জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-২২/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ২২
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 যমুনোত্রীর পথে শেষ গ্রাম খরসোলী থেকে পাণ্ডা সহযোগে কঠিন পার্বত্যপথ অতিক্রমপূর্বক শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যে অর্থাৎ যমুনোত্রী পৌঁছলেন গঙ্গাধর মহারাজ। এখানকার উষ্ণ গহ্বরে একরাত্রি বাস করার পর ভয়ঙ্কর শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় পৌঁছন উত্তরকাশী। সেখান থেকে গঙ্গোত্রী। তাঁর বহুদিনের অভীপ্সিত গঙ্গোত্রী দর্শন, স্পর্শন করে অনুপম আনন্দে নিমগ্ন হলেন।  প্রায় এক সপ্তাহকাল এই দিব্যভূমিতে অতিবাহিত করেন। এখান থেকে ফেরেন উত্তরকাশীতে। এখানে ভয়ানক উদরাময় রোগে আক্রান্ত হলেন। ক্রমে সুস্থ হয়ে পৌঁছলেন টিহরি। গঙ্গোত্রী থেকে আনা এক শিশি গঙ্গাজল ডাকযোগে বরানগর মঠে পাঠান। মঠের ভাইয়েরা এর ফলে জানতে পারলেন যে গঙ্গাধর হিমালয়ে।

  টিহরি থেকে রওনা দিলেন চন্দ্রবদনী পীঠস্থান দর্শনের লক্ষ্যে। হিমালয়ের এক অতি উচ্চ পর্বতচূড়ায় এর অবস্থান। এই পর্বতের পথ অতি দুরূহ। সেখানে পৌঁছিয়ে নির্জন গিরিমন্দিরে পরম আনন্দে দুই রাত্রি অতিবাহিত করলেন। ফেরার সময় মায়ের চরণে পুনরায় এই স্থানে আসবার আকুতি জানিয়ে পার্বত্য পথে নামতে লাগলেন। কিছু পথ অতিক্রম করার পর বুঝলেন পথহারা হয়েছেন। এমন একটি জায়গায় পথ হারান যেখান থেকে উপর বা নীচ কোনওদিকেই আর এগনো সম্ভব নয়। কিন্তু এর জন্য বিন্দুমাত্র ভীত হলেন না, কারণ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল--এই পর্বত দেবীস্থান, যেখানেই থাকুন না কেন মায়ের কোলেই রয়েছেন। কিছু সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর ‘জয় মা’ বলে নীচে একদিকে প্রায় গড়াতে গড়াতে নামতে থাকলেন।

  এইভাবে পর্বতের পাদদেশে পৌঁছে দেখেন সমতল ভূমি। সেখানে কয়েকজন কৃষক গম পুড়িয়ে খাচ্ছে। তাঁকে এইভাবে আসতে দেখে তারা ভীষণ অবাক হয়ে গেল। কেননা এই পথে কেউ কোনওদিন আসেনি। তারা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল, চন্দ্রবদনী-মাঈ-এর কৃপাতেই এটা সম্ভব হয়েছে। তিনিই তাঁকে হাত ধরে এখানে নিয়ে এসেছেন!

  এই প্রসঙ্গে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করে নেওয়া বিবেচকের কাজ হবে। নির্দিষ্ট সময়ক্রমের মধ্যে ঘটনাগুলিকে সাজিয়ে নিলে সহজভাবে বোধগম্য হয়। ১৮৮৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ মানবলীলা সাঙ্গ করার পর নরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে যে ক'জন যুবক ভক্ত সংসার ত্যাগের সংকল্প গ্রহণ করে বরানগর মঠে একত্রিত হন, গঙ্গাধর তাঁদের অন্যতম। ১৮৯০ সালের জুন মাসে হিমালয় থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি যথাবিহিত সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। ঘটনাচক্রে তাঁর শরীরে অখণ্ড ব্রহ্মচর্যের লক্ষণসমূহ দেখে লামারা ‘গেলাং’ বলে সম্বোধন করেন। সেই ঘটনার কথা স্মরণে রেখে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সন্ন্যাস নাম দেন ‘স্বামী অখণ্ডানন্দ’! যাই হোক চন্দ্রবদনী পীঠস্থান দর্শনের পর গঙ্গাধর মহারাজ কিছু পথ অতিক্রম করে শ্রীনগরে পৌঁছন। অলকানন্দায় অবগাহন করে কমলেশ্বর-মঠ দর্শন করেন। সেখান থেকে রুদ্রপ্রয়াগ হয়ে কেদারনাথের দিকে অগ্রসর হন। কেদারনাথকে দর্শন করে তিনি লেখেন,“এই দেখাতেই আমার সকল দেখার অবসান হইল।”(তিব্বতের পথে হিমালয়--স্বামী অখণ্ডানন্দ)। কেদারনাথ দর্শনের পর বদরীনরায়ণের অভিমুখে যাত্রা করলেন। সেখানে পৌঁছে তপস্যানুকূল কোনও স্থানে কালাতিপাত করবেন এমনই মনের বাসনা ছিল। কিন্তু তিব্বত যাত্রার সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে বুঝে তিব্বত অভিমুখী হলেন। মানা পাস দিয়ে তিব্বতের তুষারাবৃত মালভূমিতে প্রবেশ করলেন। সামান্য শীতবস্ত্র অঙ্গে ধারণ করে, সম্পূর্ণ নগ্নপদে পরিভ্রমণরত অবস্থায় নিদারুণ ক্লান্তিতে তুষারের উপরই নিদ্রিত হয়ে পড়েন। নিকটবর্তী বৌদ্ধমঠের সন্ন্যাসী তাঁকে এমতাবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে সযত্নে মঠে তুলে নিয়ে যান। আগুনের সেক ইত্যাদি দ্বারা ক্রমশ সুস্থ করে তোলেন। নগ্নপ্রায় গঙ্গাধর মহারাজের শারীরিক লক্ষণ সমূহ দেখে মঠের লামারা বুঝতে পারেন তিনি অখণ্ড ব্রহ্মচর্যের অধিকারী। তাঁকে ‘গেলাং’ সম্বোধনে খুবই সম্মান জ্ঞাপন করে মঠে থাকবার অনুরোধ জানান। এই থুলিং মঠে থেকে দিন পনেরোর মধ্যে তিব্বতি ভাষা শিখে নেন তিনি। তিন-চার মাস তিব্বতের এই অঞ্চলে কাটিয়ে সেখানকার মঠ-মন্দির, রীতিনীতি বিষয়ে সম্যকভাবে অবহিত হন। ১৮৮৭ সালে অক্টোবরের শেষদিকে বদরি- অঞ্চলে প্রত্যাবর্তন করেন নিতিপাসের মধ্য দিয়ে। তবে পুনরায় তিব্বতে গিয়ে তাঁর কৈলাস, মানস সরোবর ও লাসা দর্শনের পরিকল্পনা ছিল।

 তিব্বতে একটি বিষয় অখণ্ডানন্দজী লক্ষ্য করেছিলেন যে মুখ্য অনুশাসনগুলি বৌদ্ধ মঠগুলিতে বজায় আছে। এখানকার পবিত্র পরিবেশ তাঁকে মুগ্ধ করল। তিনি উপলব্ধি করলেন এই মঠগুলি আধ্যাত্মিকতার আধার এবং সেখানে জাতিস্মরের আবির্ভাব হয়। পুণ্যভূমির এমনই প্রভাব! একজন শীর্ষস্থানীয় লামা তাঁর কাছে শ্রীরামকৃষ্ণের ছবিটি দেখে জিজ্ঞাসা করেন,“এ ছবি কোথায় পেলে, এমন মুখ, চোখ, কান তো সাধারণ মানুষের নয়--এ ভগবান তথাগতের।” ছবিটি তিনি তাঁর বেদীর উপর স্থাপনপূর্বক ধূপদীপসহ আরতি করেন! এদিকে ১৮৮৮ সালে বদরীনাথের ‘পট’ খোলামাত্রই গঙ্গাধর মহারাজ সেখানে চলে যান। সেটা ছিল মে মাস। তাঁর অতি প্রিয়, বহু আকাঙ্ক্ষিত বদরিকাশ্রমে তিন মাস তপস্যায় অতিবাহিত করে কৈলাসদর্শনমানসে শিপছিলাম পাসের মধ্য দিয়ে তিব্বতের দাবা জেলায় উপস্থিত হলেন। কৈলাস ও মানস সরোবর তিব্বতের পশ্চিমাংশে তুষারাবৃত মালভূমি অঞ্চলে অবস্থিত। শান্ত, নিস্তব্ধ এক গাম্ভীর্যময় তপোভূমি! অন্যদিকে মানস সরোবর হল তিব্বতের উচ্চ মালভূমি অঞ্চলে বরফ গলা জলের একটি বৃহৎ স্বচ্ছ সরোবর। যার সৌন্দর্যের জুড়ি মেলা ভার! এই সরোবরের পরিধি প্রায় ৫০ মাইল। তিনি দেখলেন এর চারিপাশে রয়েছে ৮টি বৌদ্ধমঠ এবং কৈলাস পর্বতের পাশে রয়েছে ৬টি মঠ। তবে এই স্বর্গীয় দিব্যভূমিতে তপস্যায় কালাতিপাতের ইচ্ছায় এবার আর কোনও মঠে অবস্থান করলেন না। কৈলাসের নিকটবর্তী ছেকরা নামক একটি স্থানে লাসার এক ধনশালী খাম্বা বা যাযাবর-এর আতিথ্য স্বীকার করেন। তাঁর কাছে শ্রীরামকৃষ্ণের ছবি দেখে সেই খাম্বা বুদ্ধজ্ঞানে সেটি নিয়ে ভগবান বুদ্ধের সিংহাসনে স্থাপন করে নিত্য পূজা আরম্ভ করে। সেখান থেকে ফিরে আসার সময় গঙ্গাধর মহারাজ তাঁকে না বলেই ছবিটি নিয়ে চলে আসেন এবং সেই নিতিপাস দিয়েই নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে বদরীনারায়ণ প্রত্যাবর্তন করেন। কুমায়ুন, আলমোড়া, রাণীখেত প্রভৃতি স্থান হয়ে কর্ণপ্রয়াগে পৌঁছন। এই অঞ্চলেই শীতকাল অতিবাহিত করেন। হৃষীকেশে একবার প্রখ্যাত সাধু মায়ারাম অবধূতকে গঙ্গাধর মহারাজ জিজ্ঞাসা করেন,“কোন পথ দিয়ে হিমালয় যাব?” কারণ অবধূতের চারধাম ঘোরা ছিল। তিনি সম্মুখে হাঁটাপথ দেখিয়ে দিতে গঙ্গাধর মহারাজ বলেন,“আমি তো ভেবেছিলাম শৃঙ্গ থেকে শৃঙ্গ লাফিয়ে যাব।” সঙ্গে সঙ্গে মায়ারাম তাঁর সঙ্গীসাধুদের ডেকে বলেন,“আরে দেখো দেখো --বাঙ্গালী ক্যা বোলতা। গুরু মেহেরবান তো চেলা পহলবান।”(তিব্বতের পথে হিমালয়--স্বামী অখণ্ডানন্দ)। 

পরবর্তী সময়ে বারংবার তুষারময় হিমালয় পর্বতের এপার ওপার পরিভ্রমণ করায় তিনি তিব্বতি ও পাহাড়িদের কাছে ‘বরফানী বাবা’ নামে পরিচিত হন। স্বামীজীও আদর করে তাঁকে এই নামে কখনও কখনও সম্বোধন করতেন!

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments