ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ--৬/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

পর্ব – ৬

ঠুমরীর বিষয়বস্তুর মধ্যে এক ধরনের হালকা যৌনতার আবেদন প্রকট হয়ে থাকে যে কারনে এক ঝলক শুনে খুব সহজেই তাকে অশ্লীল বলে আখ্যায়িত করা যায়। কিন্তু সেই অশ্লীলতার মধ্যেও একটি অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক ভাব থাকে যার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের আরাধনার মধুর ভক্তি প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। এখানে মনে করা হয় সব জীবিত আত্মা হলো নারী এবং একমাত্র পুরুষ হলেন পরমাত্মা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। নারীর সঙ্গে পুরুষের অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের সাথে রাধারানী বা গোপিনীদের মিলনের লিখিত রূপ পরিস্ফুটিত হয় ঠুমরীর প্রতিটি ছত্রে। এই কারণে নারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে ঠুমরী গান লেখা হয়। ঠুমরী গায়ক ও পণ্ডিত ডঃ বিদ্যা রাও-য়ের মতে ঠুমরি অনেকসময় পুরুষদের দ্বারা রচিত হলেও তার মধ্য দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নারীদের অবদমিত কণ্ঠস্বর যেন শোনা যায়। অপূর্ণ প্রেমের যন্ত্রণা, বিরহের কষ্ট, মিলনের আনন্দ এবং দুঃখ ও বঞ্চনা মিশ্রিত ক্রোধ ইত্যাদি আবেগের বহিঃপ্রকাশই ঠুমরীর প্রধান উপজীব্য। সাধারণতঃ রাধাকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে এই সমস্ত গানগুলি রচনা হয় কিন্তু কখনো বা অজ্ঞাত সাধারন পুরুষ বা নারীও এইসব কাব্য কাহিনীর নায়ক নায়িকা হতে পারেন।                                     
 
  ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত পিটার ম্যানুয়ালের 'ঠুমরি ইন হিস্টোরিক্যাল এন্ড স্টাইলিশটিক পার্সপেক্টিভস্' বইয়ে ঠুমরি সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এইভাবে - " একটি ভালো ঠুমরির কথা অসম্পূর্ণ হলেও তাতে আবেগের প্রকাশ অনেক বিস্তৃত সরল এবং সহজভাবে হতে পারে যাতে গায়ক অনেক রকম ভাবে কথাটিকে ব্যাক্ত করতে পারেন। একই সঙ্গে প্রতিবার সেই পংক্তিটি স্বাধীনভাবে শেষ হতে পারে এবং ওই এক পংক্তির মধ্য দিয়ে যেভাবে অনুভূতির প্রকাশ ঘটে সেটা সরল মনে হলেও গানের ভাব পরিষ্কার করে বোঝানোর জন্য দুই বা তার বেশি পংক্তির কোন প্রয়োজন নেই। ঠুমরীতে কাব্য তার সাহিত্যের অংশটি পরিত্যাগ করে এবং এটি সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ একটি সঙ্গীতের বিষয়ে পরিণত হয়"।                          

  ঠুমরী গানের বিকাশের সাথে সাথে উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে সৃষ্ট আর এক ধ্রুপদী নৃত্যকলা কথকের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র ছিল। কত্থক নামটি এসেছে কথক বা কথাকার থেকে যাদের পেশা ছিল হিন্দু পৌরাণিক মহাকাব্যের জনপ্রিয় অংশবিশেষ গল্পচ্ছলে বর্ণনা করা। মধ্যযুগের এবং মুঘল যুগে মন্দির ও রাজদরবারে কত্থক নৃত্যের খুবই প্রচলন ছিল এবং কত্থকের বিষয়বস্তুর উপরে গভীর বৈষ্ণব প্রভাব ছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষে লখনৌতে কত্থক এবং ঠুমরির জনপ্রিয়তা প্রায় সমান সমান ছিল। ঠুমরীর মতো লোকপ্রচলিত উৎসব যেমন রাস বা চরাচরি নিয়ে কত্থকের বিষয় সৃষ্টি হতো। রাসের মতো লোক উৎসবকে আরেকটু উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেয়ে 'রাহস' নামে এক নতুন আঙ্গিকের নৃত্যশৈলী রচনার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব অযোধ্যার নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের। তিনি নিজেই কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় ও নৃত্য পরিবেশন করতেন তাঁর দরবারের নৃত্যশিল্পীদের নিয়ে। লখনৌ ও অযোধ্যা রাজদরবারের পরবর্তীকালে কলকাতাও নাচ ও গানের এই যুগ্ম ধারাকে গ্রহণ করে। নির্বাসিত নবাব কলকাতাতে আসার পরে খুব স্বাভাবিকভাবে তার মধ্যে স্থানীয় প্রভাব পড়তে শুরু করে। অযোধ্যার দরবারে ঠুমরী ও কত্থকের একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো সৃষ্টি হয়েছিল। লক্ষ্ণৌর নবাব দরবারে সেদিক থেকে অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি ছিল যাতে স্থানীয় সংস্কৃতি, ভাষা ও উচ্চারণ রীতির প্রভাব খুব বেশি থাকত। ব্রজের উৎসবগুলি এইভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এছাড়াও দিল্লির তুলনায় অযোধ্যাতে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা অনেক বেশি ছিল এবং সেই পারস্পরিক বোঝাপড়া ও যোগাযোগ তাদের কলা ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছিল। 

  যেহেতু নবাবের অধীনস্থ অঞ্চলগুলি অধিকাংশই হিন্দু অধ্যুষিত ছিল সেজন্য হিন্দু তীর্থযাত্রী ও হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীর চরিত্রগুলি নবাবেরা ও তাদের রাজদরবারের সঙ্গীত ও নৃত্যশিল্পীরা গ্রহণ করেছিলেন উদার হৃদয়ে অনেকটা বিশ্বায়নের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। দরবারের শিল্পীরা এই জনপ্রিয় কলারীতিকে আরো মার্জিত করে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতেন। হিন্দুস্তানি সংগীতে ঠুমরী এবং ধ্রুপদী নৃত্য হিসাবে কত্থকের বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে বিনদাদিন মহারাজকে একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি একটি বিশেষ আঙ্গিকের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা পরবর্তীকালে 'লক্ষ্ণৌ ঘরানা' নামে পরিচিতি লাভ করে। বিনদাদিন এবং তার ভাই কালিকাপ্রসাদ কত্থকের দুনিয়ায় এক বিরাট বিপ্লব ঘটিয়ে তাতে আভিজাত্যের স্পর্শ এনে দিয়েছিলেন। বিনদাদিন মাত্র ন' বছর বয়সে তার বাবা দুর্গা প্রসাদ ও কাকা ঠাকুর প্রসাদের কাছ থেকে নাচ শেখা শুরু করেছিলেন। বার বৎসর বয়সে তৎকালীন পন্ডিত কুদু সিংহকে তাল বিষয়ে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের সভায় প্রতিযোগিতায় আহ্বান করেছিলেন। বারো বৎসর বালকের নৃত্যকলা বিষয়ে পুঁথিগত ও ব্যবহারিক জ্ঞান দেখে নবাব মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং নবাবের দরবারে একজন গুরুত্বপূর্ণ সভা গায়ক হিসেবে তাঁকে নিযুক্ত করেছিলেন।      

  উনবিংশ শতাব্দীর ঠুমরী গানের বিখ্যাত গায়ক ও রচয়িতারা হলেন  লালন পিয়া, মথুরার 'সরস পিয়া', কালে খান, রামপুরের 'নজর পিয়া', নজর আলি, বেরিলী ও রামপুরের সনদ পিয়া, মাধো পিয়া, চাঁদ পিয়া ও অন্যান্যরা।        

  তারানা - এরপরে এলো তারানা গান। সাহিত্যে যেমন অর্থহীন, ছন্দহীন কবিতা লেখা হয়, সংগীতে তেমনি অর্থহীন কতকগুলি ধ্বনি দিয়ে যে গানের সৃষ্টি হয়েছিল তার নাম তরানা বা 'তেলেনা'। এর গাইবার পদ্ধতি খেয়ালের অনুরূপ।                           
                                                                                                 ক্রমশঃ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments