জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে --১১/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ১১

কোনো এক যুগে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা থানা ছিল বগড়ি রাজ্য। ‘বকডিহি’ থেকেই নাকি ‘বগড়ি’ নামের উৎপত্তি। জনশ্রুতি মহাভারতের বক রাক্ষসের রাজ্য ছিল বকডিহি। ১৭২০ সালে সামশের সিংহ বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাকে পরাজিত করে বগড়ি অধিকার করেন এবং গড়বেতা থেকে মঙ্গলাপোতায় রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। সম্ভবত সেই সময় থেকেই আমাদের গ্রামে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। রাজবাড়ির সামনের মাঠের উত্তরপ্রান্তে মাটির তৈরি দক্ষিণমুখী মস্ত বড় মঙ্গলামাড়া,এর ভিতরেই তখন ঠাকুর গড়তেন দুর্লভ কাকা। বছরে মাত্র কয়েকটা ঠাকুর গড়ার ডাক পেতেন। অন্য সময় দুর্লভকাকা ঘরামির কাজ করতেন। অভাবের সংসার ছিল, ওনার স্ত্রী ঢেঁকিতে চিড়েকুটে বিক্রি করতেন। সংসারে অভাব থাকলেও দুর্লভকাকার ছেলেরা খুব মেধাবী ছিল। বড়ছেলে লক্ষ্মীনারায়ণ শীল, দু’বেলা খেতে পেতনা। বই কিনতে পারত না, সেই লক্ষ্মীদা ১৯৭১ সালে আমাদের স্কুল থেকে স্কুল ফ্যাইনাল পরীক্ষায় রাজ্যে প্রথমস্থান অধিকার করেছিল। লক্ষ্মীদা আমার থেকে দু’বছরের সিনিয়র ছিল। ঠাকুর গড়ার কাজে লক্ষ্মীদা বাবাকে সাহায্যও করত। এই মঙ্গলামাড়ার সামনে রয়েছে সান বাঁধানো আটচালা। এই দুটিকে ঘিরেই সারা মাঠজুড়ে মেলা বসত, এখনও বসে। আমার ছোটবেলায় মেলার দু’প্রান্তে বাঁশের উঁচু মাচানে নহবত বাজত। মেলায় নাগরদোলা বসত। তখন দিনেরবেলা কাঠিনাচ, সাঁওতালি নাচ ইত্যাদি হত, রাতে হত তর্জা, বাউলগান, যাত্রাপালা ইত্যাদি। মেলায় জুয়া খেলাও হত। বাইরে থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসা যাত্রাদলকে এই জুয়াড়িদেরই টাকা দিতে হত।
    রথেরমেলা হত গোটাদুই গ্রাম পেরিয়ে ধানছড়া গ্রামের আশ্রমে। এই মেলার আকর্ষণ আমাদের কাছে এতটাই তীব্র ছিল যে দলবেঁধে পায়ে হেঁটে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মধ্যে মেলা দেখতে যেতাম। অন্যান্য মেলার মত এখানেও একই জিনিস বিক্রি হত। আর বিক্রি হত আম, কাঁঠাল। কাঠের পুতুল বিক্রি হত। এই পুতুলগুলো কাঠ কুঁদে  তৈরি করা হত। তখন প্রায় সব বাচ্চামেয়েকেই এই পুতুল নিয়ে খেলতে দেখা যেত। একবার আমার সাথে একটা কাণ্ড হয়ে ছিল। ময়রাদের একটি মেয়ে আমার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ত। মেলায় ওর বাবা দোকান দিয়েছিলেন, ও মিষ্টি বিক্রি করছিল। আমি ওর থেকে কালোজাম কিনে দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি। কালোজামগুলো বেশ বড় সাইজের। হঠাৎ মেয়েটি আমার হাত  থেকে শালপাতার ঠোঙ্গাটি কেড়ে নিয়ে বড় মিষ্টিগুলো বদলে ছোট মিষ্টি দিল। আমি তো হাঁ হয়ে রয়ে গেছি! ও বলে, ভুল করে বড় দেওয়া হয়ে গেছল। তখন আমার নিজের গালেই চড় মারতে ইচ্ছে করছিল।
      আশ্রমটি অনেকখানি জায়গা জুড়ে অবস্থিত। শাক-সবজি, ফুল ফল চাষ হয়, অনেক গরু আছে, দুধ হয় প্রচুর। এখন স্কুলও হয়েছে। এই সারস্বত আশ্রমটির প্রধান কার্যালয় আসামে। এখানে মাঝে মাঝে ধর্ম মহাসভার আয়োজন করা হয়। আসাম, ত্রিপুরা, বাংলাদেশ থেকে ভক্তরা আসেন। মেলাও বসে, সব ধর্মের মানুষের সমাগম হয় এই মেলার কারণে। অন্য সময়ও আশ্রমে গেলে সাবাইকে খাওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। এঁদের পায়েস একবার খেলে সারাজীবন মনে থাকবে। একবার আশ্রমটি ভাল করে দেখার জন্য গেছলাম। প্রার্থনাগৃহে ঢুকে দেখলাম, ভক্তদের বসার জায়গা বাদে যে অংশটি আরাধ্য দেবতার গৃহ হিসেবে সংরক্ষিত, সেখানে সবই আছে। কিন্তু কোনো দেবদেবীর মূর্তি নেই। জিজ্ঞেস করে জানলাম, এখানে বসে ওই শূন্যস্থানে যে যার আরাধ্য দেবতা বা ঈশ্বরকে কল্পনা করে প্রার্থনা করতে পারেন।
    পৌষ সংক্রান্তির দিন থেকেই আশে পাশের বিভিন্ন গ্রামে মেলা শুরু হত। পৌষ সংক্রান্তির দিন নদীতে টুসু ভাসানো দেখতে ভোরবেলা নদীর পাড়ে হাজির হতাম, মহিলারা গান গাইতে গাইতে জলে টুসু ভাসাতেন। কিছুটা ভেসে যাওয়ার পরেই দুষ্টু ছেলেরা ঝাঁপ দিয়ে তুলে নিত। এখনে টুসু ভাসানো হয় দু’রকম ভাবে। টুসুর মাটির সরা পাওয়া যায়। সরার ওপরে গোলকরে প্রদীপ বসানো থাকে এই সরা বা মালসার মধ্যে পুজোর উপকরণ ও ফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রদীপগুলি জ্বেলে দেওয়া হয়। এই মালসাটিকেই মহিলারা টুসুগান  গাইতে গাইতে নদীতে ভাসান। আর একটা হয় শলার তৈরি ছোট্ট রথের মত, রঙ্গিন কাগজ দিয়ে সাজানো। এর মধ্যেও মূর্তি থাকেনা, পুজোর উপকরণ দিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
১ মাঘ থেকে বড়দির শ্বশুরবাড়ির গ্রাম ভেদুয়াতে চারদিন ধরে মেলা হয়। কখনো দাদাদের সাথে পায়ে হেঁটে, কখনো তনুকাকিমার সঙ্গে গরুরগাড়ি চড়ে মেলা দেখার জন্য দিদির বাড়ি যেতাম। তনু কাকিমা সম্পর্কে বড়দির পিসিশাশুড়ি। তনু কাকিমা আমাদের ছোট ঠাকুরদার বড়বৌমা। বড়দির শ্বশুরবাড়িতেও শেষের দিকে জ্বালাতন শুরু হয়েছিল। জামাইবাবুরা পাঁচভাই দুইবোন। সবার বড় জামাইবাবু মহসিন খান ছিলেন স্কুল শিক্ষক। মেজ হুসেনদা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। ভিলাই ষ্টীলপ্ল্যান্টে চাকরি করতেন।বিয়ে হয়েছিল আমার সেজকাকা আতিউর রহমান খানের বড় মেয়ে জয়নাব আরা, আমাদের জুনুদির সঙ্গে। সেজভাই মনোয়ারদা ছিলেন পুলিশ অফিসার। এনার বিয়ে হয়েছিল আমার ছোটপিসির মেজমেয়ে সুফিয়াদির সঙ্গে। দিদিরা তিন বোনে তিন জা হয়েছিলেন। তারপরের ভাই ওয়্যারলেসে চাকরি করতেন। ছোটভাই কুণাল তখন মেডিকেল পড়তেন। তিনি একদিন মাতৃসমা বড়বৌদিকে, মানে আমার বড়দিকে জানান, আমাকে তাঁর খুব পছন্দ। পরবর্তীকালে সে আমাকে বিয়ে করতে চায়। বড়দির বড় মেয়ে লাইলির থেকে কথাটা আমিও জেনে গেছলাম। তারপর থেকেই দিদির বাড়ি যেতে ভীষণ লজ্জা লাগত। বড়দি জানত এ বিয়ে অসম্ভভ। তাকে বিনা যৌতুকে বাড়ির বড়বৌ করে নিয়ে এলেও ছোটবৌয়ের বেলা সেটা করবেন না। মেজ ও সেজ ছেলের বিয়েতে শ্বশুরমশাই বিয়ের মজলিশে যৌতুকের টাকা গুনে নিয়েছিলেন।

    সেজকাকা সমবায় দপ্তরের জেলা স্তরের অফিসার ছিলেন। কাকার তিনমেয়ে একছেলে। জুনুদি তো বড়দির জা হয়েছিল। মেজ নাজুদি, নাজমার শ্বশুরবাড়ি বসিরহাটে।  জামাইবাবু নজরুল ইসলাম মোল্লা বিয়ের সময় সম্ভবত বাঁকুড়াতে বিডিও ছিলেন। ছোটমেয়ে মনির নাম ছিল হুসনেআরা। মনি আমার থেকে ৮ মাসের ছোট। ওর বিয়ে হয়েছিল বর্ধমানে। ওর স্বামী ডঃ এনামুল মল্লিক কৃষি বিভাগের বড় অফিসার ছিলেন। সেজকাকার ছেলে, ফজলুর রহমান খান, সংক্ষেপে ‘এফ আর খান’ বর্তমানে একজন প্রসিদ্ধ ‘ই এন টি’। ছোটকাকা মুজিবর রহমান  এই বাংলায় পছন্দ মত চাকরি না পেয়ে পূর্ববাংলা চলে গিয়ে ওখানে জেলা জজ হিসেবে কাজে যোগ দেন। ছোটকাকার চারছেলে, মেয়ে নেই। বড়ছেলে বাবলুদা আমার মেজদার সমবয়সী। উনি খুলনায় একটি কলেজে অধ্যাপনা করতেন। মেজছেলে রমুদা বাংলাদেশের প্রথম সমুদ্র বিজ্ঞানী ছিলেন। সেজ ছেলে নীল ও ওর স্বপ্না দুজনেই ডাক্তার। ছোটছেলে বিশেষকিছু করত না।
    ছোট ঠাকুরদা সহিদুদ্দিন খানের কথা কিছুই বলা হয়নি। উনিও পুলিশ অফিসার ছিলেন। এর পেছনে অন্য এক ঘটনা রয়েছে। ঠাকুরদারা পাঁচভাই ছিলেন। একভাই শুনেছি যুবক অবস্থায় মারা গেছলেন। বাকি তিনভাই গ্রামে থেকে চাষ আবাদ দেখাশোনা করতেন। চাষির বাড়িতে গাই-বলদ থাকটাই স্বাভাবিক। ছোট ঠাকুরদা মাঝে মাঝে বাগালের সঙ্গে মাঠে গরু নিয়ে যেতেন। একদিন হালবাড়ি দিয়ে একটি বাছুর গরুকে মেরে ফেলেছিলেন। মেজ ঠাকুরদার ভয়ে সেজ ঠাকুরদা ছোটভাইটিকে একরাত চিলেকোঠায় লুকিয়ে রেখে পরদিন ঠাকুরদার কাছে পৌঁছে দিয়ে সব ঘটনা শুনিয়ে বলেন, দাদা তুমি ওকে কোন একটা কাজে ঢুকিয়ে দাও, হাতের কাছে পেলে মেজদা ওকে মেরেই ফেলবে। ঠাকুরদা ভাইকে কনস্টেবলের পোস্টে কাজ পাইয়ে দেন। তারপর পড়াশোনা করে একের পর এক পরীক্ষা দিয়ে  বহু বছর পর উনি অফিসারের পোস্ট পেয়েছিলেন। ছোটঠাকুমা খুব জাঁদরেল মহিলা  ছিলেন, একথা আগেই বলেছি। এঁদের ছয়ছেলে তিনমেয়ে। দুই পিসির কথা আগেই বলেছি। ভাইবোনেদের মধ্যে সবার বড় ছিলেন পারুলপিসি। এই পিসির শ্বশুরবাড়ি এই জেলারই এক গ্রামের সচ্ছল পরিবারে। ছোট ঠাকুরদার বড়ছেলে স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মেজ খুব ভাল ফুটবল খেলতেন। বি এন আর এ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই সুবাদে চাকরিও পেয়েছিলেন। সেজছেলে হাইস্কুলে চাকরি পেয়েও করেননি। এখন সেই ভুলের মাশুল গুনছেন। বাকি তিনভাই অন্য কাজ করেন। এদের মধ্যে  ছোটছেলে আমার থেকে বছর আড়াইয়ের বড় হলেও আমার সাথে একই ক্লাসে পড়ত। ঠাকুরদা ঠাকুমা ন্যায় অন্যায়ের বিচার না করে এই ছেলেদের জন্য অর্থ সঞ্চয় করে থাকলেও শেষ বয়সটা দুজনেরই খুবই কষ্টে কেটে ছিল।দীর্ঘ কয়েক বছর শয্যাশায়ী ছিলেন। ঠাকুরদা আগে মুক্তি পেয়েছিলে। ঠাকুমা আরও কয়েক বছর বেঁচেছিলেন। যদিও সেটাকে ঠিক বাঁচা বলেনা।যে ঘরে থাকতেন, দুর্গন্ধে ঢোকা যেতনা। একমাত্র বড়ছেলে যতটা সম্ভভ মায়ের সেবা করতেন। 
      আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি, সেই সময় বাংলার একজন নতুন শিক্ষক আমাদের স্কুলে যোগ দেন। সম্ভবত শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেছিলেন। খুব সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন, কেতাদুরস্থ পোশাক পরতেন, স্বাভাবিক স্বরে কথাও বলতেন না। হঠাৎ শুনি স্যার এক ছাত্রীর প্রেমে পড়েছেন। আমি নিজেও একদিন চিঠি দেওয়া নেওয়া করতে দেখে ফেলেছিলাম, তবে কাউকে সে কথা বলিনি। ছাত্রীর বাড়ির লোক তড়িঘড়ি মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ওকে দাদার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। জানিনা কি ঘটেছিল, ওই দিদিটির বিয়ে হয়ে যায়, আর স্যারও স্কুলের চাকুরি ছেড়ে দেন। দিদিটার সঙ্গে কয়েকবার দেখা হয়েছে। শেষবার দেখার সময় ওর মধ্যে একটা পাগলামি লক্ষ্য করেছিলাম। দুটি আসুখি জীবন এভাবেই ভেসে চলেছে। কিম্বা থেমে গেছে। সঠিক খবর জানা হয়ে ওঠেনি।
                                                                                  (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments