জ্বলদর্চি

অক্ষয়তৃতীয়া /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব - ১৭

অক্ষয়তৃতীয়া 

ভাস্করব্রত পতি

শ্রীকৃষ্ণ পরশুরাম রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই অক্ষয়তৃতীয়ার দিনেই। তাই কোঙ্কন ও মালাবার উপকূলে এদিনেই পরশুরামের পূজার্চনা করার রীতি রয়েছে। ব্যাসদেব অক্ষয়তৃতীয়াতেই শুরু করেন 'মহাভারত' লেখার কাজ। আর মহাভারত অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ কৌরবদের হাত থেকে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন। আজকেই সমুদ্রের বুক থেকে জমি উদ্ধার করে ছিলেন এই শ্রীকৃষ্ণ। আজকের পবিত্র দিনেই ত্রেতাযুগের সূত্রপাত। তবে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এটি নাকি সত্যযুগের প্রথমদিন। দেবাদিদেব মহাদেবকে তপস্যায় সন্তুষ্ট করলে মহাদেব কুবেরকে অজস্র ধন সম্পদের অধিকারী করে দেন আজকেই। তাই ধনসম্পদের দেবতা হিসেবে আরাধনা করা হয় কুবেরকে। প্রভু ঋষভ নাকি তাঁর এক বছরের উপবাস ভেঙেছিলেন আখের রস খেয়ে। তাই জৈন ধর্মের মানুষজন ঋষভদেবের মূর্তিটিকে এদিন স্নান করান আখের রস দিয়ে। জীবনের যেকোনো নতুন উদ্যোগের শুভ সূচনার জন্য এই অক্ষয়তৃতীয়াকেই বেছে নিতে চায় সকলেই। এখন অবশ্য সোনা কেনার একটা চল শুরু হয়েছে শুভ প্রাপ্তিযোগের আশায়। 

আর অক্ষয়তৃতীয়া এলেই দোকানে দোকানে দোকান পূজোর ধুম পড়ে। যাঁরা পয়লা বৈশাখের দিন হালখাতা করতে পারেননা, তাঁরা অক্ষয়তৃতীয়ার দিনে লক্ষ্মী গনেশের পূজো সহকারে হালখাতার আয়োজন করে। আমন্ত্রনপত্রে লেখা থাকে 'শুভ অক্ষয়তৃতীয়া'। অশৌচ অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্য গঙ্গাস্নানে ভিড় হয় এদিন। ফলহারিণী কালিপূজার দেবী প্রতিমার মেড় বাঁধার কাজও শুরু হয় এই দিনেই। এসবই বাংলার সংস্কৃতি। বাঙালির সংস্কৃতি। 

অক্ষয়তৃতীয়া হল দেবী অন্নপূর্ণার জন্মদিন। মানুষ যাতে সারাবছর খেয়ে পরে বেঁচে থাকে, তার জন্য আরাধনা করা হয় দেবীর। কিন্তু ভারতজুড়ে আজ অসংখ্য নিরন্ন মানুষের হাহাকার। কিন্তু অন্নপূর্ণার দেখা নেই। সূর্যদেব পাণ্ডবদের দান করেছিলেন 'অক্ষয়পাত্র'। যে পাত্রের খাবার কোনো দিনই শেষ হবেনা। হিন্দুরা এইদিনের পূজা করে বিশেষ কারনে। আসলে মৃত্যুর পরে যাতে বৈকুণ্ঠধামে আশ্রয় মেলে। অক্ষয়তৃতীয়াতেই পুরীর রথযাত্রার জন্য রথ তৈরির কাজ শুরু হয়। 

দক্ষিণ ভারতের লোকেরা এইদিনে উপোসী থাকেন। শাস্ত্রানুসারে এদিন সোনা, যব, গম, জলভরা কলস, ফলের রস, দই, ছানার মিষ্টি, ছোলা, চাল, শষ্য ইত্যাদি দান করলে ভালো ফল মেলে। আসলে শ্রীকৃষ্ণ সুদামাকে চিড়ে উপহার দিয়েছিলেন। সেই থেকেই এই উপহার দেওয়ার চল শুরু হয়েছে। অক্ষয়তৃতীয়ার সকালে স্নান সেরে ব্রাম্ভণকে নতুন গামছা, ছাতা, অর্থ, তালপাতার পাখা দান করলে অক্ষয় পূর্ণতা অর্জিত হয়। 

বৈশাখের শুক্লপক্ষের তৃতীয় দিন হোলো অক্ষয় তৃতীয়া। এই তিথিতে কর্মফলের ক্ষয় নাই। অক্ষয়ফলা তৃতীয়া তিথি বিশেষ। একে 'চিরঞ্জীবি' তিথিও বলে। আমাদের চিরায়ত সংস্কৃতিগুলো একটু চোখ মেলে দেখলে যে চারটি "আবুজা মুহূর্ত" র খোঁজ পাই, এই অক্ষয়তৃতীয়া তাদেরই একটা। বাকিগুলো হোলো বসন্ত পঞ্চমী, ভাদলী নবমী এবং দেবউঠানী একাদশী। হিন্দি এলাকায় অক্ষয়তৃতীয়াকে বলে 'আখা তীজ' বা 'অক্ষরতীজ'। হিন্দুদের সাড়ে তিনটি সর্বাধিক শুভ মুহুর্তের অন্যতম এটি। কার্তিকের শুক্লপক্ষের প্রথম দিনটি আধখানা তিথি। অন্য দুটি পূর্ণ তিথি হোলো পয়লা চৈত্র এবং বিজয়া দশমী।

সারা ভারত জুড়ে এই দিনটিকে মান্যতা দেওয়া হয় কৃষি ও বানিজ্যের প্রতিভূ হিসেবে। পূর্ব ভারতের ওড়িশা থেকে পশ্চিম ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা পর্যন্ত কৃষকরা এই পবিত্র দিনেই লাঙ্গল নিয়ে জমিতে হাল করার কাজ শুরু করে। গুজরাটের চাষিরাও এদিন লাঙলের ফলায় জমিকে বিদ্ধ করে সারা বছর কৃষি সমৃদ্ধির বাসনায়। 

১৯৩৬ সালে রেভারেন্ড কে এস ম্যাকডোনাল্ড লিখেছিলেন, "হিন্দুদের কাছে এই দিনটি পবিত্র, কারণ শাস্ত্রমতে এই দিন ভিক্ষা ও উপহার দিলে অক্ষয় পুণ্য অর্জিত হয়। ভবিষ্যতে পাপ করলেও সেই পুণ্যফল নষ্ট হয়না। তাই কৃপণরাও হাত উপুড় করে দেন।" এদিন দান করলে পূর্ণ অক্ষয়লাভ হয়।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments