জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা-১১/ সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা 

 সুরশ্রী ঘোষ সাহা 

একাদশ পর্ব : বারো মাসের তেরো পার্বণ 

একটা সময় ছিল যখন গ্রাম জীবনে মানুষ সত্যিকারেই বারো মাসে তেরো পার্বণ নিয়ে মেতে থাকত। বৈশাখ মানেই যেমন একদিকে ঘন কালো মেঘের গর্জন ও তুমুল ঝড়-ঝঞ্ঝা, অপরদিকে তেমনি এই সময় বাংলায় চির নতুনের আহ্বান হয়। কৃষকের ঘর ভরে ওঠে ক্ষেত থেকে ওঠা নতুন ফসলে। হালখাতা করে ব্যবসায়ীরা এইসময় ব্যবসার নতুন খাতা খোলে। আগে নববর্ষ বরণ উৎসবকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলত বৈশাখী মেলা। খেলনা টমটমের টুংটাং শব্দ, তালপাতার ভেঁপুর পু-পু-পু সুর, নাগরদোলায় দোল খাওয়া শিশু-কিশোরদের কলরবের সঙ্গে পুতুল নাচের আসর থেকে মাইকে ভেসে আসা লোকসঙ্গীত আর ঢাক ঢোলের শব্দ নিয়ে গ্রাম-বাংলায় বসত বৈশাখী মেলা। যদিও এখন আর এই বৈশাখী মেলা সেভাবে সব জায়গায় দেখা যায় না। 


 বৈশাখের পরপরই জৈষ্ঠ্য মাসে ঘরে ঘরে জামাই ষষ্ঠী পালন করা হত খুব ধুমধাম করে। যা আজও হয়। জামাইকে ডেকে এনে সমাদার করা ও কন্যা যাতে সন্তানবতী হয় সেই লক্ষ্যে মা ষষ্ঠীর উপলক্ষে উপবাস করেন শাশুড়ি-মা। বর্তমানে চাকরিজীবি জামাইরা শ্বশুর বাড়িতে আসতে পারে না বলে, সরকার থেকে এই দিনটা সরকারি ছুটিও ঘোষণা করা হয়েছে। তাই শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য উপহার হাতে মেয়ে-জামাইদের আগমন ঘটছে... 


 শ্রাবণ মাস মানেই তো শিবের আরাধনার মাস। প্রতি বছর এই শ্রাবণে লক্ষ লক্ষ পূণ্যার্থী ভিড় জমান তারকেশ্বরের মন্দিরে। শুরু হয় শ্রাবণী মেলাও। শেওড়াফুলির গঙ্গা থেকে জল নিয়ে প্রায় ৪০ কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে পূণ্য লাভের ইচ্ছায় পৌঁছায় তারকেশ্বর মন্দিরে। এই উপলক্ষে অল্প বয়সী কিশোর-যুবকরা মানত রাখে। দিন নেই, রাত নেই খালি পায়ে হেঁটেই চলে তারা। অবাক হয়ে যাই, বাচ্চা বাচ্চা ছেলেময়েগুলোর ঈশ্বর ভক্তি দেখে। এই শ্রাবণ মাসেই আবার জন্মাষ্টমী উৎসবও পালন করা হয় ঘরে ঘরে। 


 ভাদ্র মাসের শুক্লা পক্ষে রাধাষ্টমীর পরদিন নবমী তিথিতে পালিত হত তালনবমী ব্রত। দিনভর উপবাস রেখে সন্ধ্যায় চাঁদ দর্শনের পরে ভঙ্গ করা হত সেই উপবাস। এদিনই দুর্গোৎসব বা দশেরার প্রস্তুতি শুরু হত গৃহস্থের অন্দরমহলে। পঞ্জিকায় এখনও তাল নবমীর উল্লেখ থাকে। তাল আজও পাওয়া যায়। বাজারে তাল দেখতে পেয়ে কিনে এনে তালের ক্ষীর ও বড়া করে খাই আমরা। কিন্তু গ্রাম বাংলার তাল নবমী উৎসব এখন বহু মানুষের স্মৃতিতে আর গল্পে ছাড়া প্রায় অস্তিত্বহীন। 


 আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন গ্রাম শহর মিলেমিশে সর্বত্র "দুর্গাষষ্ঠী", "মহাসপ্তমী", "মহাষ্টমী", "মহানবমী" ও "বিজয়াদশমী" পালিত হয়। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষটিকে বলা হয় "দেবীপক্ষ"। আর দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম মহালয়া। এই দিন হিন্দুরা তর্পণ করে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করে। অপরদিকে দেবীপক্ষের শেষ দিনটি হল কোজাগরী পূর্ণিমা। এই দিন হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয় ঘরে ঘরে।

 ছোটবেলা থেকে বেশ কয়েকবার আমি গ্রামের দুর্গা পুজো দেখেছি। শহরের জাঁকজমকপূর্ণ পুজোর থেকে গ্রামের পুজো অনেকটাই আলাদা। না আছে সেখানে এত আলোর রোশনাই, না আছে বিপুল সংখ্যক পুজো। একটা দুটো পুজোকে কেন্দ্র করে মানুষের উদ্দীপনা সেখানে চরম থাকে। জাগ্রত কোন পুজোর বেদীতে আজও চুপিচুপি পাঁঠা বলি চলে। যেসব জায়গায় মানুষের অবস্থা আরও খারাপ সেখানে কুমড়ো বলি দেওয়া হয়।

 কার্তিক মাসে গ্রাম বাংলায় বেশ কয়েকটা উৎসব পালিত হয়। যেমন - ভাইফোঁটা, কার্তিক পূর্ণিমা, কার্তিক একাদশী, ও দীপাবলি। বিবাহিত বউদের বাচ্চা না হলে, তাদের দুয়ারে কার্তিক ফেলে যাওয়ার রীতি গ্রাম মফস্বলে আজও চালু আছে। তবে বেশিরভাগ মানুষ তিনবছর টানা পুজো ও চারবছরের উদযাপনের ঝক্কি এড়াতে লুকিয়ে অন্যের দুয়ারে কিংবা পুকুরে কার্তিক ঠাকুর ফেলে আসে। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলি। এই বছর কার্তিক উদযাপনে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে শোনা — আমার পাশের বাড়িতেই এই কার্তিক পুজোর নিমন্ত্রণ ছিল। দুদিন আগেই তাদের একমাত্র মেয়ের চার বছরের জন্মদিন পালিত হয়েছে। মনে তাই প্রশ্ন জাগে, বাচ্চা হওয়ার পর কেউ কার্তিক ফেলেছিল কিনা? বৌমার উত্তরে জানতে পারি, না। বাচ্চা আসার দুই বছর আগেই পাড়ার ছেলেরা কার্তিক ফেলেছিল। কিন্তু শাশুড়িমা তা পুকুরে বিসর্জন দেওয়ান। খুব অদ্ভুত ভাবে তার পর থেকে নাকি যখনই বৌমার সন্তান আসে, নষ্ট হয়ে যেতে শুরু হয়। বারবার মিস্ড অ্যাবরশনের শেষে তারা স্বামী - স্ত্রী কার্তিকের কাছে মানত করে, সন্তান দাও, পুজো দেব। কার্তিক সেই কথা শোনে। আর বাড়িতে লক্ষ্মী আসে। 
 
 কার্তিকের সংক্রান্তিতে গ্রামের ঘরে ঘরে মানুষ ইতু পাতে। আর অগ্রহায়ণের সংক্রান্তিতে সেই ইতু তোলে। সরাতে মাটি দিয়ে ছোলা মটর ছড়িয়ে দেয়। তার উপর ঘট পাতে। সেই ঘটে জল, তালের শিষ, কচু গাছ, কলমি লতা দেয়। সেই ঘটের জল টপ টপ করে নিচের মাটিতে পড়ে ছোলা মটরের অঙ্কুর বেরিয়ে গাছ গজায়। একমাস ধরে চারটে রবিবার সেই ঘটকে পুজো করা হয়। যেদিন তোলা হয় সেদিন ইতু ঠাকুরকে আবার  পুজো করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে আসা হয়। এখনও এই ইতু পুজোর গ্রামীণ রীতি বহু ঘরে ঘরে চলে আসছে। ইতু হলেন শস্যের দেবী। তার পুজোর উদ্দেশ্য হল, সংসারের সুখ ও ঐশ্বর্য কামনা। একসময় ঘরে ঘরে ইতু পেতে ব্রতীরা রোজ ইতুর ব্রতকথাও পড়ত। যদিও ইতু পুজোও এখন ছোট করে অনেকেই শুধু নিয়ম রক্ষা মতো একদিনেই সারছে শুনতে পাওয়া যায়। 

 গ্রাম জীবনে নবান্ন উৎসব পালিত হত অগ্রহায়ণের নতুন ধান উঠলে। ঘরে ঘরে তখন নবান্নের জন্য নতুন ওঠা ধান লক্ষ্মীর হাঁড়িতে তুলে রাখা হয়। তারপর সেই ধান ভেনে নতুন চালের রান্না করা হয়। এবং আত্মীয় স্বজনকে ডেকে খাওয়ানো হয়। অনেক জায়গায় এই উপলক্ষে মেলাও বসত। নবান্ন উৎসবও এখন প্রায় খুব ছোট করে হচ্ছে। 

 পৌষ মাসে একদিকে যেমন পৌষ-কালী পুজো হয়। অপরদিকে তেমনি পৌষ বা মকরসংক্রান্তির পিঠে পুলি উৎসব চলে গ্রামাঞ্চলে ঘরে ঘরে। 

 ফাল্গুনের দোল পূর্ণিমায় পালিত হয় বসন্ত উৎসব। এখন এই উৎসব খুব ছোট করে রঙ ও আবির খেলার মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আগে দোল পূর্ণিমার দিন বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছেলেমেয়েরা গুরুজনদের প্রণাম করতে যেত। অতিথি সেবা হত মঠ - ফুটকড়াই দিয়ে। যে রীতি রেওয়াজ এখন আর প্রায় নেই। কারুর কারুর বাড়িতে রাধাকৃষ্ণের পুজোও হত। সন্ধ্যায় বিরাট বড় চাঁদটা যখন আকাশ জুড়ে আলো ছড়াত, তখন কোথাও মঞ্চ টাঙিয়ে ফাংশন হত। দূরের শহর থেকে ভাড়া করে আনা হত শিল্পী-নর্তকীদের। 


 গ্রামে চৈত্র মাসে রবি ফসল ও গ্রীষ্মকালীন ফসলের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম এক সঙ্গে করতে হয় বলে কৃষকের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। চৈতালি ফসলে তখন ক্ষেত ভরে ওঠে। যেমন - টমেটো, ঢেঁড়স, বেগুন, করলা, ঝিঙা, ধুন্দুল, চিচিঙা, শসা, ওলকচু, পটল, কাঁকরোল, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া, লালশাক, পুঁইশাক, কলমি শাক এই সবকিছু চাষ হয়। তারপর চৈত্রের শেষ দিনে পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী চড়ক পূজার উৎসব চলে। এই চড়ক উৎসব হল, চৈত্র মাসে পালিত হিন্দু দেবতা শিবের গাজন উৎসবের একটি অঙ্গ। এই উৎসব শিব, নীল, মনসা ও ধর্মঠাকুরের পূজাকেন্দ্রিক উৎসব। গাজনের সন্ন্যাসী বা ভক্তরা নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রণা দিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ইষ্ট দেবতাকে সন্তোষ প্রদানের চেষ্টা করেন। গাজন উপলক্ষ্যে তারা শোভাযাত্রা সহকারে দেবতার মন্দিরে যান। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে মেলাও বসে, যা চড়ক সংক্রান্তির মেলা নামে অভিহিত। আগে যে বিপুল পরিমাণে হত, এখন তা কমে গিয়ে গুটিকয়েক জায়গায় টিম টিম করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজোও হয়। বলা হয় এটি প্রকৃত সময়ের দুর্গা পূজা। কিছু কিছু পাড়া - ঘরে অন্নপূর্ণা ও শিব পূজাও করা হয় এই একই সময়ে। 

 গ্রাম শহর নির্বিশেষে মানুষের জীবনে কর্ম ব্যস্ততা এখন বহুগুন বেড়ে গিয়েছে, আর মানুষ কর্ম সূত্রে নিজের বাড়ি থেকে এত দূরে দূরে জীবন কাটাচ্ছে, যে তাদের জীবনে উৎসবের সংখ্যা বড়ই কমে এসেছে। সেইদিন আর বেশি দূরে নেই, যখন প্রবাসী বাঙালি নিজেদের পুরনো ঐতিহ্য উৎসবের নামটুকুও জানবে না। বাংলার বাইরে জীবন কাটাতে কাটাতে অন্য রাজ্যের কালচার, পুজো - উৎসবকে নিজের করে নেবে। তাদের ঘরে পালিত হবে- করবা চৌত, দশেরা, নবরাত্রি এমন কত কিছু...
                                                                      (ক্রমশ...)

ছবি : লেখিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments