জ্বলদর্চি

আগডুম রাজ্যে -৯/ অলোক চট্টোপাধ্যায়

আগডুম রাজ্যে -৯ 

 অলোক চট্টোপাধ্যায়

আমি প্রায় কেঁদে ফেলার ভান করে বললাম – পকেটেই তো ছিল। তোমরাই ধস্তাধস্তি করে আমাকে থলিতে ভরার সময়ে পড়ে গেল নাকি? ওরে আমার কী সর্বনাশ হল রে ! আমি এখন কি করে সময় মাপব?
এমন সময়ে বাইরে থেকে ওর একজন অনুচর এসে জানাল – অন্য লোকটার কাছেও ওরকম কোনো যন্তর টন্তর নেই হুজুর। ভাল করে তল্লাশি নিয়ে দেখেছি।
ফোড়নদাসের মুখ দেখে মনে হল আমার কথাটা সে ঠিক অবিশ্বাস করতে পারছে না। মুখে অবশ্য ধমকে বলল – চালাকি করবি না। ঠিক করে বল কোথায় রেখেছিস?
আমিও ডুকরে কেঁদে বললাম – নিজেই তো দেখলে আমার কাছে নেই। আহারে, এমন দামী যন্তরটা শেষে রাস্তায় খোয়া গেল! ফোড়নদাস এবার আমাকে ভরে আনা থলিটাও ঝেড়েঝুড়ে দেখল। আমার তৈরি ফুটোটা দেখে বেজায় চটে গিয়ে সামনের লোকটাকে ধমক লাগালো – একটা ভালো দেখে আস্ত থলিও নিয়ে যেতে পারিসনি? তারপর নিজের মনেই বলল – রাস্তায় আসার সময়েও ফুটো দিয়ে পড়ে গিয়ে থাকতে পারে। যাই হোক, বেশি দেরি হয়নি, এখনো খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে।
ওর চ্যালাচামুন্ডাদের হাঁক পেড়ে ডাকল আবার। লোকগুলো আসতে তাদের হুকুম দিল তক্ষুনি রাস্তায় আর বিশেষ করে আমাদের যেখানে ধরেছিল সেখানে আঁতিপাঁতি করে খুঁজে দেখতে। আমাকে বলল – জিনিসটা কেমন দেখতে এদের বুঝিয়ে বলে দে। মনে রাখিস, ওটা বিচারসভায় আমি দেখেছিলাম। আবোলতাবোল কিছু বানিয়ে বলে পার পাবি না।
-তারচেয়ে আমাদের সঙ্গে নিয়ে চল না। আমি তো দূর থেকে দেখলেই ওটা চিনতে পারব। আমি বললাম। আশা ছিল ওদের সঙ্গে নিয়ে গেলে অন্ধকারে ওদের চোখে ধুলো দিয়ে পালানোর একটা চেষ্টা করা যাবে। কিন্তু ফোড়নদাস ঠিক বুঝে গেল। বলল – আচ্ছা, আর সেই সুযোগে তোমরা পালাবে, তাই না? ঊঁহু বাবা, সেটি হচ্ছে না। ভালো কথায় জিনিসটা কেমন দেখতে এদের বুঝিয়ে দে।
আমি চোখের জল মুছতে মুছতে বললাম – গোল পানা চ্যাপটা জিনিস। হাতে বাঁধবার জন্যে চামড়ার স্ট্র্যাপ, ওই মানে ফিতে মতন আর কি, লাগানো আছে। গোলটার মধ্যে কাঁটার মতন আছে, সেগুলো সমানে ঘুরতে থাকে। বর্ণনাটা ফোড়নদাসের পছন্দ হল। লোকগুলোকে বলল – শুনে নিয়েছিস ঠিক করে? এখন খুঁজে নিয়ে আয়। চোরা লন্ঠন নিয়ে যাবি। দেখে কেউ যেন বুঝতে না পারে কিছু খুঁজছিস। অবশ্য রাতবিরেতে কে আর দেখবে, তবুও সাবধানের মার নেই। এখন তাড়াতাড়ি যা। আর হ্যাঁ, যে আগে দেখতে পাবি সে পাঁচ টঙ্ক বখশিস পাবি।
আমাকে যে লোকটা বয়ে এনেছিল সে বলল – আমিও যাই কর্তা?
 কি ভেবে ফোড়নদাস রাজি হয়ে গেল। - হ্যাঁ, তুইও যা। রাস্তার কোন পাশ দিয়ে এসেছিলি মনে করে করে দেখবি। যাবার আগে এই ঘরে তালা লাগিয়ে দিবি।
সবাই চলে গেল। দরজার বাইরে হুড়কো টেনে শেকল তুলে তালা লাগানোর আওয়াজ পেলাম। তখনো বুকের ভেতরে ঢিপ ঢিপ করছে।  চালাকিটা ধরা পড়ে গেলে কপালে অশেষ দুর্গতি ছিল। কোনোমতে আপাতত বাঁচা গেছে। খুব হাসিও পেল। নিচু আওয়াজে একটু হেসেও নিলাম নিজে নিজেই। তবে তারপরেই মনে হল কতক্ষণ আর? ঘড়ি খুঁজে না পেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তো ফিরে আসবে ওরা। তখন কি করব?
দূরে কোথাও ঢং ঢং করে একটা ঘন্টা বাজতে লাগল। প্রথমে মনে হয়েছিল আমাদের যেমন ঘন্টায় ঘন্টায় কোথাও কোথাও ঘন্টা পেটায় সেই রকম হবে। তারপরেই মনে হল এদের দেশে তো সময়ের হিসেবই নেই। তারপর যখন শুনলাম ঘন্টা বেজেই চলেছে তখন মনে হল এটা বন্দিশালার চোর পালানোর ঘন্টা হবে হয়তো। যাই হোক ঐ বাঁধা ছাঁদা অবস্থাতেই কেমন করে যেন চোখ জড়িয়ে এল ঘুমে। ঘরের মেঝেতেই এক কোনে যেমন পড়েছিলাম সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানিনা। বেশ খাসা একটা স্বপ্নও দেখছিলাম। আমি যেন বাড়ি ফিরে এসেছি আর বৌদিমনি ভারি খুশি হয়ে আমাকে একবাটি মুড়ি আর গরম গরম বেগুনি ভেজে খেতে দিয়েছে। এমন সময়ে দাদা কোত্থেকে এসে খুব রাগমাগ করে আমায় ধরে ঝাঁকাতে লাগল আর বলতে লাগল – ফের পালিয়েছিলি কেন? বল শীগগির, নয়তো পিটিয়ে তক্তা করে দেব। ঘুমটা সেখানেই ভেঙে গিয়ে দেখি দাদা নয়, চটপটি আমার দু কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছে আর বলছে – শীগগির ওঠো – শীগগির ওঠো।
তাকে দেখে কি যে আনন্দ হল সে আর কহতব্য নয়। আমি ধড়মড় করে উঠে তার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বললাম – চটপটি, তোমাকে ওরা কোথায় ধরে রেখেছিল? ছাড়া পেলে কি করে?
সে খুব গম্ভীর মুখে আমার হাত-পায়ের বাঁধন খুলতে খুলতে বলল – আমি কিন্তু চটপটি নই। অন্ধকারে ঠিকমত বুঝতে পারছো না যে আমার গালে আঁচিল নেই।
আরে, তাইতো! ঠাহর করে দেখলাম, এ তো ঘটপটি। আরো অবাক হয়ে বললাম – সে কি! তুমি কি করে এলে? আর তালা খুলে ঢুকলেই বা কিভাবে? 
-আমি চোর সেটা তো জানোই, যে কোনো তালা খোলা আমার কাছে কোনো সমস্যাই নয় । আর কিভাবে এখানে এলাম সে কথা পরে শুনো । ঘটপটি বলল। - আগে এখান থেকে পালাতে হবে। ফোড়নদাস তার দলবল নিয়ে যে কোনো সময়ে ফিরে আসবে। চটপটিকেও বাঁধন টাধন খুলে দিয়েছি । তোমার পাশের ঘরটাতেই বেঁধে রেখেছিল ওকে। ভাগ্যিস ফোড়নদাস ওর প্রাসাদের পেছনদিকের পোড়ো ঘর গুলোতে তোমাদের রেখেছিল, তাই বেশি ঝামেলা পোয়াতে হয়নি। সব পাহারাদার অবশ্য রাস্তায় রাস্তায় তোমার ওই ঘড়ি না কি বস্তু – সেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। তোমাদের ঘরে তালা বন্ধ করে রেখে নিশ্চিন্ত। সে যাক, চলো এখন।
আর বলার দরকার ছিল না। তিন লাফে আমরা ঘরের বাইরে। চারদিকে মিশকালো অন্ধকার। তারই মধ্যে ঝোপঝাড় ভেঙে একটু এগোতেই দেখি শুধু চটপটিই নয়, চকমকিও রয়েছে সেখানে। আমরা চারজন যথাসাধ্য চুপিচুপি ওই বাড়ির পেছন দিকের জঙ্গল পেরিয়ে একটা পাঁচিলের সামনে পৌঁছে গেলাম।
ঘটপটি, স্বাভাবিক ভাবেই, পাঁচিল টপকানোতেও ওস্তাদ। সেই প্রথমে টিকটিকির মত সড়সড় করে পাঁচিলের মাথায় উঠে গেল। তারপর হাত বাড়িয়ে টেনে তুলল আমাদের। সবাই উল্টোদিকে লাফিয়ে নামলাম। তারপরেও  হনহন করে অনেকটা পথ চলার পরে একসময়ে খুব নিশ্চিন্ত মুখে ঘটপটি বলল – যাক, আমরা মোটামুটি ফোড়নদাসের এলাকার থেকে বেরিয়ে এসেছি। এবার আমরা ধীরে সুস্থে কথাবার্তা বলতে বলতে এগোতে পারি।
চটপটি এবারে বলল – আমি তো পাশের ঘর থেকে ফোড়নদাসের সঙ্গে তোমার কথাবার্তাগুলো বেশ পষ্টোই শুনতে পাচ্ছিলাম। আহা, কি ঠকান ঠকিয়েছো ওদের। ঘড়ি হারানোর গল্পটা শুনে আমারই তো একদম সত্যি বলেই মনে হচ্ছিল। থলিটাতে সত্যিই ফুটো ছিল? ও, তুমিই যেতে যেতে বানিয়েছিলে? সাব্বাস। 
চকমকি খুব গম্ভীর গলায় মুরুব্বীদের মত বলল – তুমি কিন্তু বুদ্ধি খাটানোর ক্লাসে থাকলে খুব ভালো ফল করতে পারবে। চাও তো মুশকিল মামাকে বলে ভর্তি করে দিতে পারি।
কিন্তু ঘটপটি ওর তালা ভাঙার বিদ্যে নিয়ে ওখানে পৌঁছোলো কি করে। সেখানে পুরো কৃতিত্ব চকমকির। ফোড়নদাসের লোকজনদের দেখে ও বিপদ বুঝতে পেরেছিল। বারবার কু কু করে ডেকেছে, কিন্তু চটপটি অন্যমনস্ক থাকায় খেয়াল করেনি। শেষে ওদের দুজন লোক ওকেও তাড়া করে। ও গাছপালার ভেতর দিয়ে পালিয়েছিল বটে কিন্তু লোকগুলো চলে যেতে ও আবার ফিরে এসে দূর থেকে আমাদের থলেয় ভরে বন্দী করে নিয়ে যাবার পুরো ব্যাপারটা দেখে।  একবার ভেবেছিল মুশকিল মামাকে গিয়ে বলবে। কিন্তু ভেবে দেখে তাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তখন নিজেই বুদ্ধি খাটিয়ে সোজা চলে যায় বন্দীশালায় ঘটপটির কাছে। কারণ, ফোড়নদাসের দলবলের চোখে ধুলো দিয়ে ওর বাড়িতে ঢুকে আমাদের উদ্ধার করা তার পক্ষেই সম্ভব। ঘটপটি বেচারাকে অবস্থার গূরুত্ব বুঝে এই প্রথমবার টঙ্ক না নিয়েই বন্দীশালার থেকে পালাতে হয়েছে। এমনকি রাতের খাবারটুকুও না খেয়ে । আসার পথে ফোড়নদাসের দলবলকে রাস্তায় চোরা লন্ঠন নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখে আন্দাজ করে যে আমরা কিছু একটা ভুজুং ভাজুং দিয়ে ওদের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছি। ফলে আমাদের উদ্ধার করার কাজটা আরো সোজা হয়ে যায়।
-সত্যি, চকমকির বুদ্ধিতেই আমরা এত সহজে ছাড়া পেলাম। আমি কৃতজ্ঞ ভাবে বললাম। উত্তরে সে বেশ খুশি খুশি গলায় বলল – আর তাছাড়া, ঘড়িটা আমার কাছে রাখার বুদ্ধিটাও কিন্তু আমারই। তা না হলে তো এত কিছু করার সুযোগও থাকত না।
-আর আমি যে খবর পেয়েই এসে পাঁচিল টপকে তালা খুলে তোমাদের উদ্ধার করলাম, সেটা বুঝি কিছু না? ঘটপটি অভিমানী গলায় বলল। আমি তাড়াতাড়ি বললাম – তা কেন? আসল কাজটাই তো তুমি করলে। এরই ভেতর চটপটি খুব উদাস গলায় জানালো – এতসব কিন্তু হয়েছে আমারই জন্যে। আমি যদি সময় মত চকমকির কু দেওয়া শুনে সরে পড়তাম তাহলে এত কান্ড কিছুই হত না আর তোমরাও কেউ নিজেদের বিদ্যে দেখাতে পারতে না।
-আচ্ছা, সেটা কি খুব কৃতিত্বের কথা? চকমকি ফোঁস করে উঠল। -বিপদটা তো তুমিই নেমন্তন্ন করে ডেকে এনেছো। আর যদি তোমার কথামত তোমার জন্যেই আমরা বিদ্যে দেখাতে পেরেছি এমন হয় তাহলে আমি তো বলব আসল কাজটা করেছে ফোড়নদাস। সে তোমাদের ধরে নিয়ে না গেলে এত কিছু কান্ডই তো হত না। তাই নয় কি?
আবার পাছে ওদের মধ্যে একটা তর্কাতর্কি বাধে, আমি ব্যস্ত হয়ে জানতে চাইলাম - আচ্ছা, আমরা এখন যাচ্ছি কোথায়?
-যেখানে যাবার জন্যে বেরিয়েছিলাম সেখানেই। চটপটি জানাল। - শিক্ষালয়ে। মুশকিল মামার কাছে। তবে এখন আরো কিছুটা ঘুরে পেছন দিক দিয়ে যাব আমরা। কারণ সামনের দিকে ওদের লোকেরা নজর রাখতে পারে। এখনো বেশ খানিকটা রাত্তির বাকি আছে। শিক্ষালয়ে পৌঁছে একটা কোনো খালি ঘরে আমরা কিছুটা ঘুমিয়েও নিতে পারি।
ঘটপটি বলল – আমি কিন্তু তোমাদের সঙ্গে যাব না। আমাকে গিয়ে এখন দেখতে হবে কোন সেপাইরা আমাকে খুঁজতে বেরিয়েছে। তাদের হাতে ধরা পড়ে আবার বব্দীশালায় ফিরতে হবে। আর হ্যাঁ, তোমাকে বলে রাখি, বটকেষ্টও কিন্তু তোমাকে গরুখোঁজা খুঁজছে। চোর হিসেবে তুমি পালিয়েছো সেই অবধি ঠিক আছে, কিন্তু সবাইকার মত আবার ধরা পড়ে ফেরৎ না আসাটা ঠিক নয়। আবার বলতে গেলে একজন সেপাইএর পক্ষে  পালিয়ে যাওয়া চোরকে ফের পাকড়াও করে না আনাটা খুব অসম্মানের ব্যাপার। সেজন্যে বটকেষ্ট বেশ ভালোই চটে আছে তোমার ওপর। ধরতে পারলে আগে দু ঘা লাগিয়ে তারপর খাঁচায় ভরবে।
সামনের একটা রাস্তার মোড়ে ঘটপটি বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমরা তিনজন আরো অনেক পথ ঘুরে শেষমেশ পৌঁছোলাম লম্বা পাঁচিল ঘেরা সেই শিক্ষালয় নামের জায়গাটাতে। ঢুকলাম অবশ্য পেছনের দিকের এক জায়গার ভাঙা পাঁচিল টপকে। চকমকি রাস্তা দেখিয়ে আমাদের নিয়ে গেল একটা ক্লাসঘরের মত বড় ঘরে। সেখানেই চাটাইএর ওপর শুয়ে কিছুটা গল্প করে, কিছুটা ঘুমিয়ে বাকি রাতটা  কাটিয়ে দিলাম আমরা।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments