জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা --১২/সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা 

সুরশ্রী ঘোষ সাহা 

দ্বাদশ পর্ব : পরিবার কথা 

জেঠিমার বাড়িতে তিনখানা চালার নিচে মাটির ভিতরে তিনটে উনুন বানানো আছে। শুকনো কাঠ, প্যাকাটি, ঘুটে এইসব সেখানে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। একটা উনুনে সব নিরামিষ রান্না হয়, একটা উনুনে আমিষ মাছ - মাংস। আর তৃতীয় উনুনটা কালো রূপ নিয়ে চুপচাপ কর্মহীন শুয়ে থাকে। বিয়ে করে শ্বশুর ভিটেতে আসার পর থেকে জেঠিমা সেখানে বিরাট বড় কড়াইয়ে বালি ফেলে একটা কাঠের চেরা ফালি দিয়ে নেড়ে নেড়ে ফোলা ফোলা মুড়ি ভাজত। কখনো আবার শুকনো কড়াইয়ে বিনি ধান ছড়িয়ে দিত। ফট ফট আওয়াজ করতে করতে খোসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ত সাদা সাদা খই। পরে অবসর সময়ে বসে সেই ধানের খোসা আর খই আলাদা করত কুলোয় করে। কিন্তু এখন এই সবকিছুই স্মৃতি। ঘরে মুড়ি-খই কোন কিছুই আর ভাজা হয় না। তৃতীয় উনুন আগুন ছাড়াই জীবন কাটাচ্ছে বছরের পর বছর।

 উনিশশো চৌষট্টি সালে জেঠিমা স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিল। পরীক্ষা রীতি তো চিরকালই রূপ বদলাতে থাকে। ঠিক সেই সময়ে না ছিল মাধ্যমিক, না ম্যাট্রিক। ক্লাস নাইন, টেন আর ইলেভেন পাশ করলে একটা সার্টিফিকেট দেওয়া হত। ওটাই চূড়ান্ত রেজাল্ট। হরিশনগর স্কুল থেকে মাত্র দুটি মেয়ে সেই ফাইনাল পরীক্ষা পাশ করল। তখনকার সময়ে সেটাই বিরাট বড় আলোচনার বিষয়। পরের বছর পঁয়ষট্টিতে জেঠিমার বিয়ে হয়ে গেল। তখন গ্রাম ঘরে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত কোন আইবুড়ো মেয়ে থাকত না। বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাওয়ার বদনাম জুটত। দশ এগারো বছর কী খুব বেশি তেরো-চোদ্দোর মধ্যে পাড়া ঘরের সব মেয়ের বিয়ে হয়ে যেত। নারীশিক্ষার প্রয়োজন তখনও তেমন বিপুল সাড়া ফেলেনি জনসমাজে। শহরের দিকে মেয়েরা স্কুল জীবন পেলেও অজ পাড়া-গ্রামে খুব কম মানুষই আগ্রহ দেখাত। 

 বিয়ের পর আমার বাপি জেঠিমাকে ট্রেনিং নেওয়ালো। বলল, চাকরি তোমাকে করতেই হবে, বৌদি। গ্রামের মেয়েদের তোমাকে ভীষণ প্রয়োজন। স্কুলে দিদিমণি পড়ায় শুনলে সেই স্কুলে মেয়েদের শিক্ষা নিতে পাঠাবে। ট্রেনিং নিয়ে প্রথমে পোলবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জেঠিমা চাকরি পেল। কিন্তু সংসার সন্তান ফেলে যে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই করতে পারল না। কিছু মাস পর বাড়ি থেকে এক কিলোমিটারের ভিতর মহেশ্বরবাটি উত্তর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জেঠিমার চাকরি হল। 


 জেঠু তখন মহেশ্বরবাটি কালিমাতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। সারা চাকরি জীবন প্রধান শিক্ষক হিসেবেই কাটিয়ে দিয়েছে। তখন প্রধান শিক্ষক মানেই বিরাট কোন ঘটনা নয়। স্বল্প মাইনের অতি সাধারণ ছাপোষা এক চাকরি। শিক্ষকতার পাশাপাশি চাষবাস ক্ষেত খামারের কাজও করত। লিখিত ভাবে কখনো গ্রাম-প্রধান হয়নি। কিন্তু গ্রামের মানুষ তাদের নানা সমস্যা নিয়ে জেঠুর কাছে বুদ্ধি ও উপায় বের করে দেওয়ার জন্য ছুটে ছুটে আসত। গ্রামে তখন বেশিরভাগ বাড়িতে অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত মানুষ, শুধু চাষবাস করে জীবন অতিবাহিত করে। তাদের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে থাকা জেঠুর বাড়ির শিক্ষার আলো সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ত ভরা জোছনার মতো। বিয়ের পর পরই একটা কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় জেঠিমা। যদিও সে ক'দিনের মধ্যে মারা যায়। তখন গ্রামে সন্তান হত বাড়িতেই। ধাইমা এসে নিজের হাতে করে প্রসব করাতো। আজকের মতন স্টেরিলাইজড কিছুই ছিল না। তাই বেশিরভাগ ঘরেই সদ্যোজাত বাঁচত কম, মরত বেশি। যারা বাঁচত তাদের মা ষষ্ঠীর সন্তান বলে ধরে নেওয়া হত। জেঠিমার ঘরে কয়েক বছর অন্তর অন্তর সেই মৃত মেয়েটাকে খুঁজে পেতে চাইতে পাঁচটা পুত্র সন্তান জন্ম নিল। এও খানিক ইতিহাস গড়ে ওঠা বৈকি! আজও যখন কন্যা সন্তান জন্মালে লুকিয়ে তাকে অনাথ আশ্রমের দরজায় ফেলে আসে মানুষ, আজও প্রতি আল্ট্রা সাউন্ড সেন্টারে লিখে রাখা থাকে, — সন্তান ছেলে কী মেয়ে জানতে চাওয়া আইনত অপরাধ। সেখানে হারিয়ে যাওয়া কন্যা সন্তানের জন্য জেঠু-জেঠিমা সারা জীবন আফসোস করে গেল। শেষে গ্রামের একটি মেয়েকে পালিত কন্যা হিসেবে গ্রহণ করে মানুষ করল। পরবর্তী প্রজন্মের কালে আর কন্যা সন্তানের অভাব হয়নি যদিও। বড় ছেলের ও সেজ ছেলের ঘরে মেয়ে এসেছে। তবে পরিবারে পুত্রের সংখ্যাই বেশি। 

 আগে গ্রামের মানুষ শহরের মানুষের থেকে কম অসুস্থ হত। কারণ জমির টাটকা, সারবিহীন ও ভেজালমুক্ত খাবার। এখন যদিও গ্রামের মানুষের খাদ্য তালিকাও সারমুক্ত নয়। এমনকি শহুরে ম্যাগি, পাস্তা গ্রামের শিশুদের জলখাবারে প্রবেশ করে গেছে। বাবারা কাজ থেকে ফেরার পথে সন্তানদের জন্য পেস্ট্রী - পিৎজা় - বার্গারও নিয়ে ফিরছে। ধীরে ধীরে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠছে সেইসব খাবারে। শহরের যদিও বাতাস আর জলেও বিষ। সেদিক থেকে গ্রাম আজও খানিক সুস্থ প্রকৃতি-পরিবেশ ধরে আছে। 

 জেঠিমা গল্প করে, ছোট থেকেই আমরা অধিক পরিশ্রমে অভ্যস্ত ছিলাম। সংসার ও বাইরের কাজ করাটা আমাদের কাছে কোন কালেই কোন ব্যাপার হত না। ভোর চারটেতে উঠে থেকে রাত নটায় শুতে যাওয়া পর্যন্ত গ্রামের মানুষ সমানে খেটেই চলত। আজও চলে। অযথা বসে থেকে সময় নষ্ট করতে আমরা কেউ কখনো পারিনি। যখন কিছুই করার থাকে না, তখন ঠাকুরের নামগান করি। গ্রামের মানুষ নিজের জীবনের সব কাজ নিজের হাতেই চিরকাল করে। 

 ফোকলা মুখে জেঠিমা হাসে। বলে, তোদের শহরের বাড়িতে বাড়িতে তো সকাল থেকে কত কাজের লোক আসে। কেউ বাসন মেজে, ঘর মুছে, কাপড় কেচে মেলে দিয়ে যায়। তো কেউ এসে দুপুর-রাতের রান্না করে দিয়ে যায়। আমরা সেসব ভাবতেই পারি না। কোন্ সকালে অন্ধকার থাকতে উঠে আমি ঘর উঠোন ঝাঁট দিয়ে, মুছে, আগের রাতের বাসন নিয়ে পুকুরে মাজতে গেছি। ফিরে রান্না করে এক এক করে ছেলেদের ডেকে খাইয়ে গেছি নতুন ওঠা শস্য নিয়ে কাজ করতে। হয় শুকনো করা, নয় সেদ্ধ করা, কী মরাইয়ে তোলা, বা ঢেঁকিতে ভানা, এমন কত ধরনের কাজ। ঠাকুর পুজো দিয়ে গেছি স্কুলে পড়াতে। আবার সময় মতন ফিরে এসে লেগে পড়েছি সংসারের অন্যান্য কাজে। গোয়াল ঘরে কিংবা কাঁথা বোনায়। আমাদের পাঁচটা ছেলেকে পড়াতে বাড়িতে কখনো কোন মাস্টার আসেনি। সন্ধ্যায় হ্যারিকেনের আলোয় ওদেরকে একদিকে পড়তে বসিয়ে অন্যদিকে দুধ জাল দেওয়া কী রুটি সেঁকা চালিয়েছি। 

 তোর বাবা এসে একটা রেডিও দিয়ে গিয়েছিল। আমাদের অন্ধকার সন্ধ্যাগুলোয় সেই বেতারের মহিমা ছিল অসীম। 'দিস ইজ় অল ইন্ডিয়া রেডিও' শুনতে শুনতে যেন অন্য কোন জীবনে ঢুকে যেতাম আমরা। ছেলেপুলেরা প্রথম প্রথম ভাবত, কাকার এনে দেওয়া ঐ ম্যাজিক বাক্সের ভিতরেই বুঝি মানুষ বসে আছে। নব ঘুরিয়ে দেশ-বিদেশের খবর পাওয়া আর গান শোনাটুকুই ছিল তখন আমাদের জীবনের শৌখিনতা। 

 জেঠিমার কথাগুলো শুনতে শুনতে আমিও সেই পুরনো দিনের সময়ে হারিয়ে গেছিলাম। চার বছরের ভাইপোটা এসে বলল, ঠাম্মা, আমিও সুতো চা খাব। আসলে ও রান্নাঘরে গিয়ে দেখে এসেছে, ঠাম্মার চায়ের জন্য জল গরম হচ্ছে। গ্রীন-টি ব্যাগ রাখা রয়েছে, একটা ফাঁকা কাপে। চিনির অপকারিতা সম্পর্কে সবাই এখন জানে। তাই চিনির জায়গায় ব্রাউন সুগার বা জ্যাগারি পাউডার খাওয়া হচ্ছে। 

 আমারও সুতো চা খেতে ইচ্ছে হল। হাতে কাপ নিয়ে সুতো নাড়াচাড়া করতে করতে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সামনে বিরাট খোলা প্রান্তর। সব ধান কেটে চলে গেছে ঘরে ঘরে। এক ধারে মাচায় জড়িয়ে আছে লাউ গাছ। অন্য ধারে লতানে ধুধুল গাছ উঠে গিয়েছে সুপারি গাছের মাথার কাছাকাছি। জোনাকি পোকারা তাদের মিটমিটে আলো জ্বালিয়ে অন্ধকারকে ভাঙার চেষ্টা করছে। 

 খালের ধারে বাঁশ গাছের চেরা পাতাগুলো হাল্কা হাল্কা দুলছে। আর তার ঠিক পিছনে এক কামড় খাওয়া বিস্কুটের মতো চাঁদটার গায়ে যেন মনে হল, একলা বুড়ি এক মনে বসে চরকা কাটছে। 
                                                                     (ক্রমশ...) 

ছবি : লেখিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments