জ্বলদর্চি

অল্পস্বল্প এবং ব্যক্তিগত পূর্ণেন্দু পত্রী/ ঈশিতা ভাদুড়ী

স্মৃতি ডট কম ৬
অল্পস্বল্প এবং ব্যক্তিগত পূর্ণেন্দু পত্রী 

ঈশিতা ভাদুড়ী

‘যে টেলিফোন আসার কথা সে টেলিফোন আসে নি। / প্রতীক্ষাতে প্রতীক্ষাতে / সূর্য ডোবে রক্তপাতে / সব নিভিয়ে একলা আকাশ নিজের শূন্য বিছানাতে। / একান্তে যার হাসির কথা হাসে নি। / যে টেলিফোন আসার কথা সে টেলিফোন আসে নি’…
– এমন অনবদ্য লাইন পড়ে যে কিশোরী পাঠ্যপুস্তকের বাইরে প্রথম কবিতা পড়া শুরু করেছে, সে কেমন ও কতখানি মন্ত্রমুগ্ধ হতে পারে সেকথা ব্যক্ত করার মতো অক্ষর নেই আমার। আমি তাঁর সাহিত্যের বা শিল্পের আলোচনা করতে বসিনি এখানে। সেনেট হল ভাঙার প্রতিবাদ করে উঠেছিলেন যে মানুষটি তাঁর আলোচনাও নয়। বরঞ্চ গুণমুগ্ধ পাঠকের প্রতি তাঁর যে দৃষ্টি, আমি সেইটুকুই বলতে চাই। এবং আমার লেখাজোকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কতখানি, সেটুকুও।
তখন সতের বছর বয়েস আমার। ‘তুমি এলে সূর্যোদয় হয়’ বইটি হাতে এল। আর আমার উন্মাদ-অবস্থা। এমন সব কবিতা আছে সে বইতে যেগুলি সতেরো-আঠারো বছরের পক্ষে ‘স্ফীত বন্যাজল’।
‘সবাই মানুষ থাকবে না। / মানুষের কেউ কেউ ঢেউ হবে, কেউ কেউ নদী / প্রকাশ্যে যে ভাঙে ও ভাসায়…’
– যে কবি এমন সরল সুন্দর ভাষায় ভাব ব্যক্ত করেন, তাঁর সঙ্গে আলাপ না হলে যে বৃথা সব, এমন মনে হতে লাগলো। ইতিমধ্যে বছর ঘুরে গেছে। ততদিনে আমি ‘কচ ও দেবযানী’ পড়ে ফেলেছি, অন্যান্য বইও। হিন্দুস্তান পার্ক থেকে ঝাড়গ্রামে ফিরে চিঠি লিখলাম কবিকে। কিন্তু আমি চিঠি লিখলেই বা তিনি উত্তর দেবেন কেন! তিনি তো শুধু কবি নন, তিনি ছবি আঁকেন, তিনি সিনেমা তৈরী করেন। তিনি কত বিখ্যাত মানুষ! তিনি আমাকে চিঠি লিখতে যাবেন কোন দুঃখে! কি কান্ড! যা ভাবলাম তা তো নয়। চিঠি তো এলো। খামের ওপর সুন্দর হস্তাক্ষরে আমার নাম ঠিকানা, অন্য দিকে তাঁর নাম। স্বপ্ন নয় তো? এত বড় একজন মানুষ আমার মতো সামান্য একটি মেয়েকে চিঠির জবাব দিয়েছেন, বিষয়টি অবশ্যই কমলা হলুদ-সবুজ স্বপ্নের মতো। খামটি হাতে নিয়ে আমার শিহরণ এমন যে অনেকক্ষণ প্রায় সারা দুপুর খামটি না খুলে ধরে রাখলাম। খুললাম যখন তখন আরেক বিস্ময়। 
তিনি লিখেছেন – গতকাল রাত্রে বাড়ি ফিরে তোমার চিঠি পেলুম। গতকাল লোডশেডিং-এর অনুকারে তুমি ছিলে ঈপ্সিতা। আজ সকালে আবিষ্কার করলুম তুমি ঈপ্সিতা নও, ঈশিতা। বেশ সুন্দর নাম। সচরাচর চোখে পড়ে না বা কানে আসে না। এইটুকু পড়ে খুবই অবাক হচ্ছো নিশ্চয়ই। এমন পত্রপাঠ উত্তর আশা করনি নিশ্চয়ই… অবশ্যই চিঠির উত্তর দেবে। সঙ্গে কবিতা পাঠাবে না?...
– এমন দীর্ঘ এবং আন্তরিক চিঠি তো সত্যিই প্রাপ্য নয় আমার।
তিনি লিখেছিলেন – … তোমার কবিতা পড়েছি। অনুভূতির একটা আন্তরিক প্রকাশ আছে ওর মধ্যে। আর আছে একটা চমৎকার শব্দের ব্যবহার – ‘সমুদ্রজনোচিত’।… আমার আরও একটা কবিতার বইয়ের manuscript তৈরী। তার নাম ‘কথোপকথন’। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে, পরস্পরকে ভালোবেসে কথা বলছে। কখনো ছন্দে। কখনো গদ্যে। নানান ভঙ্গিমায়। এই নিয়ে ৬০টা কবিতা লিখেছি। সেগুলো একসঙ্গে জুড়ে একটা অন্য রকমের বই করবার ইচ্ছে আছে…কবে কলকাতায় আসছো? খুব তাড়াতাড়ি একবার চলে এসো এক বান্ডিল লেখা নিয়ে। পড়বো, গল্প করবো। ঝাড়গ্রামে আমি একবার গিয়েছিলাম বছর দুই আগে, একটা Documentary ছবির শুটিং করতে। বেশ ভাল জায়গাটা। লোভনীয়। বিশেষ করে শালের জঙ্গল…
আমি মনে করি, আজ যে আমি কবিতা লিখি, সে বিষয়ে যদি কারও কারও কোনো কৃতিত্ব থাকে তবে তাঁদের মধ্যে একজন অবশ্যই পূর্ণেন্দু পত্রী, বলা ভালো তাঁর কবিতাই উদ্বুদ্ধ করেছে আমাকে কবিতা লিখতে। 
‘বুকের মধ্যে বাহান্নটা মেহগনি কাঠের আলমারি। / আমার যা কিছু প্রিয় জিনিস, সব সেইখানে। / সেই সব হাসি, যা আকাশময় সোনালী ডানার ওড়াওড়ি / সেই সব চোখ, যার নীল জলে কেবল ডুবে মরবার ঢেউ / সেই সব স্পর্শ, যা সুইচ টিপলে আলোর জ্বলে ওঠার মতো / সব ঐ আলমারির ভিতরে…’
— শুধু কবিতা নয়, ব্যক্তি পূর্ণেন্দু পত্রীও ছিলেন অত্যন্ত বড় মাপের। তাঁর আন্তরিকতা ছিল অতুলনীয়। একসময় আমি 'ঠুংরী' নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতাম, 'ঠুংরী' নামাঙ্কনটি করে দিয়েছিলেন স্ব-ইচ্ছায়, যদিও এত পত্রিকার ভিড়ে নতুন আরেকটি পত্রিকা প্রকাশের বিপক্ষে ছিলেন তিনি।
‘তুমি এলে সূর্যোদয় হবে। / পাখি জাগে সমুদ্রের ঘাটে / গন্ধের বাসরঘর জেগে ওঠে উদাসীন ঘাসের প্রান্তরে / হাড়ের শুষ্কতা, ভাঙা হাটে’... 
— তাঁর কবিতা পড়ে যতখানি মুগ্ধতা, তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়ে আরও বেশি মুগ্ধতা। চিঠির পর চিঠি তাঁকে চিনতেও সাহায্য করেছিল অনেকটা।
কখনও তিনি লিখেছিলেন – প্রত্যেক বছর শীতের এই শুরুর সময় এ্যাজমাতে ভুগি। কোনও রাত্রিতেই ঘুম হয় না। শীত গাঢ় হলে তবে সুস্থ হই। আনন্দবাজার আপিসে ৩টে থেকে যে কোনও সময় আসতে পার। লোডশেডিং হলেও আমার কাছে আসতে দেবে।
কখনও লিখেছিলেন – পুজোর লেখা আর একটা ডকুমেন্টারী ফিল্মের জন্যে নানা দেশ-দেশান্তরে দৌড়-ঝাঁপে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, সময়মতো উত্তর দিতে পারিনি।… তুমি আমার কবিতা প্রসঙ্গে যে সব প্রশ্ন করেছ, আমি তার উত্তর দিচ্ছি না। প্রথমত সিনেমার ক্ষেত্রেই এ-ধরণের প্রশ্ন করা হয়। কবিতার ক্ষেত্রে লেখকের রচনা (কবিতা এবং কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ) পড়েই একজন লেখক তাঁর নিজের ধারণা বা মতামত গড়ে তোলেন। লেখককে প্রশ্ন করে জেনে নিয়ে নয়। অবশ্য কবি-সাহিত্যিকদেরও ইন্টারভিউ বেরোয়। সে খুব বড় হয়ে উঠলে। অত বড় আমি হইনি। আমি অত সহজে দু-দশ কথায় এই জাতীয় গভীর সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব বলে মনে হয় না।… ‘মালঞ্চ’ কবে রিলিজ হবে আমিও জানি না। আমার কাজ ছিল ছবিটা করা। এখন ডিস্ট্রিবিউটআরের কাজ ছবিটা রিলিজ করা। দেখা যাক ৮১ সালে হয় কিনা।…
পূর্ণেন্দু পত্রী এত গুণী মানুষ, তাঁর গুণে মুগ্ধ না হয়ে পাঠকের যেমন উপায় ছিলনা, সেরকমই তাঁরও পাঠকের প্রতি প্রশ্রয় কম ছিলনা। নাহলে প্রতিটি চিঠিই এত আন্তরিক কেন হবে! কেনই বা অনুরোধে আমার মতো সামান্য মানুষের প্রথম কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ তিনি করে দেবেন, কেনই বা তাঁর অমূল্য পেন্টিং থেকে দুটি আমাকে উপহার দেবেন! শুধু আমি নই, অনেক পাঠক-পাঠিকাই তাঁর প্রশ্রয় পেয়েছে।
একথা সত্য, পূর্ণেন্দু পত্রীর সঠিক মূল্যায়ণ আমরা করতে পারি নি। এর জন্য তাঁর যথেষ্ট অভিমানও ছিল। কিন্তু তিনি নিজেই তাঁর কথা বলে গেছেন তাঁর সৃষ্টিতে। সেগুলিকে যদি যথার্থ মূল্য নিরূপনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তবে লজ্জা আমাদেরই। তাঁর জন্মমাসে এই লেখার মাধ্যমে আমার শ্রদ্ধা জানাই…

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments