জ্বলদর্চি

এশিয়া (কাজাকস্তান)-র লোকগল্প /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—৭৮

এশিয়া (কাজাকস্তান)


চিন্ময় দাশ

বুড়ো মানুষের পরামর্শ

সে অনেক অনেক কাল আগে ঘটেছিল ঘটনাটা। কত কাল আগে, হিসেব করে বলা  যাবে না সে কথা। তখন ভেড়ার গায়ের লোম ছিল ঘন খয়েরী। কিংবা ধরো, ছোট্ট যে তিতির পাখি, তাদের পালক ছিল লাল রঙের। আর, পাখিগুলো চেহারায় ছোট হলে কী হবে, তাদের লেজ ছিল ইয়াব্বড় লম্বা। আরও বলি, হাতিদের যে লম্বা শুঁড়, আসলে যেটা কি না তাদের নাক, সেটা তখন ছিলই না। 
এমনই সময়কালের ঘটনা এটা। এখন যেমন বেশ কিছু যুবক ছেলেকে দেখা যায়, যেমন আলসে, তেমনি বাউন্ডুলে। সারাটা দিন টো-টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোন কাজেকর্মে মন নাই। উদ্যোগ নাই নিজে কিছু করবার। একটাই স্বভাব—সব সময় হা-হুতাশ করা, আর কপাল চাপড়ানো। সেই সাথে ভাগ্যকে দোষ দেওয়া-- আমার এটা নাই কেন? আমার ওটা নাই কেন? 
চোখ মেলে তাকালেই, দেখা যায় এমন সব যুবকদের।
ঠিক এমনই একজন যুবকের কথা এটা। একদিন ঘুরে বেড়াচ্ছিল ছেলেটা। একেবারে উদ্দেশ্যহীনভাবে। পথ হাঁটছে, আর নিজের মনেই বিধাতা পুরুষকে গাল দিয়ে চলেছে—বুঝলে ঠাকুর, তুমিই হলে যত নষ্টের গোড়া। দুনিয়ায় আনলে যখন, হাতে কিছু টাকা-পয়সা গুঁজে দিতে তো পারতে! তা না, একেবারে শূণ্য হাতে ঠেলে দিলে আমাকে। টাকা থাকলে, কত আরামে দিন কাটাতে পারতাম। আর এখন? পেটে খিদে, ঘরে একটা দানা নাই। এই কনকনে ঠাণ্ডার দেশ, গায়ে শীতের পোষাক নাই। ভালো একটা টুপি নাই যে, মাথাটা ঢাকব ভালো করে। কী দিয়ে পাঠিয়েছ আমাকে? কী আছে আমার?
এইসব ভাবতে ভাবতে একটা গাছের তলায় এসে বসে পড়ল, একটু জিরিয়ে নেবে বলে। একটু তন্দ্রাও এসে গেল চোখে।
--কীগো ছেলে, অমন করে একলাটি বসে কেন এখানে? কার যেন গলা কানে যেতে, চোখ মেলে দেখে, একেবারে সামনেটিতেই এক বুড়ো মানুষ।
বুড়ো আবার বলল—তা, মুখখানি এমন শুকনো কেন, বাছা? 
অচেনা মানুষ হলেও, গলাটা বেশ অমায়িক। শুনে ভালোই লাগল ছেলেটার। শোনাবার মত একজন কাউকে পাওয়া গেছে, গড় গড় করে মনের সব খেদ উগরে দিল বুড়োর কাছে।
বাধা দিল না। আপত্তি করল না। চুপ চাপ সব কথা শুনে গেল বুড়ো। 
ছেলেটার মুখ বন্ধ হোল যখন, বুড়ো বলল—এত হতাশা কেন মনে? হতাশা নিয়ে বাঁচা যায় না কি? আশা রাখতে হয়, উদ্যম থাকতে হয়, তবেই না জীবন!
যেমন বিরক্ত হোল ছেলেটা, মনে রাগও হোল  খুব—ছাড়ো তোমার জ্ঞানের কথা। আছেটা কী আমার? আসবে কোথা থেকে উদ্যম? কিছু উদ্যম দেবে তুমি আমাকে? ঠিক আছে, এমনি না দাও, ধার হিসেবেই দাও না হয়। শোধ দিয়ে দেব সময় মত। কথা দিলাম। 
ছেলেটা তাকে ব্যঙ্গ করছে বুঝেও, রাগ করল না বুড়ো। হাসি মুখ করেই বলল—ধার চাইবার তো কারণই নাই তোমার। অঢেল সম্পদ রয়েছে তোমার নিজেরই। বুঝতে পারো না তুমি। 
--অঢেল সম্পদ? আমার নিজেরই আছে? বলছো কী তুমি? ছেলেটা যেন আকাশ থেকে পড়েছে। 
বুড়োর মুখে আবারও হাসি। হাসি মুখেই বলল—না, মানে, চাইলেই, সম্পদ তুমি পেতে পারো। এখনই। 
ছেলেটা বলল—চাইলে দেবেটা কে? তুমি না কি?
বুড়োর মুখের হাসি তখন বেশ রহস্যময়। বলল—হ্যাঁ, আমিও দিতে পারি। অনেক সম্পদ। তার বদলে তুমি সামান্য কিছু দেবে আমাকে।
ছেলেটা বল—আমার আছেটা কী, যে দেব তোমাকে? ঠিক আছে, থাকলে দেব তোমাকে। বলো, কী চাও।
বুড়ো বলল—এই যে এত সুন্দর সুঠাম শরীরখানা তোমার। কত কিছুই তো আছে এতেই। ঠিক আছে। বড় কিছু, বা বেশী কিছু নয়। ছোট্ট একটা জিনিষ চাইছি। তোমার চোখ দুটো দাও আমাকে। পিঠে থলেটা দেখতে পাচ্ছো আমার। মোহরে ঠাসা ভর্তি। বয়েস হয়েছে। চোখে আর দেখি না ভালো। দেখতেই যদি না পেলাম, মোহর দিয়ে করবটা কী? তোমার মত কম বয়েসীর একজোড়া চোখ পেলে,আবার ভালো করে দেখতে পাবো আমি। কত কিছু আছে এই দুনিয়ায়। কত কিছু দেখেশুনে করতে পারবো আবার। 
একটু থেমে বুড়ো বলল—মোহর ভরা পুরো থলেটাই নাও আমার। ছোট্ট চোখ দুটো দাও আমাকে কেবল। 
বেদম ভড়কে গেছে ছেলেটা। অবাক গলায় বলল—বলছোটা কী তুমি? পাগল হয়ে গেছ না কি? না কি আমাকেই পাগল ভেবে বসে আছো? চোখ গেলে, আমি বাঁচবো কী করে?
বুড়ো বলল—যে চোখ দিয়ে দেখোই না ভালো করে দুনিয়াটাকে, সে চোখ থেকে কাজই বা কী জীবনে? 
ছেলেটা বলল—না, বাপু। সে তুমি যাই বলো, চোখ আমি দেব না।
--ঠিক আছে, চোখ দিতে হবে না। মাথার ভিতরে যে ঘিলু আছে, পুরোটা না দাও, কিছুটা দাও আমাকে। তার ব্দলে পুরো থলিই পেয়ে যাবে।
ছেলেটা উত্তেজিত হয়ে বলল—বলছোটা কী? মগজ আবার কেউ বেচে না কি?
--কী হবে সারা জীবন একটা ফালতু জিনিষ বয়ে বেড়িয়ে? মগজ তো তুমি কাজে লাগাওই না। 
ছেলেটা বলল—সে যাই হোক। মগজ আমি দিতে পারব না। 
--ঠিক আছে, তাহলে পা দুটো দাও তোমার। বয়সের ভারে অকেজো হয়ে এসেছে আমার পা জোড়া। ভালো করে হাঁটতে পারি না আর।
ছেলেটা আঁতকে উঠল—পা আবার দেওয়া যায় না কি কাউকে? আমি পথ চলব কী করে তখন?
বুড়ো বলল—সারাদিন তো অকাজের পথ হাঁটো তুমি। চলার দরকারটা কী তোমার? ঠিক আছে, তাহলে, হাত দুটো দাও আমাকে। কোন কাজ নাই তোমার। হাত দুটো তো কাজেই  লাগে না। যুবক ছেলের মজবুত পেশীর দুটো হাত পেলে, আবার কত কিছু করতে পারব আমি। পিঠের এই থলে আবার ভরে তুলতে পারব হীরে-জহরতে, সোনার মোহরে। 
--কী যে বলো না তুমি, তার নাই ঠিক। হাত কি একটা দেওয়ার জিনিষ না কি? ছেলেটাকে থামিয়ে, বুড়ো বলল-- কাউকে কিছু দিয়ে দুনিয়ায় পাঠায় না বিধাতা। শূন্য হাতেই আসি আমরা সবাই। যা কিছু দরকার, সবই নিজেকে অর্জন করতে হয়। যা কিছু আছে নিজের, কাজে লাগাতে হয় তাকে। মগজ, হাত-পা, দু’-দুটো চোখ—সব কিছুকে কাজে লাগাতে হয়। তখন দেখা যায়, জীবন কেমন বদলে গেছে নিজের অজান্তেই। কপাল চাপড়াতে নাই। দোষ দিতে নাই কাউকে। 
কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, ধড়মড় করে উঠে পড়ল ছেলেটা। হন হন করে হাঁটতে লাগল ফিরতি পথে।
মিষ্টি হেসে বুড়ো চেয়ে আছে তার চলে যাওয়ার দিকে। হেঁটে যাচ্ছে ছেলেটা। মাথা নাড়ছে উপর-নীচ, সম্মতি সূচকভাবে। যেন কথাগুলো বেশ মনে ধরেছে তার। 
তা দেখে ভারি তৃপ্তি হোল বুড়ো মানুষটার। বিড়বিড় করে বলল—এগিয়ে যাও, বন্ধু। নিজের জীবনকে গড়ে তোল গিয়ে। হতাশ হয়ো না কোন দিন। 
বুড়োও নিজের পথে রওণা হয়ে গেল। দেখা যাক, কোথাও হয়তো বসে আছে আরও কোন এক যুবক।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব সুন্দর একটি শিক্ষামূলক গল্প। সুন্দর দিকনির্দেশনা।

    ReplyDelete