তুর্কী নাচন
পর্ব- ১২ (পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মলয় সরকার
বোডরাম পর্ব (ক্রমশঃ)
ছাদ থেকেই দেখা যায়, পাশেই সুন্দর একটি বাগান রয়েছে। এখানে নাকি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বহু দুষ্প্রাপ্য গাছপালা আছে। এ ছাড়া দেখলাম একটি কামান। সেটি ছাদের মাথায় দেওয়ালের ধারে সমুদ্রের দিকে মুখ করে রাখা আছে। আসলে এই দুর্গটা তো একেবারে সমুদ্রের গায়ে, সমুদ্রের দিক থেকে নানা আক্রমণের জন্য প্রতিরক্ষা তো রাখতেই হত।এছাড়াও আরও কামান ছোঁড়ার জায়গাও রয়েছে। এই ছাদের থেকে সমুদ্রের দিকটা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। অসীম নীল সমুদ্রের মাঝে সাদা রাজহংসের মত বিভিন্ন নৌকার দল ঘুরে বেড়াচ্ছে।দূরে দেখা যাচ্ছে সাদা বোটগুলো সারি দিয়ে পাড়ে বেঁধে রাখা আছে , তার পিছনে পাহাড়ের গায়ে সাদা বাড়ির সারি গোটা পাহাড় জুড়ে। বাঁধা বোট গুলো দেখে আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল,’ মধুমাঝির ঐ যে নৌকা খানা , বাঁধা আছে রাজগঞ্জের ঘাটে--”।
একদিকটা রয়েছে সমুদ্রের পরেই উঁচু পাহাড়, আর একদিকে সমুদ্র সীমানাহীন। দুর্গের ভিতরেও সমুদ্রের জল ঢোকার ব্যবস্থা করে আছে।আসলে এই ইজিয়ান সমুদ্র তো ভূমধ্যসাগরের এক টুকরো অংশ, চারিদিকে পাহাড় থাকায়, জল খুব উত্তাল নয়, বেশ শান্ত। পাড়ের দিকে পাথুরে এবং অগভীর হওয়ায় অনেক জায়গাতেই মানুষ পায়ে হেঁটে স্বচ্ছন্দে সমুদ্রের ভিতর অনেকদূর যেতে পারে। অনেক জায়গায় ছোট ছোট টিলার মত পাহাড় সমুদ্রের মাঝে মাথা উঁচু করে রয়েছে। এছাড়া দেখলাম, উপর থেকে, নীচে একটা মসজিদও রয়েছে। একসময় যে এটি মসজিদ হিসাবেও ব্যবহার হত , তার চিহ্ন হিসাবে। এখানে বেশ কয়েকটি হামাম ও জলাধারও আছে।
খুব একটা তৃপ্তি নিয়ে বেরোলাম মিউজিয়াম থেকে। এবার গাড়ী ছুটল, সমুদ্রের আর একধারে, যেখান থেকে সমুদ্রের দৃশ্যটা আরও ভাল করে দেখা যায়। সূর্য মাথার উপরে, কিন্তু খুব যে কষ্ট হচ্ছে এমন নয়।
গাইড ভদ্রলোক অতি অমায়িক। বলছিলেন সুদীর্ঘ দিন অয়েল কোম্পানীতে উচ্চপদে কাজ করার পর নিছক বাড়ীতে বসে অবসর জীবন কাটানো ওনার অভিপ্রায় নয়। অর্থের খুব প্রয়োজন আছে এমন নয়। উনি যে উচ্চপদে ছিলেন, তা ওনার হাবভাব চালচলন, কথাবার্তা শুনলেই বোঝা যায় ।কাজেই উনি এই ভাবে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে নিয়মিত মিশে নিজেকে সচল ও নিজের মনকে তাজা রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন। আমি জানি না আমাদের দেশেও হয়ত এরকম ভাবে কেউ ভাবেন। এটি বেশ সম্মানজনক এবং ভদ্রভাবে করার মত কাজ ও বটে। আসলে যিনি নিজের জীবন ও মনকে যে ভাবে সচল রাখতে চান, সেটাই বড় কথা।
এর পরে গাড়িতে উঠে উনি বললেন, আমাদের বোডরাম দেখা শেষ। আর বিশেষ কিছু দেখার নেই, ছোট জায়গা তো। হতে পারে, কিন্তু আমার মন সত্যিই পরিতৃপ্ত। কত ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া গেল, ভাবতেই আমার একটা স্বপ্নের ঘোর লাগছে।
এর পর আমরা গেলাম একটা হোটেলে । এরকম হোটেলও আমি আগে দেখি নি।এটি আসলে ঠিক হোটেল নয়, একটা সমুদ্রের পাড়ে জলের উপর চারিদিক খোলা একটা রেস্টুরেন্ট, যার মাথায় শুধু ছাউনি আছে। আর আছে সুদৃশ্য চেয়ার পাতা সুন্দর করে সাজানো ।হোটেলের নাম নাজমি(Nazmi)। সমুদ্রের নোনা হাওয়া গায়ে মাখতে মাখতে এখানে খাওয়ার মজাই আলাদা।একেবার প্রায় জলের উপরেই দোকান আর পাশেই আদিগন্ত উন্মুক্ত নীল সমুদ্র।পায়ের নীচে কাঠের পাটাতনের নীচে যে সমুদ্রের জল খেলা করে যাচ্ছে বুঝছিলাম। তবে সমুদ্রের জল এখানে একেবারেই অগভীর এবং ঢেউ বিহীন। তবে ঝকঝকে পরিষ্কার, আমাদের মত যত্র তত্র আবর্জনা ফেলা বা সমুদ্রের জলে নোংরা ভাসে না।সমুদ্রের ধারটাও পরিষ্কার।সমুদ্রের মাঝে মাঝে কিছু শুকনো ডালপালা সমেত গাছের বড় বড় ডাল পোঁতা আছে। আর সেই সব শুকনো গাছের ডালে বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন ধরণের খালি বোতল দিয়ে সাজানো। এই আইডিয়াটা বেশ সুন্দর লাগছিল।
অল্প দূরেই সমুদ্রের মাঝে ছোটি ছোট পাহাড় রয়েছে দেখছিলাম । তার গায়ে , দেখা যাচ্ছে, পড়ে রয়েছে, অতীত দিনের কিছু মানুষের এই পাহাড়ের বসবাসের চিহ্নস্বরূপ পরিত্যক্ত পাথরের দেওয়াল, ঘরের সীমানা এইসব। গোটা তুরস্ক দেশের যেখানেই যাই , মানুষ কি, যেখানে পেরেছে পাহাড়ে ঘর বানিয়েই থাকত না কি, কে জানে। যাই হোক, এদিকে দেখতে পাচ্ছি হোটেলের মধ্যে মাথার উপর থেকে ঝুলছে বিভিন্ন আকৃতির, গোটা কুমড়ো বা লাউয়ের খোলা। সুন্দর করে রঙ করে ঝাড়লণ্ঠনের মত করা রয়েছে।লাউ কুমড়োর খোলা দিয়ে ঝাড় লণ্ঠন করাটাও আমার বেশ লাগল।আমরা তাজা স্যালাড আর টাটকা গোটা তাজা মাছের ফিস ফ্রাই সহযোগে স্থানীয় লাঞ্চ সারলাম।জ্যান্ত মাছ রয়েছে। যেটি বলা হবে, সেটিকে সঙ্গে সঙ্গে ফ্রাই করে দেবে।বেশ ভাল লাগছিল এই নতুন ধরণের পরিবেশের হোটেল। এই খাওয়াটাও টুরের মধ্যেই ধরা ছিল।
ভদ্রলোক রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে পাশের দিকে সমুদ্রের ধারে নিয়ে গেলেন। সেখানে দেখি স্বল্পবসনা বা বসনহীনা সুন্দরীদের রোদ পোয়ানোর ভীড়।সমুদ্রের ধারের যেমন কালো কালো সীল মাছেরা রোদ পোহায়, মড়ার মতন পড়ে থেকে, এদের দেখেও আমার সে রকম সাদা সীল মাছের কথা মনে পড়ল।
এখান থেকে রওনা দিলাম হোটেলের দিকে। সেখান থেকে মালপত্র নিয়ে আজ সন্ধ্যাতেই আমাদের গন্তব্য তু্রস্কের শেষপর্ব ইস্তাম্বুল বা এককালের কনস্ট্যান্টিনোপল।
ইস্তাম্বুল পর্ব
বসফরাস প্রণালী
দেখতে দেখতে আমরা আমাদের যাত্রার শেষ পর্বে এসে পড়লাম, একেবারে তুরস্কের রাজধানীতে, যার অনেক ইতিহাস, ভিন্ন সভ্যতা, সবই একটু অন্য রকমের। আমাদের দেশের মতই এদের দেশও বিজিত হয়েছে অনেকবার । এর আগে ওরহান পামুকের তুরস্কের উপর বইটাতে (ইস্তাম্বুল) অনেক কিছুই জেনেছিলাম। একদিকে কৃষ্ণ সাগর আর একদিকে মারমারা সাগর হয়ে ইজিয়ান সমুদ্রের ভিতর দিয়ে ভূমধ্যসাগরে পৌঁছে যাওয়ার যে সহজ রাস্তা এই বসফরাস প্রণালী, তা ব্যবহারের জন্য এই রাস্তায় জাহাজ চলাচল প্রচুর এবং তার ফলে এখানে বন্দর ও মৎস্যজীবিদের ব্যবসাও ভালই। এদের একটা মজা আছে, ইস্তাম্বুলের মাঝখান দিয়ে বসফরাস প্রণালী যাওয়ায়, তার একপাশে আছে ইউরোপ আর অপর পাশে আছে এশিয়া। দুটি মহাদেশেই এই দেশের অংশ আছে।
যাই হোক বোডরামকে বিদায় জানিয়ে ঊড়ন্ত পাখীতে চড়ে কর্তা-গিন্নী হাজির হলাম ইস্তাম্বুলের সাবিহা গোকেন ( Sabiha Gokcen) এয়ারপোর্টে। এখানে তৈরীই ছিল রথ, নিয়ে হাজির করল সোজা হোটেলে। হোটেলের দোতলায় ঘরটি বেশ সুন্দর । বড় বড় জানালা দরজা, খুব আলো হাওয়া বাতাস। ভিড়ও বেশি নেই। হোটেলের কর্মচারীদের ব্যবহারও বেশ ভাল।
সকালে জানালার বিশাল আভূমি পর্দা সরিয়ে দেখতেই মনটা ভরে গেল। একেবারে চোখের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বহু প্রতীক্ষিত আয়া সোফিয়া (এটার যদিও ইংরাজী বানান Hagia Sophia,
এখানে সবাই বলে আয়া সোফিয়া। আমিও তাই বলব)। আমাদের হোটেলটা যে এর ঠিক সামনেই তা কাল রাতে বুঝতে পারি নি, একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে ব্লু মস্ক।আশপাশে অনেকগুলি মসজিদের মিনারেট দেখতে পাচ্ছি , সকালে সেখান থেকে উঠছে আজানের সুর।প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি এখানে মসজিদের মিনারেটের মাথা গুলি কিন্তু তাজমহলের মত ঠিক ছোট গম্বুজাকৃতি নয়, সারা তুরস্কেই সেগুলি সূচালো উড পেন্সিলের মতই মাথার মতই।কচি নতুন রোদের বাচ্চা ছোট্ট বেড়াল ছানার মত আদুরে উঁকি মারছে মসজিদগুলোর গম্বুজের ফাঁক দিয়ে। যদিও বেলা অল্প গড়িয়েছে, আলো এসে গেছে, কিন্তু উঁচু মিনারের দল সূর্য বেচারীকে ঢুকতেই দেয় নি।
সকালে ব্রেকফাস্টের পর এসে হাজির আমাদের গাড়ী।সেখান থেকে আমরা গেলাম এক জায়গায়, যেখানে অপেক্ষাকৃত বড় গাড়ি একটি তার আরও কিছু পর্যটক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সেই গাড়ির গাইড আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে গাড়িতে ডেকে নিল। এই গাড়ীটি আসলে সব যাত্রীকে বিভিন্ন জায়গা থেকে জোগাড় করে একসঙ্গে কিছু দর্শনীয় দেখাবে।
আমরা প্রথমেই গেলাম সমুদ্রের উদ্দেশ্যে , ভুল বললাম, বসফরাসের দিকে। ভীষণ আনন্দে মনটা নাচছিল, এই সেই বসফরাস আর এর গভীর ফিরোজা ধরণের নীল জল , যার কথা শুনে শুনে মনের মধ্যে একটা সুন্দর ছবি তৈরী হয়ে আছে। এরই পাড়ে যেসব মানুষের বাস তাদের কথা কিছু লিখেছেন পামুক তাঁর ”ইস্তাম্বুল” বইটিতে, যদিও সেখানে এদের জীবনযাত্রা ঠিক দেখানো লেখকের উদ্দেশ্য ছিল না।আর যাঁরা এখানে থাকেন তাঁরা সব বিশাল বিশাল ধনী রাজা মহারাজার দল। এর পারে বাসস্থান বা প্রাসাদ তৈরী করেছেন বহু রাজারা।যাই হোক, অন্য প্রসঙ্গে আসি। এই বসফরাস যেমন জলের দিক থেকে যুক্ত করেছে কৃষ্ণ সাগর বা ব্ল্যাক সী এবং মারমারা সমুদ্র কে তেমনি এর উপরের সেতু, যেটি সম্ভবতঃ পৃথিবীর মধ্যে লম্বায় চতুর্থ ( যখন তৈরী হয়) ছিল, এখন এটির স্থান ৩৩ নম্বরে। কিন্তু সেদিক থেকে পিছিয়ে এলেও এটির গুরুত্ব ও সৌন্দর্য কমে না। ১৫৬০ ফুট লম্বা এই সেতুর একদিকে এশিয়ার Beylerbeyi এবং অপরদিকে ইউরোপের Ortakoy । এটি অনেকটা আমাদের হাওড়া ব্রীজ বা রবীন্দ্র সেতুর মত সাসপেনসন ব্রীজ অর্থাৎ এর দুপাশে চারটি খুঁটির সাথে টানা দিয়ে গোটা ব্রীজটি ঝুলে আছে, মাঝে কোন থাম নেই , যাতে তলা দিয়ে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারে বড় বড় জাহাজ। এর আগে যদিও আমেরিকাতে গোল্ডেন গেট ব্রীজ , ব্রুকলীন ব্রীজ বা আরও দু একটি ব্রীজ দেখেছি সমুদ্রের উপরে, কিন্তু এর অনুভূতিই আলাদা।আসলে, কেন জানি না, এই ইস্তাম্বুল বা বসফরাস নিয়ে আমার ভিতরে একটা আলাদা ভাল লাগার অনুভূতি রয়েছে।এটা বোঝাবার নয়, কাউকে বলারও নয়, কারণটা নিজেও জানি না। তবু মনে হয় এর সঙ্গে আমি কোথাও যেন বাঁধা, সেটা আমার জন্মান্তরের কোন সূত্র কি জানি না। যাই হোক, আমরা ফেরার সময় হেঁটেই ফিরেছিলাম এর উপর দিয়ে , যদিও যাবার সময় গাড়ী করেই গিয়েছিলাম। মনে পড়েছিল নিউইয়র্কের ব্রুকলিন ব্রীজের উপর দিয়ে হাঁটার কথা।এখন অবশ্য শুনছি না কি, এর উপর দিয়ে হাঁটা বারণ এবং এর নতুন একটা নামও হয়েছে “১৫ই জুলাই শহীদ সেতু”, ২০১৬ সালে এখানে যে মিলিটারী ক্যু হয় তাতে যে সমস্ত বীরেরা প্রাণ দিয়ে রুখে ছিলেন, তাঁদের স্মৃতিতে।
এর পর ধীরে ধীরে পাঠককে নিয়ে যাব ইস্তাম্বুলের ভিতরে। সঙ্গে থাকুন—
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


0 Comments