পর্ব ১৭
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
প্রীতম সেনগুপ্ত
শ্রীরামকৃষ্ণের দেহাবসানের পর(১৬ অগাস্ট, ১৮৮৬, বাংলা ৩১ শ্রাবণ) পক্ষকালের মধ্যে(১৫ ভাদ্র) শ্রীশ্রীমা বৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রা করলেন। মায়ের সঙ্গে গেলেন যোগীন, লাটু, কালী, গোলাপ-মা, লক্ষ্মী দেবী ও নিকুঞ্জ দেবী। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য বৃন্দাবন থেকে প্রত্যাবর্তনের পর অন্যান্য গুরুভ্রাতাদের মতো যোগীন সন্ন্যাস গ্রহণ করেন, সন্ন্যাস নাম হয় স্বামী যোগানন্দ। এবার থেকে আমরা যোগীন মহারাজ বা স্বামী যোগানন্দ বলেই তাঁকে অভিহিত করব। যাই হোক, বৃন্দাবন যাত্রাকালে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে! ট্রেনে যোগীন মহারাজের প্রবল জ্বর হয়। কেমন করে ট্রেন থেকে সকলকে বৃন্দাবনে নামাবেন তা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড জ্বরে ক্রমশ বেহুঁশ হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় দেখেন ঠাকুর স্থির হয়ে উপবিষ্ট এবং তাঁর কাছেই অবস্থান করছে বিকটাকৃতি জ্বরাসুর। সে ওঁকে বলছে,“তোকে দেখে নিতুম; তা পারলুম না, তোর গুরু পরমহংসের জন্য। তোকে এখনই ছেড়ে দিতে হচ্ছে। যাক্, এই বেটীকে(লাল কাপড় পরা এক স্ত্রী মূর্তি দেখিয়ে) রসগোল্লা দিস।” ভোরবেলায় মহারাজের জ্বর কমে গেল। পরবর্তী সময়ে জয়পুরে কোনও এক মন্দিরে স্বপ্নে দর্শন পাওয়া মূর্তিটি দেখে যোগীন-মা-কে (ঠাকুরের উল্লেখযোগ্য মহিলা ভক্ত ও অনুগামিনী) জানান। কাছেই একটি রসগোল্লার দোকান ছিল। দেবীকে রসগোল্লা ভোগ নিবেদন করা হয়। অনুমান করা যায় এই দেবী হলেন শীতলা এবং সেবার শ্রীশ্রীঠাকুরের কৃপায় বসন্ত রোগ থেকে যোগানন্দজী রক্ষা পান!
একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল শ্রীশ্রীমায়ের প্রথম দীক্ষিত সন্তান হলেন স্বামী যোগানন্দজী। বৃন্দাবনেই এই দীক্ষাদান করেছিলেন। এর আগে যোগীন মহারাজকে এক বিশেষ ইষ্টমন্ত্রে দীক্ষাদানের জন্য মা ঠাকুরের আদেশপ্রাপ্ত হন। অথচ তখনও পর্যন্ত কাউকেই দীক্ষাদান করেন নি। তাই প্রথমাবস্থায় ওই আদেশকে তেমন গুরুত্ব দেন নি, মনের খেয়াল বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু উপর্যুপরি তিন দিন এইভাবে আদিষ্ট হওয়ার পর যোগীন মহারাজকে বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন। মহারাজ জানান, ঠাকুর তাঁকে কিছু একটা বলবেন এইরকম মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু কার্যত আর বলে যান নি। এছাড়া তিনিও মন্ত্র গ্রহণের আদেশ লাভ করেছেন। মা তাঁকে দীক্ষাদান করে শেষমেশ শ্রীশ্রীঠাকুরের আদেশ পালন করেছিলেন। বৃন্দাবনে শ্রীশ্রীমা এক বৎসরকাল ছিলেন। এই সময় মায়ের সেবার পূর্ণ দায়িত্ব বহন করেন যোগীন মহারাজ। এরপর ১৮৮৮ সালে নীলাম্বরবাবুর বাগানে মায়ের অবস্থানকালেও মায়ের সেবার পূর্ণ দায়িত্বভার বহন করেন। কেউ সামান্য টাকা পয়সা দিলে মাতৃভক্ত মহারাজ সেগুলি সঞ্চিত করে রাখতেন। উদ্দেশ্য মা তীর্থযাত্রায় গেলে সেগুলি যাতে ব্যয় করতে পারেন। এইভাবে প্রায় ছয়শো টাকা সঞ্চয় করেছিলেন। ৺জগদ্ধাত্রী পূজা উপলক্ষে শ্রীশ্রীমা জয়রামবাটী যেতেন পুজোর তৈজসপত্র মাজতে। মা'কে এই কাজ থেকে নিষ্কৃতি দিতে পুজোর জন্য কাঠের বারকোশ, সিংহাসনের চৌকি, ইত্যাদি করিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় এই পূজার খরচ চালাবার জন্য তিনশো টাকা দিয়ে তিন বিঘা জমিও কিনে দিয়েছিলেন।
বাস্তবিকপক্ষে শ্রীশ্রীমা'কে তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন, স্বয়ং জগজ্জননীকে পেয়েছিলেন তাঁর মধ্যে। তিনি তো জগজ্জননীই! একবার শরৎ মহারাজ ( স্বামী সারদানন্দ, ঠাকুরের আরেক সন্ন্যাসী সন্তান) তাঁকে বলেন,“যোগীন, নরেনের সব কথা তো বুঝতে পারি না; কত রকম কথা বলে-- যখন যেটাকে ধরবে সেটাকে এমন বড় করবে যে, অপরগুলো একেবারে ছোট হয়ে যাবে।” উত্তরে যোগানন্দজী বলেন, “শরৎ তোকে একটা কথা বলে দিচ্ছি, তুই মাকে ধর, তিনি যা বলবেন তাই ঠিক।” শুধু তাই নয় শরৎ মহারাজকে মায়ের কাছে নিয়ে গেলেন। ক্রমে তিনিও মায়ের সেবাধিকার অর্জন করেন এবং তাঁর মাতৃসেবা আরেক ইতিহাস! যোগানন্দজী ঠাকুরের সন্ন্যাসী সন্তানদের মধ্যে সর্বাগ্রে দেহত্যাগ করেন। দেহত্যাগের অনেক পরে শ্রীশ্রীমা একবার বলেছিলেন,“যোগীনের মতো আমাকে কেউ ভালোবাসত না।” আরও বলেছিলেন, “আমার ভার কি সকলে নিতে পারে? পারতো যোগীন, আর শরৎ।”
যোগীন মহারাজের মঠজীবন প্রসঙ্গে একটি অপূর্ব চিত্র অঙ্কন করেছেন স্বামী গম্ভীরানন্দজী তাঁর ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা’ গ্রন্থটিতে। সেটি এইরকম--“তাঁহার চক্ষু সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দ বলিতেন-- যেন জগন্নাথের চোখ। দক্ষিণেশ্বর ও কাশীপুরে তিনি এত ধ্যান করিতেন যে চক্ষু লাল হইয়া থাকিত; তাই ঠাকুর বলিতেন--অর্জুনের চোখের মতো। মঠজীবনে তাঁহার এই ‘অর্জুনচক্ষু’ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিত। এই সময়ের চিত্র জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর লেখনীতে এইরূপ অঙ্কিত হইয়াছে -- তিনি একদিন এই লম্বা, কৃশ ও অপূর্ব নয়নযুক্ত সাধুটিকে বরাহনগরের মঠের দিকে যাইতে দেখেন। সন্ন্যাসী যোগানন্দের চরণ তখন রিক্ত, আবরণ একখানি মাত্র বহির্বাস, মস্তক মুণ্ডিত। তাঁহার পিঠে একটি ঝুলিতে আনাজ-তরকারি, আর ডান হাতে একটা হাঁড়ি। ঠাকুরসেবার এই দ্রব্যসম্ভার লইয়া দারুণ রৌদ্রে হাঁটিয়া চলিয়াছেন সাবর্ণ চৌধুরীদের বংশধর; অথচ তাঁহার মুখ স্নিগ্ধ, প্রশান্ত!” তাঁর সম্বন্ধে মা বলেছিলেন,“যোগীন কৃষ্ণসখা গাণ্ডিবী অর্জুন--ধর্মরাজ্য সংস্থাপনের জন্য ভগবানের নরলীলার সাথী হয়েছে।”
যোগানন্দজী নির্জনতাপ্রিয় ছিলেন। তেমন শাস্ত্র পড়াশোনা করেন নি। গীতা, উপনিষদ পড়েছিলেন। গভীর তপস্যায় মগ্ন থাকতেন। ১৮৯১ সালে প্রয়াগে কঠোর তপস্যায় রত হন। সঙ্গে ছিলেন গুরুভ্রাতা স্বামী নিরঞ্জনানন্দ। সেখান থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে কাশীতে যান। সীতারামের ছত্রের সামনে থাকতেন, গভীর তপস্যায় ডুবে যান। এই সময় তপস্যার জন্য সময় বাঁচাতে ভিক্ষাপ্রাপ্ত রুটিগুলি রেখে দিতেন এবং সেগুলি থেকে একটু একটু নিয়ে জলে ভিজিয়ে তিন চারদিন ধরে খেতেন। এই কৃচ্ছ্রতার ফলে উদরাময়ে আক্রান্ত হন। এটিই তাঁর দেহত্যাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়! তিনি অদ্ভুত ইন্দ্রিয়জিৎ পুরুষ ছিলেন। ইন্দ্রিয়জয়ের উপায় ঠাকুর তাঁকে যেভাবে বলেছিলেন তা পালন করে হাতেনাতে ফললাভ করেন। এই বিষয়ে ‘শ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ‘ গ্রন্থে বর্ণনাটি এইরকম--“স্বামী যোগানন্দ যাঁহার মতো ইন্দ্রিয়জিৎ পুরুষ বিরল দেখিয়াছি, দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরকে একদিন ঐ বিষয়ে প্রশ্ন করেন। তাঁহার বয়স তখন অল্প, বোধহয় ১৪/১৫ হইবে এবং অল্পদিনই ঠাকুরের নিকট গতায়াত করিতেছেন। সে সময় নারায়ণ নামে এক হঠযোগীও দক্ষিণেশ্বরে পঞ্চবটীতলে কুটীরে থাকিয়া নেতি ধৌতি ইত্যাদি ক্রিয়া দেখাইয়া কাহাকেও কাহাকেও কৌতূহলাকৃষ্ট করিতেছেন। যোগেন স্বামীজী বলিতেন যে, তিনিও তাহাদের মধ্যে একজন ছিলেন এবং ঐ সকল ক্রিয়া দেখিয়া ভাবিয়াছিলেন--ঐ সকল না করিলে বোধহয় কাম যায় না এবং ভগবদ্দর্শন হয় না। ... যোগেন স্বামীজী বলিতেন, ঠাকুর আমার প্রশ্নের উত্তরে বললেন--খুব হরিনাম করবি, তা হলেই যাবে। কথাটা আমার একটুও মনের মতো হল না। ...তারপর ভাবলাম--উনি যা বলেছেন তা করেই দেখি না কেন--কি হয়? এই বলে একমনে খুব হরিনাম করতে লাগলুম। আর বাস্তবিকই অল্পদিনেই ঠাকুর যেমন বলেছিলেন, প্রত্যক্ষ ফল পেতে লাগলুম।”
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


0 Comments