জ্বলদর্চি

হৃদয়ে রয়েছ গোপনে /দেবাশিস ভট্টাচার্য

হৃদয়ে রয়েছ গোপনে

দেবাশিস ভট্টাচার্য


‘হৃদয়ে রয়েছ গোপনে’ একটি উপন্যাস। এই লেখাটি গড়ে উঠেছে এক অধ্যাপক-গবেষক লেখকের কলমে। যিনি প্রায় বাহান্ন থেকে পঞ্চান্ন বছর ধরে বাংলা সাহিত্যের নানা অচেনা জগৎকে আমাদের সামনে যুক্তিনির্ভর মননশীলতায় উন্মোচিত করে চলেছেন। তিনি শান্তিনিকেতনবাসী অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য। উপন্যাসটির নাম শুনেই রাবীন্দ্রনাথের গানটির কথা মনে পড়ে। এ উপন্যাসের কেন্দ্রে আসলে রবীন্দ্রজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় উদ্ঘাটিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে এর আগে আমরা নানাভাবে দেখবার চেষ্টা দেখেছি। কখনো তাঁর সাহিত্যের বিজ্ঞাননির্ভর বিশ্লেষণ, কখনো তথ্যপূর্ণ জীবন পর্যালোচনা আবার কখনো তাঁর ভাবজীবনকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে অরাবীন্দ্রিক করে আঁকবার চেষ্টাও হয়েছে।

 কিন্তু গবেষকের নির্মোহ তথ্যবিন্যাস এবং কার্যকারণনির্ভর কবির ভাবজীবনকে মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথকে এতটা সত্যের কাছাকাছি নিয়ে আসবার চেষ্টা এর আগে দেখা যায় নি। এই কাজে তিনি রাণু অধিকারী এবং রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র এবং রবীন্দ্রচর্চায় নিবিষ্ট থাকা গবেষকদের তথ্য আর ওই সময়ে কবিমনের প্রকৃত ভাবনার জগতটিকে কাজে লাগিয়ে তাকে নিষ্পৃহ দূরত্ব থেকে দেখবার চেষ্টা করেছেন। ঐতিহাসিক উপন্যাসে তথ্যকে এমনভাবে রসায়িত করতে হয় যাতে তা সাহিত্যের সত্য হয়ে ওঠে। এ উপন্যাসে সে বিষয়ে লেখকের তীক্ষ্ণ সতর্কতা আমরা দেখতে পাবো। এ উপন্যাসের ভাষার মিষ্টতা গদ্যরীতির সাবলীলতা  একে সাহিত্যের এক অন্য উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করেছে। গবেষণা-প্রবন্ধের ভাষা এবং রসসাহিত্যের ভাষার ফারাক অনেক। তথ্যনিষ্ঠ গবেষকের গদ্য যে এতটা মুগ্ধকর হতে পারে তা এ উপন্যাস না পড়লে বোঝা  যাবে না। হয়তো বিষয় রবীন্দ্রনাথ বলেই তথ্যের সঙ্গে গবেষক তাঁর ভাবময় কবিত্ব দিয়ে উপন্যাসটির পরিবেশনাকে অন্য মাত্রা দিতে পেরেছেন। 

কবির জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাস ঐতিহাসিক উপন্যাস হতে পারে আবার জীবনীমূলক উপন্যাসও হতে পারে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ‘কুমারসম্ভবের কবি’ উপন্যাসে কালিদাসের জীবনকে অসাধারণ দক্ষতায় সাহিত্য-সত্য করে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাঙ্গ জীবন ‘হৃদয়ে রয়েছ গোপনে’-তে পাওয়া যাবে না। কিন্তু বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের স্বাদ মিলতে পারে। অর্থাৎ জীবনের একটি পর্ব, রবীন্দ্র-জীবনের পরিণত পর্বের দোলাচলতায় ভরা এক কবি মনের ও কর্মের জগতের সঙ্গে যখন নানা টানাপোড়েনে দ্বিধান্বিত, সেই সময়কার এক গুণমুগ্ধ পাঠিকার হৃদয় দান এবং মান-অভিমানের সংঘাত—এই নিয়ে এ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে আবিষ্কৃত হতে দেখা যায়। শুধু তাই নয় এ উপন্যাসে এক বয়ঃসন্ধির তরুণী কীভাবে পূর্ণায়ত নারী হয়ে উঠেছে—এক যুগন্ধর কবির সাহচর্যে ও সংস্পর্শে তাও আবিষ্কৃত হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের নাটক, উপন্যাস, ছোটোগল্পে যে সব চরিত্র দেখা যায়, যেমন—চারুশশী, রতন, গিরিবালা, আশালতা, সুচরিতা, মালিনী, অপর্ণা—তাদেরই মতো এই রাণু বহির্জগতে সত্য হয়েও রবীন্দ্রনাথের অন্তর্জগতে কি ভাবনায় নবজাত হয়ে উঠছে তা আমরা ভেবে নিতে পারি এ উপন্যাস পড়ে। তাই ‘হৃদয়ে রয়েছ গোপনে’ শুধু রবীন্দ্রনাথকে চিনে নেবার আরেকটি প্রয়াস হয়েও হয়ে ওঠে রবীন্দ্রসাহিত্য পাঠের এক আবশ্যক সহায়ক গ্রন্থ।
এ বইটির আছে অন্য মূল্যও। সেটি বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত। বাঙালির জীবনে প্রেমভাবনা দীক্ষা পায় রবীন্দ্র-সান্নিধ্য থেকে। রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, কাহিনি থেকে বাঙালির মননশীল প্রেমজীবনের একটি আদর্শ রূপ যে নির্মিত হয়েছে বিগত প্রায় একশ’ বছর ধরে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এই দিকটিকে আরো চাক্ষুষভাবে দেখবার ও উপলব্ধি করবার একটি নতুন জগৎ এই উপন্যাসে আছে। প্রকৃত রাবীন্দ্রিক প্রেমের স্বরূপ নিয়ে যে বিভিন্ন ধারণার দ্বন্দ্ব দেখা যায়, তার একটি হাতে-কলমে প্রমাণ পাঠক পেয়ে যাবেন এই উপন্যাসে। যেখানে শুধু কল্পনায় রবীন্দ্রনাথকে কাল্পনিক চরিত্র করে তাঁর নামটিকে ব্যবহার করে বাজার তৈরির জন্য বাঙালি জাতিকে কলুষিত করা হয় নি। প্রকৃত সত্য আবিষ্কার করা হয়েছে তথ্যের আধারে। মিথ্যা নয় আছে গবেষকের নিষ্ঠা এবং শ্রম। আছে যুক্তি এবং আবেগের সহৃদয় সমাবেশ। এ বই তাই শুধু একটি উপন্যাস নয়। পাঠকের উপরি পাওনা অনেক। পড়া শুরু করলে না শেষ করে থাকা যায় না এমন এক আকর্ষণীয় মননধর্মী ভাষায় লেখক এ বইটি লিখেছেন। বইটি মননশীল সাংস্কৃতিক জীবনের এক অনবদ্য দলিল হয়ে থাকবে এ বিষয়ে দ্বিমত না থাকারই কথা।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments