জ্বলদর্চি

রূপহলুদ /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব - ১০
রূপহলুদ

ভাস্করব্রত পতি

"রূপ হলুদের ব্রত করে চাইছি বর এমন।
জন্মে জন্মে রূপ যেন হয় হলুদের মতন।।"
স্বামীর সোহাগ এবং নিজের রূপসৌন্দর্যের কামনায় এই লৌকিক উৎসব তথা ব্রত পালিত হয় একান্ত ঘরোয়াভাবে। এটি একদমই সধবা মহিলাদের নিজস্ব উৎসব। বাড়ির বা বাড়ির পার্শ্ববর্তী যে কোনও একজন এয়োকে প্রনাম এবং শ্রদ্ধা জানিয়ে শুরু হয় এই ব্রত। এর যাবতীয় নিয়ম চলে পরপর চার বছর। প্রতি বছর রূপহলুদ পালন শুরু হয় চৈত্রের সংক্রান্তিতে। তা পালিত হয় দীর্ঘ একমাস ধরে। বৈশাখী সংক্রান্তির দিন তা শেষ হয় আনুষ্ঠানিক ভাবে। এভাবেই প্রতি বছর পালিত হয় ঐ নির্দিষ্ট সময়ে।

ড. শীলা বসাক লিখেছেন, "কুমারী জীবনে নারীরা যে শিক্ষালাভ করে পরবর্তী বিবাহিত জীবনে সে শিক্ষাকেই অনুসরণ করার প্রবণতা সধবা নারীদের মধ্যে দেখা যায়। তাই গৃহের নৈতিক ও ধর্মীয় পরিবেশকে নিত্য ব্রত পালনের মধ্যে দিয়ে রক্ষা করার চেষ্টা বা প্রবণতা সধবা নারীদের মধ্যে দেখা যায়। সধবাদের ব্রতকল্পকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন ধন-সম্পদ, সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি প্রভৃতি বৃদ্ধির আশায় দেবী লক্ষ্মীর, সন্তানের মঙ্গলকামনায় দেবী ষষ্ঠীর, স্বামী পুত্র-আত্মীয় পরিজন সকলের মঙ্গলকামনায় মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত পালন করা হয়। এছাড়া রোগমুক্তি, অকালমৃত্যুরোধ এবং বৈধব্যখণ্ডন ও আয়ুবৃদ্ধির কামনায় সধবা নারীরা কিছু ব্রত পালন করে।" ঠিক এই ধরনের কামনায় এই বাংলায় উদযাপিত হয় নখছুট, আদাহলুদ, নিত্যসিঁদুর, সৌভাগ্যচতুর্থী, তেজোদর্পণ, আদর সিংহাসন, এয়ো সংক্রান্তি, ষোলো কলা ইত্যাদি উৎসবগুলি।

উৎসব পালনের প্রথম বছরে প্রথম দিন (চড়কের দিন) সকালে একজন এয়ো মহিলার কপালে হলুদ বাটা মাখিয়ে তাঁর কাছ থেকে ব্রত নিতে হয়। বিকেলে ঐ মহিলার চুল ভালো করে আঁচড়িয়ে ও বেঁধে তাঁর কপালে এবং সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে উপাদেয় খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। এভাবেই প্রতিদিন সকালে এবং বিকেলে একই পদ্ধতিতে একজন করে এয়োকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে বৈশাখ সংক্রান্তি পর্যন্ত। আসলে এভাবে অন্য এয়োস্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমেই ব্রতিনীর মনোষ্কামনা পূরণ করার রীতিনীতি। বলা যেতে পারে এয়োস্ত্রীদের সেবাযত্ন করাই মূল উদ্দেশ্য।

দ্বিতীয় বছরে ঐ একই পদ্ধতিতে প্রতিদিন যে কোনও দুজন এয়োকে এভাবে সন্তুষ্ট করা হয় একমাস জুড়ে। তৃতীয় বছরে তিনজন এয়োকে করতে হয়। চতুর্থ বছরে চারজন এয়োকে এরকম করা হয়। চতুর্থ বছরে উদযাপনের শেষ দিনে ঐ চারজনকে একসাথে বাড়িতে ডেকে আপ্যায়ণ করার নিয়ম আছে। তাঁদের প্রত্যেকের মাথায় সুগন্ধি কেশ তেল মাখিয়ে চুল বাঁধা হয়। তারপর প্রত্যেককে নতুন কাপড় পরিয়ে আগের মতোই কপালে এবং সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে তাঁদের পরিপাটি করে আহারের ব্যবস্থা করা হয়। শেষে প্রত্যেককে একটি করে হলুদে ডোবানো ( ছোপানো ) গামছা, সিঁদুর চুপড়ি, চিরুনি, আলতা, মিস্টি এবং যৎসামান্য দক্ষিনা দান করার নিদান রয়েছে। তবে যে এয়োকে নিয়ে প্রথম বছরে রূপহলুদ উপচার পালিত হয়েছিল, এদিন তাঁর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। ঐ এয়োকে এদিন দেওয়া হয় হলুদ গোলা জলে ছোপানো লালপাড় শাড়ি, আয়না, চিরুনি, তালপাতার হাতপাখা, দামী সিঁদুর কৌটো এবং রৌপ্য মুদ্রা। আসলে রূপহলুদ নামক লৌকিক উৎসবে প্রথম বছরে একজন, দ্বিতীয় বছরে দুজন, তৃতীয় বছরে তিনজন এবং চতুর্থ বছরে চারজন সধবার সেবাযত্ন করাই মূল উপচার।

এটি সম্পূর্ণ ঘরোয়া উৎসব। বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সার্বজনীন না হলেও বাঙালি সংস্কৃতির এক অতি জনপ্রিয় উদাহরণ এটি। ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্মান জানানো এবং অন্যদের আপন করে নেওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় ছত্রে ছত্রে। মনের আবিলতা দূরে ঠেলে অন্য এয়োস্ত্রীর কাছে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার সুর উথলে ওঠে এক মাস ধরে। ফলে ঐ ব্রতিনীও তাঁর জীবনের সাথে অতি সহজেই পেয়ে যায় নিরহঙ্কার, অহিংসা, ঈর্ষাহীনভাবে বেঁচে থাকার রসদ। একজন মহিলা যদি অন্য মহিলাকে সম্মান জানায়, এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে কি? এটাই এই উৎসবের মূল উপজীব্য। এটি এক ধরনের 'মনস্তাত্ত্বিক থেরাপি'। আর তার ছাপ পড়তো ব্রতিনীর মুখমণ্ডলে।

এক অনাড়ম্বর এবং সহজ সরল সাধাসিধে জীবনের সাথে নিজেকে মিলিয়ে নেয়। এটাই তাঁর সারা জীবনের চলার পথে পাথেয় হয়ে ওঠে। সকলের কাছে ঐ কম বয়সী মহিলাটি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে ভালোবাসার মানুষ। স্বাভাবিকভাবে তাঁর কপালে জোটে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি সহ পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে একরাশ অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং স্নেহ। এই উৎসব আসলে Mentally Strong করে মহিলাদের। মনের মধ্যে প্যাঁচ জমতে পারেনা। ফলে দুশ্চিন্তা থাকে না। আনন্দে এবং হাসি মশগুলে কেটে যায় জীবন। আর তার ছাপ পড়ে মুখমণ্ডলে। দৈহিক রূপে। চিন্তা না থাকলে মুখে বলিরেখা আসেনা। রূপ বজায় থাকে অনেক বছর ধরে। সৌন্দর্য বেড়ে যায় অচিরেই। এটাই এই উৎসবের তথা ব্রতের গূঢ় রহস্য। খোলামন এবং দিলদরিয়া হৃদয় নিয়ে আর সকলকে আপন করে নেওয়ার বিরল ক্ষমতায় ভর করে ঐ সধবা হয়ে ওঠে আরও সুন্দর। আরও রূপবতী। আরও প্রিয়পাত্র। ফলে সহজেই তাঁর কপালে জোটে সুখ, সমৃদ্ধি, সৌভাগ্য এবং রূপ লাবণ্য।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments