জ্বলদর্চি

ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ- ১০/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

পর্ব – ১০

বাঈজীদের কোঠা থেকে গ্রামোফোনে এবং জনসমক্ষে ঠুমরি গান বেরিয়ে আসার সাথে সাথে পূর্বের মাদকতাময় যৌন আবেদন হারিয়ে গেল এবং ক্রমে ঠুমরি গান একটি বিশুদ্ধ ও বিমুর্ত শিল্প রীতিতে পরিগণিত হলো। পুরুষ গায়কদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ঠুমরিতে বাঈজীদের 'নখরা' বা মাদকতা মেশানোর কৌশল নষ্ট হয়ে গেল। ১৯২০ সাল ও তৎপরবর্তী সময়কে ঠুমরি গানের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সময় বলে মনে করা হয় যখন বাঈজীদের থেকে ঠুমরিকে পুরুষ শিল্পীরা উদ্ধার করে এনে শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি ধারা হিসেবে পরিচিতি দান করলেন। এর ফলে ঠুমরি একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা পেল এবং সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করলো। এই সময়ে শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্যান্য ধারার মতো সমস্ত সরাসরি অনুষ্ঠানে বোল বনাও ঠুমরির একটি প্রধান অংশ অবশ্যই থাকতো কিন্তু ঠুমরির সাথে কত্থক নৃত্যের আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ ঘটে গেল অর্থাৎ ঠুমরি সহযোগে কত্থক নাচের অঙ্গ সঞ্চালনা ও অভিনয়রীতির বিলোপ ঘটল। কণ্ঠ ও নৃত্যশিল্পীরা যেকোনো একটি শাখায় পারদর্শিতা অর্জনের চেষ্টা করতে শুরু করলেন।                                
 
 ১৯০২ সালের পরে গ্রামোফোন রেকর্ডের যুগে বোল বনাও শ্রেণীর ঠুমরী শিল্পীরা রাজকীয় মর্যাদা লাভ করলেন এবং রেকর্ডের মাধ্যমে সারা দেশজুড়ে রাজা ও অন্যান্য অভিজাত শ্রেণীর ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে সমগ্র ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে বোল বনাও ঠুমরিকে অসম্ভব জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। সারাদেশে বোল বনাও ঠুমরির জন্য বেনারস বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল এবং বেনারস তার এই জনপ্রিয়তা বজায় রেখেছিল। বেনারস থেকে এই সময়ে বহু খ্যাতনামা শিল্পীর আবির্ভাব হয়েছিল। ১৯১০ সালের পরে কলকাতা যখন ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের রাজধানী হল সেই সময়ে বেনারসের সাথে সাথে পূরব অঙ্গ বা রীতি (যা বিহার ও উত্তরপ্রদেশে প্রচলিত) জনপ্রিয় হয়ে উঠল এবং তাদের বেশিরভাগই শিল্পীরাই কলকাতাতে এসে আশ্রয় নিলেন। বাংলাতে এই সময়ে নিধিরাম গুপ্তা যার লেখা 'নিধুবাবুর টপ্পা' নামে বিখ্যাত ছিল, ছাড়াও গিরিজা শংকর চক্রবর্তীর মতো সংগীতশিল্পীরা নতুন প্রজন্মের মধ্যে খেয়াল ও ঠুমরি গানকে জনপ্রিয় করেছিলেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন সুনীল বসু, নয়না দেবী ও জমিরুদ্দিন খান যাঁরা বোল বনাও ঠুমরির এক একজন উজ্জ্বল শিল্পী ছিলেন।                                           
  
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে ঠুমরি গানের দীর্ঘ বিস্ময়কর যাত্রাপথ পর্যালোচনা করলে ভারতীয় সংগীতের কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। প্রথমতঃ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থানের মত পুরুষশাসিত প্রাচীন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে ঠুমরি গান নারীর কণ্ঠস্বর হয়ে প্রকাশিত, যদিও ঠুমরির গান ও নাচ মহিলারা করতেন বলে ঠুমরিকে মেয়েদের একচেটিয়া বলা হতো তা' নয়। মূল কারণ হল ঠুমরি গানগুলির রচয়িতারা ঠুমরি গান লিখতেন নারীর দৃষ্টিকোণ দিয়ে। কিন্তু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে এই বিতর্কিত অসঞ্জাত সমাজে নারীর ভূমিকা বা তাদের অবস্থানের পরিবর্তন হত পুরুষদের মর্জিমাফিক মত। কিন্তু এইসব সীমাবদ্ধতার মাঝেও নারীরা নিজেদের জন্য একটি স্বতন্ত্র স্থান তৈরি করতে পেরেছিলেন ঠিক যেমন দীর্ঘ ও রক্ষণশীল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে ঠুমরি একটি নিজস্ব ধারা তৈরি করতে পেরেছিল। এই সম্বন্ধে বিখ্যাত হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ও লেখক ডঃ বিদ্যা রাও ১৯৯০ সালে তাঁর লিখিত প্রবন্ধ "ঠুমরি অ্যাজ ফেমিনিন ভয়েস"-এ লিখেছেন "শাস্ত্রীয় বা মার্গসঙ্গীতের জগতে ঠুমরি খুব ছোট একটি অংশ যা মহিলাদের গাইবার প্রথা ছিল। এটি স্বল্প পরিসরের একটি অসাধারণ ঝলক কলা যাতে নির্দিষ্ট কাব্যধর্মিতা, সাঙ্গীতিক উপাদান, রাগ ও তাল ব্যবহৃত হতে পারে। এটি হালকা এবং আকর্ষক হবে কিন্তু তার মধ্যে খেয়াল বা ধ্রুপদের আভিজাত্যের অভাব থাকে। ঠুমরি সবচেয়ে ভালো লাগে ছোট ব্যক্তিগত মেহফিলে শুনতে। খেয়ালের মূল উদ্দেশ্যই থাকে রাগের সবরকম দরজা রক্ষা করে তার বিপজ্জনক স্থান গুলির দিকে দৃষ্টি রাখা এবং মনে রাখতে হবে কোনভাবেই যেন রাগের বিশুদ্ধতা নষ্ট না হয়। ঠুমরি যেন সেই দিক থেকে কোন উন্মুক্ত নারীশরীরের মত। গাইবার ধরনটি পুরোপুরি এই রীতিটির খোলামেলা ভাবের উপর নির্ভর করে। এটি একটি ছোট্ট রীতি যা ছোট স্কেল, হালকা ছোট রাগে এবং ছোট তালে গাওয়া হয় কিন্তু এটি নিজেকে বিস্তৃত এবং সমস্ত রকম ভাঙ্গা গড়ার জন্য প্রস্তুত করে রাখে। ফলে এটি ক্রমাগত নিজের ভিতরে নিজেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, একক ও অপ্রত্যাশিত ভাবে প্রসারিত করতে সক্ষম হয় নারী শরীরের মতোই ঠুমরি মুক্ত, বিপজ্জনক অথচ উর্বর এবং পুনঃসৃষ্টিতে সক্ষম"।          
  
ধ্রুপদী সংগীতের প্রথা অনুযায়ী রাগকে কয়েকটি বিশেষ স্তরের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হয়। খেয়ালের উপস্থাপনাকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায় - ধীর গতির বড় খেয়াল এবং দ্রুতগতির ছোট খেয়াল। রাগের রূপ পরিস্ফুটনের সময় সীমিত নয় এবং কিছু কিছু গায়ক এর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নেন। এটি শুরু হয় আলাপ বা ধীর লয়ের স্বর সঞ্চালন দিয়ে যেখানে রাগের বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরা হয়। এরপরে শিল্পী চলে আসেন গানের কথায় অর্থাৎ বন্দিশে। গানের কথার বিভিন্নভাবে প্রকাশ প্রাথমিকভাবে অতি ধীর গতিতে চলতে থাকে, যাকে 'অতি বিলম্বিত লয়' বলা হয়। লয় ধীরে ধীরে দ্রুতগতি লাভ করার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে তিনভাবে অর্থাৎ 'বিলম্বিত', 'মধ্য' ও 'দ্রুতলয়ে' এবং বন্দিশটির রাগও সেইসঙ্গে বদলাতে থাকে। এই বিভাগগুলি ধীর ও দ্রুতগতির সুরেলা কারিগরি ও সূত্র দিয়ে যুক্ত থাকে যাকে বলে 'তান', যাতে কখনো কখনো ব্যবহৃত হয় 'তান সরগম', আবার কখনো বা আ-কার ব্যবহার করে। স্বর উল্লেখ করে 'তানে'র নির্দিষ্ট ব্যবহার 'সরগম' নামে চিহ্নিত হয়ে থাকে এবং বিশেষ কিছু ঘরানাতে এর ব্যবহার হয়। মনে করা হয় কর্ণাটকী সংগীত এর অনুপ্রেরণা।     
                                                                                               ক্রমশঃ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments