দেখা যায় যে কোন না কোন কামনার কামনার তাড়নায় কাজ করছি। তা হলেই হলো যে নিষ্কাম কর্ম হয় না । তবে সংসারের কাজ করতে করতে তাঁর নিকট প্রার্থনা করতে হয় --“প্রভু, আমার কাজ কমিয়ে দাও।”(ধর্মপ্রসঙ্গে স্বামী ব্রহ্মানন্দ)


    বেলুড় মঠের নিয়মাবলির প্রথম অনুচ্ছেদটি বিভিন্নভাবে মঠের অধ্যাত্মপিপাসুদের কাছে প্রায়ই বলতেন। এখানে লিখিত আছে--“শ্রীভগবান রামকৃষ্ণ-প্রদর্শিত প্রণালী অবলম্বন করিয়া নিজের মুক্তিসাধন করা ও জগতের সর্বপ্রকার কল্যাণ-সাধনে শিক্ষিত হওয়ার জন্য এই মঠ প্রতিষ্ঠিত হইল।” সঙ্ঘের নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে কর্ম ও উপাসনার মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধনে তিনি সর্বদা তৎপর ছিলেন। এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করে বলেছেন--“কর্ম না করলে জ্ঞানলাভ হয় না। যারা কর্ম ছেড়ে শুধু ধ্যানজপ সাধন-ভজন নিয়ে থাকে তাদেরও ঝুপড়ি বাঁধতে আর ভিক্ষে করতে সময় কেটে যায়।” মহারাজ আরও বলতেন,“ঠাকুর-স্বামীজীর কর্মে কোন বন্ধন আসে না। তাঁদের কাজ করছি এই ভাব নিয়ে কাজ করলে কোন বন্ধন তো হয়ই না, বরং শারীরিক, নৈতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সব দিকেই উন্নতি হবে।” গীতায় শ্রীভগবানের উপদেশ আছে এইরকম--“সর্বকর্মাণ্যপি সদা কুর্বাণো মদ্ব্যপাশ্রয়ঃ/ মৎপ্রসাদাদবাপ্নোতি শাশ্বতং পদমব্যয়ম।”
    যে প্রবল কর্মযজ্ঞের ভার স্বামীজী তাঁর গুরুভাই ব্রহ্মানন্দজীর হাতে অর্পণ করতে চেয়েছিলেন, সেটির লিখিত দলিল ছিল এইরকম--“I, Swami Vivekananda of Belur Math, Dist.Howrah,Bengal herewith bequeth all I possess in land, buildings,Governmental securities, cash or othetwise to my Gurubhai Swami Brahmananda of the Belur Math, Howrah District, Bengal.
    Also, this revokes and nullifies all will and testaments that have preceded this my last dated the 20th June,1899”--Swami Vivekananda.
    Witnesses--Swami Saradananda, Swami Shivananda, Swami Turiananda, Swami Sadananda, Swami Trigunatita, Sri Hariprasanna Chatterjee. (ব্রহ্মানন্দ-চরিত, স্বামী প্রভানন্দ)
    মহারাজ অবশ্য স্বামীজীর এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেন নি। স্বামীজীকে চিঠি লিখলেন। স্বামীজী এই বিষয়ে তাঁর অতি প্রিয় ‘রাজা’র পরামর্শ গ্রহণ করলেন। ঠিক হল বেলুড় মঠের সম্পত্তি কয়েকজন গুরুভাইকে নিয়ে গঠিত ট্রাস্ট বা অছি রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করবে। সেই অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থাও গৃহীত হল। প্যারিসে ব্রিটিশ কনসালের সামনে দলিলে স্বাক্ষর করলেন স্বামীজী। তারপর সেই কাগজপত্র বেলুড় মঠে পাঠিয়ে দিলেন।
    শ্রীরামকৃষ্ণ মানসপুত্র মহাসমাধিতে লীন হলেন ১৯২২ সালের ১০ এপ্রিল, সোমবার। এইসময় তিনি বলরামমন্দিরে বাস করছিলেন। তাঁর দেহত্যাগকালের অপূর্ব বর্ণনা দিয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণদেবের গৃহীভক্ত ও সুসাহিত্যিক দেবেন্দ্রনাথ বসু। তিনি লিখছেন--“...২৪ মার্চ, ১৯২২,শুক্রবার , স্বামী ব্রহ্মানন্দ হঠাৎ বিসূচিকারোগে আক্রান্ত হন। স্থির ধীর প্রশান্তভাবে রোগযন্ত্রণা অষ্টাহকাল ভোগ করিবার পর বহুমূত্ররোগের সূত্রপাত হয়। এই সময়ে তিনি কলকাতায় ‘বলরাম-মন্দিরে’ বাস করিতেছিলেন। ডাক্তার কবিরাজ তাঁহার জীবনের আশা ত্যাগ করিলেন। ৮ এপ্রিল, শনিবার, রাত্রিতে সমবেত সাধু ব্রহ্মচারী ভক্তগণকে স্নেহভরে কাছে ডাকিয়া একে একে আশীর্বাদ করিলেন। সকলের মুখে হতাশার ভাব দেখিয়া বলিলেন,“ভয় পেও না। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা।” তারপর গুরুভাইদের নিকট বিদায় গ্রহণ করিতে করিতে তাঁহার মন সহসা এক অজানা রাজ্যে উধাও হইয়া গেল; বলিলেন,“রামকৃষ্ণের কৃষ্ণটি চাই। ওঁ বিষ্ণু, ওঁ বিষ্ণু, ওঁ বিষ্ণু! কৃষ্ণ এসেছে? আমাদের এ কৃষ্ণ--কষ্টের কৃষ্ণ নয়, এ গোপের কৃষ্ণ-- কমলে কৃষ্ণ!”
    শ্রীরামকৃষ্ণ কোন সময়ে বলিয়াছিলেন,“দেখলাম গঙ্গার উপর একটি প্রস্ফুটিত পদ্ম--তার উপরে বালগোপালমূর্তি সখা রাখালের হাত ধরে নৃত্য করছেন।”
    শ্রীরামকৃষ্ণের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল,“ব্রজের স্বপ্নে ব্রজের রাখালের জীবনাবসান হইবে।” ব্রহ্মানন্দের গুরুভ্রাতাগণ বুঝিলেন সময় সন্নিকট।
    কিছুক্ষণ পরে রাখালরাজ আবার বলিতে লাগিলেন,“আমি ব্রজের রাখাল, আমায় নূপুর পরিয়ে দে, আমি কৃষ্ণের হাত ধরে নাচব।” দর্শন চলিতে লাগিল-- পুনরায় বলিলেন,“এবারের খেলা শেষ হলো! কৃষ্ণ, কৃষ্ণ! আহা তোদের চোখ নেই, দেখতে পাচ্ছিস নে-- আমার কমলে কৃষ্ণ, পীতবসনে কৃষ্ণ! ব্রহ্ম-সমুদ্রে বিশ্বাসের বটপত্রে ভেসে যাচ্ছি। ঠাকুরের পা-দুখানি কি সুন্দর! দেখ! দেখ! একটি কচি ছেলে আমার গায়ে হাত বুলুচ্ছে--বলছে আয়!”
    ব্রহ্মানন্দ পরক্ষণেই মহাধ্যানে নিমগ্ন হইয়া গেলেন। ধ্যানে পরদিন অহোরাত্র কাটিল। তৎপর দিবস সোমবার, ১০ এপ্রিল রাত্রি আটটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের সময় সেই মহাধ্যান মহাসমাধিতে মগ্ন হইয়া গেল। পরদিন নন্দনের পারিজাত চন্দনলিপ্ত করিয়া বেলুড় মঠে গঙ্গাকূলে অনলে আহুতি দেওয়া হইল।
    সাধু বা সাধকজীবনের পুণ্যকাহিনী চিরদিন লোকচক্ষুর অন্তরালেই থাকিয়া যায়। সেইজন্যই সে ইতিহাস সর্বাঙ্গসুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করা অসম্ভব। কিন্তু রসাল ফল কি করিয়া সুপরিপক্ক হয়, তাহা অজানা থাকিলেও তার রসাস্বাদনে কোন বাধা হয় না। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বলিতেন,“অত হিসাবে কাজ কি? তুমি আম খাও।”

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments