জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ/ পর্ব – ১০ /বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা  অ্যাভিনিউ 
পর্ব – ১০
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় 
 


শামুকের মতো আমি ঘরবাড়ি পিঠে নিয়ে ঘুরি
এই দুনিয়ায় আমি পেয়ে গেছি অনন্ত আশ্রয়
এই রৌদ্র বৃষ্টি, এই শতদল বৃক্ষের সংসার
অস্থায়ী উনুন, খুদ কুঁড়ো –
আবার বাতাসে ওড়ে ছাই’ 
 আমি চলে যাই দূরে, আমি তো যাবোই ,
জন্ম-মৃত্যু ছাড়া আমি কোন সীমানা মেনেছি? ( এক জীবন) 

কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিসত্তার ভেতর বিভিন্ন দিগন্ত আছে। আছে বহুমাত্রিক জীবনের অফুরান রূপের উৎসব, স্মৃতির আগুন, পিপাসার বর্ণমালা। এসব নিয়ে অন্যত্র কোথাও লিখব কখনো। এই ধারাবাহিক গদ্যে আমি কেবলমাত্র তাঁর দেশবিভাগ এবং সত্তার উথালপাথাল নিয়েই লিখতে বসেছি। আগের পর্বে এই নিয়ে সামান্য কিছু কথা লিখেওছি। কিন্তু বিরাট এই বিশ্ব, অনন্ত পৃথিবীর মাঝে স্বপ্ন ও জাগরণের মিলয়াতন। কবির তো কোন দেশকাল মানচিত্র নেই। এই দুনিয়ায় অনন্ত আশ্রয়ের স্বপ্ন নিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী স্বপ্নের স্পর্ধা তাঁর। তিনি জীবনকে দেখেছেন শতদল বৃক্ষের সংসারে। কোথায় লুকিয়ে থাকে একজন কবির ঠিকানা? তিনি স্বপ্নে জীবন দেখেন, আবার জীবনের স্বপ্নও দেখেন। জীবন এবং অনন্ত জীবনের কাঁটাতারের বেড়ার সামনে এসে দাঁড়ান এবং উচ্চারণ করেন – এসেছি দৈব পিকনিকে। তখন মনে হয় দেশ কাল এবং পার্থিক ভূখণ্ডের উপরে একজন সত্যদ্রষ্টা কবির অবস্থান। জগত পারাবারের তীরে যেন এক মহোৎসবে মিলিত হয়েছি আমরা সবাই। এক দৈব পিকনিকে এসেছি।সাময়িক  জীবনের বাইরে এক অপরিমেয় জীবনের অনুসন্ধান, দিগন্তের উপরে এক মহাদিগন্তের হদিশ পাই আমরা। কবিতা তো সার্বিক উপলব্ধির। কবিতা তো জীবন পুনঃপাঠের আয়োজন। প্রতীয়মান জীবনের বৃত্ত পেরিয়ে আরও গভীরে যাওয়ার উপলক্ষ্য। রূপ থেকে রূপান্তর, সে ও অন্য দেশ। অন্য ভূখণ্ড। যদি ফিরে তাকাই সেই যাত্রাপথের দিকে।আমরা দেখতে পাব সেই ধাত্রীমাকে। 
 
"শিয়ালদার ফুটপাতে বসে আছেন আমার ধাইমা
দুটো হাত সামনে রাখা,
ঠোট নড়ে উঠছে  মাঝে মাঝে।
যে কেউ ভাববে দিনকানা এক হেঁজিপেঁজি বাহাত্তুরে
 রিফিউজি বুড়ি। 
আঁতুড় ঘরে আমার মুমূর্ষু মায়ের কোল থেকে 
একদিন আমাকে বুকে তুলে নিয়েছিলেন…
ধাইমা, এ কোন পৃথিবী আমাকে দেখালে?
বুড়ি , সর্বনাশিনী , আমাকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছিলি
এই অকল্পনীয় পৃথিবীতে
আমি আর কত কিছু হারাবো ?" ( ধাত্রী) 
একজন কবি জীবন দেখেন এভাবেই। হারাতে হারাতে একা হয়ে প্রাচুর্যের গভীরে অনুভব করেন রিক্ততার ছায়পথ। অজস্র অভিব্যক্তির দিকে চোখ ফেলে দেখতে পান শূন্যতা ও দহনের বহুবর্ণ বিন্যাস। নানা মুহূর্তের অন্তর্গত বেদনা যে দীর্ঘশ্বাস তৈরি করে।এক ধূসর বাস্তব থেকে উঠে আসে বেদনালাঞ্ছিত স্মৃতি।‘ একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো / লাঠি লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্কর বাড়ির ছেলেরা/  ভিখারীর মতন  চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি রাস- উৎসব/ অবিরল রঙের ধারায় সুবর্ণ কঙ্কন পরা ফর্সা রমণীরা  কতবার আমোদে হেসেছে/  আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি / বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন , দেখিস একদিন/ আমরাও…/ বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই/ সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি লজেন্স সেই রাস উৎসব আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবে না ।’ এই কবিতায় যে তিন প্রহরের বিল আমরা দেখতে পাই  তা মাদারীপুরের পূর্ব মাইজপাড়ার এক ব্রাহ্মনপল্লির কাছেই। কবিতাটি বহন করেছে সেই ছায়া। শ্রেণি বৈষম্য আর বঞ্ছনার সাথে জড়িয়ে আছে উদ্বাস্তু জীবন যাপিত  একটি কিশোরের একান্ত বেদনাবোধ। 
শুধু তাই নয় মধ্যবিত্তের সংকট  খুব আন্তরিক ভাবে বাস্তব প্রতিবেদন সৃষ্টি করেছে তাঁর কবিতায়। আত্মিক বিচ্ছিন্নতা শুধু নয়,  ‘যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মানুষের সাথে যার হয় নাকো দেখা’ সমস্যাদীর্ণ জীবনের আর্থিক ছবিটিও কি পরিস্ফুট হয়নি বেশ কিছু কবিতায়? অবশ্যই হয়েছে । বিরূপ পরিস্থিতিতে সহায় সম্বলহীন মানুষের মর্মস্পর্শী বৃত্তান্ত সন্নিবিষ্ট হয়েছে নিজস্ব অনুভবে। বেঁচে থাকার চাবি হারানো মানুষের দুঃসহ জীবনযাপন, অস্বচ্ছলতার প্রশ্নও এসেছে অবধারিতভাবে।    
‘হাতে পায়ে শৃঙ্খলিত বিষণ্ণ মানুষ 
হারিয়ে ফেলেছে সব চাবি
আমি মাছহীন ভাতের থালার সামনে বসেছি
 আমি দাঁড়িয়েছি চালের দোকানের লাইনে
 আমার চুলে ভেজাল তেলের গন্ধ।’ 
এরকম উদাহরণ তো কম নয়। আত্মসংলগ্ন ভূমির জন্য মানুষের অন্তর্গত মায়াটান অপ্রতিরোধ্য।এর বাইরে ডাল ভাত রুটি রুজির জীবনে যে প্রভাব যে সংকট ঘনীভূত হয়েছিল তাও প্রতীয়মান হয়েছে কবিতার ছত্রে ছত্রে।  দেশবিভাগ তো শুধুমাত্র সম্প্রদায়গত  বিভাজন নয়, মানুষের স্বাধীনতা এবং মানবিক চেতনারও বিভাজন। আমরা সেই সময়ের ছবি ইতিহাসের পাতায় সেভাবে পাব না। যতখানি দেখতে পাব সাহিত্যের আলোয়। কবিতার নিরাভরণ দীপ্তিতে। কানাডার ম্যাকগ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী এবং গবেষক আনামের কথাগুলো এই প্রসঙ্গে তুলে ধরা যেতে পারে। তিনি বলেছেন-‘  সরকারি  ইতিহাস ও পাঠ্যপুস্তকের যে রূপরেখা তার ভেতর সত্যকে আড়াল করার নির্মম  প্রয়াস থাকে। ফলে মানবিক বিষয়গুলি ধামাচাপা পড়ে যায়। কিন্তু মানুষের হৃদয় জানে আসল সত্য। সেখানে রক্তের অক্ষরে লেখা থাকে প্রকৃত ইতিহাস। বাংলা গল্প উপন্যাস এবং গল্পে আমরা সেই সময়ের প্রকৃত প্রতিবিম্ব দেখতে পাই।’ জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার রঙে তা যতখানি বৈচিত্র্যময় তার চেয়েও অনেক বেশি নগ্ন বাস্তব।  
আত্মজৈবনিক এই কবিতায় আমরা দেখতে পাই হৃদয়ের রক্তক্ষরণ –
‘ আমার বাবা মৃত্যুর আগে বলেছিলেন,
আমি বাড়ি যাচ্ছি!
তখন আমরা সামান্য সামান্য ভাড়াবাড়িতে থাকি
পূর্ববঙ্গের  দেশের কথা বাবা কখনও উচ্চারণ করতেন না
তবু মৃত্যুর আগে … বাবা… বাড়ির স্বপ্ন 
সে কোন স্বপ্নের দেশে ছিল আমাদের বাড়ি ( বালুকণার মতো অ- সামান্য কাব্যগ্রন্থ থেকে) 
এই স্বপ্নের দেশের অনুসন্ধান করতে গিয়ে বাস্তবের ধূলিধূসর আর  নির্মম রুক্ষতায় ভরা সময়ের প্রতিচ্ছবি উগরে দিয়েছে শব্দগুলি । ভাড়াবাড়ি শব্দটি গভীর তাৎপর্য নিয়ে এসেছে কবিতায়।যেন আমরা সবাই নিজের দেশ থেকে বিচ্যুত হয়ে , নিজের মাটি থেকে নির্বাসিত হয়ে ভাড়াবাড়িতে থাকি।অথচ গভীর এক টান থেকে স্বদেশের প্রতি। মর্মে মর্মে উচ্চারিত হয় সেই মায়া -সুর।আমি বাড়ি যাচ্ছি- এই শব্দগুচ্ছ এক প্রাগভীর দ্যোতনায় বেজে ওঠে। লোকজগতের কাঁটাতার পেরিয়ে অমৃতময় ভূখন্ডে ফিরে যায় নির্বাসিত মানুষ। শিকড়বিচ্যুত মানুষের যন্ত্রণাকে ঐশী অনুভবে রঞ্জিত করেছে এই কবিতা। 
আবার কৈশোর নিয়ে আসে দুরন্ত উন্মাদনার মুহূর্ত।সেখানে মানবিকতার স্পর্শ আলোর রেখা হয়ে আসে। নিস্তব্ধতার মধ্যে বেদনার্ত মন দোলায়িত হয় শত টুকরো হয়ে যাওয়া সোনালি পিরিচের জন্য।    
‘কৈশোর ভেঙেছে তার একমাত্র গোপন কার্নিশ 
কৈশোর ভেঙেছে
ভেঙে গেছে যত ঢেউ ছিল দূর আকাশগঙ্গায়
শত টুকরো হয়ে গেছে সোনালি পিরিচ
সে ভেঙেছে, সে নিজে ভেঙেছে
পাথরকুচির আঠা  দুই চোখে লেগেছিল  তার
রক্ত ঝরে পড়েছিল হাতে
তবুও সমস্ত সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে এসে 
পা সেঁকে নিয়েছে গাঢ় আগুনের আঁচে 
কৈশোর ভেঙেছে সব ফেরার নিয়ম
যেরকম জলস্তম্ভ ভাঙে
কৈশোর ভেঙেছে তার নীল মখমলে ঢাকা
অতিপ্রিয় পুতুলের দেশ
সে ভেঙেছে অনুপম তাঁত’
এখানে স্মৃতি ও বেদনা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।আশা ও আকাঙ্ক্ষা শূন্য জীবনের বিপরীতে তারুণ্যের চাঞ্চল্য যা থেকে গেছে সেতুর ওপারে। শিল্পীমন খুঁজে বেড়ায় স্মৃতির সেই উদ্ভাসন। ভেসে ওঠে জীবন সত্যের উদয়-মুহূর্ত। আসলে অজস্র অপারতার প্রান্ত থেকেই তিনি যেন জীবনকে স্পর্শ করছেন। দেখছেন বাস্তবের ভেতর রয়ে গেছে কত বিভ্রম, কত গোলকধাঁধা।শিউলির গন্ধে সচকিত হয়ে ওঠে স্নায়ু। তাই ভালোবাসার বেষ্টনীই আবদ্ধ করেছে কবিকে- ‘আমার খুব ইচ্ছে হয় ভালোবাসার মুঠোয় ফেরা।’ তিনি বারবার ফিরে এসেছেন মাটির কাছে, ভালোবাসার কাছে। 
শৈশব মেশানো আলপথ, পুকুরের ধারে  ঝুঁকে থাকা খেজুর গাছ
একসময় ভোর ছিল শিউলির  গন্ধমাখা,
চোখে স্থলপদ্মের স্নেহ
একসময় বিকেল ছিল গাব গাছে লাল পিঁপড়ের কামড়
অথবা মন্দিরের দূরাগত টুংটাং 
অথবা  পাটখেতে কচি অসভ্যতা
একসময় সকাল ছিল নদীর ধারে স্কুল নৌকার প্রতীক্ষায় বসে থাকা
অথবা জারুল গাছের নীচে 
চিকন বৃষ্টিতে ভেজা 
একসময় গাঢ় রাত্রি ছিল প্রগাঢ় অকৃত্রিম নিস্তব্ধতা 
জন্মভূমির অন্বেষণ, মাটির মমত্ব আর সত্যিকারের শিকড়ের স্বরূপ চিনতে চেয়েছেন। আনন্দরস সন্ধান করেছেন এর মধ্যেই। তাই রাষ্ট্র আর দেশ অন্য এক অনুভূতি নিয়ে আসে- 
"এ আমার দেশ বলে  চিৎকার করে উঠি / কর্ণপাত করে না একজনও / এমনকি আমার দেশও কোনও উত্তর দেয় না।"
তিনি সুন্দর দেখেছেন। ‘ সুন্দর মেখেছে এত ছাইভস্ম’ তাও  দেখেছেন। দেখেছেন ‘ বনের ভেতরে এত হাসিমুখ ক্ষুধার্ত মানুষ’। আর তাই সারাজীবন খুঁজে ফিরেছেন সেই ছেলেটাকে 
"ছেঁড়া জামা, রুক্ষ চুল, জুতোয় পেরেক- 
সে ছেলেটা কোথায় যে গেল!
পকেটে চকমকি ভরা, দুপুরে বা মধ্যরাত্রে মেধার ভ্রমণ 
পায়ের তলায় সর্ষে, সর্বক্ষণ খিদে –
চতুর্দিকে সার্থকতা উদ্যানের বাথরুম হয়েছে
বস্তি ভেঙে গড়া হল  অন্তিম যাত্রার কত রাস্তা
অফিসে ফেরার পথে অনেকেই সেইখানে
নিজের জুতোর শব্দে মুগ্ধ হয়ে গেছে-
এরকম সুন্দরের মধ্যে সেই অভুক্ত যৌবন
দুহাত  ছড়িয়ে তবু ঘোষণা করেছে,
আমি আছি।
কোথায় যে গেল সেই ছেলেটা, কোথায় যে গেল সেই
কোথায় যে গেল সেই ছেলেটা, দেখিনি বহুদিন।"

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments