জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-১৫/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ১৫

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

স্বামী যোগানন্দ

শ্রীরামকৃষ্ণের অপর এক ত্যাগী ঈশ্বরকোটি সন্তান হলেন স্বামী যোগানন্দ। তাঁর পূর্বা‌শ্রমের নাম ছিল যোগীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী। দক্ষিণেশ্বরে বিখ্যাত সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশে জন্মগ্রহণ করেন (১৮৬১ সালের ৩০ মার্চ, ১২৬৭ বঙ্গাব্দের ১৮ চৈত্র চান্দ্র ফাল্গুন কৃষ্ণা চতুর্থী তিথি, শনিবার)। স্বামী বিবেকানন্দের তুলনায় বয়সে বছর  দুয়েক বড় ছিলেন। পিতা নবীনচন্দ্র চৌধুরী অতিশয় নিষ্ঠাবান ধার্মিক ব্রাহ্মণ ছিলেন। সারাদিন পূজা, উপাসনা, ধ্যানে অনেক সময় কাটিয়ে দিতেন। বাল্যকাল থেকেই যোগীন্দ্রনাথের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার প্রতি ঝোঁক লক্ষ্য করা গিয়েছিল। পাঁচ বছর বয়সি বালক নীরবে আকাশের নক্ষত্রাদির দিকে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে থাকত একদৃষ্টিতে। বন্ধুদের কল্পনাপ্রসূত ভাবনা থেকে বলত,“এটা আমার জায়গা নয়, আমার জায়গা ওইখানে।” বালক মনে করত তাঁর সব আপনজনেরা ওই স্বর্গীয় নক্ষত্রমণ্ডলের মধ্যে রয়েছে! যোগীন্দ্রনাথ যখন কলেজ ছাত্র, তৎকালীন ব্রাহ্মসমাজের তরুণ ও প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা কেশবচন্দ্র সেন লিখিত একটি নিবন্ধে শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে জানতে পারেন। এই নিবন্ধ পাঠের পর শ্রীরামকৃষ্ণ সমীপে উপস্থিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অথচ দক্ষিণেশ্বরেরই অধিবাসী ছিলেন। কিন্তু রাসমণির ভবতারিণী মন্দিরে মায়ের পূজারি শ্রীরামকৃষ্ণকে এতদিন দর্শন করতে যান নি। এর পিছনে কারণ ছিল। স্থানীয় মানুষজনের অধিকাংশ শ্রীরামকৃষ্ণ বিষয়ে ভালো কথা বলতেন না। তারা তাঁকে বুঝতে পারেন নি। কেউ বলত ‘পাগল’, কেউ ‘ঠগ’। এই বিরুদ্ধ সমালোচনার পরিবেশে তরুণ যোগীন্দ্রনাথ নিজেকে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। তবে প্রথমবার শ্রীরামকৃষ্ণ দর্শনের আগে একটি ঘটনা ঘটেছিল। দক্ষিণেশ্বর মন্দির এলাকায় অপূর্ব উদ্যানে পুষ্পরাজি প্রস্ফুটিত হয়ে থাকত। সেই পুষ্পের কয়েকটি যোগীন্দ্রনাথের তুলে নেওয়ার ইচ্ছা হল। সেখানে এক ব্যক্তি উপস্থিত ছিল, তাঁকে উদ্যানের মালি মনে করে বললেন,“ ও মালি, আমাকে কয়েকটা ফুল তুলে দেবে।” সেই মালি কয়েকটি ফুল তুলে দেয় তাঁর হাতে।
   কেশবচন্দ্রের নিবন্ধ পড়ে যেদিন প্রথম দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরের সামনে উপস্থিত হলেন, দেখলেন ঘরের মধ্যে যে ব্যক্তি অনর্গল ধর্মীয় প্রসঙ্গ করে চলেছেন এবং উপস্থিত সকলে তা মুগ্ধ হয়ে শুনছেন, তিনি আর কেউ নন, সেই মালি! কলকাতা শহরের তাবড় তাবড় লোকের সামনে বেদান্তের উচ্চ কথা ব্যাখ্যা করে চলেছেন। যোগীন্দ্রনাথ ভাবলেন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলে যদি তাঁকে চিনতে পেরে যান তাহলে লজ্জার শেষ থাকবে না। এই ভেবে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের অমৃতকথা শ্রবণ করতে লাগলেন। এদিকে হঠাৎই শ্রীরামকৃষ্ণ একজনকে বললেন,“বাইরে যারা যারা দাঁড়িয়ে আছে ভিতরে আসতে বল।“ বাইরে একমাত্র যোগীন্দ্রনাথই দাঁড়িয়ে ছিলেন। একেই কি বলে ঈশ্বরের আহ্বান! যাই হোক অগত্যা তাঁকে ঘরে প্রবেশ করতেই হল। শ্রীরামকৃষ্ণ স্বাগত জানালেন। বললেন--“তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ?“ যোগীন্দ্রনাথ নিজের নাম ও পরিচয় জানালেন। পরিচয় পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তিনি বললেন,“তবে তো তুমি আমাদের চেনা ঘর গো! তোমাদের  বাড়িতে আমি তখন কত যেতুম, ভাগবত ,পুরাণ প্রভৃতি শুনতুম--তোমাদের বাড়ির কর্তাদের ভিতর কেউ কেউ আমাকে বড় যত্ন করতেন।” এরপর ওই ঘরে উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“এঁরা দক্ষিণেশ্বরের সাবর্ণ চৌধুরী। এঁদের প্রতাপে সেকালে বাঘে-গরুতে একসঙ্গে জল খেত। এঁরা লোকের জাত দিতে নিতে পারতেন। ভক্তিমানও সব খুব ছিলেন--বাড়িতে কত ভাগবত-পুরাণাদি পাঠ হত। জানাশোনা হল, বেশ হল-- এখানে যাওয়া আসা করো। মহদ্বংশে জন্ম তোমার লক্ষণ সব আছে। বেশ আধার--খুব (ভগবদ্ভক্তি) হবে।” 
   শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের বিদগ্ধ সন্ন্যাসী স্বামী মাধবানন্দজী শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ পার্ষদদের নিয়ে লিখছেন--“...তাঁহারা যে এ পৃথিবীর লোক ছিলেন না, তাহা বাল্যকাল হইতেই তাঁহাদের জীবনের ধারা ও অধ্যাত্মরাজ্যে দ্রুত, অভূতপূর্ব উন্নতির কথা পর্যালোচনা করিলেই সহজে বুঝিতে পারা যায়। অন্য দশজনের মতোই সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিপালিত হইয়া, কিরূপে এক অন্তর্নিহিত প্রেরণায় তাঁহারা নানা বাধাবিপত্তি অতিক্রম করিয়া--অধিকাংশ স্থলে যৌবনের প্রারম্ভেই--শ্রীরামকৃষ্ণের পাদমূলে উপনীত হন এবং তাঁহার দিব্যস্পর্শে এক নূতন রাজ্যের সন্ধান পান, তাহা পাঠ করিলে অতিমাত্রায় বিস্মিত হইতে হয়। আরও বিস্মিত হইতে হয় শ্রীরামকৃষ্ণের লোক চিনিবার ও তাহাদিগকে নিজ নিজ ভাব অনুযায়ী ধর্মরাজ্যে অগ্রসর করিয়া দিবার ক্ষমতা দেখিয়া। ইহাতে স্ত্রী-পুরুষ, গৃহি-ত্যাগী, ব্রাহ্মণ-শূদ্রাদির ভেদ ছিল না। দেহগত কোন বাহ্য আবরণ তাঁহার অতীন্দ্রিয় দৃষ্টিকে প্রতিহত করিতে পারিত না। কোন কোন স্থলে জগন্মাতা তাঁহাকে পূর্ব হইতেই ইহাদের আগমন বিষয়ে জানাইয়া দিয়াছিলেন। এইজন্য সাধনকালের অবসানে তিনি অত্যন্ত উৎকণ্ঠার সহিত ঐ সকল চিহ্নিত ভক্তের আগমন প্রতীক্ষা করিতেন।” স্বামী যোগানন্দজীর জীবনকথা পর্যালোচনা করলে এই বক্তব্যের সত্যতা পরিস্ফুট হয়। কেননা লীলাপ্রসঙ্গকার স্বামী সারদানন্দজী লিখছেন--“প্রথম আগমন দিবসে ঠাকুর ইহাকে দেখিয়া এবং ইহার পরিচয় পাইয়া বিশেষ প্রীত হইয়াছিলেন এবং বুঝিয়াছিলেন, তাঁহার নিকট ধর্মলাভ করিতে আসিবে বলিয়া যে-সকল ব্যক্তিকে শ্রীশ্রীজগন্মাতা তাঁহাকে বহু পূর্বে দেখাইয়াছিলেন, যোগীন কেবলমাত্র তাঁহাদের অন্যতম নহেন, কিন্তু যে ছয়জন বিশেষ ব্যক্তিকে ঈশ্বরকোটি বলিয়া জগদম্বার কৃপায় তিনি পরে জানিতে পারিয়াছিলেন, ইনি তাঁহাদিগেরও অন্যতম।”


   শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যোগীন্দ্রনাথ বা যোগীনের যাতায়াত শুরু হল। স্বভাবানুযায়ী নির্জনতাপ্রিয় ছিলেন। তাই কখন তিনি আসতেন বা যেতেন, কেউ টের পেত না। ভক্তরাও নয়! দিনকে দিন শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গলাভে তাঁর মনে প্রবল বৈরাগ্যের সঞ্চার হল। প্রবেশিকা পরীক্ষান্তে আর পড়াশোনায় মন বসল না। ঐহিক জীবনের প্রতি উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেল। ঠাকুর বলেছেন, কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ না করলে ঈশ্বরলাভ হয় না। এদিকে সমৃদ্ধ সম্পদশালী বংশের মানুষ হয়েও বিষয়বিমুখতার কারণে পিতা নবীনচন্দ্র দারিদ্র কবলিত হলেন। সংসারের অনটন নিরসনার্থে আনুমানিক ১৮৮৪ সালে চাকরির সন্ধানে কানপুরে গিয়ে উপস্থিত হলেন যোগীন্দ্রনাথ। এই পর্যায়ে একের পর এক নাটকীয় মোড় নিতে থাকল যোগীনের জীবন। তিনি ক্রমে ক্রমে সংসারের অসারতা আরও সম্যকভাবে উপলব্ধি করলেন। কিন্তু পড়ে গেলেন বিপাকে। সেই বিপাক কীরকম , সেসব নিয়ে রীতিমতো চমকপ্রদ সব ঘটনার উল্লেখ করব পরবর্তী পর্যায়ে। পরম কারুণিকের কৃপায় সেসব অবশ্য উতরে গিয়েছিলেন । শ্রীরামকৃষ্ণের ঈশ্বরকোটি সন্তান হয়েও ঐহিক জীবনের ক্লেদ তাঁকে আক্রমণে জর্জরিত করতে ছাড়ে নি!

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments