জ্বলদর্চি

তুর্কী নাচন-১১ /মলয় সরকার

তুর্কী নাচন 

পর্ব-১১ (পূর্ব প্রকাশিতের পর)


মলয় সরকার

বোডরাম পর্ব(ক্রমশঃ)


এখান থেকে আমরা গেলাম আর এক ইতিহাস বিখ্যাত স্মরণীয় স্থান দেখতে। সেটি হল মিন্দাস গেট  (Myndus Gate)। আগেই বলেছি এই শহর ছিল বিরাট এক পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, যেটা ছিল প্রায় দুর্ভেদ্য। তখনকার দিনে শহরের বেশ কয়েকটি গেট ছিল। তার মধ্যে একটি হল এই মিন্দাস গেট। এটি বর্তমান গুমুস্লুক গ্রামের মধ্যে। এই গেটটি ছিল সাত কিমি বিস্তৃত শহরের ঘেরা দেওয়ালের অনেক গেটের মধ্যে একটি। অন্য গেটগুলির অস্ত্বিত্ব খুব একট বোঝা যায় না। খ্রীঃ পূ ৩৬৪ তেও এই হেলিকারনাসাস বেশ সমৃদ্ধই ছিল। পাশেই ছিল বেশ ব্যস্ত এক সমুদ্র বন্দর। আগেই বলেছি দেশটা, অনেক পাহাড়ী উঁচুনীচু আর মরুভূমির রুক্ষতা মিশানো।তার একপাশে রয়েছে প্রচুর জাহাজ , মাছধরা নৌকায় ভর্তি নীল সমুদ্র আর এক দিকে রয়েছে উঁচু উঁচু পাহাড় , তবে পাহাড়গুলো যে বিশাল অনতিক্রম্য উঁচু , তা নয়।
 

 এই জায়গাটা একটু উঁচুতে। গেটের পাশে বেশ কিছুটা দেওয়ালের অংশ বিশেষ দেখা যায়।গেটের মাঝখানে রয়েছে চওড়া রাস্তার জায়গা। আর দু পাশে দুটি উঁচু টাওয়ারের মত রয়েছে যার আপাততঃ একতলা সমান অংশই পড়ে রয়েছে।তবে যে দেওয়াল ছিল বা গেট ছিল তা যথেষ্ট চওড়া এবং পাথরের তৈরী। গাইড বললেন, সেই যুগে আলেকজান্ডার  এই গেটের ভিতর দিয়েই ঢুকেছিলেন তখনকার বোডরামে।দেওয়ালটাকে ছুঁয়ে সেই ইতিহাসকে অনুভব করার চেষ্টা করলাম।কালের প্রভাবে, ভূমিকম্প বা অন্যান্য নানা কিছুর কারণে সে যুগের অনেকখানিই ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু যা আছে, যা আমরা পাচ্ছি, তা-ই বা কম কি। আলেকজান্ডারের নাম ইতিহাসের পাতাতেই পড়েছি। তাঁর স্মৃতিবিজড়িত কিছু, হোক না সেটা ধ্বংস-বিজয় আর হত্যার সাথে জড়িত, তবু সেই যুগকে যে অনুভব করতে পারছি, এটাই বা কম কি! আর একটা কথা তো ইতিহাস অস্বীকার করতে পারে না, আলেক্সাণ্ডার যেখানে যেখানেই গিয়েছিলেন, সেখানের সভ্যতাই পরিবর্তিত হয়েছিল, উন্নীত হয়েছিল। আজকের ভারতবর্ষের অনেকখানিই তো গ্রীক প্রভাবে প্রভাবিত। চিকিৎসা শাস্ত্রে ইউনানি পদ্ধতি তো ওদেরই দেওয়া। যাই হোক, আশে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে অনেক ভাঙ্গা পাথরের টুকরো।প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, অর্থাৎ আমাদের দেশের বুদ্ধদেব বা তাঁর কাছাকাছি সময়ের জিনিস, এটিকে আমাদের সাঁচীস্তুপ বা ঐ সময়ের যা আছে তার প্রায় সমসাময়িক ভাবতে পারি।


এখান থেকে আমরা চলে এলাম আর একসারি পাহাড়ের মাথায় ,আপাতঃ পরিত্যক্ত উইন্ডমিল দেখতে। কি জানি আমার , এই উইণ্ডমিল দেখলেই সেই ডন কিহোতের গল্পটা মনে পড়ে যায় আর হাসি আসে। যাই হোক, সেটা অন্য কথা।


এই জায়গায় এসে বেশ ভাল লাগছে, কারণ এর একপাশে রয়েছে নীল পাহাড় ঘেরা সমুদ্র বা বোডরাম উপসাগর আর একদিকে রয়েছে গামবেট উপসাগর। পাহাড়ের মাথায় রয়েছে মোট সাতটি উইণ্ডমিলের স্মৃতিচিহ্ন।এগুলি ১৮৭০ সাল থেকে  অল্প কিছুদিন আগে, ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চালু অবস্থায় ছিল এবং আশেপাশের স্থানীয় মানুষের গম ভাঙ্গার কাজে লাগত। দু একটিকে মেরামত করে মোটামুটি দর্শনীয় অবস্থায় আনা হয়েছে। পাহাড়ের উপরে থাকার জন্য এখানে উপসাগরীয় বায়ুর প্রবাহটা ভাল পাওয়া যেত, তাই এই উইণ্ডমিলের ভাবনা। এগুলি সেই হল্যাণ্ডের উইণ্ডমিলের মত নয় বা বিশাল যে বড় তা-ও নয়, গোল গোল পাথরের ঘরের মাথার দিকে দেওয়ালের সাথে লাগানো বড় বড় কাঠের ব্লেডের পাখা, যেগুলো হাওয়া পেলেই ঘুরত।ঘরগুলোও সাদা রঙ করা ছোট ছোট ঘর, কেবলমাত্র মেসিনের জন্যই তৈরী। এখন অনেক মানুষের বালখিল্যসুলভ শিল্পকীর্তিতে চিত্রিত। আর ঘরগুলোর মাথাটা ওলটানো টিনের চোঙার মত।এখান থেকে সম্পূর্ণ বোডরামের ছবি দেখা যায় ।আর এক পাশে নীল উপসাগর- ভীষণ সুন্দর দৃশ্য। 


সামনে বসে রয়েছে দু একটি গরীব দোকানী যারা কখন একজন দর্শক আসবে, তার আশায় হা- পিত্যেশ করে বসে থাকে কিছু চা , বিস্কুট বা কিছু ফলের রস নিয়ে। দু তিনজন উট নিয়েও বসে আছে ঘোরাবে বলে। এই বিদেশ বিভুঁই জায়গায় আমরা বাইরে থেকে কোথাও কিছু খাব না, ঠিক করেই বেরিয়েছিলাম। কাজেই ওদের প্রত্যাশাকে ব্যর্থ করেই চলে আসতে হল। 

এখান থেকে আমরা এলাম মিউজিয়ামের সামনে। 


মিউজিয়ামটা একেবারে সমদ্রের লাগোয়া। পাশাপাশি সমুদ্রের ধারে রাখা রয়েছে অজস্র নানা বর্ণের, নানা আকারের মাছ ধরার নৌকা বা ট্রলার বা অন্যান্য নানা কাজের নৌকা। সমুদ্রের জলেও ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রচুর এরকম নৌকা। বেশ সুন্দর লাগল দেখতে। গাঢ় নীল জলে চকচকে রোদে এত বাহারী রকমের নৌকা এক অদ্ভূত মায়াময় দৃশ্য সৃষ্টি করেছিল।সেগুলো সাদা ধবধবে মাস্তুলে প্রচুর দড়িদড়া নিয়ে দেশের পতাকা শোভিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে একটা কথা একটাও রঙ চটা বা বিবর্ণ নয়, সব যেন গতকালই রঙ করা হয়েছে। কি করে এগুলো ওরা রক্ষা করে জানি না। বেশ লাগছিল এর পাশ দিয়ে পরিস্কার রাস্তায় হাঁটতে। খানিকটা হাঁটার পর গাইড বললেন, চলুন এবার মিউজিয়ামে যাই। অগত্যা পা বাড়ালাম।


মুখ ঘোরাতেই দেখি একটি মূর্তি। সেখানে রয়েছেন সেই ইতিহাস বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও পণ্ডিত হেরোডোটাস। আমার কেমন যেন একটা আচ্ছন্নতা লাগল। যে হেরোডোটাসের নাম এতকাল শুনে এসেছি, তিনি এই জায়গার সেটা জানতাম না। মনে মনে তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে এগোলাম মিউজিয়ামের দিকে।গাইড আমাদের দরজা থেকেই ছেড়ে দিয়ে বললেন, আপনারা আপনাদের সময় মত ঘুরে আসুন, তাড়াহুড়ো নেই। আমি বাইরেই থাকছি। আমরা এগোলাম দুজনেই।


এই মিউজিয়ামের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। এটি আপাততঃ মিউজিয়াম হলেও এটি কিন্তু তৈরী হয়েছিল দুর্গ হিসাবে। এরও আগে এর কাছাকাছি কোথাও ছিল প্রায় ৩৫০ খ্রীঃ পূঃ তে তৈরী মসুলাসের(Mausolus) সমাধি .।এই মসুলাসের নাম থেকেই ইংরাজী Mausoleum শব্দটির উৎপত্তি। এনার স্ত্রী ছিলেন নিজেরই বোন, রাণী আর্তেমিসিয়া (দ্বিতীয়)। এনার সমাধি সৌধটি ছিল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি, যেটি সপ্তম আশ্চর্যের শেষ বেঁচে যাওয়া আশ্চর্য। এটি ধ্বংস হয় দ্বাদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর বিভিন্ন ভূমিকম্পে। এটি ছিল তখনকার দিনে ১৪৮ ফুট উঁচু ও চারদিক ঘেরা দেয়াল, বিভিন্ন ধরণের সুন্দর কারুকার্য খচিত।
এই ধ্বংসস্তুপের পড়ে থাকা টুকরো আজও দেখতে পাওয়া যায়। রাজা মসুলাস এখানে তৈরী করেছিলেন তাঁর সাধের শহর হেলিকারনেসাস ( Halicarnassus ), যেটি আজ বোডরাম নামে খ্যাত।


এই সমাধি সৌধেরই নানা পাথর ও বেঁচে যাওয়া জিনিসপত্র দিয়ে এই বর্তমান মিউজিয়ামটি তৈরী হয়েছিল।তৈরী শুরু হয়েছিল এক জার্মান নাইটের তত্বাবধানে ১৪০৪ খ্রীষ্টাব্দে। এই জায়গাটিতেই ছিল রাজা মসুলাসের প্রাসাদ। সেটি গাইড আমাদের বলছিলেন আমাদের মিউজিয়ামে ঢোকার আগেই।সঠিক মনে পড়ছে না, বোধ হয় তাঁর একটা মূর্তিও ঢোকার মুখেই দেখছিলাম। তবে ভিতরে একটি জিনিস আছে, বড় সুন্দর, তা হল সেই রাণী আর্টিমিসিয়ার মূর্তি। যেটি ,তাঁর যে দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল তার উপর নানা আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে সে সময়ে তিনি কেমন দেখতে ছিলেন, তার নিখুঁত অবয়ব তৈরী করা আছে।


এই দুর্গটি সমুদ্র ঘেরা হওয়ায় বেশ সুরক্ষিত ছিল, দূর থেকে নজর রাখা যেত, কেউ কোথাও থেকে আক্রমণ করতে আসছে কি না। কেউ আক্রমণ করতে এলে তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ভালই ছিল।এটি প্রথমে একটি চ্যাপেল হিসাবে তৈরী হয়েছিল। যে সমস্ত কারিগররা এটি তৈরী করেছিল, তাদের বলা হয়েছিল, তাদের জন্য স্বর্গের ব্যবস্থা একেবারে পাকা।এটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতি দখল করেছে সংস্কার করেছে আর নিজেদের চিহ্ন রেখে গেছে।তার ফলে এখানে আছে বেশ কয়েকটি গেট বা দরজা, যেগুলির নাম ফ্রেঞ্চ গেট বা জার্মান গেট ইত্যাদি। এটি কখনও ব্যবহার হয়েছে  চার্চ হিসাবে, কখনও মসজিদ হিসাবে । আবার কখনও বা জেলখানা, দুর্গ, বা সৈন্য থাকার জায়গা। নানা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে বারবার, বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে । লুট হয়েছে এখান থেকে অনেক সামগ্রী। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এখনও এখানকার বেশ কিছু জিনিস দেখা যায়।শেষের দিকে এটি ছিল ইটালিয়ানদের হাতে। তাদের হাত থেকে ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে, তুরস্ককে যখন সবার হাত থেকে মুক্ত করে স্বাধীন দেশ হিসাবে গড়ে তুলছিলেন, তখন এটি হাতে নেন কামাল আতাতুর্ক। তিনি গ্রহণ করার পর প্রায় চল্লিশ বছর এটি খালি পড়েছিল। শেষে ১৯৬২ খ্রীষ্টাব্দে এটিকে তুরস্ক সরকার মিউজিয়াম হিসাবে ঘোষণা করে।


এই মিউজিয়ামটি মূলতঃ গড়ে উঠেছে Underwater Archeological Museum হিসাবে। সমুদের তলায়, বিশেষ করে ইজিয়ান সমুদ্র বা ভূমধ্য সাগরের নীচে থেকে যা অতীতের জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছে সেই সমস্ত সংগ্রহ করে রাখা আছে এখানে।বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাহাজডুবি হওয়ার পরে সেই সমস্ত জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এর ফলে সেই সময়টাকে ধরে রাখা গেছে। এমন কি প্রায় আড়াই হাজার খ্রীঃপূঃ সময়ের ব্রোঞ্জ যুগের জিনিসপত্রও আছে। আর আছে বিশাল কক্ষে দুটি ডুবে যাওয়া জাহাজের পুনর্নির্মিত দেহ।এর একটি ডুবেছিল ১০৭৭ সালে অন্যটি চতুর্দশ শতাব্দীতে। এখান থেকে যদিও ব্রিটিশরা প্রচুর জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে তাদের দেশের মিউজিয়াম সাজিয়েছে তবুও, আজও যা রয়ে গেছে তা কম নয়।


আগেই বলেছি একটি কক্ষ বিশেষ করে আলাদা করে রাখা আছে সেই রাণী আর্তেমিসিয়া (দ্বিতীয়) র জন্য। সেখানে তাঁর পূর্ণাবয়ব মূর্তি ছাড়াও তাঁর ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র ,অলঙ্কার ইত্যাদি সুন্দর করে রাখা আছে।বেশ বড় মিউজিয়ামটিতে নানা ছবি , রিলিফের কাজ রয়েছে।নানা কাঁচ, মাটি, ব্রোঞ্জের ও বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ধরণের জিনিসই এখানে রয়েছে। রয়েছে ইজিপ্সিয়ান দের জিনিসপত্রও। বেশ লাগছিল ঘুরতে।একটা মোহের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। আসলে আমি ইতিহাস ভীষণ ভালবাসি। তাই যে দেশেই যাই সেখানে মিউজিয়ামটা আগে দেখি। এতে আমার মনে হয় দেশটার সম্বন্ধে ভাল করে জানা যায়। যে দেশ মিউজিয়ামকে যত যত্ন করে তারা নিজের অতীতকে তত ভাল জানে, এবং সেই শ্রদ্ধা থেকেই তারা এগিয়ে চলে নতুনের দিকে।নিজের দেশের মিউজিয়ামগুলো তো দেখেইছি, বিদেশেরও কি ফ্লোরেন্স, কি প্যারিস ,কি তুরস্ক, কিংবা মেক্সিকো, এগুলো আমার দ্রষ্টব্যের মধ্যে থাকেই। 
সুধী পাঠক, এগিয়ে চলুন আমার সঙ্গে। এখনও অনেক কিছুই দেখার আছে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments