জ্বলদর্চি

কবি নবীনচন্দ্র : একশো পঁচাত্তর বছর /সুগত ত্রিপাঠী

কবি নবীনচন্দ্র : একশো পঁচাত্তর বছর

সুগত ত্রিপাঠী


২৩ জানুয়ারি কেবল নেতাজির জন্মদিবস নয়, অপর এক কৃতি বাঙালির প্রয়াণ দিবস-ও। তিনি নবীনচন্দ্র সেন। রবীন্দ্র-পূর্ববর্তী তথা রবীন্দ্র-সমসাময়িক যুগের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য কবি তিনি।
        তাঁর ছাত্রজীবন ছিল খুবই উজ্জ্বল। পরাধীন ভারতবর্ষে চাকুরী জীবনেও ছিলেন সুপ্রতিষ্ঠিত। হয়ে ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু ইংরেজের চাকরী করলেও মনেপ্রাণে খাঁটি স্বদেশী ছিলেন মানুষটি। ছিলেন অসম্ভব তেজস্বী। ইংরেজ-শাসনের কঠোর সমালোচক। তারই ফলশ্রুতি তাঁর অসামান্য কাব্যগ্রন্থ 'পলাশীর যুদ্ধ'। হয়তো আবেগের কিছু বাড়াবাড়ি আছে এ কাব্যে, কিন্তু এ আবেগ যে তাঁর নিখাদ স্বদেশপ্রেম থেকে উৎসারিত, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। নবীনচন্দ্র সেনের কাব্য গীতিধর্মী, বর্ণনাবহুল। —"সামান্য বণিক এই শত্রুগণ নয়। দেখিবে তাদের হায়। রাজা-রাজ্য, ব্যবসায়, বিপণি, সমরক্ষেত্র, অস্ত্র-বিনিময়"— ভয়ানক ইংরেজ সম্পর্কে সিরাজ-সেনাপতি মোহনলালের মুখ দিয়ে ভারতবাসীকে তিনি এই ভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন। এর ফলও অবশ্য ভুগতে হয়েছিল তাঁকে। ইংরেজ সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন কবি।
           বাংলা সাহিত্যে সে সময় দীর্ঘকাব্য রচনার যুগ। তিন মহারথী— মাইকেল মধুসূদন, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আর নবীনচন্দ্র সেন— বাংলা কাব্যের এক নতুন যুগের সেই উন্মেষ লগ্নে পত্র-পুষ্প-ফলে সমৃদ্ধ করছেন সারস্বত-অঙ্গন। মাইকেল লিখলেন 'মেঘনাদবধ কাব্য', 'বৃত্রসংহার' বেরোলো হেমচন্দ্রের হাত থেকে। নবীন এলেন 'রৈবতক-কুরুক্ষেত্র-প্রভাস' নিয়ে। শ্রীকৃষ্ণের জীবন-আধারিত এ কাব্যগ্রন্থ চিরকালীন প্রতিষ্ঠা লাভ করল বাংলায়। এক নূতন আঙ্গিকে কৃষ্ণের চরিত্রকে তুলে ধরলেন তিনি। তাঁর মতে, শ্রীকৃষ্ণ এক ধর্মরাজ্যের স্থপতি। এবং সেটাই ভারতের প্রথম যথার্থ সাম্রাজ্য। ব্রাহ্মণরা নানাভাবে শ্রীকৃষ্ণের বিরোধিতা করেছিলেন— এ রকম মতেও বিশ্বাসী ছিলেন কবি। প্রভূত সমালোচনা হয়েছিল এ গ্রন্থের। সমালোচকদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন। প্রসঙ্গত, বঙ্কিম নিজেও শ্রীকৃষ্ণের জীবন নিয়ে 'কৃষ্ণচরিত্র' রচনা করেছেন। বহু মানুষের কাছে তা সাদরে গৃহীত হলেও ভক্তের কাছে প্রায়শই অপাঙক্তেয়। এখানে শ্রীকৃষ্ণ যত না ভগবান তার চেয়ে অনেক বেশি রক্তমাংসের মানুষ, অজস্র দোষগুণ-সমন্বিত যিনি। নানা প্রকার যুক্তি দিয়ে বঙ্কিম তাঁর মত প্রতিষ্ঠা করেছেন। আবার বিপরীত যুক্তি দিয়ে বহু মানুষ এ গ্রন্থকে নস্যাৎ করেছেন। যাই হোক, 'রৈবতক-কুরুক্ষেত্র-প্রভাস' উচ্চ-প্রশংসিতও হয়েছে কোনও কোনও প্রাজ্ঞজন দ্বারা। 'খৃষ্ট', 'অমিতাভ', 'অমৃতাভ' কবির অন্যান্য কয়েকটি বই। 'আমার জীবন' নাম দিয়ে লিখেছিলেন আত্মজীবনী। স্বাদু সে রচনা। পদ্যে 'গীতা'-র অনুবাদ করেছিলেন, লিখেছিলেন 'মার্কণ্ডেয়-চণ্ডী'।
          প্রকৃতপক্ষে, কবিতা ছিল নবীনের রক্তে। নিতান্ত বাল্যকাল থেকেই তিনি রচয়িতা। বাবা ছিলেন কাব্যানুরাগী। স্বচ্ছল গৃহে জন্ম তাঁর। কিন্তু বালক বয়সে পিতৃবিয়োগের পর থেকেই দুর্দশার চরম। সে সময় বিদ্যাসাগরের সাহায্যপ্রার্থী হয়েছিলেন অনন্যোপায় নবীন। করুণার সাগর মানুষটি আগন্তুক বালককে একপ্রকার হাত ধরে টেনে তুললেন। আমৃত্যু নবীন ভুলতে পারেননি মহামানবের সেই মহাঋণ। পরিণত বয়সে সে সম্পর্কে লিখেছেন, "যে এক ভেলায় ভরসা করিয়া ভাসিতেছিলাম তাহাও ত ডুবিয়া গেল। এখন কি করি ? অবস্থার ঘোর ঘটায় চারিদিক সমাচ্ছন্ন। মস্তকের উপর ঝটিকা গর্জিতেছে। ঘন ঘন বজ্রপাত হইতেছে।
 ঘোরতর অন্ধকার ভিন্ন কিছুই দেখিতেছি না। একটি ক্ষীণ জ্যোতিঃ, একটি ক্ষুদ্র নক্ষত্রও কোন দিকে দেখিতেছি না যে উহাকে উপলক্ষ্য করিয়া ভাসিয়া থাকি। তরঙ্গের উপর তরঙ্গ আসিয়া এরূপ আহত ও নিমজ্জিত করিতেছে যে, আর ভাসিয়া থাকিবার আশা দেখিতেছি না। একটি কিশোর বয়স্ক কলিকাতার পথের কাঙ্গাল কেমন করিয়া কূল পাইবে ? সকল অবলম্বন ভাসিয়া গিয়াছে, সকল আশা নিবিয়া গিয়াছে। একমাত্র আশা সেই বিপদভঞ্জন হরি। ভক্তিভরে, অবসন্ন প্রাণে, অশ্রুপূর্ণ নয়নে তাঁহার দিকে চাহিলাম। তিনি প্রহ্লাদের মত আমাকেও তাঁহার নর-মূর্তিতে দেখা দিলেন। সেই নর-নারায়ণ শ্রীঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি সম্প্রতি স্বর্গধামে গমন করিয়াছেন। শ্রী ভগবদ্বাক্য—'ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে'— মানবের একমাত্র সান্ত্বনার কথা। 'পুণ্যং পরোপকারশ্চ পাপঞ্চ পর পীড়নে'— এই মহাধর্ম সংস্থাপন করিবার জন্য ঈশ্বরচন্দ্রের অবতার। সেই মহাব্রত সাধন করিয়া, তাঁহার অবতারে বঙ্গদেশ পবিত্র করিয়া তিনি তিরোহিত হইয়াছেন মাত্র। তাঁহার মৃত্যু নাই। তিনি চিরজীবী। তিনি চিরদিন শ্রীঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই থাকিবেন।" ('আমার জীবন') বিদ্যাসাগর সম্পর্কে মাইকেল মধুসূদন দত্তের অতি বিখ্যাত কবিতা এবং রবীন্দ্রনাথের 'বিদ্যাসাগরচরিত' প্রবন্ধ বহুপঠিত, বহুআলোচিত। কিন্তু নবীনচন্দ্র সেনের এই বিদ্যাসাগর-বিশ্লেষণ ততখানি আলোচিত নয়। তাই ধান ভানতে শিবের এই গীতটুকু।
          নবীনচন্দ্রের কেবল 'পলাশীর যুদ্ধ' কাব্যগ্রন্থ নয়, প্রায় সব গ্রন্থেই আবেগের আতিশয্য আছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। এ উক্তি কিয়দংশে সত্য, সর্বাংশে কখনওই নয়। এ বিষয়ে বিচার করতে হলে কবির সময়কাল অবশ্য বিচার্য। নবীন যে সময়ে লিখছেন, আধুনিক কাব্য-সাহিত্য বলতে যা বোঝায়, তা তখনও পরিপূর্ণ রূপ পায়নি। অলঙ্কারবহুল-ঝঙ্কারময় শব্দ, ঘটনা-বর্ণনার ঘনঘটা তৎকালে প্রচলিত রীতি ছিল। হঠাৎ করে তার বাইরে যাওয়া সহজ নয়। এর কারণ এই— প্রচলিত ধারা থেকে সরে গিয়ে যদি কেউ সাহিত্যসৃষ্টিতে ব্যাপৃত হন, অর্থাৎ নতুন ধরনের কিছু সৃষ্টি করেন, তা গৃহীত হতে পারে, না-ও হতে পারে। ওই ঝুঁকিটা সবাই নেন না। 'পায়রা কবির বকবকানি'-র মতো মন্তব্য অন্য কোনও কবি সম্পর্কে করলে তিনি হয়তো চিরতরে লেখাই বন্ধ করে দিতেন হতাশায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অসাধারণ পুরুষ, তাই গ্রাহ্য করেননি ও-সব সমালোচকদের। যাই হোক, নবীনের বহু কাব্যে আবেগের নিয়ন্ত্রিত প্রকাশই দেখা গিয়েছে। বস্তুত, রবীন্দ্রনাথের পূর্বে বাংলা কাব্যে গীতিকবিতার মূর্ছনা, মাধুর্য নবীনচন্দ্রের লেখাতেই দেখা গিয়েছিল। আর সে-কালের কাব্যকে যদি কারও বাগাড়ম্বর মনে হয়, এ-কালের কাব্যও তৎকালীন মানুষের চোখে ন্যাকামি, অর্থহীন প্রলাপ ছাড়া কিছু বোধ হবে না। তাঁদের কাছে এ-সব ইদানিংকালের কবিতা হয়ে দাঁড়াতে পারে দুর্বোধ্য, হয়তো বা কবিতা পদবাচ্যই নয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই যখন তাঁর সমসাময়িক এক তথাকথিত আধুনিক কবির কবিতা সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, 'যদি বুঝাইয়া দিতে পার, শিরোপা দিব', অন্যদের কী কথা ! তাই সাহিত্যের বিচার অনেক ক্ষেত্রেই করতে হয় সময়ের নিরিখে। শেক্সপিয়রের মতো নাটক এ যুগে কেউ লিখবেন কি ? অথবা কালিদাস-ভবভূতির অনুসরণে ? তাই বলে শেক্সপিয়র-কালিদাসের মর্যাদা কোনও অংশে ন্যূন, এ-কথা অতি বড় মূর্খেরও মুখ থেকে বেরোবে না আশাকরি। আজও উপরোক্ত তিন জনই  বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে পূজিত। এই সঙ্গে বলে রাখা ভালো, আর একশ্রেণীর সমালোচক আছেন, যাঁরা অন্যের পোঁ-ধরা এবং ভীরু। কোনও স্রষ্টার মূল্যায়ন করতে বসলে এঁরা প্রথমেই খোঁজেন, কোনও বড় মানুষ ওই লেখক-কবি-শিল্পী সম্পর্কে কী বলেছেন। প্রথমেই এঁরা এই ধারণা গেঁথে নেন, অমুক যখন এ-কথা বলেছেন, তা ভুল হতেই পারে না। কাজেই ওই ধারণাটাকে নিজের মতো করে একটু সাজিয়ে নিলেই মোটামুটি পিঠরক্ষা হয়। পাঠ্যপুস্তক থেকে পাঠ্যবহির্ভূত পুস্তক— সর্বত্রই এই শ্রেণীর আলোচক-সমালোচকদের দাপাদাপি চোখে পড়ে। নবীনের সম্পর্কেও একই কথা সত্যি। তাঁর সমসাময়িক এবং কিঞ্চিৎ পরবর্তী খ্যাতিমান, অতিপ্রতিষ্ঠিত, স্কলার-পণ্ডিত মানুষজন তাঁর সম্পর্কে যে কথা বলেছেন, বর্তমান সমালোচকরাও মোটামুটি সেই পোঁ-ই ধরে আছেন। ব্যাপারটা যতই অদ্ভুত হোক, ঘোর বাস্তব। "শোভিছে মিশর-জাত সুরা নিরমল/উপরে জ্বলিছে দীপ বিলম্বিত ঝাড়ে ;/ বিমল স্ফটিক-দীপ শাখায় শাখায়/ জ্বলিতেছে, চারু চিত্র-খচিত দেয়ালে।/ অনন্ত-আনন্দময়ী, আমোদ-রূপিনী/ক্লিওপেট্রা সুন্দরীর, এই সেই কক্ষ মনোহর !" ('ক্লিওপেট্রা' কাব্য) সংযত, সহজ বর্ণনা। খুব অস্বাভাবিক বোধ হচ্ছে কি ?
          নবীনচন্দ্রের জন্মের ঠিক একশো বছর পরে ভারতবর্ষ স্বাধীন হল। ২৩ জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জন্মদিনেই তাঁর দেহান্তর। মনেপ্রাণে স্বদেশী মানুষটির জীবনের সঙ্গেও দেশপ্রেমের আশ্চর্য সমাপতন জড়িত।    
          দুঃখের সঙ্গে জানাতে হয়, একসময়ের এত উল্লেখযোগ্য একজন কবি আজ অনেকটাই বিস্মৃতিতে। নেতাজির জন্মদিন নিয়ে এতকিছু হল, তাঁর জন্মের একশো পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বঙ্গে এবং বহির্বঙ্গে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন। অথচ নবীনের প্রয়াণদিবসের কথা প্রায় কারও মনে এল না, এটা ভেবে মর্মাহত হতে হয়। যাই হোক, বর্তমান বছর কবির একশো পঁচাত্তরতম জন্মবার্ষিকী। অবশ্য  জন্মবার্ষিকীতেই যে কেউ স্মরণীয় হয়ে ওঠেন, এ কথা বলা হচ্ছে না। তবু অনেকেই একটা উপলক্ষ চান। তাই মনীষী-মহাপুরুষদের, কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকদের জন্মদিবস, প্রয়াণদিবস ইত্যাদি পালনের প্রথা রয়েছে। অন্তত সেই সময়েও এঁদের স্মরণ-মনন হয় ;  মানব মনের কিছু উন্নতি সাধনের ক্ষেত্রে যা বহুক্ষেত্রেই প্রভূত কার্যকরী।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 




Post a Comment

0 Comments