জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত /পর্ব-২২/সুদর্শন নন্দী

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত   

পর্ব-২২

সুদর্শন নন্দী 

ঠাকুরের কাছে দ্বিজ, দ্বিজর পিতা ও ভাইরা, মাস্টার প্রভৃতি বসে আছেন। আজ ৯ই অগস্ট, ১৮৮৫ খ্রী। সংসার ও ঈশ্বর লাভের বিষয়ে কথা হচ্ছে। ঠাকুর সোনা পাবার উপমা দিয়ে বললেন--আমি বলি, চৈতন্যলাভের পর সংসারে গিয়ে থাক। অনেক পরিশ্রম করে যদি কেউ সোনা পায়, সে মাটির ভিতর রাখতে পারে — বাক্সের ভিতরও রাখতে পারে, জলের ভিতরও রাখতে পারে — সোনার কিছু হয় না। অমি বলি, অনাসক্ত হয়ে সংসার কর। হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙ্গ — তাহলে হাতে আঠা লাগবে না। কাঁচা মনকে সংসারে রাখতে গেলে মন মলিন হয়ে যায়। জ্ঞানলাভ কর তবে সংসারে থাকতে হয়। শুধু জলে দুধ রাখলে দুধ নষ্ট হয়ে যায়। মাখন তুলে জলের উপর রাখলে আর কোন গোল থাকে না।
একাধিক উপমা দিয়ে ঠাকুর বিষয়টি পরিস্কার করে বোঝালেন ভক্তদের। 
আজ জন্মাষ্টমী, মঙ্গলবার। ১৭ই ভাদ্র; ১লা সেপ্টেম্বর, ১৮৮৫। ঠাকুর স্নান করবেন। এক ভক্ত তেল মাখাচ্ছেন।  মাস্টার গঙ্গাস্নান করে এসে ঠাকুরকে প্রণাম করলেন। ভক্তের দুই থাক নিয়ে কথা শুরু হল।  
শ্রীরামকৃষ্ণ বিড়ালের উপমা দিয়ে বললেন — দুরকম ভক্ত আছে। এক থাকের বিল্লির ছা'র স্বভাব। সব নির্ভর — মা যা করে। বিল্লির ছা কেবল মিউ মিউ করে। কোথায় যাবে, কি করবে — কিছুই জানে না। মা কখন হেঁশালে রাখছে — কখন বা বিছানার উপরে রাখছে। এরূপ ভক্ত ঈশ্বরকে আমমোক্তারি (বকলমা) দেয়। আমমোক্তারি দিয়ে নিশ্চিন্ত।
শিখরা বলেছিল — ঈশ্বর দয়ালু। আমি বললাম, তিনি আমাদের মা-বাপ, তিনি আবার দয়ালু কি? ছেলেদের জন্ম দিয়ে বাপ-মা লালন-পালন করবে না, তো কি বামুনপাড়ার লোকেরা এসে করবে? এ-ভক্তদের ঠিক বিশ্বাস — তিনি আপনার মা, আপনার বাপ।
আর-এক থাক ভক্ত আছে, তাদের বানরের ছা'র স্বভাব। বানরের ছা নিজে জো-সো করে মাকে আঁকড়ে ধরে। এদের একটু কর্তৃত্ব বোধ আছে। আমায় তীর্থ করতে হবে, জপতপ করতে হবে, ষোড়শোপচারে পূজা করতে হবে, তবে আমি ঈশ্বরকে ধরতে পারব, — এদের এই ভাব।
দুজনেই ভক্ত যত এগোবে, ততই দেখবে তিনিই সব হয়েছেন — তিনিই সব করছেন। তিনিই গুরু, তিনিই ইষ্ট। তিনিই জ্ঞান, ভক্তি সব দিচ্ছেন। যত এগোবে, দেখবে, চন্দন কাঠের পরও আছে, — রূপার খনি, — সোনার খনি, — হীরে মাণিক! তাই এগিয়ে পড়। 
১৮৮৫, ১৮ই অক্টোবর।ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামপুকুরের বাটীতে ভক্তসঙ্গে। শরীর অসুস্থ — কলিকাতায় চিকিৎসা করতে এসেছেন।  
গিরিশ বললেন তিনি শ্রীকৃষ্ণ যে অবতার তা প্রমাণ করবেন। 
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন — এ-সব যা কথা হচ্ছে, এ কিছুই নয়। এ-সব বিকারের রোগীর খেয়াল। বিকারের রোগী বলেছিল, — এক জালা জল খাব। এক হাঁড়ি ভাত খাব! বদ্যি বললে, আচ্ছা আচ্ছা খাবি। পথ্য পেয়ে যা বলবি তখন করা যাবে।
কাঁচা ঘির উপমা দিয়ে বললেন-যতক্ষণ কাঁচা ঘি, ততক্ষণই কলকলানি শোনা যায়। পাকা হলে আর শব্দ থাকে না। যার যেমন মন, ঈশ্বরকে সেইরূপ দেখে।  
আজ বৃহস্পতিবার, ২২শে অক্টোবর, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ (৭ই কার্তিক, ১২৯২, শুক্লা চতুর্দশী)। শ্যামপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণ — দুতলা ঘরের মধ্যে। ডাক্তার সরকার শ্রীযুক্ত ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও ভক্তেরা রয়েছেন।  নির্লিপ্ত সংসারীর নির্লিপ্ত হবার উপায় বিষয়ে কথা হচ্ছে।
ঠাকুর উপমা সহকারে বললেন- সংসারী ঈশ্বরের পাদপদ্মে ভক্তি রেখে সংসার করে, সে ধন্য, সে বীরপুরুষ! যেমন কারু মাথায় দুমন বোঝা আছে, আর বর যাচ্ছে, মাথায় বোঝা — তবু সে বর দেখছে। খুব শক্তি না থাকলে হয় না। যেমন পাঁকাল মাছ পাঁকে থাকে, কিন্তু গায়ে একটুকুও পাঁক নাই। পানকৌটি জলে সর্বদা ডুব মারে, কিন্তু পাখা একবার ঝাড়া দিলেই আর গায়ে জল থাকে না।
কিন্তু সংসারে নির্লিপ্তভাবে থাকতে গেলে কিছু সাধন করা চাই। দিনকতক নির্জনে থাকা দরকার; তা একবছর হোক, ছয়মাস হোক তিনমাস হোক বা একমাস হোক। সেই নির্জনে ঈশ্বরচিন্তা করতে হয়। সর্বদা তাঁকে ব্যাকুল হয়ে ভক্তির জন্য প্রার্থনা করতে হয়। আর মনে মনে বলতে হয়, ‘আমার এ-সংসারে কেউ নাই, যাদের আপনার বলি, তারা দুদিনের জন্য। ভগবান আমার একমাত্র আপনার লোক, তিনিই আমার সর্বস্ব; হায়! কেমন করে তাঁকে পাব!’
দিলেন কাঁঠাল, দুধ, জনক রাজার উপমা। বললেন-ভক্তিলাভের পর সংসার করা যায়। যেমন হাতে তেল মেখে কাঁটাল ভাঙলে হাতে আর আঠা লাগে না। সংসার জলের স্বরূপ আর মানুষের মনটি যেন দুধ। জলে যদি দুধ রাখতে যাও, দুধে-জলে এক হয়ে যাবে। তাই নির্জন স্থানে দই পাততে হয়। দই পেতে মাখন তুলতে হয়। মাখন তুলে যদি জলে রাখ, তাহলে জলে মিশবে না; নির্লিপ্ত হয়ে ভাসতে থাকবে।
ব্রহ্মজ্ঞানীরা আমায় বলেছিল, মহাশয়! আমাদের জনক রাজার মত। তাঁর মতো নির্লিপ্তভাবে আমরা সংসার করব। আমি বললুম, ‘নির্লিপ্তভাবে সংসার করা বড় কঠিন। মুখে বললেই জনক রাজা হওয়া যায় না। জনক রাজা হেঁটমুণ্ড হয়ে উর্ধ্বপদ করে কত তপস্যা করেছিলেন! তোমাদের হেঁটমুণ্ড বা উর্ধ্বপদ হতে হবে না, কিন্তু সাধন চাই। নির্জনে বাস চাই! নির্জনে জ্ঞানলাভ, ভক্তিলাভ করে তবে গিয়ে সংসার করতে হয়। দই নির্জনে পাততে হয়। ঠেলাঠেলি নাড়ানাড়ি করলে দই বসে না।
মাখন তুলে যদি নূতন হাঁড়িতে রাখ, মাখন নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে না। যদি ঘোলের হাঁড়িতে রাখ, সন্দেহ হয়। ঠাকুরের সরস উপমা শুনে সব ভক্ত হাসলেন। 
‘ঈশ্বর সাকার না নিরাকার সে বিষয়ে জানতে চাইলেন একজন ভক্ত।  
উপমা সহকারে শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন — তিনি সাকার আবার নিরাকার। একজন সন্ন্যাসী জগন্নাথদর্শন করতে গিছিল। জগন্নাথদর্শন করে সন্দেহ হল ঈশ্বর সাকার না নিরাকার। হাতে দণ্ড ছিল, সেই দণ্ড দিয়ে দেখতে লাগল, জগন্নাথের গায়ে ঠেকে কিনা। একবার এ-ধার থেকে ও-ধারে দণ্ডটি নিয়ে যাবার সময় দেখলে যে, জগন্নাথের গায়ে ঠেকল না — দেখে যে সেখানে ঠাকুরের মূর্তি নাই! আবার দণ্ড এ-ধার থেকে ও-ধারে লয়ে যাবার সময় বিগ্রহের গায়ে ঠেকল; তখন সন্ন্যাসী বুঝলে যে ঈশ্বর নিরাকার, আবার সাকার।
কিন্তু এটি ধারণা করা বড় শক্ত। যিনি নিরাকার, তিনি আবার সাকার কিরূপে হবেন? এ-সন্দহ মনে উঠে। আবার যদি সাকার হন, তো নানারূপ কেন?”
ডাক্তার বললেন— যিনি আকার করেছেন, তিনি সাকার। তিনি আবার মন করেছেন, তাই তিনি নিরাকার। তিনি সবই হতে পারেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ আবার উপমা দিলেন গামলার রঙের। বললেন — ঈশ্বরকে লাভ না করতে পারলে, এ-সব বুঝা যায় না। সাধকের জন্য তিনি নানাভাবে নানারূপে দেখা দেন। একজনের এক গামলা রঙ ছিল। অনেকে তার কাছে কাপড় রঙ করাতে আসত। সে লোকটি জিজ্ঞাসা করত, তুমি কি রঙে ছোপাতে চাও। একজন হয়তো বললে, ‘আমি লাল রঙে ছোপাতে চাই।’ অমনি সেই লোকটি গামলার রঙে সেও কাপড়খানি ছুপিয়ে বলত, ‘এই লও, তোমার লাল রঙে ছোপানো কাপড়।’ আর-একজন হয়তো বললে, ‘আমার হলদে রঙে ছোপানো চাই।’ অমনি সেই লোকটি সেই গামলায় কাপড়খানি ডুবিয়ে বলত, ‘এই লও তোমার হলদে রঙ।’ নীল রঙে ছোপাতে চাইলে আবার সেই একই গামলায় ডুবিয়ে সেই কথা, ‘এই লও তোমার নীল রঙে ছোপানো কাপড়।’ এইরকমে যে যে রঙে ছোপাতে চাইত, তার কাপড় সেই রঙে সেই একই গামলা হতে ছোপানো হত। একজন লোক এই আশ্চর্য ব্যাপার দেখছিল। যার গামলা, সে জিজ্ঞাসা করলে, ‘কেমন হে! তোমার কি রঙে ছোপাতে হবে?’ তখন সে বললে, ‘ভাই! তুমি যে রঙে রঙেছ, আমায় সেই রঙ দাও! ঠাকুরের উপমা শুনে সকলে হাসতে লাগলেন।
                                           (ক্রমশঃ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments