জ্বলদর্চি

রত্নকন্ঠী লতা মঙ্গেশকর ও আমার স্মৃতিযন্ত্রণা / বাবলু গিরি

রত্নকন্ঠী লতা মঙ্গেশকর ও আমার স্মৃতিযন্ত্রণা

বাবলু গিরি 


যখন আমরা সরস্বতীর বন্দনায় মগ্ন ছিলাম, সেইসময় মহাযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সুরের সম্রাজ্ঞী সরস্বতীকন্ঠী লতা মঙ্গেশকর, ব্রিচ ক‍্যান্ডি হাসপাতালে।
কেমন প্রস্তুতি, ঘর থেকে চেয়ে পাঠালেন বাবার সব গান, ও একটা ইয়ার ফোন, যাতে বাবা দিননাথ মঙ্গেশকরের গান শুনতে পারেন। আর শুনতে শুনতে কাকে যেন বলে গেছেন, অনেক বছরের পর বাবার গান শুনে মনে হচ্ছে, "মেরা বহুত কমী রহ গয়ী", এ এক আশ্চর্য জীবন দর্শন, সুরের সম্রাজ্ঞী শেষ জীবনে বাবার গান শুনে বলছেন, "মেরা বহুত কুছ কমী রহ গয়ী"। 
পিতা দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন লতা'দির সঙ্গীত জগতের প্রথম শিক্ষা গুরু।

রত্নকন্ঠী লতা'দি ছিলেন, সঙ্গীতের সাধক, তাঁর এই সাধনা ছিল গভীর সঙ্গীত অনুসন্ধানের সাধনা। আর এইরকম সাধকরা শিশুর মতো সরল হয়। একবার কোনো এক বড় অনুষ্ঠানে উদিতের সঙ্গে কোনো একটা ডুয়েট গান ছিলো, এক জায়গায় লতাজিকে থামতে হবে আর সেখান থেকে উদিত (উদিত নারায়ন) শুরু করবেন। আর লতাদি ঐ খানে ভুল করে উদিতের লাইনটা বার বার গেয়ে দিচ্ছিলেন। উদিতকে তখন বলে দিলেন "তুই ঐ জায়গায় আমাকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিবি।" কিন্তু তিনি যখন পারফর্ম করেন তখন তিনি সেই গানের মধ‍্যে ঢুবে যান, যেমন কোনো সাধক সাধনার সময়, সমাধিস্থ হন। উদিত বার বার হাত দেখাচ্ছে কিন্তু দিদি থামছেন না। একসময় দেখতে পেয়ে থেমে যান। আর জীব কামড়ে লজ্জা পেয়ে যান, যা কিনা কোনও নতুন গায়িকা ভুল করলে তার জীবনের যে অবস্থা হয়, এই সরলতা একমাত্র পরম জ্ঞানী, সাধনার চূড়ান্ত স্থিতিতে পৌঁছতে পেরেছেন, সেইরকম সাধকেরই থাকে। 
আমি যখন মিউজিক ইনডাস্ট্রিতে ছিলাম, অর্থাৎ তখন আমি বেশকিছু মিউজিক কোম্পানিতে ম‍্যানেজারের পোষ্টে চাকরি করছি। তারপর পীযূষ চক্রবর্তী, ডাকনাম  বাবলু চক্রবর্তী যিনি আমার শ্রদ্ধেয় মামাশ্বশুর, একদিন আমায় জানালেন তিনি একটি মিউজিক কোম্পানি খুলবেন এবং আমি ডাইরেক্টর হিসাবে থাকবো। এটা আমার জীবনের স্বপ্ন ছিলো, আমি রাজি হয়ে গেলাম শুরু হলো আমার স্বপ্নের কোম্পানিকে গড়ে তোলার। নাম দিলাম "ডোট্ মিউজিক" ( DOTE MUSIC).
DOTE মানে ভালোবাসার পাগল। 

এবং ধীরে ধীরে আমাদের কোম্পানি বাংলায় এক বিশের পপুলার হয়ে উঠছিলো। তখনই আমি ঠিক করলাম যে, যে সব লিজেন্ড বেঁচে আছেন তাদের নিয়ে কিছু কাজ করব, যাতে আমাদের মিউজিক কোম্পানির এক ব্র‍্যান্ড তৈরী হয়। আর তাতেই আমার মনে পড়লো যে, লতা মঙ্গেশকরের কোনো রবীন্দ্র সঙ্গীতের অ‍্যালবাম নেই। দুয়েকটা গান বাংলা সিনেমায় প্লে ব‍্যাক করেছেন। ব‍্যাস আমি ঠিক করলাম লতাদির কন্ঠে রবীঠাকুরের গানের অ‍্যালবাম বার করবো। লতাজির সঙ্গে দেখা করার অনুমতি যোগাড় করলাম অনেক কষ্টে, সে কথা অন‍্যদিন বলবো। আর আমি পীযূষ চক্রবর্তী অর্থাৎ বাবলু'দা, দুজনে মিলে আমরা পৌঁছে গেলাম প্রভুকুঞ্জে, যেখানে - লতা মঙ্গেশকর, হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর, উষা মঙ্গেশকর, মিনা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁষলে একই বাড়ির আলাদা আলাদা ফ্ল‍্যাট নিয়ে থাকতেন। পেডার রোড্ এ এই বাড়ি। পেডার রোড মুম্বাইয়ের আভিজাত্য পূর্ণ এলাকা। এইখানে আম্বানি সাহেবের বিখ‍্যাত বাড়িও আছে।

আমাদের সবকথা শুনে রাজি হয়ে গেলেন। তখন উষা'দি লতাদির সবকিছু দেখাশোনা করতেন, একপ্রকার লতাদির Guardian cum secretary ছিলেন। উনি বললেন গান বেছে আনতে আর উনারাও কিছু গান বাছবেন। দুটো ক‍্যাসেট একসঙ্গে কম্বো প‍্যাকে বেরোবে। গান থাকবে দুটো ক‍্যাসেটের এপিঠ ওপিঠ মিলে ষোলটা গান। আমি অনেক খেটে অনেকের সঙ্গে আলোচনা করে ১৬ টি গান বেছে নিয়ে গিয়ে দেখালাম লতা'দিকে, তিনি রাজিও হলেন। শেষ পযর্ন্ত আমাদের কোম্পানির অন্তর্কলহে, তা আর শেষ পযর্ন্ত হয়ে ওঠেনি। এই ব‍্যথা আমার অন্তরে আজও জ্বলন্ত হয়ে যন্ত্রণা দেয়।

   আজ লতা'দির চলে যাওয়া আমার জীবনের এক অনন্ত বেদনা জ্বালিয়ে দিয়ে গেলেন। রেখে গেলেন তাঁর স্বর্গীয় কন্ঠের গান যা আমি ও অনন্ত প্রজন্ম হৃদয়ে ভরে রাখবো।

   তাঁর গান শুনলে আমার মনে হতো, যেন কোনো কন্ঠ, এ গান গাইছে না,কোনো স্বর্গীয় সঙ্গীত যন্ত্রের থেকে এ সুর বেরিয়ে আসে, মনে হতো কোনো স্বর্গীয় পাখি,এ সুরের মূর্ছনা তুলছেন। তাঁর কন্ঠ এক আশ্চর্য জাদু, যা এক বিস্ময়কর অনুভূতি। 

   কোটি কোটি প্রণাম। আমরা গর্বিত যে এইরকম অমূল্য কন্ঠের গানের সম্পদের অধিকারী ভারতের সঙ্গীত জগতের গর্ব, লতা মঙ্গেশকর।
   
এই সৃষ্টিযাত্রা •••এই রত্নকন্ঠীর মহাপ্রস্থানের 
শুভ মুহূর্তে এসে আমরা মগ্ন হই তাঁর মহাসৃষ্টির সঙ্গীতে। আমার একটা কবিতা তাঁর মহান আত্মার উদ্দেশ্যে -

      সুরসুন্দরী লতা মঙ্গেশকর
                        
এ এক পরিক্রমা ছিলো সুরসাধনার।
অবতার ছিলেন সুরের।
ছড়িয়ে বিছিয়ে রেখে গেছে প্রাণের গান।
একেকটা গানের এক একেকটা ইতিহাস,
একেকটা স্বপ্ন ছড়ানো মধুরতা।
আহা এ রত্নকন্ঠ কেন চলে গেল?
এখন কি করি এই রত্নগর্ভাকন্ঠের?
শুধু কি হৃদয়ে বাজিয়ে যাবো ঐ মুগ্ধস্বর?
না কি প্রতিটি গান হবে সঙ্গীতের পরিক্রমা?

এ এক পরিক্রমা ছিলো শব্দের বাগানে,
মহাসঙ্গীতের।
এসো অবগাহন করি, সঙ্গীতসরোবরে।
ঐ যাচ্ছেন সুরসুন্দরী মহা পরিক্রমায়।
এসো তাঁর সুরে সুর মিলাই, গাহি জয়গান।
প্রণাম রত্নকন্ঠী, সুরসুন্দরী লতা মঙ্গেশকর।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments