জ্বলদর্চি

দুটি কবিতা /পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

দুটি কবিতা 
পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

তোমরা ঘুমিয়ে থাকো

তোমাদের লিখতে নেই।
তোমাদের লিখতে নেই রে
মাটির গন্ধ কি যে!
তোমাদের লিখতে নেই রে
কোন সুখে যায় 
চোখের পাতা ভিজে।
তোমাকে লিখতে নেই তা
কেমন করে 
কোন উপোসী শিল্পী আঁকেন
রামধনু রং ছবি।

এ সকল লেখার কেবল
ভার পেয়েছেন
ইনিয়ে বলা বিনিয়ে বলা
গোষ্ঠী পোঁছা কবি।

তোমাদের বলতে হয় না।
তোমাদের বলতে হয় না কথা।
কথার পিঠে পিঠে।
তোমাকে বলতে হয় না,
কেমন করে হারায় মানুষ
নিজের বাস্তুভিটে।
তোমাদের বলতে হয় না
কেমন করে স্বপ্ন হারায়
বুকের তীব্র ঝড়ে।

এ সকল বলার কেবল
ভার পেয়েছেন
শিবির ঘেঁষা
বন্ধু কবিবরে।

তোমাদের কাঁদতে নেই।
তোমাদের কাঁদতে নেই রে
আকাশ ঝরার বেলা।
তোমাদের কাঁদতে নেই রে
উথালপাথাল প্রেমের অবহেলায়।
তোমাদের কাঁদতে নেই রে
যখন তোমার কাঁদার কথা
পাঁজর ভাঙা রক্ত জমা মনে।

সে কাঁদার দায় নিয়েছেন
মুখোশ পরা
ছদ্ম সুধী জনে।

তোমাদের বসতে হয় না।
তোমাদের বসতে হয় না
মোম গালিচার বুকে।
তোমাদের বসতে হয় না
জ্যোৎস্না ছোঁয়া বৃষ্টি ধোয়া
সৃষ্টিবাদের সুখে।
তোমাদের বসতে হয় না
জিরেন দিয়ে 
হাঁফিয়ে নেওয়ার বেলা।

সে কেবল করতে পারে
যাদের কাছে জীবন শুধু
মেঘ ফাগুনের খেলা।

তোমাদের চিনতে নেই।
তোমাদের চিনতে নেইরে
শোষণবাদীর মুখ।
তোমাদের চিনতে নেই রে
বাঁধন ছেঁড়া সৃষ্টি অভিমুখ।
তোমাদের চিনতে নেই রে
শোষণ ঘেরা
ঘুণের চলাফেরা।

এ চেনার যোগ্য শুধু
আদর পাওয়া কাছের মানুষেরা।

তোমাদের ঘামটা শুকাক।
তোমাদের ঘুমটা শুকাক
শোকের শিশির মুক্ত ধুলোর আঁচে।
তোমাদের ঘামটা শুকাক
মানুষ মারার তুচ্ছ অজুহাতে।
তোমাদের ঘাম জিতে হোক
অমৃত নয়
গরলধারার শিস।
বাঁচবার ইচ্ছে বাঁচুক
মৃত্যু যাদের হুল্লোড়ে দেয় বিষ।


ওরা এবং রূপকথা

সেদিনও পূবদিকের আকাশ লাল করে
রক্তিম সূর্যটা শান্ত আগুনের গোলার মতো পৃথিবীর খোঁজ নিতে উঠেছিল।
ওরা তিনজন-
নারায়ণ,আকবর,আর জনাথন-
সকালের উজ্জ্বলতা গায়ে মেখে রওনা দিলো ভবিতব্যের
বাসস্থানের দিকে;
তার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের দূতিয়ালী নিয়ে।
ওদের হাতে অস্ত্র ছিল না,ফুল ছিল।
চলার পথে রণভেরি,দুন্দুভির 
শব্দ ছিল না,গাইছিল বসন্তের কোকিল।
রক্তপাতের হস্তিনাপুরের স্বপ্ন ছিল না চোখে-
ছিল  তিনজোড়া চোখে ভরা মায়ার সমুদ্র, যেখানে অনায়াসে সাঁতার কাটতে পারে শান্তি,সমৃদ্ধির স্বাধীনতায় বাঁচতে চাওয়া অনুভূতিরা।
রাস্তা সহজ ছিল না।
আকাশে হঠাৎ করে উঠেছিল ঝোড়ো বজ্রগর্ভ মেঘ।
তাদের আশপাশে পড়ছিল
সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের মতো আগুলের পশলা।
ওরা তিনজন-
নারায়ণ,আকবর আর জনাথন ছিল অকুতোভয়,বেপরোয়া অথচ শান্তিকামী।
ওরা সমাজ হারিয়েছিল,
আপনজন হারিয়েছিল,
ওদের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার মুকুটে কাঁটা ও ধারালো বর্শার জিজ্ঞাসাচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল সামাজিক গোষ্ঠীবাদের,সঙ্কীর্ণতাবাদের ধ্বজাধারীরা।
তবুও ওদের চোখে ভয় ছিল না।
ছিল অর্জুনের দৃষ্টিভেদ।
সেই শ্বাপদসঙ্কুল পথ বেয়ে
আঘাতে আঘাতে প্রায়
মৃতদেহ হতে হতে
ন্যুব্জ বিধস্ত তারা
লিখছিল মানবসভ্যতার উত্থানের গান।
সে গানে সুর দিয়েছিল বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো ল্যাংটা হাড় বের করা সিংহ-হৃদয় বিশ্ব নাগরিকেরা।
সূর্য যখন একদম মাথার উপরে-
তখন সহসা শুরু হয়েছিল এক অসম লড়াই।
একদিকে গোষ্ঠীবাদী,রক্তপাত ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লড়াইয়ে বিশ্বাসী উগ্রপন্থা।
আর একদিকে শ্বেত কবুতরের বেশে
নারায়ণ,আকবর আর জনাথন।
সামনের কণ্টকাকীর্ণ পথ
আস্তে আস্তে সহজ হয়ে আসছিল তবুও।
গলিত সূর্যটা ঢলছিলো পশ্চিম আকাশে।
তার তীব্র বর্ণচ্ছটা মায়াময়  স্নিগ্ধতা ঢালতে শুরু করেছিল ওই তিনজনের
রামধনু চেতনার বুকে।
হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার পিছনের সুদীর্ঘ লাইনের থেকেও দীর্ঘতর লাইন হয়েছিল তাদের পিছনে,অজান্তে।
মন্দির,মসজিদ, গীর্জা, গ্রন্থসাহিবের আদর্শে বলীয়ান হয়ে
অষ্টাঙ্গিক মার্গের চেতনার রঙে রেঙে তারা নীরবে এগিয়ে চলছিল ভবিতব্যের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও তারও সামনে মহাসমুদ্র ঘেরা পরিখার দিকে।
নরমাংসভোজী শকুনেরা
সেই দুর্ভেদ্য প্রাচীরের ওপার থেকে খোঁজ নিয়েছিল তাদের অগ্রগমনের।
টলে গেছিল রাজসিংহাসন।
উঠে দাঁড়িয়ে ঢুলতে ঢুলতে প্রাসাদের বাইরে এসে
আজন্মলালিত বিলাসিতা জড়ানো কন্ঠে  ভবিতব্য ওদের বলেছিল-
'স্বপ্ন দেখছ! তা ভালো!
চেষ্টায় শেষটায় নির্বিকল্প সমাধি না হয়ে যায়'!
ওরা তিনজন হেসে উঠেছিলো
'মনে রেখো ভবিতব্য!
প্রতিটি যুদ্ধ প্রথমে কল্পনায় জিততে হয়।তারপর বাস্তবে!
আমরা নিরস্ত্র বিপন্ন বসুধার কোটি কোটি দূত এসেছি তোমার কাছে আত্মসমর্পনে নয়,আত্মপক্ষ সমর্থনের গরবে গরবী হতে'!
তাদের তিনজনের মাথায় স্নেহচুম্বন এঁকে দিয়েছিল মায়াচাঁদ!
বলেছিলো দীর্ঘজীবী হও।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
ওরা বলেছিল
'ছদ্মবিপ্লবে আস্থা নেই!
নিজেদের চেতনার রঙে রাঙিয়ে নিজেদের পাওনাগণ্ডা
বুঝে নিতে হবে।বুঝিয়ে দিতে হবে আমাদের'।
চাঁদ জোরে জোরে মাথা নেড়েছিলো দুদিকে।
ভবিতব্য বিরক্ত হয়ে বলেছিল-
'চরাচর তো আমারই ছিল!
তোমরা কে হে চুনোপুটির দল! এখানে এসেছো স্বার্থে ভাগ বসাতে?
হেসে উঠেছিলো ওরা তিনজন।
নারায়ণ,আকবর আর জনাথন-বলেছিল-
' নতুন করে লেখা হবে বেঁচে থাকর,যোগ্যতা অর্জনের ইতিহাস! তৈরী হও আতঙ্কবাদী'।
মায়াচাঁদ সমর্থন জানিয়েছিল-
ঠিক!ঠিক!! ঠিক!!!

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇




Post a Comment

0 Comments