জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলে গোরুর গাড়ি /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ১২

জঙ্গলমহলে গোরুর গাড়ি

সূর্যকান্ত মাহাতো

লালমাটির কাঁচা রাস্তা। ধুলো উড়িয়ে ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ করতে করতে এগিয়ে চলেছে একটি গোরুর গাড়ি। দুলকি চাল তার। বর গাড়ি সেটি। ছই দিয়ে সাজানো। রাস্তার দু পাশে শাল, শিমুল, পলাশের গাছ। তাদের ডালে ডালে ফাগুনের রঙ। পাতাঝরা ডাল গুলোতে শিমুল ও পলাশ ফুলগুলো লালিমা ছড়াচ্ছে। সদ্যোজাত কচি শাল পাতাগুলো সকালের আলোয় যেন খিলখিল করে হাসছে। কিছুটা এগোতেই চোখে পড়ল, একটা বড় বাঁধ। পদ্ম ও শালুকের বড় বড় বৃত্তাকার পাতাগুলোয় ঢাকা পড়েছে বাঁধের গভীর নীল জল। তার ভিতর থেকেই মুখ তুলে আছে এদিক ওদিক প্রস্ফুটিত পদ্ম ও শালুকের ফুল। ফাঁকে ফাঁকে ডুব মারছে কয়েকটা পানকৌড়ি। জল টলমল পদ্মপাতায় বসে আছে একটি শিকারি মাছরাঙ্গা পাখি।

নববধূটি গোরুর গাড়ির ছই এর ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে এইসব দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছে তার নতুন ঠিকানায়। বিচ্ছেদের যে কষ্ট নিয়ে সে বেরিয়েছিল, প্রকৃতির এই দৃশ্য দেখার পর এখন সেই কষ্ট অনেকটাই হালকা হয়েছে।

"ওকি ও গাড়িয়াল ভাই রে আর কত রবো পন্থের দিকে চেয়ে..."

 একটি ভাওয়াইয়া গান। লিখেছেন ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিন। গানের বিষয়টিও বড় করুন। দীর্ঘদিন মেয়েটি বাপের বাড়ির কোনও খবর পায়নি। বাবা মাকে দেখার জন্য  সে বড়ই ব্যাকুল ও উতলা। তাই গোরুর গাড়ির গাড়োয়ানকে মনের কথা জানাচ্ছে, এই গানের মধ্য দিয়ে। গাড়োয়ান যেন বাবা-মাকে গিয়ে তার মনের কথাটা বলেন।

মনে পড়ে গেল, কালিদাসের "মেঘদূত" কাব্যের কথা। সেখানে সংবাদবাহক ছিল মেঘ। এখানে গোরুর গাড়ির দারোয়ান। সংস্কৃতের সেই ভাবগাম্ভীর্য এখানে নেই। আছে গ্রাম বাংলার সহজ সরল সরসতার ছোঁয়া।

আজ থেকে তিরিশ বছর আগেও জঙ্গলমহলে বরযাত্রার গাড়ি হিসাবে গোরুর গাড়িই ব্যবহৃত হত। এটা অনেক প্রাচীন। তিরিশ নয়, আজ থেকে এক হাজার বছর আগেও বরযাত্রায় গোরুর গাড়ি বা গো-যান ব্যবহৃত হত। সে ইঙ্গিত চর্যাপদেও রয়েছে।

আশ্চর্যের ব্যাপার হল, গোরুর গাড়ি একমাত্র যান, অতি প্রাচীনকাল থেকে যার কোনও আকার বা গঠনগত পরিবর্তন হয়নি। ভারতের প্রাচীন প্রস্তর ও মৃৎফলকগুলোই তার প্রমাণ। সেই বড় বড় চাকা। শরীর লম্বাটে ত্রিভুজের আকার। কেবল কাঠের চাকার পরিবর্তে এখন লোহার চাকা ব্যবহৃত হচ্ছে। এটুকুই যা পরিবর্তন।

তবে চাকার কথাটা যখন উঠলই একটু পিছনে ফিরে যাওয়াই যাক। মূলত ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন মেসোপটেমিয়াতে চাকা আবিষ্কৃত হয়। কুমোররাই সে চাকা ব্যবহার করত। চাকাযুক্ত গাড়ির ছবি প্রথম পাওয়া যায় পোল্যান্ডে(৩৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি)। চাকার সঙ্গে গবাদি পশুর সম্পর্ক প্রথম দেখা যায় নুবিয়াতে। জল উত্তোলনের চাকা ঘোরাতেই গবাদি পশুগুলোর প্রয়োজন হত।

স্পোক বা আরাযুক্ত চাকার ব্যবহার আরও পরে এসেছে। ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বের সমসাময়িক। অশ্ব চালিত বাহনের চাকাগুলো ছিল স্পোকযুক্ত। এই ধরনের চাকাগুলো বেশ মজবুত আর শক্তিশালী হয়। যে কোনও এবড়ো খেবড়ো রাস্তাতেও চলতে পারে। চাকাগুলো বড় হওয়ার এটাই একটা সুবিধা। একারনেই মাঠ ঘাট জল জঙ্গল খাল বিল যেকোনও জায়গায় চলাচল করতে হলে চাকাগুলোকে বড় হতেই হবে। তাই গোরুর গাড়ির চাকাও বেশ বড় আকারের হয়। 

এক সময় জঙ্গলমহল নয়, গোটা ভারতবর্ষে একমাত্র স্থলযান বলতে ছিল গোরুর গাড়ি। সেই নব্য প্রস্তর যুগ থেকে গোরুর গাড়ি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফ্রান্সের ফঁতেয়া অঞ্চলের আল্পস পর্বতের উপত্যকায়, একটি গুহায় গোরুর গাড়ির ছবি পাওয়া যায়। যা দেখে অনুমান করা যায় খ্রিষ্টের জন্মের ৩১০০ বছর আগে, ব্রোঞ্জ যুগেও গোরুর গাড়ি ছিল। এমনকি হরপ্পা সভ্যতাতেও গোরুর গাড়ির প্রচলন ছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়। অথচ আজ সেই স্থলযান একরকম বিলুপ্তির পথে।

জঙ্গলমহলের মানুষের মূল জীবন ও জীবিকা হল চাষবাস তথা কৃষিকাজ। স্থলযান হিসাবে গোরুর গাড়ি ছিল কৃষি কাজেরই একটা অন্যতম অঙ্গ। মাঠ থেকে ধান, গম, সরিষা, আলু বয়ে আনা। জঙ্গল থেকে কাঠ, ঝুড়ি-ঝাঁটি, পাতাও এই গাড়িতে করেই নিয়ে আসা হয়। এছাড়াও উৎপাদিত ফসল, হাতে বোনা ঠেকা,কুলা, মাটির তৈরী কলসী, হাঁড়ি গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে নিকটবর্তী হাটে বিক্রি করতে যাওয়া হয়। মূলত কৃষিজ শস্য বা ফসল পরিবহনের কাজেই গোরুর গাড়ি ব্যবহৃত হত। পরে পরে সেটা অন্য কাজেও ব্যবহৃত হতে লাগল। কৃষিজাত দ্রব্য ছাড়াও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ও গোরুর গাড়িতে বহন করা হয়। তাই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলমে ফুটে উঠেছিল সহজপাঠের দুটো লাইন---
"কুমোর পাড়ার গোরুর গাড়ি
বোঝাই করা কলসি হাড়ি।"

শুধু তাই নয় গ্রামের হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেও গোরুর গাড়িতে করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেত। এই তো কয়েক বছর আগেও এমনটা হয়েছে। কত মা আছেন হাসপাতালে যাওয়ার পথেই গোরুর গাড়িতে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। দলবেঁধে কোথাও অনুষ্ঠানে গেলেও গোরুর গাড়ি ব্যবহার করা হত। আগেকার দিনে তো দুর্গ বা গড় রক্ষা করতেও গোরুর গাড়ি ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতেন রাজা ও শাসকেরা। এখন যদিও সেটা আর নেই। তবে বরযাত্রার গাড়ি হিসাবে গোরুর গাড়ির কনভয় ছিল বিখ্যাত। চিরকাল সেটা ইতিহাস হয়েই থেকে যাবে।

মাথায় গামছা বাঁধা গাড়োয়ানের হ্যাট হ্যাট শব্দ করতে করতে গোরুর গাড়ি ছুটিয়ে চালানোর দৃশ্য এখন আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। ট্রাক, ছোট গাড়ি, ট্রাক্টর, মোটর চালিত ভ্যান, রিক্সা, টোটো, অটো প্রভৃতির বহুল ব্যবহার গোরুর গাড়িকে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে দিয়েছে। আধুনিক সভ্যতার কাছে গোরুর গাড়ি তার অস্তিত্ব রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তার দুলকি চাল, ধীরগতি এখন বাদের খাতায়। বরং গতি গতি আর গতি। এটাই যেন বর্তমান সময়ের ধর্ম। আগামী দিনে তাই ধীরে ধীরে গোরুর গাড়িও ডাইনোসরের দলে নাম লেখাবে, এটা সুনিশ্চিত।

 গোরুর গাড়ির বিভিন্ন অংশ সমূহের নাম সেরকম ভাবে কোথাও সংরক্ষিত নেই। জঙ্গলমহলের অর্ধেক মানুষ সব নাম জানেনও না। বর্তমান প্রজন্ম তো আরোই জানে না। তাই চলুন জেনে নিই, জঙ্গলমহলের মানুষ গোরুর গাড়ির বিভিন্ন অংশকে কী নামে ডাকেন। এগুলো সবই কুড়মালি শব্দ।

১) পাই--- চাকার মাঝের অংশ। এক থেকে দেড় হাত লম্বা কাঠের টুকরো।
২) আরা (স্পোক)--- পাইয়ের সঙ্গে খিল মারা শক্ত দন্ডায়মান কাঠের দন্ড।
৩) পঁঠা বা পুঁঠা বা পাটি--- আরার সঙ্গে বিশেষ ভাবে জুড়ে জুড়ে গোলাকার আকৃতি তৈরি করা হয়।
৪) হাইল--- চাকার চারপাশে বেড়া দেওয়া লোহার চাকতি।
৫) বঁদ বা বেড়ি--- পাইয়ের মাথায় চারপাশে বেড়া দেওয়া লোহার চাকতি।
৬) উলা--- পাইয়ের ছিদ্র মুখে লাগানো লোহার বেয়ারিং।
৭) লিঘা--- কাঠ বা লোহার তৈরি তিন থেকে সাড়ে তিন হাত লম্বা দন্ড, যা দুটো চাকাকে যুক্ত করে। গাড়ির ভারও সহ্য করে।
৮) উদল--- নয় থেকে দশ হাত লম্বা মোটা কাঠের দন্ড।
৯) ডংগী--- লিঘার মাপে নালা তৈরি করা কাঠের দন্ড, যা দুটো চাকাকে সমান দূরত্বে রাখে।
১০) তেতলা--- উদলের সঙ্গে দুই পাশে খিল দিয়ে আঁটা থাকে। যা লিঘাকে শক্ত করে ধরে রাখে।
১১) ঘৈড়া--- উদলের সামনে ও পিছনে দুই প্রান্তে ছিদ্র করা কাঠের দন্ড। যা সারিসুগাকে ধরে রাখে।
১২) কৈড়লা বা জিহ্বা--- উদলের দুটো কাঠকে সামনের দিকে যুক্ত করে ধরে রাখার জন্য বিশেষ আকারের তৈরি খিলান বা কাষ্ঠ দন্ড।
১৩) পাছা---  উদলের পিছন দিকে লাগানো দন্ড। যা উদলকে সমান দূরত্বে রাখে।
১৪) পাঁজরি--- উদলের সঙ্গে যুক্ত এক ফুট ছাড়া খিলানো কাঠ বা বাঁশের খন্ড।
১৫) বাতা--- পাঁজরির উপর বিছানো বাঁশের ফালি।
১৬) সারিসুগা--- গাড়ির উপরের জিনিসপত্র যাতে পড়ে না যায় তাই বাঁশ ও কাঠের তৈরি লম্বা খাঁজা।
১৭) শ্যৈল বা জুহাখাড়ি বা জুহাখিল--- জোঁয়ালের দুই দিকে লাগানো কাঠ বাঁশ বা লোহার তৈরি এক ফুট লম্বা টুকরো। যা দিয়ে গরু জোড়া হয়।
১৮) আলহনি বা কানিখিল--- মোটা লোহার জলুইয়ের মতো। লিঘার দুই পাশের ছিদ্রে ঢোকানো থাকে। যাতে চাকা খুলে না যায়।
১৯) সুতবই--- গাড়িকে সমান্তরালভাবে দাঁড় করানো জন্য কাঠ ও বাঁশের খন্ড বা স্ট্যান্ড।
২০) আড়াস--- ১২ থেকে ১৪ হাত লম্বা মোটা কাঠ বা বাঁশ। যা লোড করা ফসলের উপর চাপিয়ে শক্ত করে বাঁধা হয়। যাতে পড়ে না যায়।
২১) বরহি বা দড়ি--- লম্বা মোটা দড়ি। মালপত্র বাঁধার জন্য।

(তথ্য- কুড়মালি কৃষি সংস্কৃতি: সৃষ্টিধর মাহাত)

২২) জুহা বা জুয়াল বা জোয়াল--- গাড়িটি টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য গোরুর কাঁধে আটকানো লম্বা বাঁশ বা কাষ্ঠ দন্ড।

এছাড়াও গাড়ির চালক তথা গাড়োয়ান যেখানে বসে, তার সামনের অংশটাকে বলে "টুঁড়ি"।

জঙ্গলমহলে এখনও অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারের গাড়োয়ানরা তাদের গাড়িতে মাল পরিবহন করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করেন। গোরুর গাড়ির ব্যবহার দিন দিন কমে আসায় তাদের রুজি রোজগারেও টান পড়ছে। একে তো বলদগুলো পালনের খরচ আছে। সেইসঙ্গে ফি-বছর গোরুর গাড়িটিও সারাতে হয়। নতুন কাঠ, নতুন বাঁশ, মিস্ত্রী খরচ তো আছেই। তার উপর সেভাবে ভাড়াও জুটছে না। এখন গোরুর গাড়ির পরিবর্তে  যন্ত্র চালিত যানকেই বেছে নিচ্ছেন সকলে। 

তাই সব কিছু মিলিয়ে ধীরে ধীরে মুখ থুবড়ে পড়ছে, অতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এই গোরুর গাড়ি। কী আর করা যাবে! সময়ের ধর্মকে তো আমাদের স্বীকার করতেই হবে। তাই একটা সময় জঙ্গলমহলের মানুষগুলোও হয় তো প্রত্যক্ষ করবেন, তাদের চোখের সামনে থেকে একটু একটু করে মুছে যাচ্ছে কঙ্কালসার গোরুর গাড়িগুলো।

তথ্যসূত্র:
১) কুড়মালি ভাষা ও সংস্কৃতি: সম্পাদনা- কিরীটি মাহাত, বিশ্বনাথ মাহাত
২) বাঙ্গালীর ইতিহাস: নীহাররঞ্জন রায়(আদি পর্ব)
৩) উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

3 Comments