জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৭৪

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৭৪

সম্পাদকীয়,
একটা পাতি মাছরাঙা পাখির ছবি তুলে পাঠিয়েছিল, বাসবদত্তা আন্টি। আমি তোমাদের মতো অবাক হয়ে বললাম, মাছরাঙা কেন? মাছরাঙা কি পরিযায়ী পাখি? আমার প্রশ্ন শুনে বাসবদত্তা আন্টি একটা লেখা পাঠালো, তোমরা পড়তে চাইলে পড়ে নাও সে লেখা চলো যাই-তে। আমার তো পাখিদের লেখা পড়ে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কোথায়? কেন রূপকথার দেশে।  আমার মনের ইচ্ছের কথা বুঝতে পেরে কৃষ্ণা আন্টি একটা রূপকথার গল্প লিখে পাঠিয়েছে। রূপকথার গল্প একবার শুরু হলে সহজে শেষ হবার নয়। এমনকি তনুজা আন্টিও রূপকথার ছড়া লিখেছে। পাখির ছবি দেখে সবার মন আজ উড়ু উড়ু। তোমাদের বন্ধু প্রবাহনীলও টাইম মেশিনে চেপে কোথায় যেন যাবার কথা বলছিল। এবার বলি আসল কথাটা, মাছরাঙা পাখির স্বভাব তো তোমরা জানো? ঘাপটি মেরে বসে থাকবে জলের পাশে। যেই না মাছ উপরে আসবে অমনি ছোঁ মেরে ধরবে মাছটাকে। ঠিক গোয়েন্দা পুলিশের মতো। আর মজার ব্যাপার কি জানো, জয়াবতীও এবারের পর্বে তেমন একটা দুঃসাহসিক কাজ করেছে।  সেটা কি? তা বলা যাবে না। পড়ে দেখো। দারুণ সাহসী কণ্যা আমাদের জয়াবতী। তার জয়যাত্রা অব্যাহত থাকুক। এমন আর এক গুণী কণ্যা তরু দত্তের কথা আমাদের শুনিয়েছে পীযূষ আঙ্কেল। কি এবার বুঝলে তো, মাছরাঙা পাখিটা কিন্তু উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। তাকে রীতিমতো গল্প কবিতা আর আঁকার টোপ দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। স্কুল খোলা সত্ত্বেও স্নেহা, সুদেষ্ণা আর শ্রেয়সী ছবি এঁকে পাঠিয়েছো বলে তোমাদের বাসন্তী আবির পাঠালাম। দোলের আগাম শুভেচ্ছা ছোটোবন্ধুদের। --- মৌসুমী ঘোষ।

ধারাবাহিক উপন্যাস

জয়াবতীর জয়যাত্রা
ষষ্ঠ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
 
উহহ পড়া আর পড়া। এরকম জানলে কে আসত চিকিচ্ছে শিখতে?   
 শুধু পড়ে বুঝি কবরেজ হয়? গাছপালা চিনতে হবে না? তারপর এটার সঙ্গে ওটা মেশানো, ঠিক ঠিক অনুপাত না হলে সব মাটি। সে উত্তর দিল না পুণ্যির কথার। মনে মনে বলল পরের জন্মে পুণ্যি যেন একটা শুখনো পুথি হয়ে জন্মায়। যে পুথি এত শুকনো, যে তা উইয়েও খাবে না।
কিন্তু এটা কী হল? ঠাকুরমশাই বদলে গেল কী করে? আর ছোট গোপালের বেশ বদল হবে কোত্থেকে? গোপাল কোথায়? জয়াবতী ভালো করে চেয়ে দেখল, গোপাল আছে, তবে এই গোপাল একটু বড়। আবার ফিসফিস করে বলতে গেল পুণ্যিকে। পুণ্যি এবার খুব রেগে গেল ‘তোর  মাতায় দেকচি বেম্মদত্যি ঢুকেচে, এত বাজে বকতেও পারিস, এটা সেই ঠাকুরমশাই নয়, কোনদিন বলবি আমি পুণ্যি নই, অন্য কেউ’
জয়াবতীর উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই জগোপিসি খ্যানখেনে গলায় বলে উঠল ‘মাগো মা, কী হেজলদাগড়া মেয়েমানুষ গো। কোতায় একটু ঠাকুর দেবতার নাম শুনবি, তা না কেবল বকবক, কালই দীনুকে বলব, এ দুটোকে ঘেঁটি ধরে নিজেদের গেরামে ফিরিয়ে দে আসতে’
ঠাকুমা ধমক না দিলে তখুনি একটা গোল বাধত। পুজোর পর গান হল। ঠাকুরমশাই আজ এক ছোঁড়াকে জুটিয়ে এনেছেন, দিব্যি গলা। ছোকরা গাইছিল
‘হরি হরায় নম কৃষ্ণ যাদবায় নম
যাদবায় মাধবায় কেশবায় নম’
জয়াবতী গানের মধ্যেই আবার পুণ্যিকে ফিসফিস করে বলল
‘এই পুণ্যি, হরি মানে কী জানিস তো? চুরি করি’
পুণ্যি কটমট করে ওর দিকে তাকাল। গানের পর মন্দিরের দরজা বন্ধ হয় খানিকক্ষণের জন্যে, রাধামাধব আর গোপালের বেশ বদলে শয়ান দেন ঠাকুরমশাই, তারপর তিনি বেরিয়ে এলে প্রণাম করার হুড়োমুড়ি লাগে। অন্যদিকে জগোপিসি প্রসাদ দিতে শুরু করে, সেটা অবশ্য বাইরের লোকদের। বাড়ির জন্যে এক গামলা প্রসাদ এই চিকের মধ্যে চলে আসে, সেটা ঠাকুমা সবার মধ্যে ভাগ করে দেন। পুণ্যি রাতের মতো খেয়ে নেয় বলে ঠাকুমা ওকে বসিয়ে যত্ন করে খাওয়ান, আবার রাতে এক পাথরের খোরা ভরতি দুধও পাঠান, পুণ্যি আপত্তি করলে বলেন ‘কচি রাঁড়ির অত নিয়ম মানতে নেই’
জয়াবতী দুখানা লুচি আর মোহনভোগ হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে খায়, সে এখন একপেট খেয়ে রাতের খাওয়া নষ্ট করতে চায় না। রাতেও অবশ্য লুচি, তার সঙ্গে কখনো হাঁসের ডিমের ডালনা, কখনো গাছপাঁঠার তরকারি। সেনখুড়িমার হাতের রান্না যেন অমৃত। এইসময় তার খাওয়ার দিকে বেশি মন থাকে না, চিকের আড়াল থেকে সে কেবলই  বাইরের লোকজন, তাদের আচার আচরণ দেখতে থাকে। সে দেখল ঠাকুরমশাই সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছেন, তাঁর পেছনে সেই ছোকরা, তার হাতে পুঁটুলি, অন্যদিন একটা থাকে, প্রসাদ আর ফল মূলের, আজ আরেকটা বেশি পুঁটলি কীসের? সে দেখল পুণ্যিকে ঠাকুমা একটা সুন্দর রেকাবিতে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন,  বেচারিকে খাওয়ার সময় ওঠানো উচিত নয়, সে তাড়াতাড়ি ঠাকুমাকে গিয়ে বলল ‘ও ঠাকমা, ঠাকুরমশাইকে আটকাতে হবে, খুব দরকার, যা হোক বলে আটকাও’
ঠাকুমা হকচকিয়ে গেলেও তক্ষুনি পবনকে ডাকলেন। পবন লেঠেল একদম মেয়েদের চিকের কাছটায় থাকে, যদি কোন গণ্ডগোল হয়, ঠেকাবে।
‘বলেন মাঠান’
পবন মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়ায়।
‘মুখপোড়া শিগগির যা, ঠাকুরমশাইকে বল, বউমার সাবিত্রী ব্রত উদযাপন নিয়ে কথা বলতে হবে, আমি ডেকেছি’
‘কী ব্রত মাঠান?’
‘তোকে অত কিচু ব্যাখ্যান দিতে পারব না, তুই যা আগে’
জয়াবতী দেখল পবন ছুটে গিয়ে ঠাকুমশাই আর তার সাগরেদের পথ আটকে দাঁড়াল, তাতে হকচকিয়ে গেল ওরা। ঠাকুমশাইয়ের চোখেমুখে একটু কি ভয় ফুটে উঠল? তিনি ফিরে দাঁড়ালেন, তখন সে দেখল ঠাকুরমশাইয়ের কাঁধের কাছে দাগটা তো দিব্যি আছে। ইসস । সে কি তবে ভুল করল? মানী লোককে এমন ভাবে...
অবাক আর খানিক রুষ্ট হলেও ঠাকুরমশাইকে আসতেই হল। কত্তামা ডেকেছেন বলে কথা, চিকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন কত্তামা, পেছন পেছন জয়াবতীও যাচ্ছে দেখে জগোপিসি বলল, ‘মাগো মা, মেয়েমানুষ চিকের বাইরে যাচ্ছে , ও বউমা, তুমি দীনুকে বলতে পারো না?’
জয়াবতী শান্ত স্বরে বলল ‘কবরেজি শাস্তরে মেয়েমানুষ পুরুষমানুষ কিচু হয় না, রোগের কাচে আবার এসব কী?’
সে গিয়ে বলে ‘ও ঠাকমা, সাবিত্তি ব্রতের কতা বলার আগে ওই ছোকরাকে দেকাতে বল ওর বাঁহাতের পুঁটুলিতে কী আছে?’
‘এ আবার কেমন কতা কত্তামা? আর এই মেয়েটিই বা কে? মেয়ে জেঠা কোতাকার? সেনমশাইকে বলে দেবেন আর পুজো করতে আসব না আমরা’
ঠাকমা থতমত খেয়ে যান। তিনি বলেন ‘মানিক আমার, তুমি ভেতরে যাও, মানী লোকের সঙ্গে এভাবে কতা বলে?’ জয়াবতী অবিচলিত গলায় বলে ‘ওর পুঁটলির মধ্যে অষ্টধাতুর গোপাল আছে ঠাকমা। তুমি দেকো মন্দিরে গিয়ে যে গোপাল পালটে গেছে’
ছোকরা তেরিয়া ভাবে বলে ‘এই দেকো, পচা ফুল পাতা পুকুরে ফেলব বলে নে যাচ্চি। উবগার করতে নেই মানুষের।’ সে পুঁটলি খুলে দেখায় সত্যি একরাশ বাসি ফুলপাতা।
তারপর যেই পুঁটলি বন্ধ করতে যায়, অমনি ঝাঁপিয়ে পড়ে জয়াবতী, পুঁটলির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে সে বার করে আনে ছোট্ট অষ্টধাতুর গোপাল!
তারপর? তারপর আর কী? জগোপিসির চিল চিৎকার, সব লোকের ছোটাছুটি, ছোকরাটির পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা, পবনের তার ওপর লাফিয়ে পড়া, একেবারে পালাগান যেন। ঠাকুরমশাই লজ্জায় মরে যাচ্ছিলেন একেবারে, বদ বুদ্ধিটা তাঁর এই অপোগণ্ড ভাগ্নের, কিন্তু তিনি জেনেবুঝেও চুপ করে ছিলেন যে।
জয়াবতী পরে পুণ্যিকে বলেছিল  ‘ঠাকুরমশাইকে আবার পুজোয় রাখাটা ঠিক হল না সেনমশাইয়ের। উনিই আসল পাণ্ডা।’
পুণ্যি  ওর দিকে কটমট করে না তাকালে সে আরও বকেই যেত। ( ক্রমশ )



রাজকুমারী আর পবিত্র জল               

কৃষ্ণা দাস 
(এক)    

ক্রমশ রাত ঘনিয়ে এল। কিশোরী রাজকুমারী জ্বরাগ্রস্থ বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর মাথা কোলে তুলে পরম মমতায় তার মাথায় জলপট্টি দিতে লাগল। সন্ন্যাসী ম্লান হেসে বলল “এবার আমার যাবার সময় হয়েছে বেটি, তুই মন প্রস্তুত কর”।

             পর্ণকুঠিরের বাইরে ঝড়ের আওয়াজকে ছিন্নভিন্ন করে রাজকুমারী আর্তনাদ করে উঠল “নাআ! তুমি আমাকে ছেড়ে কোথ্থাও যাবে না বাবা।”

            সন্ন্যাসী আবারও ম্লান হেসে বলল “জন্মালে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে”।

            “নাআআ, সন্ন্যাসী বাবা তুমি মরবে না, তুমি ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই, আমি যে একা হয়ে যাব এ পৃথিবীতে”।

            “ সে কথা বলারই সময় হয়েছে বেটি। এত দিন যে কথা বলিনি আজ তা বলব। তুই মন দিয়ে শোন”।

            গভীর অরণ্যে তখন ঝড়ের আওয়াজও যেন থেমে গেছে এমন নিঃস্তব্ধতা। রাজকুমারী আরো ঝুঁকে পড়ল সন্ন্যাসীর মুখের ওপর।

             সন্ন্যাসী বলে চলল, “ আজ থেকে পনের ষোল বছর আগে নানা দেশ ঘুরতে ঘুরতে যোগবলে এসে পড়ি অমরাবতী রাজ্যে। নির্জন দ্বীপের মধ্যে সে এক অপূর্ব সুন্দর রাজ্য। স্বর্গের অমরাবতীর মতই ফলে ফুলে হাসিখুশি আনন্দোজ্জ্বল এক দেশ। প্রজাদের মঙ্গলের জন্য সদা সচেষ্ট সে দেশের রাজা রাণী। আমি সে দেশে প্রবেশ করতেই তারা আমাকে পরম সমাদরে বরণ করে নিল। তাদের কোনো সন্তান ছিল না। এর জন্য মন কষ্ট ছিল তাদের।  তারা আমার কাছে মনবেদনা জানাল।  আমি তাদের আকুতিতে আমার সমস্ত শক্তি একত্রিত করে তাদের আশির্বাদ করি। যথাকালে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান জন্ম নিল। কিন্তু তার কিছু দিনের মধ্যেই ধেয়ে এল এক মরণ ব্যাধি। জ্বর কাশি শ্বাসকষ্টে লোকে মরতে লাগল দেশ জুড়ে। বদ্যির ঔষধ কাজে লাগল না। দেশ জুড়ে হাহাকার পড়ে গেল। শয়ে শয়ে মৃতদেহ চারিদিকে, সৎকারের কাউকে পাওয়া গেল না। ভয়ার্ত রাজা রাণী আমার স্মরণাপন্ন হল। আমি যোগবলে অনাগত ভবিষ্যৎ দেখতে পেলাম। তাদেরকে জানালাম  ভবিষ্যতের কথা প্রতিকারের কথা। সব শুনে তারা রাজি হল আমার কথায়। আমি শিশুকন্যাকে চাদরে মুড়ে কোলে তুলে নিলাম, আর রাজা রাণী এবং বাকি বেঁচে থাকা সমস্ত রাজ্যবাসীকে মন্ত্রপূত করে পাথর বানিয়ে দিলাম। কথা দিলাম এই শিশুকন্যাই বড় হয়ে আবার সবাইকে জীবন্ত করবে”।

          দীর্ঘ কথার শেষে সন্ন্যাসী থামল। রাজকুমারী এতক্ষণ শুনছিল মন দিয়ে, এবার বলে উঠল “সন্ন্যাসী বাবা আমিই সেই রাজকন্যা তাই না? বল আমাকে, কী ভাবে আমি তাদের বাঁচাব, শিগ্রি বলো, আমি যে আর তর সইতে পারছি না।“

           সন্ন্যাসী আবারও ম্লান হাসল। তার পর এক এক করে জানাল পরবর্তী কার্যক্রম।

(দুই)

           সন্ন্যাসীবাবার বর্ণনা মত বিশাল সমুদ্রের মধ্যে সেই দ্বীপের সন্ধান পেল রাজকুমারী।দেখল একটা নৌকা বাঁধা সমুদ্রের তটে।মাঝিদের সঙ্গে কথা হল।কোথায় যাবে শুনে তারা তাকে বোঝাতে লাগল ঐ দ্বীপে কেউ যায় না, কারণ গেলে মৃত্যু অবধারিত। ঐ দ্বীপে আছে করোনা রাক্ষস। তার ছোঁয়া লাগলে কেউ বাঁচে না। তাছাড়া বিশাল বিষনাগও আছে। তার হাত থেকে কেউ কখনো রেহাই পায় না।পুরুষের ছদ্মবেশে রাজকুমারী তাদের আশ্বস্ত করল তাকে কেউ মারতে পারবে না।সন্ন্যাসীবাবার দেওয়া স্বর্ণমুদ্রায় মাঝিদের রাজি করাল।উত্তাল সমুদ্রে নৌকা ভেসে পড়ল।

      দ্বীপটির কাছে গিয়ে রাজকুমারী নৌকাটিকে একটা বালুকাময় তীরে নোঙর করতে বলল। তীরে নেমেই দেখল সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে বিশাল খাঁড়া পাহাড়। সে দিকে তাকিয়ে রাজকুমারী চিন্তায় পড়ে গেল। এমন খাঁড়া পাহাড়ে সে উঠবে কী করে? আর উঠলেও খুঁজে পাবে তো মায়াবি সরোবর? আর তা না পেলে  যে সব হারাবে। সন্ন্যাসীবাবা দিনের আলোয় তাকে কাজ সেরে নীচে নেমে আসতে বলেছেন। এদিকে সকাল গড়িয়ে  দুপুর হয়ে এল। রাজকুমারী আর দেরী না করে  পুরুষ পোষাক গুটিয়ে হাঁটুর কাছ পর্যন্ত করে পাহাড়ে চড়তে থাকল। কাঁটা গাছের আঁচড়ে পা ছড়ে রক্ত ঝড়তে লাগল। রাজকুমারীর তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে প্রাণপণ শক্তিতে পাহাড়ের উপরে চড়তে লাগল। অবশেষে যখন উপরের শৃঙ্গে উঠল- দেখল এক অসাধারণ দৃশ্য।এক অপরূপ স্বচ্ছ নীল জলের সরোবর।এই সেই মায়াবি সরোবর, যার জলে আছে এমন খনিজ ও দৈব গুন যার স্পর্শে রোগ ব্যাধি দূর হয়, প্রাণ ফিরে আসে।সরোবরে অস্তগামী সূর্যের আলো এসে পড়েছে , কী তার অপূর্ব শোভা।সরোবরের চারিদিক অপূর্ব ফুলে ফলে ছাওয়া গাছ।ফুলের সুগন্ধে যেন স্বর্গ নেয়ে এসেছে।রাজকুমারী মোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকল সে দিকে।সন্ন্যাসী বাবা তাকে এই সরোবরের জল সংগ্রহ করতে বলেছিলেন। তখনই কোথা থেকে এক প্রকান্ড গোলা যেন একটা তার দিকে গড়িয়ে নামতে লাগল।এর কথাই সন্ন্যাসী বাবা বলেছিলেন তাহলে, এই সেই করোনা রাক্ষস? রাক্ষসটাকে দেখতে একটা বিশাল বলের মত।মধ্যে একটা রক্তাক্ত চক্ষু। সারা গায়ে সবুজ কাঁটা  বেরিয়ে। তার গা বেয়ে সবুজ লালা ঝরছে।থলথলে বিভৎস তাকে দেখতে। রাজকুমারী কাল বিলম্ব না করে সরোবর থেকে পিচকিরি দিয়ে জল তুলে নিল।তার পর এগিয়ে গেল রাক্ষসের দিকে। এই রাক্ষসের স্পর্শ নাকি সাংঘাতিক। সন্ন্যাসীবাবা বার বার বলেছেন ভুলেও ওকে যেন স্পর্শ না করে, করলেই মৃত্যু অবধারিত।এমন কী ওর ঘ্রাণও জীবনঘাতী। রাজকুমারী তাই মুখে নাকে আগে থেকেই কাপড় বেঁধে রেখেছিল। দূর থেকে রাজকুমারী পিচকারির জল ছিটিয়ে দিল করোনা রাক্ষসের গায়ে।যন্ত্রণায় রাক্ষসটা ছটফট করে লাফাতে লাগল। রাজকন্যা  খোলা তরবারি নিয়ে এক কোপে তখন রাক্ষসটাকে দু’টুকরো করে দিল।সঙ্গে সঙ্গে রাক্ষসটা শূন্যে লাফিয়ে মিলিয়ে গেল।রাজকুমারী সরোবরের জলে তরবারি ধুয়ে নিল।সন্ন্যাসীবাবার দেওয়া শক্তি না থাকলে রাক্ষসটাকে এভাবে এক কোপে বধ করা রাজকুমারীর পক্ষে কখনোই সম্ভব হত না । হঠাৎ নিজের গলার রুদ্রাক্ষের দিকে নজর পড়ল রাজকুমারীর। দেখল সেগুলো খয়েরি থেকে ধীরে ধীরে  সাদাটে হয়ে যাচ্ছে। এই রুদ্রাক্ষ সন্ন্যাসী বাবার দেওয়া রক্ষা কবচ । যতক্ষণ না সাদা হয় ততক্ষণ এই কবচ তাকে রক্ষা করবে। রাজকুমারী  পিচকারি খুলে ভরে নিল সরোবরের জল। তার পর দ্রুত নামতে লাগল সেই মায়াবি পাহাড় থেকে। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি বাকি নেই। দিনের আলো নিভলেই এই পাহাড় নাকি সমুদ্রের জলে ডুবে যাবে। রাজকুমারী প্রাণপণে নামতে লাগল ।কিন্ত তার পা ফসকে গেল। রাজকুমারী পড়ে যেতে লাগল নীচের কুয়াশা মাখা উপত্যকায়। রাজকুমারী বুঝল এ যাত্রায় সে আর বেঁচে ফিরবে না। নীচে পড়ে হাড়গোড় ভেঙে সে মারাই পড়বে। সাঁ সাঁ করে পড়ছে নীচে, বাতাসের ঘর্ষণের আওয়াজে কান তার ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। রাজকুমারী চোখ বন্ধ করে ফেলল।
            কিন্তু আশ্চর্য ! তার কিছুই হল না। সে যেন ভাসতে ভাসতে নেমে এল শেষটায়। এসে দা্ঁড়াল কুয়াশা মাখা উপত্যকায়। গলায় রুদ্রাক্ষর দিকে চোখ পড়তেই দেখল তা এইমাত্র সম্পূর্ণ সাদা হয়ে গেল। তার মানে সন্ন্যাসীবাবার দেওয়া এই মন্ত্রপূত রুদ্রাক্ষই তাকে পতন থেকে রক্ষা করল।
            রাজকন্যা ঠিক করল রাতটা কোনো গাছে কাটিয়ে সকালে সে খুঁজবে তার বাবা-মার রাজ্য শান্তিনগর। ছোট থেকে সন্ন্যাসী বাবা তাকে ছেলেদের মতই  গাছে চড়া, ঘোড়ায় চড়া, তরবারি চালানোর শিক্ষা দিয়েছিল । রাজকন্যা  সন্তর্পণে একটা গাছে উঠে বসল। পাখিরা বাসায় ফিরে তখন খুব কিচিরমিচির করছে। গাছে উঠে নিজের মাথার পাগড়ি খুলে গাছের সঙ্গে নিজেকে শক্ত করে বেঁধে নিল। এতে করে যদি ঘুমিয়েও পড়ে তবে গাছ থেকে নীচে পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকবে না। সারাদিনের ধকলে রাজকুমারী অচিরেই ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর রাতে তীব্র আলোয় ঘুম ভেঙে গেল রাজকুমারীর। নীচে তাকিয়ে দেখল এক বিশাল  সাপ  গভীর জঙ্গল থেকে এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসছে। এই তাহলে সেই বিষনাগ।রাজকুমারী দেখল সাপটার মাথার ঠিক মাঝখানে এক বিশাল মণি। সেই মণির এতই তেজ যে তার আলোয় পুরো জঙ্গল আলোয় আলো।সাপটা  নিজের মাথার মণিটাকে খুলে রাখল কাছের এক সরোবরের পাড়ে। তার ঊজ্জ্বল আলোয় পুরো বন আলোকিত‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍ হয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে সাপটিকে আর দেখা গেল না। রাজকুমারী দ্রুত গাছ থেকে নেমে এল। তার মাথায় এক বুদ্ধি এল।সে পাতায় করে কিছু সরোবরের পাড়ের নরম মাটি তুলে নিয়ে মণিটার কাছে গেল। নিজের তরবারি মণিটার পাশে মাটিতে গে্ঁথে রেখে মণিটা  মাটি চাপা দিয়ে দিল।সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল। রাজকুমারী দ্রুত পাশের গাছের মগডালে চড়ে বসল। চারদিক অন্ধকার হয়ে যেতেই সাপটা সাঁ সাঁ করে ছুটে এল মণির কাছে।তরবারিটাকেই শত্রু ভেবে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরল। ফল হল সাংঘাতিক, নিজেকে নিজেই ফালা ফালা করে কেটে মৃত্যুবরণ করল সাপটা। ঠিক এটাই চেয়েছিল রাজকুমারী। নেমে এল গাছ থেকে। মণিটা হাতে তুলে নিল। সরোবরের জলে মাটি ধুতে নামল। আশ্চর্য মণিটা জলে ডোবাতেই জল শুকিয়ে যেতে লাগল ক্রমশঃ, আর দেখা গেল জলের নীচে একটার পর একটা সিঁড়ি নেমে গেছে। রাজকুমারীর কৌতূহলী হল।সে মণি নিয়ে একটু একটু করে নিচে নামতে লাগল।শেষ পর্যন্ত সব জল শুকিয়ে গেলে শেষ সিঁড়ির শেষের ধাপে দেখল একটা সোনার বিশাল দরজা। রাজকুমারী সে দরজায় হাত দিতে না দিতেই তা নিঃশব্দে  নিজেই খুলে গেল। রাজকুমারী প্রবেশ করল সে দরজার ওপারে।  আশ্চর্যজনক ভাবে ওপারটা অপূর্ব সুন্দর। গাছে গাছে ফুল ফল পাখি। পাখির কলতানে প্রজাপতির  ওড়াউড়িতে অসাধারণ মন ভালো করা পরিবেশ। কিন্তু কোনো মানুষজন চোখে পড়ল না। শুধু একাধিক পাথরের মূর্তি এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তারা যেন কাজ করতে করতে, কথা বলতে বলতে, পথ চলতে চলতে হঠাৎই পাথর হয়ে গেছে।রাজকুমারী বুঝল এটাই সেই শান্তিনগর। সে উত্তেজনায় রাজপ্রাসাদের খোঁজে  ছুটল।কিছু দূরে যেতেই দেখল বিশাল রাজপ্রাসাদ। দ্রুত রাজপ্রাসাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল রাজকুমারী।ওপরে উঠে দেখল রাজা রানির পাথরের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে হাত জোড় করে। যেন এই মাত্র কাউকে তারা প্রণাম করল। অপূর্ব সুন্দর সে মূর্তি দুটো। রাজকুমারী অবাক হয়ে দেখল ।রানীর মুখ যেন অবিকল তারই মত। এই তবে তার মা বাবা! আবেগে কেঁদে ফেলল রাজকুমারী।বুকের ভেতর আনন্দ আর কষ্টের সুনামি শুরু হল। কিন্তু না, আর দেরী নয়, এখন তার অনেক কাজ।এখনই পিচকারির পবিত্র জল এদের সবার ওপর ছিটিয়ে জীবন ফিরিয়ে দিতে হবে। তার পর ছুটে যেতে হবে সন্ন্যাসীবাবার কাছে, অন্ততঃ শেষ নিঃশ্বাসটুকু যেন তিনি তার কোলেই নিতে পারেন। রাজকুমারী ভেজা চোখ হাতের উল্টো পিঠে মুছে পিচকিরিতে হাত রাখল। 



রূপকথা

তনুজা চক্রবর্তী

সুর ভাঁজে উড়ে উড়ে খুঁজে ফেরে কলি 
কোন মুখে ওদেরকে চলে যেতে বলি!

ডালে ডালে ফুলেফুলে চেনা মিঠে সুর,
আশাবরী মালকোষ রাগে ভরপুর।

শিশু মন ভয়ে কাঁপে ওড়াওড়ি দেখে, 
পড়ে যায় সব ফুল রোজ সাজি থেকে। 

কেন ওরা বুঝবেনা, শুনবেনা কথা ? 
 চায় শুধু মধু খাক রেখে নীরবতা।

গুনগুন শুনলেই খালি মনে হয় ,
 ফুল গুলো অলিদের আর কারো নয়!

 দোষ বাপু ফুলেদের করে তারা ভুল,
বলে দিক কাল থেকে ফুটবেনা ফুল ।

ছোটোদের আবদার মজা লাগে ভারি,
অলিদের সাথে যেন চিরকাল আড়ি !

নিয়মের যাঁতাকলে বড়ো জটিলতা, 
কল্পনা গড়ে নেয় নানা রূপকথা।

মাল্টিভার্স

প্রবাহনীল দাস
সপ্তম শ্রেণি, বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতন
পশ্চিম মেদিনীপুর

যেমন করে সবাই করি সকল রকম কাজ
কেমন হত, তেমন যদি না করতাম আজ?
কেমন হত দুনিয়াটা? একটু আগে ভাবো,
তারপরে তো তোমায় নিয়েই সেই দুনিয়ায় যাবো।

জল ফুরোলে নারকেলটার, নদীর ধারে গিয়ে
চিরটাকাল মানুষ তাতেই জল আসতো নিয়ে।
নোংরা হলে হয় নারকেল ছুঁড়েই দিত ফেলে,
নয়তো সেটা ঘষতো চেপে, বোটলব্রাশের ফুলে।

কলাপাতার মশারিতে হয়ত শুতো রাতে,
গাঁদা পাতায় কাজ চালাত, কঠিন কোন ঘা-তে।
হয়তো মাথায় কুমড়ো পরেই বলত তাকে ছাতা,
আর কত কী পারত হতে, ভেবেই ঘোরে মাথা।

নিম পাতাতেই হয়তো ধুত মুখের সকল ব্রণ।
সত্যি যদি এইরকমই দুনিয়া থাকে কোন,
স্পেস-টাইমকে টপকে যাবো চড়ে ‘আকাশভ্যান’
সঙ্গে যাবেন ডক্টর স্ট্রেঞ্জ, আর স্পাইডারমান।




স্মরণীয়
(কবি তরু দত্ত)

কলমে - পীযূষ প্রতিহার

১৮৫৬ সালের ৪মার্চ উত্তর কলকাতার রামবাগানের দত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তরু দত্ত। তাঁর পরিবার খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত ছিল। দিদি অরু দত্তের সঙ্গে তরু দত্তকে তাঁদের বাবা উন্নত শিক্ষা ও রুচি  লাভের জন্য ১৮৬৯ সালে ইউরোপে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল দক্ষিণ ফ্রান্সের একটি আবাসিক স্কুলে। এক বছর ফ্রান্সে থেকে ইংল্যান্ড চলে আসেন তিনি। মাঝে কিছুদিন ইটালি ও জার্মানিতেও ছিলেন। ১৮৭১-৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি কেমব্রিজে কাটান এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হায়ার লেকচারস ফর উইমেন এ যোগ দেন। মাত্র আঠেরো বছর বয়সে তরু দত্তর প্রথম লেখা বের হয় বেঙ্গল ম্যাগাজিনে ফরাসি কবি Leconte de Lisle কে নিয়ে একটি প্রতিবেদন। দ্বিতীয় লেখাটি ছিল আর এক ফরাসি কবি Josephin Soulary কে নিয়ে। সঙ্গে এই কবিদের কিছু ফরাসি কবিতার ইংরেজি অনুবাদও ছিল। এর পরেই দিদি অরু দত্তের সঙ্গে যৌথভাবে ১৮৭৩ সালে বিশিষ্ট কয়েকজন ফরাসি কবির কবিতার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। ১৬৫টি কবিতা তরু অনুবাদ করেছেন এবং অরু ছবি এঁকেছেন, অরু নিজে অনুবাদ করেছেন ৮টি।  এই গ্রন্থটি ভারতের সাহিত্যে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৮৭৩এ তাঁর বাবা গোবিন্দচন্দ্রের উৎসাহে  সংকলনটি A Sheaf Gleaned in French Field(ফরাসি ক্ষেতে কুড়ানো এক আঁটি ফসল) নামে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটি তাঁর প্রকৃতি প্রেমের নিদর্শন। বইটি তাঁর বাবা ১৮৭৬ এ তিনি তখন রোগশয্যায় তখন প্রকাশ করেন। এছাড়াও দুটি উপন্যাস তিনি লিখেছিলেন 'শ্রীমতি দ্যারভারের দিনপঞ্জি' এবং 'বিয়াঙ্কা-এক তরুণী স্প্যানিশ পরিচারিকার কাহিনী' । 'শ্রীমতি দ্যারভারের দিনপঞ্জি'(Le Journal de Mademoiselle d'Arvers) হল ভারতীয় লেখকের প্রথম ফরাসি ভাষার উপন্যাস। আর 'বিয়াঙ্কা-এক স্প্যানিশ পরিচারিকার কাহিনী'(Bianca or The Young Spanish Maiden) ইংরেজি ভাষায় প্রথম ভারতীয় নারীর লেখা উপন্যাস। এছাড়াও ইংরেজিতে কিছু ছোট ছোট মৌলিক কবিতা তিনি লিখেছিলেন। এছাড়াও আর একটি কবিতা সংকলনAncient Ballads and Legends of Hindustan তাঁর বাবা খুঁজে পেয়েছিলেন তরুর মৃত্যুর পর, যেটি ১৮৮২সালে কিগান পল প্রকাশ করেছিলেন লন্ডন থেকে। ভারতীয় সনাতন কাহিনী নির্ভর এইসব কবিতাগুলো তাঁর ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি টান প্রকাশ করে। এই কবিতাগুলোর মধ্যে Our Casuarina Tree বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করে। 
   অত্যন্ত প্রতিভাবান এই কবি মাত্র ২১বছর বয়সে ৩০ শে আগষ্ট ১৮৭৭সালে মারা যান।


ধারাবাহিক ভ্রমণ
চলো যাই
কলমে - বাসবদত্তা কদম

পর্ব ৩
ভেদানথাঙ্গল পখিরালয়ের কথা বলার আগে বলি শোনো চেন্নাই গিয়ে পাখির নেশা আমাকে কিভাবে আবার পেয়ে বসলো। আবার বলছি এই জন্য, সেই ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে পাখি দেখতে যেতাম, সে তো আমি আগেই বলেছি। সেই নেশাটা বিভিন্ন কাজের চাপে কখন যেন একটু ঢিলে হয়ে গেছিল। কিন্তু একটা অদ্ভুত ঘটনা আমাকে আবার ওদের অনেকটা কাছে নিয়ে এল।  
প্রদীপ জ্বালবার আগে সলতে পাকাতে হয় তো, এটা সেই সলতে পাকানোর কথা। 
-পাখি দেখতে সলতে কি হবে? 
-শোনো, শুনেই দেখ, পাখি আর সলতে কিভাবে জড়িয়েছে।
চেন্নাইতে গিয়ে যে বাড়িতে থাকতে শুরু করলাম; সব বাড়ির মত তার ঘর, বারান্দা, রান্নাঘর, বাথরুম এমনকি একখানা ছাদ তাও আছে। কিন্তু যা আমায় খুব টানল, তা হোল- বাড়ি দেখতে গিয়ে দেখে ফেলা একখানা জঙ্গল, মাঠ, পুকুর। 
বাড়ি দেখতে গিয়ে সে বাড়ির পিছনের বারান্দায় গিয়ে দেখি, একখানা আগোছালো বাগান আর পুকুর। মাঝখানে একখানা পাঁচিল, এ বাড়ি থেকে ঐ জমিটাকে আলাদা করেছে। সে জমির এক ধারে একখানা বটগাছ তার ঝুরিগুলো হাওয়ায় দোল দিচ্ছে। সেই গাছের ডালে দুখানা সারস। কয়েকখানা হাঁস, প্রচুর কাঠবেড়ালি। ভাবা যায় নাকি, হাতের নাগালে এমন পাখিদের আস্তানা!  
এমন বাড়ি ভাড়া না নেবার কোনো মানেই হয় না। বাড়িওলা ভাবছেন তার বাড়িখানা আমার বেজায় পছন্দ হয়েছে। পছন্দ তো পিছনের এলোমেলো বাগানখানা। সেকথা বললে যদি ভাড়াটিয়া নাকচ হয়, তাই বেমালুম চেপে গেলাম সেকথা। তারপর থেকে রোজ সকালে উঠে আমার প্রথম কাজ হলো, পুকুর আর গাছগুলো খোঁজা। নতুন কী কী পাখি দেখতে পাই! শুধু কি সকাল, যখন তখন। মানে যখন সময় পাই তখনই। 
সারস আসে, সঙ্গে দু-একটা হাঁস; আমাদের সবসময় দেখা কাক, শালিক মাছরাঙা, কাঠঠোকরা আর কাঠবেড়ালি এরা তো আছেই। 
এরপর একদিন এক নিঃঝুম দুপুরে দেখি পুকুরের জলের ওপর দোল খাচ্ছে এক পাখি। ঠিক যেন একখানা তার বাঁধা আছে, তাতেই দোল খাচ্ছে সে। দোল খেতে খেতে হটাৎ ঝুপুস। আমি বুঝতেই পারিনি এই সেই সাদা মাছরাঙা। আরেকখানি সুন্দর নাম আছে তার ‘মুক্ত বিহঙ্গ’। অনেক রঙে রাঙা মাছরাঙা আমরা সবাই দেখেছি কিন্তু একে দেখা যায় একটু কম। পুকুরপাড়ে একটা গাছের ডালে বসে সাধনায় মগ্ন থাকে সে। আমি ওকে দেখতে, গ্রিলের মধ্যে দিয়ে গলাটা বাড়াবার চেষ্টা করছি যেই, অমনি ফুড়ুৎ! তারপর ওর বোধহয় একটু মায়া হলো। কয়েকবার এসে দেখা দিয়ে গেল আমাকে। 
কালো সাদা ছাপ মাছরাঙা কম দেখা গেলেও, একেবারেই দেখা যায় না তা কিন্তু নয়; বিশেষত আমাদের দেশ, নেপাল, চীন, এবং এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন অংশে ও আফ্রিকা মহাদেশে এই সাদা কালো ছোপ মাছরাঙার দেখা পাওয়া যায়। 
মাছরাঙা অনেক প্রকারের। বিভিন্ন তাদের নাম। বাঙলায় সবাই মাছরাঙা। ইংরেজিতে Kingfisher। ছোট লেজ, ছোট পা, ছোট শরীর আর বিশাল দুই ঠোঁটের এই বর্গের পাখি পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশে পাওয়া যায়। অতি ঠান্ডার দেশ আলাস্কাতেও এরা আছে। রঙ আর চেহারার  পার্থক্য ধরে খুঁজলে পৃথিবীতে ৯০ টির বেশি প্রজাতি পাওয়া যাবে। 
এরা কিন্তু পরিযায়ী নয়। নিজের এলাকার বাইরে খুব বেশি দূর যায় না এরা। খাবারের লোভে আর প্রয়োজনে, কাছাকাছি অঞ্চলের মধ্যে স্থান পরিবর্তন করে। তাই এদের ঠিক পরিযায়ী পাখি বলা যায় না। তবে অতি শীতে খাবার না পেলে খানিক বাসস্থানের পরিবর্তন ঘটায়। এদের সব চেয়ে প্রিয় খাদ্য মাছ। তবে জলের পোকা, ব্যাঙাচি এসবও চলে। সব ধরনের মাছরাঙার যে সব বৈশিষ্টগুলো প্রায় এক, তা হোল (ক্রমশঃ)


আরও পড়ুন 


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments