জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ -১১/শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। এগারো
শুভঙ্কর দাস 

"আলো তার পদচিহ্ন 
আকাশ না রাখে---
চলে যেতে জানে,তাই
চিরদিন থাকে।"

ইংরেজ রাজসরকারের রাজধানী কলকাতা। বঙ্গসংস্কৃতি ও বঙ্গ-ইতিহাসের লালনভূমি।কতকিছুই যে দিনপ্রতিদিন কলকাতায় ঘটে চলে,তার ইয়ত্তা করা যায় না!প্রাচীন ও নবীনের দ্বন্দ্বমুখর ঘাত-প্রতিঘাতের আবহাওয়ার কলকাতা সর্বদা সরগরম। সেই কলকাতায় পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে কুমারচন্দ্র।
সে কিছুতেই ভালো করে ঘুমোতে পারে না! নিজের ভেতর সে দেখতে পাচ্ছে এক অচেনা অজানা পথিককে।যে মহানগরীর আহ্বানে যথারীতি পথে নেমে পড়েছে।হাঁটছে। হাঁটছে। হাঁটছে। 
এই হেঁটে যাওয়া জীবন কুমারের কোনোদিন থামবে না,যতদিন না সে তার অন্তরের আলোকযাত্রীকে খুঁজে না পায়!
কলকাতা তো যেতে হবে।
কিন্তু কীভাবে?
সঙ্গে কে যাবে?
প্রথমবার এক অজপাড়াগাঁ ছেড়ে একেবারে মহানগরে শুধু পৌঁছাতে হবে না,সেখানেই থাকতে হবে।
সহসা সময়দেবীর সুতোতে টান পড়লে দেখতে পাব,১৮২৮ সালে নভেম্বর মাসে সেই মেদিনীপুর থেকে পাড়ি দিয়েছিলেন এক সিংহশিশু। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
সেকালের কলকাতা যাওয়ার যাত্রাপথটি একটি বিবরণ পাওয়া যায়,সমকালীন সংবাদপত্রে,
"কলিকাতা এবং উত্তরোত্তরাঞ্চল হইতে জলপথে তমলুক ক্ষীরপাই ঘাটাল রাধানগর এবং মেদিনীপুর প্রভৃতি স্থান সকলে যাইতে হইলে উলুবেড়িয়া বাসপাতির খাল অথবা তেমোয়ানি প্রভৃতি দুর্গম স্থান হইয়া যাইতে হইত কিন্তু বাসপাতির খালে বর্ষা ভিন্ন অন্য কয়েকমাস বারির সমুহ অপ্রতুল হইত"
এছাড়াও রয়েছে ডাকাতের প্রবল উৎপাত।দামোদর, রূপনারায়ণ ও ভাগীরথীর তীরবর্তী বহু গ্রামে ডাকাতের আস্তানা ছিল এবং ডাকাতে কালীর নরবলির কথাও শোনা যেত!
তাই যাত্রীরা সব সময় নদীপথে দল বেঁধে একাধিক নৌকা সহযোগে যাতায়াত করত।
কিন্তু সেদিন ঠাকুরদাস পুত্রের হাত ধরে হাঁটা শুরু করেছিলেন। যাত্রাপথটি একটু অবলোকন করা প্রয়োজন। 
বীরসিংহ থেকে বেরিয়ে ঘাটাল হয়ে,আরামবাগের ভিতর দিয়ে পুরাতন বারানসী রাস্তা ধরে চাঁপাডাঙা শিয়াখালার উপর দিয়ে সালিখা ঘাট।শিলাই, দ্বারকেশ্বর, কানা দ্বারকেশ্বর,মুণ্ডেশ্বরী,দামোদর পার হয়ে ভাগীরথীকে স্পর্শ করে কলকাতায় পৌঁছাতে পেরেছিলেন।
ঠিক সেই রকম আবার যাত্রা শুরু হল মহানগরের দিকে।
১৯১০ সালের শেষের দিকে।
এবারও আর এক ঠাকুরদাস, পুত্রের হাত ধরে...
সেই হাঁটাপথ...
সেই হাঁটাপথে পৌঁছাতে হতো সুতাহাটায়, সেখান থেকে গরুর গাড়ি ধরে কুকড়াহাটি।তারপর নৌকা ধরে বাবুঘাটে যেতে হত!
সেইভাবে কুমার প্রবেশ করল মহানগরে।
উদ্দেশ্য সেই একই বিদ্যাসাগরীয়, পড়াশোনা। পড়াশোনা করে মানুষ হওয়া...
নর্ম্যাল স্কুল আবাসিক। 
এর কলকাতা,ঢাকা, হুগলি এবং মেদিনীপুরের ছেলেদের জন্য নির্দিষ্ট সিট থাকত।
কুমারচন্দ্র জানা এই স্কুলের মেদিনীপুর বিভাগে সিট পেল।সেখানে পৌঁছে নিজের কাগজপত্র সব দেখিয়ে স্কুলে ভর্তি হয়ে গেল।
প্রথমদিনের ক্লাসে কুমার পরিচিত হয়ে উঠল।
বাংলা ক্লাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বোধোদয় এর সম্পূর্ণ পাঠ ছিল।
ক্লাসের শিক্ষক সেই গ্রন্থের ভালোলাগা রচনাগুলি আলোচনা করছিলেন।
বোধোদয় এ পদার্থ, ঈশ্বর, চেতন পদার্থ,মানবজাতি,ইন্দ্রিয়, চক্ষু,নাসিকা,জ্বিহা,ত্বক,কাল এইরকম বিভিন্ন অধ্যায় আছে।তা পড়তে এবং বুঝতে পারলে প্রতিটি ছাত্রের খুব ভালো লাগবে। সেই কথা উত্থাপন করতে কুমার উঠে দাঁড়াল এবং তার সেই কৈশোরকাল থেকে পড়া অংশটি বলতে লাগল,
"মানবজাতি, বুদ্ধি ও ক্ষমতাতে সকল জন্তু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। তাহাদের বুদ্ধি ও বিবেচনাশক্তি আছে।এজন্য সর্ববিধ জন্তুর উপর আধিপত্য করে।মানুষ,পশুর ন্যায় চারি পায়ে চলে না,দুই পায়ের উপর ভর দিয়া সোজা হইয়া দাঁড়ায়।মানুষের দুই হাত,দুই পা।দুই পা দিয়া ইচ্ছামত সর্বত্র যাতায়াত করিতে পারে।...
মানুষ একাকী থাকিতে ভালোবাসে না।তাহারা পিতা,মাতা,ভ্রাতা,স্ত্রী,পুত্র, কন্যা প্রভৃতি পরিবারবর্গের মধ্যগত ও প্রতিবেশিমণ্ডলে বেষ্টিত হইয়া বাস করে..
অধিকাংশ লোকই,গ্রামে ও নগরে পরস্পরের নিকটে বাটী নির্মাণ করিয়া অবস্থিতি করে।যেখানে অল্প লোক বাস করে,তাহার নাম গ্রাম।যেখানে বহুসংখ্যক লোকের বাস,তাহাকে নগর বলে।যে নগরে রাজার বাস,অথবা রাজকীয় প্রধান স্থান,তাহাকে রাজধানী বলে,যেমন কলিকাতা বাঙ্গলা দেশের রাজধানী। "

বাংলার মাস্টারমশাই অবাক হয়ে গেলেন শুনে।মুখে বলে উঠলেন,তোমার নাম কী?

কুমার স্যার

কী অসম্ভব তোমার স্মৃতিশক্তি,তুমি তো আশ্চর্য মুখস্থ করেছো,কী করে করলে?

কুমার মৃদু হেসে চেয়ে রইল।

কী বলবে সে? এই বইয়ের কয়েকটি ছেঁড়া পাতা গাঁয়ে মাঠে মাঠে গরু চরানোর ফাঁকে কতবার যে পড়েছে,তার ইয়ত্তা নেই! 

মাস্টারমশাই দাঁড়িয়ে পড়ে কুমার কাছে এসে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করতে এগিয়ে এলেন আর সেই সময় একটা অঘটন ঘটে গেল।
মাস্টারমশাই সহসা মাথাটা ধরে পড়ে গেলেন।টেবিলের কোণ লেগে তার কপালটা চিরে গেল।তিনি মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন।ক্লাসের ছেলেরা এই আকস্মিক ঘটনায় সর্পদর্শনের মতো স্থিরচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে রইল।কী করবে?  কী বলবে? তারা খুঁজে পাচ্ছিল না!
দেখা গেল,মাস্টারমশাইয়ের কপাল চিরে গেছে, সেখান থেকে রক্ত পড়ছে।
কুমার এগিয়ে এলো।
তার মুখেচোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই।সে মাস্টারমশাইয়ের রক্তাক্ত মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিল।একজনকে জল আনার কথা বলল।এবং নিজের ফতুয়া খুলে তার কিছুটা অংশ ছিঁড়ে মাস্টারমশাইয়ের মাথায় বেঁধে দিল,যাতে রক্ত পড়া বন্ধ করা যায়। একজন  ছাত্র জল আনলে,তা মাস্টারমশায়ের মুখেচোখে ছিটিয়ে দিল।কিন্তু মাস্টারমশায়ের কোনো হুঁশ ফিরল না!তখন কুমার একটা কাজ করল।
রোগা-পাতলা মাস্টারমশাইকে নিজের মজবুত পেটানো হাতের ওপর তুলে স্টাফরুমের দিকে নিয়ে চলল।এবং সেখানে তাঁকে শুইয়ে নিজেই ছেঁড়া ফতুয়াটি গায়ে পরে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ছুটল,তারপর কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার ডেকে নিয়ে ফিরল।
এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসার সময় কাছে একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র সে দেখে রেখেছিল।সেটা এইভাবে কাজে লাগাল।
সেবাশুশ্রূষার পর মাস্টারমশাইের জ্ঞান ফিরল।তিনি সব শুনলেন।এবং কুমারকে কাছে ডেকে বললেন, তোমাকে আশীর্বাদ করি কুমার,এইভাবে নিজের সাহসী ও সেবকমনটুকু নিয়ে যথার্থ বড় হও,মানুষের মতো মানুষ হও।
যথারীতি কুমার বিদ্যালয়ের মধ্যে একজন বিশেষ পাত্র হয়ে উঠল। 

সেদিন বিদ্যালয় একটু তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল।
ছাত্রাবাসে ফিরে এলো।
ঘরে ঢুকে কুমার প্রথমে কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে খেলো।তারপর ফতুয়াটা সেলাই করার জন্য অন্য ছাত্রের কাছ থেকে সুঁচ-সুতো চাইতে বেরোবে,সেই সময় সহপাঠী গঙ্গাধর বলে উঠল,কী করে কুমার,এখনই ফুটো সারাতে হবে?

হা 

কেন রে? এই তো এতো খাটলি,স্যারকে ভালো করে তুললি,একটু মুড়ি-ফুড়ি খা,তারপর ভাববি

না ভাই,কাল স্কুল আছে

তো?

আসলে আমার এই একটাই ফতুয়া, এটা না সারালে কাল স্কুল যেতে পারব না!

অ্যাঁ! তোর একটাই ফতুয়া? 

হা  বলেই কুমার ঘরের বাইরে চলে গেলো।

গঙ্গাধর অবাক হয়ে গেল!

কলকাতার এন্টালি অঞ্চল। এখানে বেশ কয়েক বিঘার ওপর নর্ম্যাল স্কুল।একদিকে শিক্ষাদানের জায়গা, অন্যদিকে ছাত্রাবাস।আবাসিক ছাত্ররা এখানে থাকে।ছাত্রাবাসের পাশে প্রশস্ত রান্নাঘর।আলাদা করে কোনো খাওয়ার স্থান নেই। সকল ছাত্র সেই রান্নাঘরের মেঝেতে সারিবদ্ধ ভাবে বসে আহার করে দুইবেলা।
রান্নাশালের পেছনে একটু বন-জঙ্গলের  মতো আছে।সেখানে আছে কুয়ো।এখানেই স্নান-টান সারে সকলেই। 
কুমার কিন্তু ব্যতিক্রম।
সে প্রতিদিন এন্টালি থেকে পায়ে হেঁটে কনভেন্ট রোড ধরে গঙ্গাস্নানে যায়।তার গঙ্গায় স্নান করতে ভালো লাগে।

তা গঙ্গাস্নানের জন্য এতো পরিশ্রম করছ কেন? এতো আর গঙ্গাসাগর নয়?জিজ্ঞেস করল গঙ্গাধর

আসলে আমার হাঁটতে খুব ভালো, রোজ সকালে কলকাতা দেখি,কেমন আনন্দ হয় 

তোমার গাঁয়ে নদী নেই? 

আছে তো

কী নাম?

হলদি 

হলদি, এ আবার কীরকম নাম?হলুদগোলা জল নাকি করে? 

হলুদগোলা কি না বলতে পারব না! তবে আমার খুব ভালো লাগে,তার আঁকা বাঁকা রূপ,জঙ্গলের ভেতর দিয়ে শান্ত ও বাধ্য বালিকার মতো বয়ে যায়!

শান্ত ও বাধ্য বালিকা? আরে তুমি তো বেশ লোক আছো? এতদিন চেপে রেখেছো!

কুমার অবাক! কী?

গঙ্গাধর নিজের খাট ছেড়ে কুমারের খাটে এসে বসল,তারপর বলে উঠল,এই শান্ত ও বাধ্য বালিকাটি কে বন্ধু? 

মানে?

সেই সময় আরও কয়েকজন ছাত্রাবাসের ছাত্র উপস্থিত। তারাও এই কৌতুকে যোগ দিল।

কুমার যত অস্বীকার করে,তারা ততোবেশি মজা করে ওঠে।
গঙ্গাধর বলে চলল,এতো লজ্জার কী আছে ভাই? এই তো পরিমল, বলেই একটি মোটাসোটা ছেলেকে দেখিয়ে বলল,এর তো দু'দুটো বউ এবং কুলিন বাহ্মণ বলে আরও দুটি বিয়ের উপযোগ চলছে,এ কিন্তু বিদ্যেসাগরকে মানে না!হাঃ হাঃ 

পরিমল অতি লাজুক। সে লজ্জায় মুখ নামিয়ে বসল।মৃদুস্বরে বলে উঠল,আমি চাইনি,কিন্তু ঘরে বাপের চাপে...

চাপ, পেটে খিদে,মুখে লাজ,বিদ্যাসাগর বেঁচে থাকলে এই চাপ একেবারে চাবকে সোজা করে দিত। একজন বলে উঠল।

গঙ্গাধর এবার একটি ধোপদুরস্ত পোশাকআশাকের ছেলেকে দেখিয়ে বলল,এটি জমিদারের পুত্র, এর নাম অবিনাশ।এতো বিয়ে সেরে পড়তে এসেছে, আর আমি তো এই একই দলের... তাই বলছি,কুমারচন্দ্র সাহসীবাহাদুর, তোমার বালিকাবধূটি কোথায়?

কুমার বলার ভঙ্গিটি দেখে হেসে ফেলে বলব, আমার কোনো বালিকাবধূ নেই, শুধু বালি আছে,এনে দেবো বাকি গঙ্গা থেকে..
বলেই গঙ্গাধরকে চেপে ধরল!
তখন গঙ্গাধর শক্ত বাঁধুনি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সহসা বলে উঠল,কাঙাল 'নাশের হেতু' পদ্যে কী বলে গেছো জানো তো?
বলেই নিজেই বলতে শুরু করল,

"রাজ্য-নাশ হেতু, রাজ অবিচার।
কার্য্য-নাশ হেতু,আলস্য সবার।
বুদ্ধি-নাশ হেতু,মাদক সেবন।
ঋদ্ধি-নাশ হেতু,জ্ঞাতি বিরোধন।
স্বাস্থ্য-নাশ হেতু,রাত্রি জাগরণ। 
ক্লান্তি-নাশ হেতু, অমূল চিন্তন।
মান-নাশ হেতু,মিথ্যা আচরণ। 
প্রাণনাশ হেতু,রিপু-পরায়ণ।
স্বপ্ন-নাশ হেতু,পর-সুখে দাহ।
সর্ব্বনাশ- হেতু,বালকবিবাহ।

এই ছড়াটি এমনভাবে নেচে নেচে গঙ্গাধর পরিবেশন করল যে কুমার হাসিতে লুটিয়ে পড়ল।
সে এমন জিনিস কেনোদিন শোনে নি! জিজ্ঞেস করল,কে এমন লিখেছে?

কাঙাল

কাঙাল?  

আরে কাঙাল হরিনাথ।

কুমার প্রথমবার এইরকম কবির নাম শুনল।

এইভাবে এক বান্ধব আবহাওয়ায় কুমার পড়াশোনা করতে লাগলেন।

প্রতিদিন ভোরে উঠে কুমার ছোট লাটসাহেবের বাড়ির পাশ দিয়ে বাবুঘাটে গিয়ে গঙ্গায় স্নান সারত।আবার স্নান সেরে সেই দীর্ঘপথ হেঁটে ফিরে আসত।
এইপথে অসংখ্য ইংরেজ রাজসরকার লোকজনদের কুমার লক্ষ্য করত।তারা হয় ঘোড়ার গাড়ি  অথবা ঘোড়ার পিঠে ইংরেজ সাহেবসুবোদের আসতে-যেতে দেখত।তাঁদের আচার-আচরণ, হাব-ভাব কুমারের চোখে পড়ত।তাঁদের দৃষ্টিতে একটা উদ্ধত আগুন এবং কথাবার্তায় ভারতীয়দের প্রতি প্রবল ঘৃণা ঝরে পড়ত।
একদিন ছাত্রাবাসে কুমার দেশে ঘটে যাওয়া একটা মারাত্মক ঘটনার কথা জানল।যা জেনে কুমার শিউরে উঠল।
একবার মহারাষ্ট্রে প্লেগ মহামারীর আকার নিয়েছিল।এক বছরে এই রোগে প্রাণ হারিয়েছে পঞ্চাশ হাজার মানুষ।এই রোগ দমন করার জন্য ইংরেজ সরকার একেবারে ক্ষেপে উঠল।কারণ এদেশের মানুষ মরে যাচ্ছে মুড়ি-মুড়কির মতো,তাতে সরকারের কোনো হোলদোল নেই, কিন্তু প্লেগ রোগ তো কালো-সাদা চামড়ার ভেদ বোঝে না।ফলে যখন এদেশের মানুষ থেকে রোগটি সাহেবসুবোকে ধরল,তখন ইংরেজ সরকার রেগে লাল হয়ে গেল।মধ্যযুগে ইউরোপে প্লেগের জন্য যে ভয়ংকর দুরবস্থা ও অসহনীয় আর্তনাদ উঠেছিল,তা প্রতিটি ইংরেজ মাত্র জানে।
ফলে তারা শুরু করে দিল প্লেগ নিবারণের নামে এদেশীয়র ওপর অত্যাচার এবং অবর্ণনীয় নোংরামি। সরকার প্লেগ তাড়ানোর জন্য সামরিক বাহিনী নামিয়ে দিল।তারা ঘরে ঘরে হানা দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলল।তাদের পায়ে বুট, কোমরে ধারালো তলোয়ার, কারো পিঠে বন্দুক, দৈত্যাকৃতি চেহারা নিয়ে তারা ঘরের একেবারে অন্দরমহলে ঢুকে লাথি মেরে বিছানা উলটে ফেলে দেয়,নানা সংসারের জিনিসপত্র নষ্ট করে এবং নারীপুরুষ সকলকে নির্বিশেষে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করায়। বন্দুক ও তলোয়ারের ভয় দেখিয়ে তাদের সকলকেই নগ্ন হতে বলে।কারণ সামরিক বাহিনী এদেশীয়দের নোংরা ও মলিন কাপড়চোপড়ে হাত দেবে না।তারপর জ্বর থাকুক আর না থাকুক,জোর করে ক্যাম্পে নিয়ে যাবে এবং সেখানে চলবে আবার একপ্রস্ত অত্যাচার।এই বিষয়ে ধনী-গরিব কেউ বাদ যায় না।ইংরেজ সরকারের চোখে এদেশের মানুষ মানেই অসভ্য, ইতর এবং কোনো নিম্নবর্গের জন্তুজানোয়ার। তাই এদের কোনো মান-সম্মান, ইচ্ছে-অনিচ্ছে বলে কিছুই থাকতে পারে না।পুরুষের সামনেই নারীর কাপড় জোর করে খুলে তাকে বিবস্ত্র করে সামরিক বাহিনী অট্টহাসি হাসত।তারপর কেউ ছুটে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিলে,তার ঘরের দরজা ভেঙে সেই নারীকে হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে বাইরে এনে প্রকাশ্য দিবালোকে নগ্ন করে দেওয়া হত!
যেখানে ভারতবর্ষে পরপুরুষের অঙ্গ ছোঁয় হলে নারীর কুল নষ্ট হত, সেখানে মহিলাদের প্রতি এই জঘন্য আচরণে অসংখ্য মহিলারা লজ্জায় ও অপমানে আত্মহত্যা করে বসল।
ভারতীয়রা যে এইসবে চুপচাপ সহ্য করছিল, তা নয়। বালগঙ্গাধর তিলক নামে এক পণ্ডিত সম্পাদক তার 'মারাঠা' ও 'কেশরী' পত্রিকায় ইংরেজদের এই অসভ্য ও মধ্যযুগীয় আচরণের প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছিলেন।কিন্তু ইংরেজ সরকার তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করল না।উল্টে আরও নির্বিচারে অত্যাচার বাড়িয়ে দিল।
আর এইসব যাঁর অঙ্গুলিহেলন হত, তিনি প্লেগ কমিটির চেয়ারম্যান ডব্লু সি রাণ্ড।তাঁর নির্দেশে সামরিক বাহিনী উন্মত্ত ষণ্ডের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ব্যাস, নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় ভারতীয়কে অস্ত্র ধরতে বাধ্য করল।
একদিন ছিল মহারানী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের হীরক জয়ন্তী উৎসব পালন।পুণার গণেশখিণ্ডে গভর্ণরের বাড়িতে খানাপিনা ও উল্লাসের পর যখন রাণ্ডের গাড়ি বেরোচ্ছিল।
আর ঝোপের মধ্যে আত্মগোপন করেছিল, দামোদর ও বালকৃষ্ণ চাপেকর দুইভাই।
তাঁদের গুলিতে গাড়ির মধ্যেই শেষ হয়ে গেল রাণ্ড। কোনোরকম বাধা দেওয়ার সুযোগ পেল না! 
এই সংবাদ সারা  ভারতবর্ষে একটা ভয়ংকর আলোড়ন তুলল।কারণ বৃটিশ ভারতবর্ষে এই প্রথমবার রাজনৈতিক হত্যা। 
এর মধ্যে আততায়ীদের ইংরেজ রাজসরকার ধরতে না পেরে প্রথমে কুড়ি হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করল।
এই দুই ভাইকে ধরার জন্য। 
তারপর তাতেও যখন কাজ হল না,তখন বালগঙ্গাধর তিলকে গ্রেফতার করল এবং কোনো নিয়ম না মেনেই... 
এই ঘটনায় সমগ্র ভারতবর্ষের বুদ্ধিজীবী ও স্বদেশসচেতন মানুষ দুটি ভাগে ভাগে হয়ে গেল।
একদিকে যেমন এই ধরণের হত্যা-রক্তারক্তিকে সমর্থন করল না আবার অন্যদিকে তিলকের গ্রেফতারকে তারা সমস্বরে প্রতিবাদ জানাল।

এসব শুনে কুমারের চোখ চিক চিক করে উঠল।
সহপাঠি গঙ্গাধর জিজ্ঞেস করল,তুই কী করবি?

কীসের? 

আজ কলকাতায় তিলকের জন্য প্রতিবাদসভা হবে,আমরা সকলে যাব ভাবছি

কখন হবে?

এই তো দুপুরবেলায় 

আচ্ছা 

কী আচ্ছারে,তুই কি যাবি?তুই কি ইংরেজ রাজসরকারের এই জঘন্য আচরণকে প্রতিবাদ জানাতে চাস না?

আমি কী করব? 

কিছু নয়, শুধু সঙ্গে যাবি...

কোথায়?

লাটসাহেব বাড়ির সামনের রাস্তায় মিছিল হবে,সেখানেই 

সহসা কুমারের মনে পড়ল
গঙ্গাস্নানের পথে একটি ঘটনার...

ক্রমশ...

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments