জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা /বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

গুচ্ছ কবিতা
বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়


দর্পণ                                 

শাহেনশাহ আকবর,
সুধীজন কন,তিনি একজন মহান দণ্ডধর।
সুবায় সুবায়,সভার সবাই ঘুরতেন মাঝে মাঝে,
প্রজাদের পাশে দাঁড়াবার আশে তাদের সকল কাজে।।

কোনো একবার,রাজসভা তাঁর,মধ্যপ্রদেশে এলো,
সে গ্রামের সব চিত্রকরেরা ফরমায়েশ এক পেলো।
শাহ আকবরের হাল আমলের চিত্র আঁকবে যে-
লাখ আশরফি বাদশাহ হতে বখশিশ পাবে সে।।

ব্রাহ্মণ চাষি মহেশ দাসের বাস ছিল সেই গ্রামে,
তীক্ষ্ণ বুদ্ধি,অতি অমায়িক, সকলে চিনত নামে।
অবস্থা দীন, ছিল বহু ঋণ,প্রায় অচল সংসার,
এই ঘোষণায় দেখা পান তাই এতটুকু ভরসার।।

************

মূল্যায়নের দিন যবে এলো,চারিদিকে শোরগোল,
বাদশা তক্তে, বসলেন এসে,থেমে গেলো কলরোল।
চিত্রকরেরা এসেছেন সবে, বাদশার ছবি নিয়ে,
ছবিগুলি সব আবৃত আছে দামি কিংখাব দিয়ে।।

শিল্পীরা সবে অকুলিত- ভাবে, ফল পাবে কি না পাবে-
কার তকদিরে লাখ আশরফি,সেটাই সকলে ভাবে।
'ইজাজত' রবে,একে একে সবে,বাদশা সকাশে যান,
সন্তর্পণে, অতি সযতনে,চিত্র খুলে দেখান।।

কোনো চিত্রই হল না কিন্তু,বাদশার মনঃপুত,
কারণ, এদের সবগুলি ছিল,ইদানীং কালচ্যুত।
একে একে সব চিত্রকরেরা সভা ত্যাগ করে যায়,
কারো তকদিরে লাখ আশরফি,অবশ্য লেখা নাই।।

'সভা শেষ হল', ঘোষক হাঁকলো, 'বন্ধ সভার দ্বার',
এমনই সময় সভাদ্বারে এসে, কারা করে তকরার?
বাদশা দেখেন,সভাদ্বারে এক সুপুরুষ মুসাফির,
 দ্বার রক্ষক রেগে তাকে বলে,'কেন কর তকসির'?

তার হাতে আছে, কিংখাবে মোড়া, চিত্র বুঝি বা হবে।
বাদশা ডাকলে, সেই মুসাফিরে,অবাক মানলো সবে।
বাদশা আদেশে, বাদশা সকাশে,গেল নবাগত জন,
বলেন বাদশা,'কি এনেছ তুমি? করাও তো দর্শন'!

মুখে মৃদু হাসি,নবাগত জন,ধীরে খোলে আবরণ,
অতি কুতুহলে, দেখলো সকলে,আছে এক দর্পণ।
সকলে অবাক,মুখে নাই বাক,এটা কিরকম চিত্র?
'চিত্র তো নয়! আরশিই হয়-এ কি তোমার চরিত্র'?

সে চিত্রকর, মহেশজি কয়, 'আমি নই বেয়াদব,
এটা সহবত,এটা শালীনতা, এটাই আদত আদব।
এটা বাদশারই ইরাদায় ছিল,হাল আমলের চিত্র,
যখনই ইচ্ছা,দেখবেন তিনি,এটা তাঁর চিরমিত্র'।।

বাদশা দাঁড়ায়ে, মহেশে জড়ায়ে,নিলেন আলিঙ্গনে
লাখ আশরফি ইনাম দিলেন-মিত্র সম্ভাষনে।
'আজ হতে তুমি আমার একজন সভাসদ হয়ে যাবে,
'মম অঙ্গুরি নাও,এর বলে সভায় আসতে পাবে'।।


                       ভেলকি ( ছড়া )


রোজ দেখি ওরে, 
বাগানেতে ঘোরে, 
অতিকায় এক গিরগিটি;

আমি দেখি তারে, 
সে দেখে আমারে, 
দুই চোখে চেয়ে মিটিমিটি ।

পাছে ভুলে যাই ,
ছবি নিতে তাই , 
যেই না খুলেছি খিড়কিটি,

দেখা তো না পাই, 
কোথায় লুকায় ,
ঠিক যেন এক ভেলকিটি ।


           কার দোষ


আমি যে পরম ভক্ত,
মাঝে মাঝে আমি চোখ বুজে থাকি,
তখন করোনা না যেন ডাকাডাকি,
বিভুর প্রেমের ছল নিয়ে থাকি,
বিত্তের অনুরক্ত,
মাথায় তখন ঘোরাফেরা করে-
ফন্দি দুরূহ শক্ত।।

আবেগে কখনও চোখে আনি জল,
তোমরা কি ভাবো এটা মিছে ছল?
ছলা কলা আমি শিখিনি কখনও,
নয় অনুচিত জীবন যাপন ও,
লক্ষ্য আমার ধন উপার্জন ও,,
এ কারণে এতো ছল,
তোমরা আমার শিষ্য, সেবক,
তোমরা আমার বল।।

অনেক অনুগামী আমার ঘরেতে ,
আসা যাওয়া করে নিত্য,
তারাই  আমার পূজক, অনুগ,
সেবক  এবং ভৃত্য:
আমার  যতেক লিপ্সা,বাসনা,
প্রত্যাশা , সাধ,মনস্কামনা -
তারাই মেটায় হয়ে একমনা,
তৃপ্ত আমার চিত্ত,
আমার কপট আশিসে তারাও 
হয় না কি পরিতৃপ্ত ?

অবিশ্বাসীরা ডেকে হেঁকে বলে--
আমি যে মহা পাষন্ড,
ভাবি নাকি শুধু নিজের স্বার্থ,
খুঁজি না কখনও কি পরমার্থ,
অর্থ এবং স্বার্থে বিভোর,
মহা ধড়িবাজ ভন্ড,
এরাই আমার যতো পরিকল্পনা -
করে যে লন্ডভন্ড ।।

ছয়তলা বাড়ি হাঁকিয়েছি আমি ?
সেতো তোমাদেরই জন্যে,
নইলে সবকে রাখবো কোথায়,
ভেবে ভেবে হতাম হন্যে,
নিন্দুক ওরা কুৎসা রটায়,
ওদের কথায় কান দিতে নাই,
ব্যবসিত আমি নই জেনো ভাই,
টাকা কড়ি আর পণ্যে।।

ভক্তি পুরিত আমাদের দেশ,
মহান ভারতবর্ষ,
জনমিত হেথা অনেক সাধক
জগতে তাঁরা আদর্শ,
মানব প্রেমেতে অবিচল মতি,
দূর করেছেন শত দুর্গতি,
ভারতবর্ষে এনেছেন তাঁরা -
আনন্দ,প্রেম,হর্ষ ।।

এই সব মহাপুরুষের মাঝে --
 আমার তো স্থান নেই
নিন্দিত আমি বর্জিত আমি,
দুষ্ট, ভ্রষ্ট ভাই,
আমি বুঝি শুধু আমারই স্বার্থ,
অর্থ আমার যে পরমার্থ,
তবুও আমার অভিনয় গুণে,
অনেক শিষ্য পাই,
আমারই কি তবে সব দোষ,আর
তোমাদের দোষ নাই ?



জীবন-মরণ 

সেদিনের কথা /ভেবেছো কি মনে, /যেদিন আর তুমি/ থাকবে না ?
টাকা কড়ি আর/ ঘর সংসার/সাথে নিয়ে যেতে/ পারবে না,
দারা ও তনয়া,/ সুত, নন্দন,
মিত্র,স্বজন,/সাথি,পরিজন,
সকলেই রবে/অতীব নীরবে/কেউ আর তোমায়/ ডাকবে না,
প্রাণহীন দেহ/ সেতো শুধু শব /কেউই ঘরেতে /রাখবে না ।

সে দিনের কথা ভাবতে গেলেই মনেতে আসে যে দারুণ ভয়,
ভাবলে মরণ-রোমহর্ষণ ভয়াতুর মন ব্যাকুল হয়,
আছে কি তোমার সেই সঞ্চয় 
যেটা দেখে ভয় মানে পরাজয়?
আছে কি শেষের সেই সম্বল যা দেবে সাহস এবং জয়?
ভাঙা ফুটো তরী ,ভয়াল লহরী যুদ্ধ শেষের এ পরাজয় ।

অবনত হয়ে ডাকো মুর্শেদে শঙ্কা হরণ মন্ত্র পাও,
মানব সেবায় নিয়োজিত থেকে ত্যাগের স্তুতিতে দীক্ষা নাও,
স্বার্থ চিন্তা করো তুমি ত্যাগ,
জীবের সেবায় আনো অনুরাগ,
সুফি সাধকের মারফতি গেয়ে মন হতে ত্রাস বিষ তাড়াও, 
জীবন তো ছোটে মরণেরই পানে তবে মিছে কেন মায়া বাড়াও ?


গান কেন ভালোবাসি

ছন্দোবদ্ধ/ সরস, স্নিগ্ধ/পদ গুলি যদি/ হয়,
সে সকল পদ/নন্দাস্পদ/কবিতা তাদের/ কয়,
সকলের মনে আনন্দ দেয়,
দুঃখ ভাবনা দূরে টেনে নেয়,
কবিতা পঠনে/সকলেরই মনে/সুখের উদয়/ হয়।।

গানেদের কাছে/আরও বেশি আছে/কবিতায় যেটা নাই,
শুনে সুর তান/ভরে মন প্রাণ/প্রশান্তি মনে পাই,
সংগীত সুর বড়ো সুমধুর,
সন্তাপ জ্বালা হয়ে যায় দূর,
মন চলে যায় দেবপুর, যেথা সুধারস পাওয়া যায় । ।।

যখন বিশ্ব/অতীব নিঃস্ব/মরুভূমি হয়ে রয়,
যখন মরণ বরণ করাটা শ্রেয় বলে মনে হয়,
তখন আসে গান,ভরে মন প্রাণ,
ক্লিষ্টকে  করে সান্ত্বনা দান,
মৃত শ্মশান /হয় ফুলের উদ্যান/প্রস্থিত হয় ভয়।।

গানকে করো গো সুজন বন্ধু গানেতে শান্তি পাও,
গানের জগতে/হয়ে একমতে/ বসত তুমি বানাও,
কত আনন্দ বুঝবে তখন,
স্বর্গীয় গান শুনবে যখন,
স্বপনে শয়নে/সাশ্রু নয়নে/ভালোবেসে গান গাও।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments