কবিতা অ্যাভিনিউ
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
পর্ব ১২
‘ আলোর ফোয়ারা জেগেছিল ,তাই
ধুয়ে গেছে সব ক্ষত
তুমি ফুটে আছো আমার জীবনে
রক্তজবার মতো।’
কবি মণিভূষন ভট্টাচার্যের কবিতায় প্রেম নিয়ে আগের পর্বে কিছু কথা হয়েছে । প্রেমকে, প্রেমের হৃদয়-সঞ্জাত অনুভবকে আপন সৃজনশীল চৈতন্যে প্রতিফলিত করবার সংকল্প ঘোষণার মধ্য দিয়ে কবি কি নিজের অন্তরের রক্তক্ষরণকেই চিহ্নিত করেননি এখানে ? করেছেন তাই প্রেম রক্তজবার মতো ফুটে আছে জীবনে। রক্তজবা শব্দটি আরও গভীর তাৎপর্য নিয়ে এসেছে কবিতায়। সত্যিকারের রূপ যে দেহসর্বস্ব নয় বরং আন্তরিক এবং তার অন্তরের উজ্জ্বলতারই যথার্থ প্রকাশ। যুগল জীবনের যাত্রাপথ তো শুধুমাত্র দুজনের চলার পথ হতে পারে না। এই পথ দিগন্তসন্ধানী এবং বিশ্বপ্রসারী। যা মানবমুক্তির কথা বলে আলোর ফোয়ারা জাগায়। ধুয়ে দেয় ক্ষতচিহ্ন। আধুনিক জীবনের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে সমকালীন সময়ের দ্বন্দ্ব, বেদনা সংক্ষোভ ও যন্ত্রণাই তো শেষ কথা নয় স্বপ্নমদির এবং রোম্যান্টিক চৈতন্যে রক্তজবা ফোটানোর সংকল্পকেই কবি তাঁর অন্তর্দৃষ্টির স্পর্শে নিত্যজীবনের সাথী করে তুলেছেন।
জীবন বহমান।এখানে জন্ম নেয় ধ্বংস আর সৃষ্টির বীজ। সভ্যতার উত্থান-পতন, হৃদয়ের আলো অন্ধকার সবই ক্ষমাহীন নির্মম শৃঙ্খলার অন্তর্গত। এই হচ্ছে মানুষের প্রবাহিত ইতিহাস। এর মাঝে রয়েছে প্রেমের এক অমোঘ অনিবার্য চালিকাশক্তি। ক্ষত মুক্তির প্রলেপের মতো যা চিরজাগরুক। রয়েছে একটি নারী হৃদয়ের স্পর্শের ইঙ্গিত। যার স্পর্শে দিগন্তে আলোর আভাস।জাগ্রত হচ্ছে সমুজ্জ্বল প্রেম। অবারিত সৌন্দর্য আর উপমার ঢেউ। এই বিস্ময়াপ্লুত আনন্দকে আবার অন্য এক কৌণিক বিন্দু থেকে দেখেছেন কবি -
“তোমার দুপুর হয়ে তোমাকে লিখছি খোলা চিঠি
তোমার অমৃত হ্রদে আমি যে চেয়েছি সেই স্নান”
অথবা
‘এত রূপ নিয়ে দাঁড়িও না কাছে,
জ্বলে পুড়ে যাবো নিঃস্ব
স্পর্শ করো না, ভিতরে দেখবো
ফুলের দহন দৃশ্য,
আঙুলে আঙুলে দীপাবলী খুলে
তিমিরে ঢেকেছে বিশ্ব,
আমি যদি হই প্রকৃত প্রার্থী,
তুমিও তো অবিমৃষ্য।’
এই কবিতার চেতনে অবচেতনে নির্মিত কবি-আত্মার অপূর্ব সমন্বয়। নিজেকে নিংড়ে প্রতিটি অক্ষর তুলে এনেছেন কবি। রূপ যেন আগুন যার স্পর্শে আঙুলে আঙুলে দীপাবলী খুলে যায়। তিমিরময় বিশ্ব পায় আলোকসংকেত। কবির রচনানৈপুণ্যে ছন্দের কারুকৃতিতে কবিতাটি পেয়ে গেছে অন্য এক মাত্রা। অস্তিত্বের অন্তর্বতী পেলব সত্তাকে ফুলের সাথে তুলনা করা হয়েছে।এর নান্দনিক সুক্ষতাকে বেদনাময় অভিবক্তিকে চিহ্নিত করার জন্য ফুলের দহন দৃশ্য শব্দবন্ধটি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রেম তো সেই আগুন যা মানুষকে পুড়িয়ে পরিশুদ্ধ করে। এই যথার্থ বোধ কবিতাটির স্বরূপ উন্মোচন করে এবং কবির প্রতি মুহূর্তের মানবিক প্রতিবেদনকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে।
“‘যখন বলি, ‘ ভালোবাসি’
ভাবি কাকে? তোমাকে? না নিজেকে?
যখন দুজনেই চুপ করে থাকি
তখন আকাশ ও সমুদ্র
আলোয় ভরে ওঠে।”
মৃদু অথচ মর্মভেদী এই উচ্চারণ। মাত্র চার পাঁচটি লাইন। যার শুরু হচ্ছে ভালোবাসা দিয়ে এবং কবিতার শেষে আলোয় ভরে উঠছে উত্তরমালা। যেন আমরা পেয়ে যাচ্ছি প্রেম কী? এর প্রকৃত সদুত্তর। নীরবতার ভেতর জ্বলে উঠছে আলো। এর পরিব্যপ্তির সাথে আকাশ এবং সমুদ্রকে তুলনা করা হয়েছে খুব সঙ্গত কারণেই। ভালোবাসা যেমন আত্মমগ্ন উচ্চারণ হতে পারে না, সেরকমই সীমারেখা দিয়ে আবদ্ধ করা যায় না এর পরিসর। "আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে” দাঁড়িয়ে সমস্ত বিশ্বলোকের সন্ধানই প্রেমের প্রকৃত উন্মুক্ত আলোক। নক্ষত্রলোকের এই আলোয় তাই ভরে উঠেছে আকাশ ও সমুদ্র। জীবন ও জগতের আজস্র আধার আর আধেয়। এর মধ্যে আমরা জটিল সামুহিক অভিজ্ঞানে পৌঁছতে চাই। এই প্রসঙ্গে এই কথাগুলো আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে- “ To achieve a common culture … we need first to achieve the means of community at every level of the common life , and it is from controlling rule that the experience of the culture will be extrapolated ; the lived experience will be related to this practical basis of political, social and economic community as spoken language is related to its grammatical structure.”
নিজের ভেতর কূপ খননের উদগ্র বাসনা নয় সামাজিক সম্পর্ক বিন্যাসের প্রতিফলন ব্যক্ত হয়েছে মণিভূষণের কবিতায়। ইতিহাস, সামাজিক চেতনা এবং অন্তরের বিভিন্ন স্তর ও বিন্যাস,হৃদয়ের ক্রমিক সন্ধান এবং মৌলিক জীবন সত্যের পুনর্নির্মাণ আমাদের পথ দেখায়। ভয়ংকর এক না- সময়ের আবর্তে যখন শেকল বাজে পায়ে, তখনও রূপকথার মৃত্যু হয় না, স্বপ্নের মৃত্যু হয় না।
“ নিজের মধ্যে লুকিয়েছিল, লুকোচুরির দায়ে
মাংসপেশি অন্ধ করে শেকল বাজে পায়ে,
সমষ্টিতে ছায়ায় এসো, মরেনি রূপকথা,
প্রত্যাখ্যানের সময় এলে মানি না সতর্কতা।
নিজের ভেতর কূপ খুঁড়েছি, জল ওঠে না ধূধূ
মরু উঠের গ্রীবার নিচে দুপুর জ্বলে শুধু,
সরস্বতী এসেছিলেন, পালিয়ে গেছেন দূরে
ছিন্ন হাঁসের পালকগুলি ওড়ে গগন জুড়ে।”
অথবা আমরা যখন তাঁর ‘ ঘর সংসার’ কবিতাটি পড়ি। যখন উচ্চারণ করি- “ আমার সবই পড়ে রইল, দরজাটি আধ-খোলা;/ পাশের ঘরে কুসুম নেই, নিঝুম শিকল তোলা-/ পেছন থেকে জ্যোৎস্না এসে বাগানে পূবদিকে/মুখে রুমাল গুঁজে দিল কুসুমকুমারীকে/তুলে নিয়ে পালিয়ে গেল। এখন ভয়ে থাকি/হঠাৎ যদি অন্য কাউকে ভুলের বশে বুকের ভিতর জড়িয়ে ধরে/ কুসুম বলে, কুসুম কুসুম কুসুম বলে ডাকি। পাড়ার তিনটি যুবক এসে কুসুমকুমারীকে / নিয়ে গেল দিঘির পাড়ে, অন্ধকারে/ নষ্ট করল তাকে- অস্ত গেল চাঁদ” তখন মানবিক সত্তার স্ফুরণ ভালোবাসার দিগন্ত খুলে দেয়।
প্রেমের বিভিন্ন অগ্নিবর্ণ আলো এসে পড়ে তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে। এরকম কিছু উদাহরণ তুলে ধরা যাক।
১
বাচ্চাদের বলো, ওরা
যেন ভয় না পায়। কারণ আমরা নাও ফিরতে পারি।
বলো ,সময় হলে ওরাও যেন বারুদে আগুন দেয়।
২
বাটি ভরা জল ছিল , অল্প খেয়ে রেখেছি টেবিলে ।
এখন সায়াহ্ন ভেঙে সমস্ত পরাগ এসে
আসবাবপত্রের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে।
অন্তিম পুষ্পের রঙ ও বুকের পাঁজরে নদীজলে,
সন্ধ্যপুষ্প গৃহস্থকে ডাক দেয় আমার বাগান হবে , এসো।
তুমি নিজে দেখে নাও কীভাবে নাচের ছন্দ
রাত্রির শরীরে মিশে যায়,
আধবাটি জলে হালকা ছায়া পড়ে প্রাণকেন্দ্রে, অর্ধেক উৎসবে।
৩
আমি তাকে বলিনি- এখনো আমার
বুকের মধ্যে পাপড়ি গোনা শেষ হয়নি,
অস্তগামী চাঁদের আলোয় গভীর রাত্রে
সমুদ্র দেখা হয়ে ওঠেনি,
প্রাণের আকাশে এখনো শ্রাবণের মেঘ।
৪
সেই থেকেই আমরা দু’জন একসঙ্গে ঘনিষ্ঠ খেলার
আত্মীয়তায় মেতেছি। দেখা যাক-
কে জেতে, কে হারে,
তাকে বলিনি আমার কাছে হারজিৎ সবই সমান।
৫
আশ্লেষ-শিখায় জ্বলে বাসনার প্রতীক সে নারী।
শরীরি রহস্যে ঘেরা বুক তৃষ্ণার প্রদীপ জ্বালে
৬
তোমার কাছে জানতে পারি
নিখিল চিত্ত পান-সুপারি
কিংবা উমা মহেশ্বরের
রক্ত জ্যোৎস্নাধারায় গিয়ে
এক ভুবনে যায় হারিয়ে-
৭
আমাদের শোবার ঘরে বড় অন্ধকার, আসর জমে না।
তাই বাগানে টেবিল নিয়ে বসে আছি,
সমস্ত উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছি শুধু ধান
চাঁদের আলোয় ভেসে আসবে সব পাখি, জলযান,
একান্তে আসবে খাবে খুঁটে খুঁটে সর্বশেষ ধান,
সর্বশেষ মদ, তার অন্য নাম দূরে চলে যাওয়া-
সেইসব বিদায়ের গান
বেজে উঠবে সাজানো টেবিলে,
প্রকাশবাবুরা এসে টুংটাং হাসির শব্দে আরও কিছুক্ষণ
আমাকে আটকে রাখবে, জ্যোৎস্নার ভিতরে প্রাণপণ
কি একটা ধরতে গিয়ে ফিরে এসে
আরও কিছুক্ষণ
প্রকাশবাবুর দিকে ঝুঁকে পড়ে
ডুবে যাব চায়ের টেবিলে
গল্পের প্রবল সরোবরে।
৮
তখন তুমি কী করো কী জানতে ভীষণ ইচ্ছে করে
নব ঘুরিয়ে তুষ্ট ভ্রমর অশোকতরু ওষ্ঠাধরে,
খোলা থাকে ক্রীমের কৌটো , চার পয়েন্টে ঘুরছে পাখা,
ছোট্ট মতো হাই ওঠে তাও একুশ রকম মর্জি মাখা,
বুকের ঘুমে অন্ধ পাখি সাঁতার কাটে পরস্পরে ,
যুগ যুগান্ত রাক্ষুসী প্রাণ কোন পাতালে রইল ঢাকা,
ইচ্ছেকে খুন করলে কি আর তুমি আমায় পুরবে জেলে
স্বপ্ন ছিঁড়ে শর্তে চুক- বাঁচুক হাজার হাজার ছেলে।
৯
যেটুকু অন্ন, দুচোখের জলে
মিলেমিশে হয় শেষ,
তীরে ভাঙাচোরা নৌকা রয়েছে
চালক নিরুদ্দেশ।
এই স্তব্ধতা দারুণ স্বচ্ছ
ত্রিকাল বাজায় তাল
পাহাড় চূড়ায় তুষার চর্বি
গলবে আগামীকাল।
১০
একদল শক্ত মানুষ এই প্রবল রাত্রিতে একটি বিশাল সারবান
তেজি দীর্ঘায়ু বৃক্ষের মতো
ভোরের দিকে টেনে নিয়ে যায়, আমি
স্বপ্ন ও তন্দ্রার মধ্যবর্তী অঞ্চলে সমস্ত আকাশে তারার আগুন
সমস্ত সমুদ্রে হাজার হাজার জাহাজ ছড়িয়ে দিয়ে
মানুষ, কেবল সীমাহীন মানুষের শব্দ শুনতে পাই।
১১
আজ সব ভুলে যাও
আজ নববসন্তের দিন ( বিবাহবিচ্ছেদের আগের দিন )
১২
আবার অন্ধকার, তুমি একবার কিছু বলতে গিয়ে
গাঢ় চোখ তুলেতাকাও, তারপর ধীরে ধীরে কোলের উপর টেনে নাও
আমার বাঁ-হাত, দু দিকে সরে যায় ধান ভরা ধান আর দুর্ভিক্ষ ঘেরা গ্রাম,
তুমি মাথায় আঁচল তুলে দিয়ে কান ঢেকে নাও
হু হু বাতাসে জানালা বন্ধ করতে চাইলে ইশারায় ‘না’ করো।
১৩
নদী হোক তোমার শরীর
ঝরুক নক্ষত্রদল মধ্যরাতে আকাশ বৃক্ষের পদতলে
নয়নে ঘনাও জেদ ভ্রূপল্লব ভোরের আকাশ।
১৪
খোসা ছাড়ানো কমলালেবুর মতো ভরে উঠল অপরাহ্ন
বহুদূর ছড়ানো ডোরাকাটা ঘাসে গাছের ছায়াগুলি ক্রমশ
দীর্ঘ হয়ে আসে, সেই নরম নতজানু আমন্ত্রণের দিকে
খোলা চুলে আনত হয় তোমার মুখ, সারা শরীর বিকেলের সমুদ্র হয়ে ওঠে
১৫
যদি তিরাশি হাজার ছেলে জেলের গরাদ ধরে
আমাকেই দেখে-
আমি জেগে উঠি এক জ্বলন্ত শক্তির চাপে জনস্রোতে
১৬
স্বজনের হৃদপিণ্ড খেয়ে
স্বজনেরা এখন ঘুমাক-
চেতনার দৃপ্ত সিংহ রূপে
অগ্নিপুত্র তুই জেগে থাক।
প্রেমের মধ্যে চেতনার কথা জাগরুকতার কথা বারবার উচ্চারিত হয়েছে। জীবন ও জগতের ক্রমবর্ধমান জটিলতা ও বহুমাত্রিক সমস্যার ভেতরে জীবনের মর্মগত উপলব্ধি এবং হৃদয়ের সুক্ষ অনুভূতি প্রেম ও প্রকৃতির ছায়া এসে পড়েছে তাঁর চিন্তায়। কবিতায় তিনি চিন্তাকে আয়ুধ হিসেবে ব্যবহার করেছেন প্রাণছন্দের উত্তাপ বিচ্ছুরণে। মানুষই সমাজের নিউক্লিয়াস।প্রেমই তার চালিকাশক্তি। মণিভূষণের কবিতায় প্রেম প্রকৃতি এবং মানবিক সমাজ সমান ভাবে গুরুত্ব পেয়েছে।
‘আমাদের মৃতদেহ, অন্ধকার, প্রতিটি পোষাক
ভেসে যাচ্ছে গোধূলির রক্তবর্ণ উদ্বিগ্ন প্রহরে
আমার শোণিতে ভেজা দৃশ্যাবলী তীব্র পরমায়ু ফিরে পাক’।
( ক্রমশ)
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


0 Comments