জ্বলদর্চি

তুর্কী নাচন - ৬/ মলয় সরকার

তুর্কী নাচন 

পর্ব-৬  (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মলয় সরকার

কায়মাকলি পর্ব

নামলাম ধীরে ধীরে। প্রথমে ভয় লাগছিল, এত লোক নামছে , দম বন্ধ হবে না তো? ভিতরে অবশ্য সব জায়গায় আলোর ভালই প্রাচুর্য  আছে, তবে বিসদৃশ নয় , স্থানের সাথে সাযুজ্য রেখে। আর অনেক জায়গাতে সিঁড়ি কাটাই আছে। যেখানে নেই, সেখানে লোহার সিঁড়ি পর্যটকদের সুবিধার জন্য করে দেওয়া আছে।কোথাও কোন অসুবিধা নেই।ভিতরে নেমে কিছু জিনিস বুঝলাম, তবে বুঝিনি অনেক জিনিস। সেগুলোর উত্তরও সঠিক ভাবে পাই নি।


এই শহর গুলি তৈরী হয়েছিল, তৎকালীন যুগে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচার জন্য। এবং এই একটিই নয়, এরকম আরও আছে। এই শহরটার প্রাচীন নাম ছিল এনেগুপ।এখানে প্রথম যুগের মানুষরা, প্রধানতঃ গ্রীক, যখন খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করে তখন অনেক চ্যাপেল, গীর্জা বানায়। সেটা আমরা এর আগেও জেরোমের দেখেছি পাহাড় কাটা, খ্রীষ্টানদের সমাবেশ বা বাসস্থানের জায়গা।সেই চ্যাপেল গুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে, এবং মুসলিম আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচাতে এবং বাঁচতেই এগুলোর নির্মাণ।


নামছিলাম নীচে।প্রথমে একটু ভয় ভয় লাগলেও পরে ধীরে ধীরে স্বচ্ছন্দ হয়ে গেলাম।নিঃশ্বাসেরও কোন অসুবিধা নেই। এত হাওয়া বাতাসের ভেন্টিলেশন, যখন সমস্ত মানুষ থাকত, প্রায় পাঁচহাজার মানুষের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের ব্যবস্থা, তা-ও আটতলা নীচে থেকে কি করে হত ঠিক বুঝি নি।হাওয়া ঢোকার জায়গা সেই শহরে ঢোকার মুখের একটি সুড়ঙ্গ মুখ নিশ্চয়ই নয়, আরও কিছু আছে , যা রুইয়া বলতে পারল না। ভিতরে সবই আছে তবে দেওয়াল গুলো বা সমস্তটাই একেবারে নিটোল শ্রীছাঁদ যুক্ত কাটা নয়, যেন একটু মোটা দাগের খোদাই। চীনের প্রাচীরের পাথর গুলো যেমন দেখেছিলাম নিখুঁত কাটা, বা কম্বোডিয়া কি আমাদের দেশের পুরানো মন্দির গুলো, এখানে সমস্ত পাহাড় কাটা-ই যেন একটু মোটা দাগের। দেওয়ালে দাগ দেখে বোঝা যাচ্ছে ছেনি জাতীয় কিছু দিয়ে কাটা। তবে কোথায় সিঁড়ি হবে, কোথায় দেওয়াল বা থাম, সে সবের প্রযুক্তিগত হিসাব নিশ্চয়ই  সঠিকই ছিল, নাহলে অনেক আগেই এটা ভারসাম্য না রাখতে পেরে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ত।কিন্তু ছেনি বাটালি জাতীয় জিনিস দিয়ে কাটা হলে, কতজন এবং কতদিনে তা করেছে, বুদ্ধিতে কুলোল না।এক একটা ঘর , গলি, পথ যেহেতু খুব প্রশস্ত নয়, একসঙ্গে বহু লোক নিশ্চয়ই কাজ করতে পারে নি। তারপর, এত পাথর কাটার পর সেই কাটা পাথরের টুকরো তো বাইরে আনতে হয়েছে, সে গুলোর ব্যবস্থাই বা কি ছিল, কে জানে।তবে এর মধ্যেই ভাঁড়ার ঘর, থাকার ঘর, এমন কি আঙ্গুর থেকে মদ তৈরীর জায়গা- সেগুলোও নির্দিষ্ট ছিল এবং সুন্দর।সব  থেকে যেটি এর মধ্যে আশ্চর্যজনক, তা হল একটি জায়গায় একটি গোল মত পাথরের দরজা। যেটি ঘোরালে দরজা বন্ধ বা খোলা যায় আজও।পাথরের এই দরজা কোন কিছু দিয়ে লাগানো নয়।পাথরের মধ্যেই গর্ত করে লাগানো।এটি কি করে সম্ভব হয়েছিল, এখনকার কেউ বলতে পারছেন না।এছাড়া আর কোন দরজা,  এখন যেটুকু দর্শনীয় আছে, এই চারতলার মধ্যে কোথাও দেখি নি। তার মানে এত ঘর ছিল, এত লোক ছিল, এত পরিবার ছিল, তাদের কোন গোপনীয়তা, চুরি চামারীর ব্যাপার, চেঁচামেচি ঝগড়া এসব কি কিছুই ছিল না? কে জানে।                                   


তবে , অনেক পরের ঘটনা, আমাদের দেশের মুঘলযুগের , দিল্লী আগ্রা বা রাজস্থানের দুর্গ গুলোতে, এত যে পর্দাপ্রথা ছিল, কোথাও কোন দরজা দেখিনি। সব কি ,বড় বড় ভারী পর্দা দিয়েই আটকানো থাকত, শীত বৃষ্টি ঝড় ঝঞ্ঝা, চোর ডাকাত, হঠাৎ আক্রমণ সব কিছু থেকেই বাঁচার জন্য? কে জানে।


আর একটা কথা রুইয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম ( এটা আমি সব প্রাচীন দ্রষ্টব্য স্থান দেখতে গিয়েই লক্ষ্য করি।) তা হল, এখানে যে এত মানুষ থাকত,তাদের জলের ব্যবস্থা বা জল নিকাশের ব্যবস্থা কি ছিল, শৌচের ব্যবস্থাই বা কি ছিল, কিংবা মানব বর্জ্য নিষ্কাশনের। আটতলার মানুষের বর্জ্য জল কি করে বাইরে আসবে বা সেখানে সে ব্যবহার্য জল পাবেই বা কি করে।রুইয়া মুখে একটা ভঙ্গী করে মৃদু হাসি দিয়ে বলল, আমার জানা নেই , তবে অনুমান করি , ব্যবহারের জল তারা উপর থেকেই নিয়ে যেত, যে করেই হোক। আর শৌচের ব্যাপারের সম্ভবতঃ কোন পাত্র নির্দিষ্ট ছিল, যা তারা প্রতিদিন উপরে এনে পরিষ্কার করত।স্মরণে এল, আমাদের দেশে, ব্রিটিশ আমলে জেলের নীচু শ্রেণীর বন্দীদের জন্য এই রকম ঘরের মধ্যেই পাত্র থাকত।তাতে যে মগ ব্যবহার করতে হত, সেটিই হত জল পানের মগ।অত্যাচারের মাত্রা বাড়লে নাকি নিজের জামা দিয়েই সব পরিষ্কার করে সেই জামা ই গায়ে দিতে হত।বিখ্যাত সাহিত্যিক, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ উপন্যাসে জেলে কারাবন্দীদের অবস্থার বর্ণনা আছে।
সে যা হোক, আমি মধ্যপ্রদেশের মাণ্ডুর প্রাসাদ ছাড়া, প্রাচীন বিশেষ কোন জায়গায় এই শৌচের ব্যাপারে কোন চিন্তা ভাবনা দেখি নি। সেই তুলনায় গ্রীক বা রোমান ধ্বংসাবশেষ যেখানে আছে, সেখানে তা দেখেছি এবং সেগুলি যথেষ্ট আধুনিক প্রথায়।

এখানে সিঁড়িগুলি বা গলি রাস্তা গুলি, এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাবার জন্য, অনেক জায়গাতেই বেশ সরু- মাত্র একজন মানুষই যেতে পারে। উচ্চতাও তেমনই। কোন জায়গায় ভালই উঁচু আবার কোন জায়গায় বেশ একটু নীচু।অবশ্য এই ধরণের ঘরে আমরা থাকার কথা ভাবতেও পারছি না। কিন্তু সারা কাপাদোসিয়া অঞ্চলে, এই সেদিন পর্যন্ত , ( ১৯২৩ সালে গ্রীক -তুর্কী বদলাবদলীর আগে পর্যন্ত) এখানের এত পাহাড় কাটা বাড়ীতে আধুনিক মানুষেরাই তো স্বচ্ছন্দে এতকাল ধরে পুরুষানুক্রমে বসবাস করেছে। নিশ্চয়ই তাদের এতে অসুবিধা হত না। তারা এতেই অভ্যস্ত ছিল।আটতলা জুড়েই কোথাও কিন্তু পাথর কাটা আমাদের বর্তমানের পাথরের মেঝে বা নিদেন পুরী ভুবনেশ্বরের মন্দিরের পাথরের দেওয়ালের মতও মসৃণ বা সুন্দর নয়। বরং সমস্ত তল গুলোই (দেওয়াল বা মেঝে ) কিছুটা উঁচুনীচু।তবে কয়েকটা ঘর দেখলাম, বেশ বড়।সেখানে বেশ কিছু মানুষ থাকতে পারে। এই সব জায়গা থেকে যা জিনিসপত্র যা পাওয়া গেছে, তা নাকি মিউজিয়ামে আছে।


এই আটতলা শহর অল্প কিছুদিন আগেও জনসমাগমে গমগম করত, ছিল প্রাণ চঞ্চল।এর মধ্যেই এরা বানাত টাটকা আঙ্গুর থেকে মদ, কিংবা তামার জিনিসপত্র।কাজেই চুল্লী তো ছিলই। তার গরম বা ধোঁয়াও তো কম নয়।
জানি না , কিছুই বুঝলাম না। শুধু দেখে এলাম আর বেরিয়ে এলাম এক অত্যাশ্চর্য জিনিস দেখে। মনে রয়ে গেল হাজার প্রশ্ন, যার উত্তর পাওয়া সত্যিই মুস্কিল। 


বেরোতেই দেখি রুইয়া আগেই এসে গেটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।হেসে জিজ্ঞাসা করল, কেমন লাগল? আমি বললাম, জীবনে ভুলব না।আশ্চর্য জিনিস পৃথিবীতে অনেক দেখেছি। কিন্তু এটি সত্যিই অনবদ্য।


দেখলাম দিনের আলো কমে এসেছে। সূর্যও বাড়ী ফেরার পথে। আমরাও তাই এবার এগোলাম বাড়ির দিকে। রুইয়া জানিয়ে দিল, আমরা ফিরতি পথে ছুঁয়ে যাব ওর্তাহিসার দুর্গ। কে যে এটাকে বানিয়েছিল,  কেনই বা বানানো হয়েছিল, এগুলো অনেকটাই ধোঁয়াটে, ইতিহাস কিছুটা দ্বন্দ্বে। এটি শহরের প্রায় মাঝেই।এর পাশ দিয়ে যেতে যেতে রুইয়া দেখাল ওই দেখুন  ওর্তাহিসার দুর্গ । এটি একটি প্রায় ৩০ মি বা ৯০০ ফুট উঁচু বদখত চেহারার , ভীষণ রকমের অসমান , সবুজের চিহ্নহীন,প্রায় হলুদ রঙের একটি পাহাড়;  যার দেওয়াল ভর্তি অসংখ্য গর্তের মত সামঞ্জস্যহীন দরজা।এটি বেশ কিছুদিন ধরেই পরিত্যক্ত।এটি প্রাকৃতিক ঝড় ঝঞ্ঝায় ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে দুর্ঘটনাপ্রবণ হওয়ায় সরকার থেকে দর্শন বন্ধ করা আছে। শুনছি, শীঘ্র মেরামতির পর খুলে দেওয়া হবে। 


তবে এর শরীরে যে বহু মানুষ এককালে বাস করত, তা , দূর থেকেই দরজা বা অলিন্দের গর্ত বা খোদাই দেখলেই বোঝা যায়।বর্তমানে এখানে আর কেউ বাস করে না।এটিকে কাপাদোসিয়ার সবচেয়ে বড় ‘ ফেয়ারী চিমনী” (Fairy Chimney) বলা হয়।


এর পর আমরা ধরলাম ফেরার পথ। এবার রুইয়া বলল, আপনাদের সঙ্গে আমার দুদিনের সঙ্গ দেওয়ার কাজ শেষ। এরপর আপনারা চলে যাবেন অন্য জায়গায়। আমি আবার অন্য সঙ্গীদের সাথে। আর হয়ত দেখা হবে না আপনাদের সাথে। সবাইকে জানিয়ে রাখি, আমার বিয়ে হবে সামনের সপ্তাহে। সবাই আমাকে আশীর্বাদ করবেন। বলতে বলতে ঈষৎ লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠল তার গোলাপী মুখ।আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোমাদের বিয়ে কেমন হয়? ও বলল,আমাদের বিয়েতে মেয়েদের খুব খরচ নেই। আমন্ত্রিত যারা আসেন, তাঁদের সব খরচ তাঁদের নিজেদের। (আমি জানিনা এর সত্য মিথ্যা)।
যাই হোক আমাদের নামিয়ে দিয়ে যখন রুইয়া হাত নেড়ে’; “বাই “ করল, ওর চোখটাও একটু অশ্রুসজল হয়ে উঠল, অজান্তে আমারও।মনে মনে ঈশ্বরের কাছে ওর ভবিষ্যৎ সুন্দর জীবনের জন্য প্রার্থনা জানালাম।আজকের ভ্রমণ শেষ করে আমরা এগোলাম হোটেলের গুহার দিকে।


পরদিন আমরা সকাল ৮.৫৫ তে ইজমিরের ফ্লাইটের উদ্দেশ্যে হোটেল ছাড়লাম ভোর ৬.৩০ এ। 

(ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments