জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা--১৩/সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা 

ত্রয়োদশ পর্ব : একান্নবর্তীতা

সুরশ্রী ঘোষ সাহা 


সাদা মৌরী ফুলে ক্ষেত ভরে আছে। একটা হাল্কা মিষ্টি গন্ধ বাতাসের গায়ে নাছোড়বান্দার মত সেঁটে রয়েছে। বিকেলবেলায় একটু হাঁটতে বেরিয়েছি। পিছন থেকে কে যেন আমার নাম ধরে ডাকল। দাঁড়িয়ে পড়ে পিছন ফিরতেই দেখি, পারুল। বহু বছর পর পারুলকে দেখলাম। সেই আগের মতোই আছে। গায়ে একটা ছাপা সুতি শাড়ি। আঁচলটা ডান কাঁধ দিয়ে উঠে মাথায় ঘোমটা হয়ে বাম কাঁধে নেতিয়ে পড়ে আছে। গায়ের রঙটা অনেক চেপে গেছে। তবে মুখের হাসি সেই আগের মতোই। এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার অস্বস্তি হচ্ছিল, অতিমারীর সময়ের কথা ভেবে। কিন্তু ও দেখলাম, ভ্রুক্ষেপহীন। ওর অমন ভালবেসে জড়িয়ে ধরায় আমিও ওর পিঠে হাত রাখলাম। পর পর প্রশ্ন করে গেল... কবে এলাম, কদিন থাকব, বাড়ির সবাই কেমন আছে, কোথায় বিয়ে হয়েছে, আর ছেলেপুলে কটা? 

 আমি হেসে ফেললাম। বললাম, তুই তো একই আছিস, পারুল? একসাথে পাঁচটা প্রশ্ন করলি আমায়। 

 দুই বন্ধু মিলে সামনের কুন্তী নদীর পারে গিয়ে বসলাম। আমাকে বলল, বেশিক্ষণ থাকতে পারব না, বুঝলি। 

 ছোট্টবেলা থেকে যখনই গ্রামের বাড়িতে যেতাম, মেয়ে বন্ধু বলতে সরল সাদামাটা এই পারুলই আমার একমাত্র সঙ্গী ছিল। আমি যখন টুয়েল্ভ পাশ করে কোন্ অনার্স নিয়ে পড়ব ভাবছি, সেজদার কাছ থেকে একদিন খবর পেলাম, পারুলের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। 

 এত বছর পর আজ আবার পারুলের সাথে দেখা হবে ভাবিনি। ভাগ্যিস, ও এই সময়ে বাপের বাড়িতে এসেছিল। 

 পারুল জানাল, খানিক দূরের রাধানগর গ্রামের এক একান্নবর্তী পরিবারে ওর বিয়ে হয়েছে। বর সুশীল, বাড়ির বড় ছেলে। তাই বড় বউ হওয়ার জন্য গোটা সংসারের সব দায়িত্ব ওর কাঁধে। ওর মুখে ওর জীবনের নানা গল্প শুনলাম আর অবাক হয়ে গেলাম। আমারই বয়সী পারুল, যে কিনা কখনো পাহাড় - সমুদ্র দেখেনি। দূরপাল্লার ট্রেনেও চাপেনি আজ পর্যন্ত। সেসব তো অনেক দূরের ব্যাপার, এতগুলো বছরে পারুল শ্বশুর বাড়ি থেকে শুধু বাপের বাড়ি ছাড়া আর কোথাও বেরুতে পারেনি। 

 ওর শ্বশুর-শাশুড়ি এ'বছর গঙ্গাসাগর ঘুরতে যাচ্ছে সংক্রান্তির সময়, পারুলেরও খুব যেতে ইচ্ছা হয়েছিল, কিন্তু বলতে পারেনি। বলে কীই-বা হবে। সংসার সামলাবে কে? 

 আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল ওর কথাগুলো শুনে। বললাম, তাও একবার বলে দেখতে পারতিস? 
ও আর কোন উত্তর দিল না। পারুলের দীর্ঘ-নিঃশ্বাস ভেসে গেল কুন্তী নদীর হাওয়ার সাথে।

 মুখ ম্লান করে বলল, জানিস, আমার যখন বাচ্চা এসেছিল, তখন প্রথম তোদের চুঁচুড়া শহরে যাই। তোর কথা খুব মনে পড়ছিল। কিন্তু আমি তো জানতাম না, তুই কোথায় থাকিস! কী সুন্দর শহরে থাকিস রে, তুই... 

 তুই তার আগে কখনো চুঁচুড়া দেখিসনি? চমকে উঠলাম আমি। 

 ওমা, দেখব কীভাবে? আমি জীবনে কতই-বা ঘর থেকে বেরিয়েছি! গ্রামে তো তখন বাচ্চা হওয়ার ডাক্তার ছিল না, তাই পোয়াতিরা চুঁচুড়া শহরেই ডাক্তার দেখাতে যেত। সেই জন্যই যেতে পারা। এখন যদিও গ্রামের ভিতরেই ওষুধের দোকানে গাইনো, সার্জেন, ডেন্টিস্ট সব ধরনের ডাক্তার বসে। 

 তোর কি ছেলে, না মেয়ে? 

 পারুল হাসল। আমাদের কি তোদের মতন একটা করে বাচ্চা নাকি? আমার বিয়ের পর পর একটা মৃত ছেলে জন্মালো, গলায় নাড়ি জড়িয়ে। জড়াবে না কেন বল্, আমি যে ভরা মাসেও সকাল থেকে উঠে সবার জন্য রান্নাবান্না, ঘর দুয়ার ঝাঁট দেওয়া, মোছা, ঘর গোছানো, সকলকে আলাদা আলাদা করে ভাত বেড়ে খাওয়ানো, গরু দোয়ানো, সব করেছি। শাশুড়ি বলত, সংসারে সব কাজ করলে নাকি বাচ্চা সুস্থ জন্মাবে। আর আমার শ্বশুর-শাশুড়ির কথাই শেষ কথা ঐ পরিবারে। পরে যখন আবার পেটে বাচ্চা এল, বরকে দিয়ে বাড়িতে বলালাম, আমি বাপের বাড়ি গিয়ে থাকতে চাই। রাজি হল না জানিস। সেই একইরকম ভাবে খাটতে খাটতেই জন্ম হল দ্বিতীয় ছেলের। 

 কথার মাঝে আমি জানতে চাইলাম, তোর ছেলেটা সুস্থ হয়েছে তো, পারুল? 

 পারুলকে মনে হল, ও শুধু যে বেরুতে পারে না, তা নয়। ও যেন মন খুলে কথা বলার সুযোগও পায় না। বলে চলল — আমার একটা নয়, দুটো ছেলে। ছেলেদের জন্ম দেওয়ার সময়ই একটু বেরুতে পারতাম বলে ভাল লাগত। আমি তো গ্রামের বাইরে কোন নদীও দেখিনি। একবার ডাক্তার দেখাতে গিয়ে জানলাম, ডাক্তারের আসতে অনেক দেরি, এমার্জেন্সি অপারেশন পড়ে গিয়েছে। সুশীল তাই আমাকে গঙ্গা দেখাতে নিয়ে গেল। গঙ্গার ধারের একটা পার্কে বসে বাদাম ভাজাও খেয়ে ছিলাম। 

 পারুলের মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, সেই গঙ্গা দেখার স্মৃতি মনে পড়ায় ওর চোখদুটো নদীর জলে রোদ পড়ার মতোই চিকচিক করছে। 

 এত বড় পেট নিয়ে গ্রাম ছেড়ে যখন শহরে যেতাম, গাড়ি চাপার সুখ পেতাম। শ্বশুর ঐ একটা ব্যাপারে উদারতা দেখাতেন। ছেলেকে বলতেন, গাড়ি ভাড়া করে বৌমাকে নিয়ে যাবি। শহরে কত মানুষ, গাড়ি-ঘোড়া, মাথার উপর দিয়ে হুশ করে ট্রেন চলে যাওয়া দেখে খুব ভাল লাগত, রে। ডাক্তার চেম্বারে আসতে দেরি করলেও খারাপ লাগত না। কত পেশেন্ট বিরক্ত হত। অথচ, আমি নির্বিকার থাকতাম। চারিদিকে সব পেশেন্টদের সাথে যেচে যেচে কথা বলতাম, আলাপ জমাতাম। কিছুক্ষণের জন্য সংসারের আর ঐ হেঁশেলের বাইরের সেই যে সুখ, তা তো কপালে আর বেশি জুটত না। 

 পারুলের কথা না শুনলে জানতে পারতাম না, এই দুনিয়ায় আমারই বয়সী কত মেয়ে আছে, যারা পেটে বাচ্চা আসলে তবেই নাকি বাড়ি থেকে শহরে যেতে পারে, নদী দেখতে পারে, আর একটু বাদাম খাওয়ার সুখ-স্মৃতি নিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। নইলে গ্রামের নিয়ম, স্বামীর সাথে বউরা পাশাপাশি একসাথে পথেঘাটে হাত ধরে বেরুতে পারবে না। বেরুলে নাকি আলোচনা হবে। গ্রামে স্বামী যাবে আগে আগে, বউ যাবে পিছন পিছন খানিক দূরত্ব রেখে। অন্যদিকে ভাসুরকে দেখেও এক গলা ঘোমটা টেনে নিতে হবে ভাইয়ের বউকে। নইলে পুকুরঘাটে, প্রাচীন বুড়ো বটগাছের নিচের ধাপিতে, কুয়োতলায় এই নিয়ে তুমুল আলোচনা হবে। যে আলোচনাকে গ্রামের মানুষ আজও ভয় পেয়ে চলে। কারণ, প্রত্যেকে জানে  তাদের চারিপাশে আর কেউ থাকুক না থাকুক, একটা সমাজ আছে। 

 পারুলের কাছে শুনলাম, সে নিজের ঘরের বিছানার জন্য একটা চাদরও শখ করে কিনতে পারে না। যদি কেনে, তো বাকি জায়েদের জন্যও কিনতে হয়। কারুর প্রয়োজন হলেও নিজের ঘরে রাখার একটা আসবাবও বেশি গড়াতে পারে না। বাকিরা দুঃখ পাবে, তাই সামর্থ্য থাকলেও করে না । সংসারে যা হয়, সবার সমান সমান। যাতে কারুর মনে কোন দুঃখ না তৈরি হয়। কিন্তু সাধ কি কারুর বেশি জাগে না? জাগে বৈকি! জাগলে ওরা গিলে নেয়। 

 অপরদিকে একান্নবর্তী সংসার হওয়ার জন্য অনেক সুবিধাও পায় সবাই। ওদের পরিবারের সদস্যদের সবার একে অপরের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, আদর-স্নেহ সবসময়ই অটুট থাকে। যে কোন বিপদে-আপদে কিংবা উৎসব, পালা-পার্বণে ওরা গোটা পরিবার একসাথে আনন্দ করে। বাড়ির শিশুরা বড় হয় বাড়ির প্রত্যেকের কাছ থেকে আদর ভালবাসা নিয়ে। তাতে কোন বাচ্চা স্বার্থপর তৈরি হতে পারে না।

 খানিক আগেই শোনা পারুলের দুঃখের কথাগুলো আর আমার তেমন বড় মনে হল না। কারণ, যখন ও বলল, ওদের ছেলেমেয়েরা কেউ কখনো নিজেদেরকে একা অনুভব করেনা। মা-বাবাকে সব কথা বলুক না বলুক, ভাইবোনেরা একে অপরের সব খবর রাখে। আমার আফসোস হচ্ছিল, এটা ভেবে যে, শহরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এটারই তো সবচেয়ে বড় অভাব। তাই তো তারা নানা হীনমন্যতায় ভোগে, নেশা করতে শেখে, আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায় তাদের মধ্যে। 

 হঠাৎ মনে হল, আমারও যদি একটা যৌথ পরিবার থাকত, কত ভাল হত। একান্নবর্তী পরিবারের যে কোন কাজ, জিনিসপত্র সকল কিছুই সবার সাথে ভাগ হওয়ার নিয়ম দেখে আমার ছেলেটাও তো ছোট থেকেই উদার মানসিকতা নিয়ে বড় হত। দায়িত্বশীলও তৈরি হত। ও যে, একা একা মানুষ হয়ে কারুর সাথেই কিছু শেয়ার করতে শিখল না। বড় হয়েও যদি এমনই থেকে যায়? 
আমার শরীরে কাঁপুনি লাগল। 

 পারুল টের পেয়ে বলল, চল উঠি। তোর মনে হয় নদীর হাওয়ায় শীত লাগছে। 

 সরল গ্রাম্য মেয়ে পারুল ধরতে পারল না, আমার কেঁপে ওঠার আসল কারণটা কী ছিল! 

                                                                     (ক্রমশ...) 

ছবি : লেখিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments