জ্বলদর্চি

অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান --৩/দিলীপ মহান্তী

অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান

দিলীপ মহান্তী

।৩।

' শুধু মাত্র নিজের জন্যই অনেকগুলি কবিতা লিখে রাখতে ইচ্ছা হয়।
নিজের জন্ম, জীবন, এবং মৃত্যুকে বিষয় করে।'
(কোলাহল: মাটির মন)

      অশোক মহান্তীও আরও কয়েকজন বাঙালি কবির মতো কবিতাকে জীবনের দিকে নিয়ে গেছেন। কখনও কখনও নয়, বেশিরভাগ সময়ই  জীবনই হয়ে উঠেছে কবিতা। কবিতাই হয়ে উঠেছে জীবন। আর সেই কবিতা অবশ্যই শিল্প সার্থক । নিজের জীবনকে রূপ ও তাৎপর্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, দিতে চেয়েছেন দীপ্তি ও ঐশ্বর্য। নিজেকে ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলেছেন আঘাতে- আঘাতে, বেদনায়- বেদনায়, যন্ত্রণায়- যন্ত্রণায়, শিল্পের মাধুরীতে যা সম্ভব হয়েছে উদাসীন ভগবানের নিরপেক্ষতায়।

১. ' আর এই উড়নচণ্ডীর দেশ পৃথিবীতে
       কতকাল হলো আমি কাব্য- অভিলাষী, গুঁড়ি মেরে বসে আছি।

     আমার পায়ের তলে দগ্ধ মৃত্তিকায় পূর্ণ নীল নভস্থল
     আমার হাতের পাঁচ শুধু কিছু শব্দরাজি আর এই পৃথিবী বিশাল
     মহাশূন্য,  মহাঘোর।
     ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে মরণ- তামাসা, দ্যাখো কীরকম ভাবে বেঁচে আছি 

     নীল অশ্বক্ষুরের তলায়।
    দিগন্তে দিগন্তে শুধু মৃত্যুরিক্ত জীবন ফোঁপায়।
         (কবিতার সংজ্ঞা : মাটির মন)

 ২.' ভালো আছি।
      দু' দিনের ভাঙাঘর, তার মধ্যে জ্বলে যায়  যতটুকু প্রাণ
      সে আমার অবশেষ।
     সে আমার মৃত্যুর পরেও বাঁচা, মরে বেঁচে থাকা, সে আমার অমরত্ব।

    আমার তো রাজ্য নেই। রাজগীরও নেই।
    আমার আকাশ নেই, সেবা নেই, উপভোগ, অস্থিরতা নেই।
   আছে, অনেক জনের সঙ্গে পা-মিলিয়ে নির্বাচন-কেন্দ্রে ছুটে যাওয়া
   রেশনের লাইনে দাঁড়ানো।

   আর আছে নিজের মধ্যেই এক দুরন্ত-দুপুর দীর্ঘ মিছিলের মতো।
   এলোমেলো, অবিশ্বস্ত। আছে পাঁক, পাঁকের ভেতরে রাখা
   ফুলের শেকড়, যা থেকে আকাশ হয়।

   পাতার আকাশ থেকে আমি যে আকাশ দেখি সে আকাশ আরো শূন্য, নীল।
    সে আকাশ মৃত্যু-ব্যাপ্ত - সব সীমাহীনতাকে ছুঁয়ে - আবার নিজেকে ছোঁয়।
   নিজেই নিজের কথা বলে - আর স্তব্ধ ও আকাশ হয়ে যায়
   সে আকাশ আরও শূন্য - আরো স্তব্ধ - শূন্য হয়ে যায়।

   আমার শূন্যতা নেই।

   নিজে আমি জেনেছি গোপন,  শিরায় রক্তের চাপ, ভালোবাসা-অনুভূতিগুলি
    সমস্ত নির্জনরাত, নির্জন দুপুরবেলা, আমাকে জড়ায়
    তাদের জড়িয়ে ধরে যে-কথা বলায়,  সেই কবিতার কথা
    সেই জীবনের কথা বার বার - 

    ভালোবেসে আছি। আরও ভালো থাকবার...
           (ভাঙাঘর : মাটির মন)

       এভাবেই জীবনকে কবিতার দিকে নিয়ে গেছেন আর কবিতা লিখতে লিখতে নিজের অজান্তেই বাংলা কবিতার ইতিহাসে নিজের স্থানটি পাকা করেছেন। কালের কোষ্ঠীপাথরে তাঁর কবিতা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। জীবিত অবস্থায় তাঁর যতটা সম্মান পাওয়া উচিত ছিল ততটা সম্মান তিনি পাননি। বড় বড় প্রতিষ্ঠান যখন তৃতীয় শ্রেণির কবিকে নিয়ে ঢাক ঢোল পিটিয়েছে তখন তিনি প্রথম শ্রেণির কবি হয়েও অজস্র ছোটো পত্রিকায় একটির পর একটি আশ্চর্য কবিতা উপহার দিয়ে প্রকৃত কবিতা পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।

       তাঁর মৃত্যু প্রায় কুড়ি বছর হতে চলল। তাঁর সময়ের অনেক বাণিজ্য-সফল কবিই বেঁচে থাকতে থাকতেই ক্রমশ ফিকে হচ্ছেন‌। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন। অথচ তাঁর কবিতা নিয়ে নতুন ভাবে চর্চা হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম তাঁর কবিতার আগুনে হাত সেঁকে নিচ্ছে।

  যদিও অশোক মহান্তীর প্রথম কবিতার বই ' আবহ সকাল' প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৪ সালে; কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই তাঁর কবিতা এই বাংলার অজস্র পত্রিকায় শ্রদ্ধার সঙ্গে ছাপা হয়েছে। নিজেও সম্পাদনা করেছেন, ১৯৭৪ - ১৯৮০ সাল পর্যন্ত 'সাম্প্রতিককাল' নামের একটি পত্রিকা। প্রথম কাব্য গ্রন্থের সময়পর্ব থেকেই তাঁর কবিতায় প্রেমের রক্তরাগের পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনের জ্বালা যন্ত্রণা ফুটে উঠলো। সময়ের সঙ্গে সমাজের সঙ্গে দেশের সঙ্গে তাঁর এক রণরক্ত বোঝাপড়া প্রত্যক্ষ করলাম। এক তীব্র দহনে প্রচলিত রীতিনীতি ও যাবতীয় অন্যায় অত্যাচার, শোষণ বঞ্চনা, যন্ত্রণার বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী কন্ঠস্বর ভাষা পাচ্ছে ঝলসানো রূপে। তথাকথিত সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি বেছে নিচ্ছেন নিজস্ব পথ। এই সময়পর্বেই তাঁর আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়। কবিতার সূত্র ধরেই তিনি খুঁজে পান জীবনসঙ্গিনী আভা ষড়ঙ্গীকে। নিজে যাঁকে সাধনা নামে ডাকতেন। যদিও বিয়ের অনেকদিন আগে থেকেই তাঁরা একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন। কবিতার মাধ্যমে কবি ও পাঠিকার যোগাযোগ, তারপর প্রেম, তারপর একসঙ্গে ঘরকরা, তারপর বিয়ে।
        আমাদের এক ঠাকুরদার শ্রাদ্ধশান্তির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন অশোকদা ও আভা বৌদি, আমাদের বাঁকুড়ার দেশের বাড়িতে।  তখনও তাঁদের বিয়ে হয়নি। শ্রাদ্ধশান্তির অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে প্রচুর আত্মীয় সমাগম হয়েছিল। ক্ষৌরকর্ম, পরের দিন শ্রাদ্ধ ও তার পরেরদিন নিয়মভঙ্গ ও নরনারায়ণ সেবা ইত্যাদি সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর সেই আত্মীয়স্বজনের সামনেই তাঁদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে হল। আমি তখন ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে ভর্তি হওয়ার পথে। তখনই শুনেছিলাম ' আবহ সকাল' নামে তাঁর একটি কবিতার বই প্রেসের প্রসূতি সদনে অপেক্ষা করছে ভূমিষ্ঠ হওয়ার জন্য। সেই সময় এক দুপুর বেলার আড্ডায়  আভা বৌদি স্মৃতি থেকে কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। অশোকদাও উপস্থিত ছিলেন। এখনো সেই মুহূর্ত জ্বলজ্বল করছে। তার মধ্যে কয়েকটি কবিতা ছিল এইরকম:

  ১. ‘রাজা তোমার বাজনা বাজাও যাচ্ছি আমি দেশে
     রাজারে তুই বুক খুলে রাখ যাচ্ছি রাজার বেশে।’
            (মরণ)

   ২. ‘নীল উৎপল কিংবা স্নেহস্পদা নীল গাভীর গা ঠেকিয়ে
      তুমি একদিন বাঁশি বাজিয়েছিলে, তখন
      নারীর আঁচল থেকে খসে পড়েছিল শিল্প এবং
      আকাশের দক্ষিণ সীমানা থেকে প্রবলতর হচ্ছিল বায়ু
            সকল ছিঁড়ে খুঁড়ে
      এক তরুণতম সন্ন্যাসীর কন্ঠে দীপ্ত হচ্ছিল তেজ
      একটি আতুর শিশুর কান্নার মতন
      শহরের অধ্যাপকের বসতবাটিতে সঞ্চিত হচ্ছিল বিষাদ
      কে যাবে কখন পারাবতের গায়ের পালক আনতে‘’
           (তুমি সূর্য তুমি সোনা)

    ৩. ‘নিচে মাটি উপরে আকাশ
       নিচে জল উর্ধ্বে বাষ্প ওঠে
       মধ্যিখানে শাশ্বত বাতাস
       ভালোবেসে মাখি বুকে ঠোঁটে
       …    …     …
       তুমি কি আমাকে নিতে পারো
       আজ কিংবা আরেক সন্ধ্যায়
       জন্মান্তরে অথবা তাহারো
       পরবর্তী অন্তিম খেয়ায়?’
         (কথা দিলে)

    ৪.  'কিছুই যাবে না বললে ভুল হয়, দিগন্তের নির্বন্ধকে মানো।
                  দেখোনি কি, প্রতি পদক্ষেপে জীবন মৃত্যুর দিকে ছুটে যায়
                  বনে বনে ঝরে পাতা    মরা পাতা পড়ে থাকে ভুঁয়ে
                  কিছুই যাবে না বললে ভুল হয়, দিগন্তের নির্বন্ধকে মানো।

      মৃত্যুর সমীপবর্তী প্রণয়ের অন্ধ অনুরাগে বিশ্বাসের তৃণ
      সে তীর চৈতন্য-মগ্ন বিদ্ধ করে নীলাভ শরীর
     রক্তে তাই দেনা,  রক্তে তাই অপারগ ইচ্ছার আকুতি দিন দিন
                      প্রতিদিন ক্ষয়
     কিছুই যাবে না বললে ভুল হয়,  দিগন্তের নির্বন্ধকে মানো।'
             ( কিছুই যাবে না বললে ভুল হয়)
       অশোক মহান্তীর কবিতাকে বুঝতে গেলে, হৃদয় ও মস্তিষ্ক দিয়ে ছুঁতে চাইলে পুরো কবিতাটি না পড়লে তা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। বিচ্ছিন্ন দু' একটি পংক্তির সাহায্যে সেই সমুদ্রকে বোঝা যায় না। বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন হয় না। সিন্ধুকে বুঝতে হলে বা স্বাদ পেতে হলে, সিন্ধুর কাছে দাঁড়াতে হয়, স্পর্শ করতে হয়। অনেক সময় তাঁর কবিতার শেষ লাইন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, শেষ লাইনে গিয়ে কবিতাটি জ্বলে ওঠে। সেই আগুন যা নিঃশব্দে পাঠক হৃদয়কে পোড়ায়। একেবারে প্রথম কাব্য গ্রন্থ 'আবহ সকাল' থেকেই তিনি এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির। অন্য অনেক বিখ্যাত কবির প্রথম কাব‍্য গ্রন্থ থেকে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ অনেক ঐশ্বর্যময়। 
     আয়নার সামনে নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শব্দ প্রজ্ঞার এই গভীর মগ্ন উচ্চারণ একজন প্রকৃত কবি হিসেবে তাঁর জাত চিনিয়ে দেয়। সমস্ত দৈন্য, অপারগ ইচ্ছা আর পৃথিবী ও জীবনের প্রতিদিনের ক্ষয়কে ধারণ করে শব্দ-পুঞ্জ আকাশের বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎরেখা হয়ে যা আমাদের বুকেও চিরস্থায়ী দাগ রেখে যাচ্ছে। 

       চারপাশের দাবদাহ, অবিচার অনাচার হিংসা যন্ত্রণা থেকে বাঁচবার জন্য তিনি কবিতা লেখেন। কবিতা তাঁর বর্ম। তিনিও তাঁর সকল ব্যথা ধন্য করে ফুল ফোটান। গান গাইতে থাকেন। সাধনা করেন। সেটাই তাঁর অস্তিত্ব। কবিতার মধ্য দিয়েই তিনি জীবনের মানে খোঁজেন। কবিতার আয়নাতেই জীবনকে দেখেন। জীবনের সঙ্গে যাবতীয় যোগাযোগের নদী তৈরি হয় শব্দের স্রোত ধরে:

‘আর সৃষ্টি রহস্যের অনেক ভেতরে চলে যেতে গিয়ে দেখি
ব্রহ্মক্ষুধা, দ্বৈতাদ্বৈত, ঈশ্বর ও অনীশ্বর সবার ভেতরে
জমেছে তর্কের স্তূপ। আর কোটি সৌরলোকে ভরেছে যে অনন্ত আকাশ
তার প্রতি বস্তুকণা যে আলো ছড়ায়, তাতে জীবনের অর্থ জেগে আছে।

মৃত নক্ষত্রের কান্না শুনতে পাও? জনহীনতার কান্না?
দারিদ্র্যসীমার নিচে যে কান্না পাহাড় হয়ে আছে?

আজ সব বুঝতে চাই। শিশুর দুঃখের ভাষা, মনের গভীর গুপ্ত
রহস্যর ভাষা, আর সুর কম্পনের ভেতরে ভেতরে সেই অনিবার্য ভাষা
যাতে এ জগৎ সৃষ্টি হয়েছিলো।
সৃষ্টি হয়েছিলো গান। মানুষের সমস্ত কবিতা। প্রিয় বোধ।

ধ্বংসের গভীর গান বেজে চলে অনন্ত বেসুরে।’
   (সুর: অতিবর্তী জাগো)

     ' পাতাল' কবিতায় আত্মদহন। কামনার আগুনে ডুবতে ডুবতে, নামতে নামতে শুদ্ধ হওয়া। পুড়ে পুড়ে সোনা হওয়ার রক্তাক্ত যন্ত্রণার কথা :

'তবে কি দুর্মরভাবে নেমে গেছি, যেখানে পাতাল
অন্ধকারে ঢাকা শুধু, কামনার আগুনে আগুনে লেলিহান
তবে কি জীবন এই, পুঁজ - রক্ত - কালি আর ক্লেদের ভেতরে
বীভৎস ও ভয়ঙ্করভাবে আলোলিত?
এই কি মরণগ্রন্থি আমাদের? একি ভয়? ভয়ের ভেতর থেকে
অমল - আলোর দিকে যাবার কি তীব্র প্ররোচনা?

বুঝিনা বলেই বুঝি কষ্ট পাই।
কষ্ট পেতে - পেতে খাঁটি হয় ইচ্ছারা আমার।

নিজেকে নৃশংস বলে জেনে গেছি আজ এই রাতের আঁধারে
নিজেকে কামুক বলে জেনে গেছি।
আর কি জেনেছি?  তবে শোনো এই রাতের স্পন্দন
শোনো,  বুকের ঝর্ণার দ্রুত স্তবগান,  শোনো ঐ মন্দিরের
ঘন্টা থেকে যে ধ্বনি উত্থিত হচ্ছে আকাশের দিকে
সে কেমন আমাকে উন্মাদ করে গ্যাছে। আর শোনো
ট্রেনলাইনের পাশে মৃতদেহ আমিও দেখেছি,  দেখেছি
আমার পাশে পড়ে আছো তুমি,  তোমার সন্তান বাড়ে অন্ধকারে।
আর শোনো,  রাত্রিকে নিজের মত পেতে চেয়ে যত খুশি
কবিতা লিখেছি,  যতখুশি আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে
পেয়ে গেছি জ্ঞান,  বিভা,  মানুষের অন্তর আত্মার ছবি
অনুভব,  কবিতার সাম্রাজ্য পেয়েছি।'
     ( পাতাল : দ্বিতীয় সঙ্কেত)

        আমরা প্রতিনিয়ত কাঁপছি সংশয়ে, ভয়ে, একাকিত্বে, অপ্রেমে, দগ্ধ যন্ত্রণায়, অনুশোচনায়। শিল্পের কাছে আশ্রয় চেয়ে, নিজেকে উজাড় করে দিতে চেয়েছিলেন এক তাপস। তাঁর বেঁচে থাকার মুহূর্তে শিল্প তাকে কতটুকু ফিরিয়ে দিয়েছিল এই প্রশ্ন প্রত্যেকের। পরে কি দিচ্ছে সে কথা আরো গুরুত্বপূর্ণ।

১. ' হঠাৎ কাঠের আলো ভরে উঠতো আভা- কল্পনায়।
       কেউ একজন খুব সন্তর্পণে গাছের বাকলে লিখে রাখতো স্তবগান
     ঈশ্বরের গান, সে তার যুবতী স্ত্রীকে অন্ধকারে ফেলে রেখে
     একাকী দৌড়তো তার বিশ্বাসের দিকে।

     কাঠআগুনের ধোঁয়া উড়ে যেতো ঈশ্বরবিহীন কোনো স্থির অন্ধকারে প্রতিদিন।’
           (কাঠআগুনের ধোঁয়া: মাটির মন)

২. 'আমি আদ্যোপান্ত কবি হয়ে উঠতে চাই,  তাই।
      এই নীল অরণ্য জ্বলা গভীর রাত্রিতে আমার যে  স্বপ্ন দেখার কথা ছিল
      সেই স্বপ্নের অতল ভেদ করে উঠে এসেছে বিষাক্ত গোখরো
     তার মুখে প্রেম কিম্বা প্রতিভার ছাপ নেই।

      হে অনন্তরাত্রি,  হে অনন্তপুণ্য,  হে অনন্ত কালোজল
      এই রাত্রির অন্ধকার শেষ হলে আরো কী অপেক্ষা করছে আমাদের?
      আমরা যারা দুঃখী, যারা নিরালম্ব, যাদের স্বপ্নের মধ্যে ভেসে ওঠে
      রাত্রির গাঢ়তা, সেই তাদের জন্য তোমার অকৃপণ হাত উন্মুক্ত করো।'
               (পাথর পূজা : দ্বিতীয় সঙ্কেত)

       অন্ধকারে, দগ্ধ যন্ত্রণায় পুড়ে পুড়েও তিনি তপস্যা করেন শব্দের। কবিতা তাঁর কাছে উৎসারিত আলো, তাঁর আশ্রয়, তাঁর মুক্তি। বুকের মধ্যে আগুন নিয়েও তিনি চারপাশের পৃথিবীকে দেখছেন রসিক প্রেমিকের দৃষ্টিতে। সেই দেখার মধ্যে একদিকে যেমন অপার বিস্ময় আছে, যন্ত্রণা আছে, প্রতিবাদ আছে তেমনি আছে সুরসিকের তাল জ্ঞান, আনন্দ- হিল্লোল।
     অনেক প্রাজ্ঞজনই তাঁর কবিতার অনুরক্ত পাঠক ছিলেন। তাঁরা ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে সেই মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন। এখন উদ্ধার করি মণীন্দ্র গুপ্তের একটি চিঠি। তিনি লিখেছেন : 

' প্রীতিভাজনেষু, বহুদিন ধরে আপনি আমাকে কবিতার বই পাঠিয়ে যাচ্ছেন, উত্তর দেওয়া হয় না। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। কিন্তু আপনার চটি চটি বইগুলি আমি কাছাকাছিই রাখি। মাঝে মাঝেই পড়ি - পড়তে পড়তে মনে হয়, জানাই আপনাকে কিছু। কিন্তু আবার অন্য কোনো দিকে চলে যাই। ৪৮ বছরের স্বীকারোক্তি নিয়ে অনেক গুলো বই হল আপনার। আলোক শিশির ও ঘাস রঙের আকাশ  পড়তে পড়তে আমার অনেকদিন মনে হয়েছে আপনার ও আমার চিন্তা ও কল্পনার মধ্যে কোথায় যেন মিল আছে।
আপনার সঙ্গে আমার কোনোদিন দেখা হয়নি। কিন্তু আমাদের জাত এক।
আমার একান্ত ভালোবাসা জানবেন। জানানো হয় না বলে রাগ করবেন না।
           মণীন্দ্র গুপ্ত


   হ্যাঁ। তাঁর কবিতা শুধু কাছাকাছি রাখার নয়, তা মাথায় করে রাখার মতোই মহার্ঘ। চারপাশের হলাহলের মাঝে অমৃত। যা জীবন মন্থন করে উঠে এসেছে। যা তাঁকে অমরত্ব দেবে। কখনও কখনও তিনি মহাদেবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। আবহমান পৃথিবীর জন্য হয়ে উঠেছেন দায়িত্ববান অভিভাবক। সেইজন্য অশোক মহান্তীর কবিতা ভুবনের প্রথম সিঁড়ি থেকেই ব্যক্তির, সমাজের ,সময়ের, ভালো মন্দ আলো অন্ধকারকে, প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে প্রবহমান চৈতন্যকে, আরো নির্মল ও পবিত্র করার বাসনায় নিজের যে দায়িত্ববোধ তা মেনে নিয়েছেন বার বার। এখানেই তাঁর শিল্পী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। এই বোধ আমরা দেখেছিলাম জীবনানন্দের মধ্যেও। অশোক মহান্তীও সময়ের শরে বিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত হয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পীড়িত হয়ে ব্যথিত হয়ে মানুষের এই দুঃসময়ের অপমানের শোষণের বঞ্চনার রূপ দেখে নিরন্তর চেষ্টা করছেন উপায় খোঁজার। মানুষের পরিত্রাণ চেয়েছেন। আমরাও সেই বার্তা শুনে আমাদের অন্তরাত্মাকে জাগ্রত করছি যাবতীয় অন্ধকারকে সরিয়ে তাঁর দেবালয়ের প্রদীপ করার জন্য।…
                                                              (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments