জ্বলদর্চি

পলিটিক‍্যাল প্রেশার /সন্দীপ দত্ত

চিত্র- মণিদীপা দাস 


পলিটিক‍্যাল প্রেশার

সন্দীপ দত্ত


চাল আর কুমড়ো দুই ভাই। রক্তের ভাই নয়,তুতো। বহরমপুরের গুঞ্জাপিসীর ডুলোকাকার মেজোছেলে হল চাল। চালের মৃগীমামার  লছেলে কুমড়ো। যেবছর গাঁয়ে শ'য়ে শ'য়ে মেয়েমানুষগুলোর মাথায় ঝেঁপে উকুন হল খুব,নাটাবাবার বুজরুকি ব‍্যবসা ফুলে ঢোল হল,পৌষের শীতে ন‍্যাড়া এক নিমগাছের তলায় দুখিনী জন্ম দিয়েছিল চালকে। সেই হিসেবে চালের বয়স এখন সাঁইত্রিশ বছর সাত মাস এগারো দিন তিন ঘন্টা ছাপান্ন সেকেন্ড। ওর আসল নাম দুধেশ্বর। ছোটবেলায় খুব নাকি ফর্সা ছিল,তাই অমন নাম। দুখিনী মা ডাকত দুধ। বড় হওয়ার পর ও নাম ধরে ডাকতে ভীষণ লজ্জা পেত সবার। তাই দুধেশ্বর বা দুধ হয়ে গেল শুধুই চাল। চাল হয়েই সে কলকাতায় আসে আট বছর আগে। এখন চালের চেহারা পাতলা হয়ে গেছে। মাথার চুলেও আর আগের মতো ঘনত্ব নেই। এখন তার অম্বল হয় খুব। জল খেলেও বায়ু ছাড়ে।
      সে তুলনায় কুমড়ো দিব‍্যি আছে। একেবারেই দিব‍্যি আছে বলাটা ভুল। চেহারাটা গোলগাল হলে হবে কি,সুগার আছে বেশ। আর আছে হাঁটুর ব‍্যথা। ওর বয়স চালের থেকে এক ঘন্টা বিয়াল্লিশ সেকেন্ড কম। ওর গায়ের রঙ গোলাপি ফর্সা। এখন রোদে পুড়ে যদিও পাল্টে গেছে একটু। ওর জন্ম পেটকুলচাঁদে। ওটা বর্ধমান জেলা। ঐ যে বছর বন‍্যায় গাঁয়ের মোদককাকার পোয়াতি মেয়েটা ভেসে গেল আর সেই দুঃখে পাগল মোদক গলায় দঢ়ি দিল সাতমানুষের বেড় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বুড়োবটে,কুমড়োকে ভ‍ূমিষ্ঠ করল বাউলি,গুপীবাউলের বউ। কুমড়োর আসল নাম তালেবর। বাউলির দেওয়া নাম। তবে ও নাম ধরে ওকে কোনওদিন ডাকেনি কেউ। জ্ঞান হওয়ার পর ও শুনেছে,বুড়োরা ওকে ডাকে বেতাল আর বড়'রা ঠাট্টা করে একগাল হেসে বলে বৈতাল।
      সেই বৈতালই এই কলকাতায় এসে হল কুমড়ো। কুমড়োর ওজন এখন চুরাশি কেজি ছ'শো সত্তর গ্রাম। পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চির চর্বিঅলা চেহারাটা তাই পাহাড়ের মতো লাগে।
      চাল আর কুমড়ো দুজনেই এখন নাগরিক। কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা। গত দশ বছর ধরে কলকাতার জল খায় আর গঙ্গার বাতাস গায়ে মাখে। দুজনেই বিবাহিত। চালের বউয়ের নাম চিনি আর কুমড়োর বউয়ের নাম ছক্কা। বউ'রা ওদের ভালবাসে খুব কিন্তু ওরা বউদের ভালবাসতে পারে না। জড়িয়ে ধরতে গেলেই ফোন আসে। সোহাগ করে একটু রসের কথা বলতে গেলেও ফোন।চুম্বন করতে গেলে অর্নগল রিং বেজে যায়,'সাকা লাকা বুম বুম'। দিন নেই রাত নেই সকাল নেই সন্ধে নেই,খালি ফোন আর ফোন। এমনকি বাথরুমে ঢুকতে গিয়েও বাধা পায় ওরা। প্রায় সব ফোনগুলোই আসে পার্টি অফিস থেকে। কালো পার্টির বেঁটে নেতা হোমড়া আর ফ‍্যাকাশে পার্টির শ্বেতি নেতা চোমড়াই বার বার তলব করে ওদের। কেননা চালের পার্টির রঙ কালো আর কুমড়োর পার্টির রঙ ফ‍্যাকাশে।পার্টিতে ওরা নাম লিখিয়েছিল বাঁচার জন‍্য। লোকে বলে,পার্টি করলে জীবনের একটা হিল্লে হয়। কুঁড়েঘর থাকলে পাকাবাড়ি হয়। পাকাবাড়ি থাকলে অট্টালিকা। সাইকেল থাকলে বাইক হয়। বাইক থাকলে চারচাকা। কিন্তু চাল আর কুমড়োর জীবনের এখনও কোনও পরিবর্তন হল না। ওরা এখনও গরীব। এতগুলো বছর পরেও এখনও ওদের হাতে গোনা ক'টা মাত্র টাকা নিয়ে সংসার চালাতে হয়। মাসের শেষে ধার করতে হয় এর তার কাছে। অথচ হোমড়া আর চোমড়া একবার তলব করলেই ওরা হাজির। বৃষ্টি হোক,ঝড় হোক,শীত হোক,জ্বর হোক, আজ পর্যন্ত একটি দিনের জন‍্যও একটা কথারও অবাধ‍্য হয়নি ওরা। ভোটের ঠিক আগের ক'টা মাস তো আরও বীভৎস যন্ত্রণা! পেট ভরে দুটো খেতেও পায় না। খালি কাজ আর কাজ। কতরকমের যে কাজ করতে হয়! জনসভা হলে মাঠে লোক জড়ো করতে হয়,মিছিল হলে পায়ে পা মেলাতে হয়,পার্টি অফিসে গোপণ মিটিং হলে চারাপোনা দাদাগুলোকে জলবাতাসা দিতে হয়,এছাড়া ভোটের মুখে এদিক সেদিকের দেওয়াল দখলের ঝামেলা তো আছেই। আর আছে পোস্টার সাঁটা এবং প্রতীক আঁকা। কালো পার্টির প্রতীক বাঁশ আর ফ‍্যাকাশে পার্টির প্রতীক থান ইট। এর সাথে আছে হোমড়া আর চোমড়ার পাঁচতলা প্রাসাদোপম বাড়িতে সারাবছর ধরে বিলিতি মদ আর ছোট পোশাকের সুন্দরী যুবতী পৌঁছে দেওয়ার কাজ। তবু চাল আর কুমড়োর মনে একফোঁটাও আনন্দ নেই। কেননা ওরা এখনও বড্ড গরীব। ওদের বউদের এখনও শাড়ি সেলাই করে পরতে হয়। ইচ্ছে থাকলেও এখনও ওরা সন্তান নিতে পারেনি খুব বেশি টাকা নেই বলে।
      এক একসময় ভীষণ প্রতিবাদ করতে মন চায়। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। পার্টির নেতা বলে কথা। এক্ষুনি যদি প্রাণটা কেড়ে নেয়। ওরা জানে,নেতাদের হাতে পিস্তল থাকে। আর থাকে পুলিশ। পিস্তলে থাকে অনেকগুলো গুলি। দিনের আলোয় খুন করলেও পুলিশ ওদের সঙ্গ দেয়। পুলিশ ওদের সহজে গ্রেফতার করে না। কারন পুলিশ ওদের ভয় পায়।
      তবু একদিন একটু রুখে দাঁড়িয়েছিল চাল আর কুমড়ো। তাতেই হোমড়া আর চোমড়ার সেকি রোষ! চোখ পাকিয়ে হোমড়া চালকে বলল,"এক্কেবারে মুখ খুলবি না। গণধর্ষণ মামলায় নাম জড়িয়ে দেবো। জেলে পচে মরে যাবি।"
চোমড়া তেরিয়া দেখিয়ে কুমড়োকে বলল,"খবরদার! আমার ওপর একদম কথা বলবি না। তানাহলে বউকে তোর পাচার করে দেবো দুবাইয়ে। কোনওদিন খুঁজে পাবিনা।"
      ওরা তাই ভয় পায়। ভয় পায় আর গাধার মতো খাটে। হোমড়া আর চোমড়ার আজ্ঞাকারী হয়ে যন্ত্রের মতো কাজ করে। প্রাণহীন পুতুলের মতো নাড়ে মাথা। কতধরনের যে কাজ! ভোটের দিনগুলোতে মৃত ভোটারের হয়ে মন ভরে ছাপ্পা মারা,নির্বাচন বানচাল করতে লুকিয়ে বোমা ছোঁড়া,পার্টির নেতা মঞ্চে উঠে যখন একের পর এক মিথ‍্যে প্রতিশ্রুতি দেয়,সামনে বসে থাকা সম্মোহিত জনতাদের উদ্দেশ‍্য করে বিবেকটাকে বিকিয়ে শ্বাস ভরে জোর গলায় হাততালি দেওয়ার কথা বলা,আরও কত কী কাজ।
      তবুও চাল আর কুমড়ো'রা গরীব থেকে যায়। গরীব হওয়াটাই যেন ওদের জন্মগত অধিকার। বাপ গরীব,বেটা গরীব,গরীব হয়ে জন্মাবে তার ছেলেপুলেরাও। এটাই যেন নিয়তি। এর থেকে কোনও নিষ্কৃতি নেই। দিন যত যায়,পার্টির দাদা থেকে শুরু করে নেতামন্ত্রীর পকেট ভরে অথচ বাপ হওয়ার স্বপ্নটা বুকেই রয়ে যায় চাল আর কুমড়োর। সংসার বাড়ালে যে টাকা বাড়াতে হয়। টাকাটাই ওদের বড্ড কম।
      তাই ওরা একদিন ঠিক করল পার্টি ছেড়ে দেবে। রাজনীতির কাজ ছেড়ে চলে যাবে দূরে কোথাও। দরকার হলে জমিনের জন‍্য প্রাণপাত করবে ওরা। প্রয়োজনে পরের জমিতে মুনিশ খাটবে।
      কালো পার্টির চাল আর ফ‍্যাকাশে পার্টির কুমড়ো আজ তাই পাশাপাশি বসে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখতে চায়। ওরা তুতো ভাই। রাজনীতির প‍্যাঁচে একে অন‍্যের প্রতিপক্ষ। হলেও ওদের চোখের জলের কোনও রঙ নেই।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments