জ্বলদর্চি

প্রথম মহিলা বাঙালি-বৈজ্ঞানিক ড: অসীমা চট্টোপাধ্যায়/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৫৬

প্রথম মহিলা বাঙালি-বৈজ্ঞানিক ড: অসীমা চট্টোপাধ্যায় ― ০১

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

(১)
বাঙালির বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণা কোনও অলীক কল্পনা নয়। ফ্লুকও নয়। রুঢ় বাস্তবের রুক্ষ্ম তপ্ত মাটিতে কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়ানো একটি ধ্রুব সত্য ঘটনা। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু আর আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়― এই দুই প্রথিতযশা বাঙালি বৈজ্ঞানিকের হাত ধরে একদিন বাঙালির বিজ্ঞান গবেষণায় যে রেনেসাঁসের প্রবর্তন ঘটেছিল উনবিংশ শতকে, তার সফল পথচলা আজও অব্যাহত। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, পুলিনবিহারী সরকার, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ-সহ একঝাঁক গুণী পণ্ডিতের হাত ধরে বিংশ শতাব্দীর বাঙালির বিজ্ঞান চর্চায় যেন জোয়ার নামে। সংকীর্ণ প্রাদেশিকতার ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। তার সুবাসিত আঘ্রাণে বিশ্বময় ম ম করছে বাঙালিয়ানা।

সুতরাং, বাঙালির বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ ও সম্ভ্রান্ত। তার বিজ্ঞান অন্বেষা আর এষণায় কখনও ঘাটতি বা খামতি ছিল না। তবে, পুরুষ শাসিত সমাজে বিজ্ঞান-গবেষণায় কোনও অংশে পিছিয়ে ছিলেন না বাঙালি রমণীরা। কতিপয় মহিলা বাঙালি বৈজ্ঞানিকের নিরন্তর লড়াই বাঙালির বিজ্ঞান চর্চার অসম্পূর্ণ ইতিহাসকে নিঃসন্দেহে সম্পূর্ণতা দিয়েছে। তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য রসায়ন বিজ্ঞানী ড: অসীমা চট্টোপাধ্যায়। তিনিই সম্ভবত প্রথম মহিলা যাকে একটি ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'ডক্টরেট অব সায়েন্স' (D.Sc) উপাধি দেওয়া হয়। সালটা ছিল ১৯৪৪। ওই বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পেলেন ডি.এসসি. (D.Sc.) ডিগ্রি। প্রথম যুগের তিনি এমনই এক বাঙালি বীরাঙ্গনা যে সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বিজ্ঞানে বাঙালির নবজাগরণ ঘটাতে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন তাঁর পথপ্রদর্শক, মেন্টর। বিশ্ববরেণ্য রসায়নবিদ সেদিন তাঁর ছাত্রীকে বলেছিলেন― 
'তুমি গাছপালা নিয়ে গবেষণা করো। তুমি তো জানো গাছপালা থেকে কত ওষুধপত্র হয়, বেঙ্গল কেমিক্যালে আমরা কত দেশীয় ওষুধ তৈরি করেছি, এই লাইনে কাজ করে তুমি দেশকে অনেক দিতে পারবে।'
      

আয়ুর্বেদশাস্ত্রে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সফল মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন ড: অসীমা চট্টোপাধ্যায়। বৈদিক যুগে যখন আয়ুর্বেদশাস্ত্রের চর্চা শুরু হয়, তখন ওষুধের খোঁজে ভেষজ উদ্ভিদ সন্ধানের কাজ চলত। উনবিংশ শতকে ওষধি গাছগাছড়ার সক্রিয় সরল যৌগ পদার্থ উদ্ধারের কাজে গতি আসে। প্রাচীন ভারতের রসায়নশাস্ত্রে যে সব ভেষজ যেমন বাসক, কালমেঘ, কুর্চি, তুলসী প্রভৃতি গাছের উল্লেখ পাওয়া যায়; সে সবই বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে তৈরি করে সফলভাবে ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করার যে কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন রসায়ন-বিজ্ঞানী ও কর্মযোগী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়; তার সফল ব্যাটন বয়ে নিয়ে যান প্রফেসর রায়-এর সুযোগ্য ছাত্রী ড: অসীমা চট্টোপাধ্যায়। মূলত তাঁর উদ্যোগে প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদকে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের আলোকে পরিচিতির নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন অসীমা দেবী।

বিংশ শতাব্দীতে ত্রিমাত্রিক অণুর চাহিদা বাড়ছে। বিদেশী জৈব-রসায়ন বিজ্ঞানীরা তেমন অণু সংশ্লেষণের কাজ শুরু করে দিয়েছেন জোরকদমে। উদ্ভিদের মধ্যে কী কী জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ায় জৈবযৌগ সৃষ্টি হয়? দেশজ ভেষজ উদ্ভিদ থেকে যৌগ নিষ্কাশনের কৌশল কী? কীভাবে যৌগ পদার্থগুলির গঠন নির্ণয় করা যায়? প্রাকৃতিক যৌগ পদার্থের সংশ্লেষণ আর বিক্রিয়া কৌশল নির্ণয়ের পর মানুষের দেহে উপক্ষারগুলির শারীরবৃত্তীয় এফেক্ট কী হবে, তার মূল সক্রিয় অংশগুলিকে ল্যাবরেটরিতে পৃথক করে ভেষজ হিসাবে সফল প্রয়োগের নেশায় মেতে উঠেছিলেন তিনি। একযোগে তাত্ত্বিক এবং ফলিত রসায়নের উভয় শাখায় কৃতিত্বের বিশেষ ছাপ রেখে গেছেন তিনি। যদিও একজন মেয়ে হয়ে সাফল্যের উন্নত শিখরে পদার্পণের রাস্তা কুসূমাস্তীর্ণ নয়, বরং কঙ্কটাকীর্ণ ছিল। সমাজের প্রতিটি স্তরে পদে পদে বাধা এসেছে। সুচারু ভাবে সে-সকল সমস্যার স্থায়ী সমাধানের রাস্তা উন্মোচিত হয়েছে। বাধার সকল শৃঙ্গ জয় করে তিনি এগিয়ে গেছেন নিজের জেদ, তিতিক্ষা আর গভীর অধ্যবসায়ের জোরে।

(২)
গোড়ার কথা :

হুগলি জেলার অন্তর্গত একটি প্রত্যন্ত গ্রাম পশ্চিম গোপীনাথপুর। সে-গ্রামে মুখোপাধ্যায় বংশের বেশ নামডাক। মুখোপাধ্যায় পরিবারটির বিখ্যাত মানুষ ছিলেন শ্রী ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়। গ্রামে তাঁর বিশাল প্রভাব-প্রতিপত্তি। ঠাকুরদাস-এর একমাত্র পুত্র শ্রী হারানচন্দ্র মুখোপাধ্যায় একজন দুঁদে নীল-অফিসার। সেসময় ইংরেজ সরকার জোর করে গ্রামে-গ্রামে নীল চাষ করাতো। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে হামেশাই গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষগুলোর প্রাণ ওষ্ঠাগত। নীল কুঠি বাড়ির নাম শুনলে আমজনতার মনে তীব্র আতঙ্ক। কখন কী বিপদ আসে, কে জানে! সবসময় একটা চাপা আর্তনাদ তাড়া করে বেড়ায়। ওই নীল কুঠি বাড়িগুলি তাই সাধারণের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল উনবিংশ শতকে। সে-নীলের চাষ দেখাশুনা করতেন শ্রী হারানচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তিনি বিয়ে করেছিলেন শরৎকুমারী দেবীকে। বর্ধমানের এক সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে শরৎকুমারী দেবী। তাঁর গানের গলা খুব মিস্টি। বাড়িতে নিয়মিত বসত গান-বাজনার আসর। সুরেলা গলায় দুর্দান্ত গান গাইতেন শরৎকুমারী দেবী। এ হেন হারানচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মজঃফরপুর গেলেন চাকরি করতে। সঙ্গে নিয়ে গেলেন পত্নী শরৎকুমারী দেবীকে। দূর মজঃফরপুরে দীর্ঘ পঁচিশ বছর ছিলেন তাঁরা। পরে শরৎকুমারী দেবী গ্রামের বাড়ি হুগলি ফেরত আসেন। হারানচন্দ্র আর শরৎকুমারী দেবীর দুই সন্তান― ননীগোপাল ও ইন্দ্রনারায়ণ। বড় ছেলে ননীগোপাল তখন বঙ্গবাসী কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক। ননীগোপাল-এর মেজো ছেলে অমিয়ভূষণ একজন নামজাদা ডাক্তার।

ননীগোপাল-এর ভাই ইন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায়ও একজন খ্যাতিমান ডাক্তার ছিলেন। যদিও শুধু মাত্র ডাক্তারীতে তাঁর মন ভরেনি। আরও অনেক পেশা ছিল তাঁর। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। ডাক্তারী বাদে, দাদা ননীগোপাল-এর মতো, বঙ্গবাসী কলেজে অধ্যাপনা করতেন। কলেজে প্রথমে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন। প্রখর জ্ঞানের অধিকারী ইন্দ্রনারায়ণ কেমিস্ট্রি ছাড়া ফিজিক্স আর বায়োলজি নিয়মিত পড়াতেন কলেজে। কমলা দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। মিশনারি স্কুল পর্যন্ত কমলা দেবীর পড়াশুনা। বিয়ের সময় তাঁর বয়েস খুব অল্প। কচি বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় উচ্চ শিক্ষালাভের সম্ভাবনা ছিল না। তবে বিয়ের পর প্রবাসী, বসুমতী প্রভৃতি পত্রিকার নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন কমলা দেবী। সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম, ফাইফরমাস খেটে যেটুকু ফুরসৎ মেলে; পত্রিকা নিয়ে বসে পড়তেন। গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে সকলের খাওয়া-দাওয়ার পর মিলত একফোঁটা বিশ্রাম। তখনই পত্রিকার পাতায় অসমাপ্ত গল্পের আস্বাদ চেঁটেপুটে উপভোগ করতেন তিনি।

বালিকা-বধূ কমলা দেবীর বাবা ছিলেন ডাক্তার হেমনাথ অধিকারী। ডাক্তারীর পাশাপাশি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে রসায়ন শাস্ত্রের প্রখ্যাত প্রফেসর ছিলেন তিনি। ডাক্তারীতে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর বহু গবেষণামূলক কাজও রয়েছে। তিনি বিয়ে করেছিলেন জ্ঞানদা দেবীকে। জ্ঞানদা দেবীর, সংস্কৃত ভাষায়, পাণ্ডিত্য ছিল দেখার মত। সংস্কৃত ভাষায় লেখা রামায়ণ অনর্গল পড়ে যাওয়া তাঁর কাছে ছিল জলভাত।
        

ডাক্তারী আর অধ্যাপনার সুবিধার্থে শ্রী ইন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায় থাকতেন কলকাতায়। সেখানে গড়ে উঠেছিল তাঁর এবং কমলা দেবীর সাজানো সংসার। সুখের সেই সংসারে একদিন লক্ষ্মী এলো। ফুটফুটে এক কণ্যা সন্তানের জন্ম দিলেন কমলা দেবী। সেদিনটা ছিল ১৯১৭ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর। ওইদিন কমলা দেবীর কোল আলো করে কলকাতায় অসীমা মুখোপাধ্যায়ের জন্ম। বাঙালির প্রথম মহিলা বৈজ্ঞানিক তিনি। প্রথম মেয়ে হওয়াতে যারপরনাই খুশি বাবা ইন্দ্রনারায়ণ। তাঁর আনন্দের সীমা পরিসীমা নেই।

(৩)
দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়...

বাবা ইন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায় কলকাতা শহরে বাস করলেও সপ্তাহান্তে প্রতি শনিবার গ্রামের বাড়ি অবশ্যই ফিরবেন― এ জানা কথা। পশ্চিম গোপীনাথপুর গ্রামে তখন তাদের একান্নবর্তী বিশাল পরিবার। চুন-সুরকির অট্টালিকা। লম্বা দালান। বাড়ির সম্মুখে ছড়ানো প্রসস্থ বাগান। বাগানে হরেকরকমের রঙিন ফুল। পরিবারের টানেই সপ্তাহের শেষে তাঁর দেশের বাড়ি ফেরা। মেয়ে-বউ নিয়ে গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে কিংবা গরুর গাড়ি চড়ে শহর থেকে গ্রামে ফিরত সকলে। রাস্তার দুধারে কত নাম না-জানা ফুল ফুটে থাকত। রঙ-বেরঙের প্রজাপতি, ফড়িং ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করত। হরেকরকম গাছগাছালির সুবাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। তার সুঘ্রাণ নিতে নিতে কখন যে বাড়ি পৌঁছে যেত, সে খেয়াল থাকত না ছোট্ট অসীমা'র। তার দুচোখে তখন অপার বিস্ময়। প্রকৃতির রঙ-রূপ-রস চেটেপুটে উপভোগ করার বয়স। সে-বিষয়ে তার কোনও খামতি ছিল না। ষোলোআনা আনন্দের প্রশান্তি তার মুখের'পর লেগে থাকত সবসময়।
        

গ্রাম্য মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় বাবার মুখে নানান গাছ-গাছড়ার নাম শুনত শিশু অসীমা। তাদের গুণাগুণ বলে শেষ করা যাবে না! দেশীয় গাছ-গাছড়ার গুণাগুণ সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই মেয়েকে সচেতন করে তুলত বাবা। ছোট্ট অসীমা তার ডাগর ডাগর চোখ বিস্ফারিত করে সে-কথা মন দিয়ে শুনত আর ভালো করে পর্যবেক্ষণ করত। এভাবে প্রকৃতি-পাঠ আর পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে তার বাল্যশিক্ষার শুরু।

এদিকে ডাক্তার বাবার অত্যন্ত আদরের দুলালী প্রায়শই জ্বরে ভোগে। অনেক ডাক্তার-বৈদ্য দেখিয়েও রোগ সারবার কোনও লক্ষণ নেই। বাবা-মায়ের চিন্তার শেষ নেই। বাবা নিজে ডাক্তার। তবুও অন্যান্য ডাক্তার বন্ধুদের সঙ্গে মেয়ের অসুখ নিয়ে প্রায়শই আলোচনা হয়। কিন্তু পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত কোনও তুকতাক বা ঔষধপত্রে রোগ-নিরাময়ের সহজ উপায় মিলছে না। অগত্যা বাবার ডাক্তার বন্ধুরা প্রায় সবাই মেয়ের হাওয়া-বদলের শলা দিলেন। অথচ তেমন ভালো জায়গা কোথায় যেখানে একরত্তি মেয়েটির কোনও ফ্যাসাদ হবে না! এই টুকু পুঁচকে মেয়ে! বাবা-মা-অন্ত-প্রাণ সে। মা-বাবাকে ছেড়ে দুদণ্ড কোথাও থাকবার কথা চিন্তা করতে পারে না সে। মায়ের চিন্তার শেষ নেই। চিন্তিত মা ডাক্তারদের পরামর্শে শেষমেশ একটা ডিসিশন নিয়েছেন― গ্রামের বাড়ি হুগলিতে পাঠাবেন মেয়েকে। মেয়ের বয়স তখন মাত্র ছয়। (ক্রমশঃ)

তথ্যসূত্র :
●'বারোজন বাঙালি রসায়নবিজ্ঞানী'―ড. রবীন্দ্রনাথ পাত্র
●বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, দৈনিক সংবাদপত্র
●উইকিপিডিয়া, সায়েন্টিফিক ওমেন

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments