জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-১২ /সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-১২

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

-মোকামা, দুর্গ, ভিলাই-

আমার এই শুধু পথ চলার সাথে স্রোতে ভেসে যাওয়াতেই চলমান জীবনের শুরু। এখন চেতনা বড়ো সীমাবদ্ধ। অনেক গুলো শব্দের কাছে আজ নতজানু হয়ে বসে আছি। সূর্যের আলোয় স্নান করে মাটিকে স্পর্শ করে ডুব দেয় কোনো এক পাখি।

মুঙ্গের রোডের বাড়ীতে থাকতে থাকতেই আবার মোরাদাবাদ থেকে মোকামা নতুন কাজের জন্য বাবাকে যেতে হল। বাবা মা-এর সাথে দিদিয়া, ছোট ভাই বাবু আর আমিও গেলাম সেখানে। ছোদ্দি আর ছোদ্দা(বটি) রয়ে গেল পিসিমার সাথে মুঙ্গের রোডের বাড়িতে। ছোদ্দাকে আবার আমি 'বটি' করে ডাকি। কারণ বটির ডাক নাম মন্টু। বড়রা 'মটি 'বললে, আমার মুখ দিয়ে বেরুত না, তাই বটি বলে ডাকতাম। ও হ্যাঁ! বলা হয় নি। এই সেই মোকামা জংশন, যেখানে প্রফুল্ল চাকী ধরা পড়েছিলেন, আর ছোট্ট ক্ষুদিরাম পালিয়ে গেছিলেন। প্রফুল্ল চাকী কে ধরার সাথে সাথেই মুখের মধ্যে বন্দুক পুরে দিয়ে 'জয়হিন্দ' বলে ট্রিগার চেপেছিলেন।

আহা! উনি মোকামা স্টেশনে নেমে নাকি জল খাচ্ছিলেন। যে ট্রেনে ওনারা ছিলেন সেই ট্রেনেই এক বাঙালির সন্দেহ হয়। মোকামা স্টেশনে নেমেই পুলিশে খবর দিয়ে দেয় সেই অতিআশ্চর্য বাঙালি লোকটি। ওখানেই ওনার একটা স্ট্যাচু আছে। শুনলে চোখে জল আসে।

--তোমার দেখছি সব মনে আছে ওই টুকু বয়সের কথা। পলাশ আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে ফেলল শিমুলকে।

--এইগুলোই তো ইতিহাস। আমাদের বাড়িতে পুরানো কথা আলোচনা হলেই আমি খুব মন দিয়ে শুনতাম। ভালো লাগত খুব। আর আমি ভালোবাসি এইধরণের গল্প শুনতে। আমি তো তোমার মা-এর কাছেও তোমাদের বাড়ীর অনেক গল্প শুনেছি যা তোমরা জানোই না। শুনেছি দিদিয়া আর বৌদিদের মুখে, ছোটবেলায় 'টপিকস' না করলে নাকি ভাত খেতাম না। অদ্ভুত লাগে সব ঘটনা।

এবার একটু চেঞ্জ করি। বড্ড একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে মজা দিঘিতে নিয়ে যাই এবার। সেই দিঘিতে ডুববে কিন্তু হাসতে পারবে না। বাড়িয়ে বলব না একটুকুও।

--হাসবো কেন? ভালো তো। জীবন তো একটা সাত রঙের রামধনুর মত। বলো শুনি...এক একটা মানুষের জীবনই তো এক একটা উপন্যাস! এটা কিন্তু আমি বিশ্বাস করি খুব।

--মোকামায় রেলের কোয়ার্টারে যেখানে থাকতাম আমরা, সেখানেই ছিল বাবার অফিসের জেনারাল ম্যানেজার-এর বাড়ি। তাঁর দুই ছেলে অচ্যুত আর আনন্দ। মনে হয় সেই ছিল আমার প্রথম প্রেম। যদি আজ সে বাঙালি হত, হয়ত খুঁজে পেত যান্ত্রিক জগতে। আবার হয়ত বা আমারই পড়শি হত। অবাঙালি, কাজেই বুঝবে না কি লিখেছি। বাঙালি হলে হয়ত ঠিক দেখতে পেত আর আমার বই পড়ে আমাকে ঠিক চিনতে পারত। ভালোবাসা? আমি বাঙালি, সে পাঞ্জাবী। আমি বউ আর সে বর। আমি পাঁচ আর সে সাত। মজার ভালোবাসা। শুরু হল নির্ভেজাল পুতুলদের প্রেম, শুরু হল নির্বেদ ভালোবাসা। তার নির্দেশে কোন ছেলের সাথে কথা বলা নিষিদ্ধ আমার। সবাইকে বলছে সরল কচি মনের কথা “মেরা বহু হ্যায় শিমুল। ওহ স্রিফ মেরা হ্যায়। মাম্মি নে বোলি, শিমুলসেই তেরে সাদি দিলবাউঙ্গী।” মোকামার কালচারাল কম্যুনিটিতে সিনেমা দেখানো হচ্ছে, “এক মালি দো ফুল” --পাশাপাশি বসে আছি আমরা নিচে। চেয়ারে সব বড়রা। যদিও এ গল্পের সময় তারিখ আমার মনে থাকার নয়। দিদিদের কাছে শোনা।

এক একবার যখন কেউ প্রেমের গল্প লিখতে বলে ভাবি লিখি তাকে নিয়ে এইভাবে...এইভাবে...

“তুমি কোথায় আছো অচ্যুত আমি জানি না। শুধু জানি আমার প্রথম প্রেম হয়ত তুমি-ই। নাহলে এখন কেন মনে পড়ছে সেই অবলা কচি বেলার খেলা।

চলে গেলাম দুর্গ বাবার ট্রান্সফারের জন্য। ভুলে গেলাম? না, অস্পষ্ট হয়ে এলো খেলা খেলা ভালোবাসা। প্রথম প্রথম বাড়িতে জিজ্ঞেস করতাম, অচ্যুতরাও আমাদের সাথে আসলে বেশ ভালো লাগত। জানতাম না, মনে মনে ওকে দেখতে চাইছি-এটাই হয়ত প্রথম ভালোবাসা।

কিন্তু আজও কেউ ভালোবাসার কথা বললে তোমাকেই প্রথম মনে পড়ে। তার মানে কি তুমিই ছিলে আমার একমাত্র ভালোবাসা? না, আজও আছে সেই ভালোবাসা অটুট, না প্রথম কলি মনের ভালোবাসায় শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা। এটা কি সম্ভব নাকি? বাবাও আজ নেই পৃথিবীতে, না হলে হয়ত তোমার ঠিকানা ঠিক পেয়ে যেতাম। যান্ত্রিক যুগে খুঁজে চলি এখনও তোমাকে। যদি দেখা পাই তোমার। কেমন দেখতে হয়েছ। কি করছ? কেমন আছো? আবছা মনে পরে, খুব সুন্দর দেখতে ছিলে, কোঁকড়ানো চুল। জমজ ভাই ছিলে তোমরা দুজন। অচ্যুত আর আনন্দ। তোমাদের পদবী মনে নেই। কি ভাবে থাকবে বলো? তখন তো ওসবের বালাই ছিল না। ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, “কাপুর না সন্ধু”? ছেড়ে দিলাম পদবির ব্যাখ্যা। দুই ভাই-এ ঝগড়া করতে আমাকে নিয়ে... আনন্দ বাদ গেলো তোমার কান্নাকাটিতে। শিমুল অচ্যুত যোগ হল। আমি কিন্তু তোমার সাথে বন্ধু করতে চাইতাম।

- “অচ্যুত কে হয় রে তোর, শিমুল?” -অচ্যুত বলেছে ও আমার বর। সবাই হাসত আমার কথা শুনে।

সত্যি ফিরে পেতাম যদি সেই নিষ্পাপ ছোটবেলা। সেই ভালোবাসা ভালোবাসা খেলা। তুমিও কি তাই ভাবছ নাকি? স্বপ্নের ভেতর ফোটে স্নেহের মতন জ্যোৎস্না। পুরানোর অনুনয়-বিনয় নেই, পিছটান নেই। আছে শুধু মনের গায়ে লটকানো মন্তব্যঃ আছো, কি নেই...”

দেখো, ছোট করে বলতে গিয়ে কত বড় হয়ে গেল। তাই হয় বোধহয়। দিদিয়াও তো আর নেই, কেই বা সেইসব দিনের গল্প করবে? সেই সহজ দিনগুলো ও আর নেই। আর আশ্চর্য কি জানো কি করে সব মনে আছে?

--এইগুলোই তো স্মৃতি শিমুল। লিখলে মনের সব জায়গায় সুস্থ বাষ্প চলাচল করতে পারে। পলাশ একটু দাঁড়িয়ে কথাকটা বলে ফেলল। হাত নিয়ে মাথার দুপাশে ধরে ঘাড় বেঁকিয়ে শরীরটাকে একটু গোছালো করে আবার বসে শুনতে লাগল।

--জানো তো ওখানেই প্রথম আমাকে 'কুমারী পুজো' করে।

--কুমারী পূজা কি একটু বলবে ? আমি সঠিক জানি না। শুনি বার বার কিন্তু কাউকে আর জিজ্ঞেস করতে পারি নি। কিছু মনে কোরো না প্লিজ।

তাও যতটুকু জানি বলছি। কেউ কেউ পড়ে হয়ত বলবে - “এটা কি থিসিস? এত লেখার কি প্রয়োজন?"

-  "আছে আছে প্রয়োজন আছে বৈ কি!”

কোথাও প্রথম দুর্গাপূজো করলে নাকি 'কুমারী পূজো' আগে করতে হয়। আর দুর্গাপূজোর সময় মা দুর্গাকে মনে রেখে এই কুমারী পূজো করা হয়। কুমারী পুজো না করলে সে পুজো সার্থক হয় না। ব্রাহ্মণ আর পাঁচ বছরের নিচে একমাত্র আমি ছিলাম মোকামায়। তাই আমাকে কুমারী করা হল। এখন তো আর ওসব মানা হয় না বারোয়ারী পূজোয়। মনে আছে এখনও... নিঃসন্তান বীণা মাসিমা সিল্কের সাদা আর লাল দিয়ে আঁকি বুকি শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে পুজোর পর কোলে করে ওনার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন কারণ, সেদিন আমি ওনার মানসী কন্যা হয়েছিলাম। পরে মা কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "মা বীণা মাসিমা কাঁদছিলেন কেন যখন আমি বাড়ি চলে এলাম?"

মা বললেন, - “ও এমনি। তুমি বুঝবে না।” আমার কিন্তু খুব অসুখ করেছিল তখন। তারপরেই তো জামালপুর এ গিয়ে বিকলয় রোগে ভুগলাম। মা বলেছিলেন পুরোহিত কে যে, 'সব করুন ঠাকুরের সামনে ওর পা পুজো করবেন না ।'

ওনারা কিন্তু করে ফেলেছিলেন আমার পা পুজো। সবার যে শরীর খারাপ হয়, তা নয় কিন্তু। আমার হয়েছিল খুব শরীর খারাপ। প্রায় মৃত্যু থেকে বেঁচে ফিরেছিলাম।

চলো! এইবার বাড়ি যাওয়া যাক। ক্লান্ত দুজনেই এখন। সন্ধ্যেপুজো করতে হবে। তারপর না হয় আবার গল্প। গ্যাপ রেখে বললে দেখবে টাইম কেটে যাচ্ছে আর শুনতেও ভালো লাগছে। কি গো তাই না? কি বলো? মনটা অনেক হালকা লাগছে। দুজনে খাবার শেষে বাড়ি ফিরে এল। অনেক কথা...অনে এ এক। যার আর পর নেই।

গাড়িতে গিয়ে দুজনে বসল। স্টিয়ারিং হাতে শিমুল আবার বলে চলল।

-তারপর বাবা আবার চলে গেলেন ভিলাই। আমরা রয়ে গেলাম মুঙ্গের রোডের বাড়িতে। এইবার একটু একটু করে মনে আসছে মিতান-কালাচাঁদ, শুভা, ডাবি, মঞ্জরী, শেলু, বেবু সব বন্ধুদের কথা। একটা কথা শুনলে তোমার ও হাসি আসবে। তখন থেকেই ছিল বাঙালি আর বিহারী। আমাদের সাথে ঝগড়া হলেই মঞ্জরী বলত:

“ বাঙ্গালি ভূত/খাটিয়া পর শুত,
খাটিয়া পর আগ লগে /ছটপটাইয়া উঠ...” বলেই শিমুল হেসে ফেলল।

--হাসছো কেন? বলবে না? পলাশ আবার হিন্দি ভালো বোঝে না।

--বলব তো। বলব বলেই তো তোমাকে বললাম। এই 'বাঙালি ভূত' বললেও ও কিন্তু আমাদের বাড়িতে 'বাছা লক্ষ্মীপূজার' সময় আমার সাথে খুব ভাব জমাত। নয়ত আমরা সবাই ওকে বাদ দিতাম। বিহার! কিন্তু বাঙালি বেশি ছিল। কি মজার তাই না?

--শিমুল! বাছা লক্ষ্মী পুজো কি ? বলো যদি শুনি, জানি কিছু তোমার কাছ থেকে। গাড়ির স্পীড একটু কমিয়ে দাও। কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে পুলিশ মামা কে জানে?

--এই লক্ষ্মীপূজা হয় বছরে চারবার। ভাদ্র, কার্তিক, পৌষ আর চৈত্র। আমাদের ঠাকুরও অদ্ভুত ছিল মানে আর কারুর দেখি নি কখনো । একটা মাটির হাঁড়িতে ঠাকুমার রাখা কত কিছু আছে, তার মধ্যে কাঠের দুটো লাল-হলুদ-সবুজ রং করা পেঁচা-পেঁচী, কাঠের সিঁদুর কৌটো, শাঁখের তৈরী সিঁদুর কৌটো। একটা বেতের সাদা রঙ্গের চুবড়িতে নতুন ধান দিয়ে পুজো করা হত। তাতে সিঁদুর মাখানো হত। নতুন ধান দিয়ে পুরানো একটা গাছকৌটো আর তার সঙ্গে একটা বেঁটে চ্যাপটা কাঠের কৌটো, সেটাও সিঁদুর মাখা রাখা হত( সবই নাকি আমার ঠাকুরমার আমলের)। সেইসব কৌটোকে নতুন চেলী পরিয়ে আলপনা দেওয়া একটা জলচৌকিতে বসানো হত ধানের চুবড়ির আশে পাশে। তার ওপর একটা নতুন লাল গামছা ঢাকা থাকত। ফুলের সুবাস পাওয়া যেত, ব্যঞ্জনের সুগন্ধ, ধূপধুনোর সুবাস, পঞ্চ প্রদীপ থেকে ঘি-এর গন্ধ, সব মিলিয়ে একটা অপার্থিব ব্যাপার হত।

পুরোহিত জ্যাঠামশাই-এর পুঁথি পড়ার পরে পুজোর ঘর সামান্য সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হতো, ওইসময় নাকি মা লক্ষ্মী দৃষ্টিভোগ সারেন। মানুষের বিশ্বাস আর কি। দরজা খোলার পরে ঘরে একটা অলৌকিক ভাব দেখা যেত।

--তুমি এত জানো কি করে? পলাশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

--আমি তো সব সময়-ই মা এর সাথে সাথে থাকতাম। মা নাকি দিদিদের বলতেন, “আমার সিমটি সব সময় পায়ে পায়ে গুট গুট করে ঘোরে।” তারপর ঝাড়্গ্রামে বড় বৌদির কাছে থাকার সময় আমিও সাহায্য করতাম বৌদিকে। তাই ঠাকুর পুজো এখনও করি আর না করলে মনটা কেমন যেন করে।

শুনলে না ঝাড়্গ্রাম গেলে বড়বৌদি বলল সারা বাড়ি আলপনা দিতাম লক্ষ্মীর চরণ, ধানের শিষ, ধানের মড়াই।

(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments