জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-১৯/সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-১৯

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

“পল দো পল কা শায়র হুঁ...পল দো মেরি কহানী হ্যায়...”

মা-এর কোনদিন ইচ্ছে ছিল না যে, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ননীবালা স্কুলে যাই।

-“স্কুল বাসে যাবে সিমটি বেশ”...প্রায় মেজদাকে তাই নিয়ে নাকি বলতেন। সেজন্য আবার গভর্মেণ্ট স্কুল রাণী বিনোদ মঞ্জরীতে ভর্তির পরীক্ষায় বসলাম...একসাথে সায়েন্স/আর্টস দুটোতেই চান্স পেলাম। কিন্তু মা আর দেখে যেতে পারেন নি। আমার জীবন তো এক ছকে বাঁধা নয়।

নতুন স্কুলে নাইনে ভর্তি হতে গেলে বাংলা, ইংলিশ, সংস্কৃত, গণিত-এর পরীক্ষা দিতে হত। আজ ও আছে কিনা সেই নিয়ম, তা জানা নেই। ভর্তির সময় সংস্কৃত-এ আমিই সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছিলাম। আর অংকে ৯৪%। স্কুল থেকে মেজদাকে ডেকে পাঠানো হল।

বড়দি জানালেন: “শিমুল যদি সংস্কৃত, লজিক, আর ম্যাথমেটিকস-নেয়, তাহলে হাইয়ার সেকেন্ডারিতে স্ট্যান্ড করার সম্ভাবনা থাকবে।”

--না: বাড়ির সব বোনেরা আর্টস পড়েছে। আমি ওকে সায়েন্স পড়াব। আমি নিজে গাইড করব। মেজদা বললেন বড়দিকে।

ঝাড়্গ্রামে তখন মেজদাদার খুব নামডাক। ফিজিক্স, আর অঙ্কের প্রফেসর ছিলেন। হাইয়ার সেকেন্ডারীতে মেজদার ছাত্র/ছাত্রীদের মধ্যে থেকেই অনেকে ন্যাশনাল স্কলারশীপ পেয়েছিল আর মনিময়দা তো প্রথম হয়েছিল। কাজেই আমি সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হলাম। অতিরিক্ত সাবজেক্ট বায়োলজি নিলাম।

আমার স্বভাবস্মৃতি স্বাধীন মায়ার আকাশে ওড়ে আজও...হ্যাঁ-জীবনটা পজিটিভ অঙ্কে গাঁথা ছিল।

রাজারাজড়াদের স্কুল। রাজকীয় ব্যাপার স্যাপার থাকত। টিফিন যে কি ভালো পেতাম-তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমার অস্বাভাবিক লজ্জা আর ভয় ভাঙ্গানোর জন্য...সরস্বতী পূজায় রাজবাড়ির অতিথিরা স্কুলের গেটে যখন ঢুকতেন, সেই সময় হাতে গোলাপ ফুলের পাপড়ি শুদ্ধ ডালি নিয়ে টীচার-রা সবার আগে আমাকে দাঁড় করাতেন কিছু মেয়ের সাথে। আমরা তখন দশম-একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রীরা। ওনাদের গাড়ি এসে স্কুলের সামনে দাঁড়ালেই গাড়ি লক্ষ্য করে ফুলের পাপড়ি ছুঁড়ে দিতাম। আর সেই গাড়ি তখন গড় গড় করে গেট দিয়ে স্কুলের ভেতরে ঢুকে পড়ত।

ছেলেদের প্রবেশ নিষেধ ছিল। বটিরা কিছু বন্ধু মিলে মেয়েদের সাড়ি পড়ে ঘোমটা দিয়ে একবার ঢুকেছিল স্কুলে। কেউ ধরতে পারে নি। পরে বটি সে কথা বাড়িতে জানায়।

বিনোদ মঞ্জরীতে পড়াশুনার সময় সরস্বতী পূজায় নাটক হত। রাজবাড়ি থেকে সমস্ত পোশাক আসত। একবার শিবাজী নাটক হয়েছিল হিন্দিতে, আমি তাতে মন্ত্রী সেজেছিলাম।

বিনোদ মঞ্জরীতে ভর্তি হয়ে অনেক কিছুর মুখোমুখি হয়েছিলাম। শুধু একবার কবিতা বলতে গিয়ে ভুলেটুলে একসা। কি লজ্জা। আজ কেউ বললেও আমি কবিতা বলি না।

বাড়ি থেকে যৎসামান্য টাকা দিলে স্কুল থেকে সব যায়গায় যাওয়া যেত। যদিও সব কিছু হত লটারি করে। লটারিতে যাদের নাম উঠবে তারাই শুধু যেতে পারবে। পুরী, ভুবনেশ্বর, কোনারক গিয়েছিলাম।

পুরো একটা বগি রিজার্ভ করা হত। বাড়ি থেকে আমাকে তো যেতে দেবে না মেজদা। তাও একদিন স্কুলে টিফিনের সময় আমাকে ডেকে পাঠালেন সুজাতাদি, ছবিদিরা। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোর নাম নেই কেন রে? বাড়িতে গিয়ে বলবি-তুই স্কুলের সাথে যাবি। বুঝলি?” কাল এসে জানাবি টিফিনের সময়। হাসি হাসি মুখ করে পরের দিন টীচার্স রুমে এসে বললাম, - “বাড়ী থেকে সবাই রাজী হয়েছেন।”

এরপর একগাল হাসি নিয়ে ক্লাসে আসলে...সবাই বলে উঠল- “এটা পুরো পার্সিয়ালটি, আমাদের নাম ওয়েটিং লিস্ট-এ আর শিমুল নাম দিল না--ওর নাম ফাইনাল লিস্টে কিভাবে হয়?” এইসব শুনে আমার চোখে জল দেখে ওরা বলল, “তুই কাঁদছিস কেন? তোর তো দোষ নয়। সব দোষ সুজাতাদি আর ছবিদির”।

আমার প্রিয় বান্ধবী ক্ষমা বলল, “সব জগন্নাথ দেবের টান -বুইলি ?”

রাণী বিনোদ মঞ্জরী লেখা ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের ছবি আজও চোখে ভাসে। কি যে আনন্দ হয়েছিল-তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। লিখতে লিখতে হয়ত কিছু ভুল থাকবে ভেবে-লেখা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু লিখতে লিখতে দেখছি লেখাটা বেশ লেখার মতো এগোচ্ছে, বানানও মোটামুটি ঠিক।

আমরা উঠেছিলাম ভারত সেবাশ্রম হোটেলে-যেখানে “বালিকা বধূ” শ্যুটিং হয়েছিল।

দিদিমণিরা খুউব ভালোবাসতেন আমাকে। আমাদের ফিজিক্সের টিচার ছবিদির সবচেয়ে স্নেহের পাত্রী ছিলাম আমি। আমাকে বান্ধবীরা রাগাত এই বলে যে, “নিশ্চয়ই ছবিদির ভাই আছে, তাই তোকে সব সময় নজর রাখেন।” কিছু বলতাম না তখন। এটা আমার স্বভাব ছিল।

পুরীতে কোনারক মন্দিরে দেখা হয়েছিল শিবপুর বি.ই কলেজ থেকে আসা বেশ কয়েকজন স্টুডেন্টদের গ্রুপ-এর সাথে। পরে বাড়িতে আমার ছোদ্দা বি.ই. কলেজের হোস্টেল থেকে ছুটিতে আসলে আমাকে রাগাতে শুরু করে 'এ ভাই, কি করে চুঁ রে, ডুবে ডুবে জল খায় চুঁ...?'

আমি এমনিতেই বড্ড ভীতু আর লাজুক ছিলাম। খালি ভাবতাম মেজদা শুনে বোধহয় আমাকে বকবে। কেউ বকলে সহ্য করতে পারতাম না। মা না থাকার অভিমানটা এসে বাসা বাঁধত। তাই ছোদ্দাকে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম “কি বলছিস? আমি কিছু করিনি তোওও!”

সে বেশ গম্ভীর গলা করে বলল, আমি ধুর্জ্জটির টেবিলে তোর ফটো দেখে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল, ওর বোন ক্ষমার বন্ধু।

আমি বললাম, “ কি নাম?”

--“শিমুল।”

-সে হেসে বলে। "তোর কোন আশা নেই।”

ওকে যত বোঝাই, “ওরে ও আমার ছোট বোন।”

সে তত হাসি চেপে বলে, “ধ্যাত, এ তোর বোন হতেই পারে না। তবে আমি ছাড়ার পাত্র নই। ঝাড়গ্রাম দিদার কাছে যাই...তারপর না হয়...”

স্কুলের টেস্ট পরীক্ষার পরে ফাইনাল ল্যাবের জন্য স্কুলে যেতে হত। তখন তো আর স্কুল বাস আসত না নিতে? তাই পাড়ার বান্ধবী মিনতি ষড়ঙ্গী আর আমি রিক্সা করে স্কুলে যেতাম। তারপর স্কুলের কাছেই ক্ষমার দিদার বাড়ির বারান্দায় অপেক্ষা করতাম সবাই। ক্ষমা রাগাবার জন্য আমাকে 'বৌদি' করে ডাকা শুরু করেছিল। বলল, “দাদা কিন্তু এসেছে শিবপুর থেকে।” আর আমি? কাঁদার উপক্রম হতাম। এইরকম অনেক ঘটনা -যেটা স্মৃতির ঘুড়িতে পতপত করে উড়ছে এতদিন পর। এতদিন তো যুদ্ধের সামিল ছিলাম।

ওদের বাড়ি থেকেই সব দেখতে পেতাম। তারপর গেট সময়মত খুললে- স্কুলের ভেতর ঢুকে যেতাম।

তারপরেই পার্সিয়াল্টি শোনার দুঃখকে ভুলে সুখের নিশিভোরে ডুবে গেলাম। পুরীর সমুদ্রের নীল জলের সাথে রং মিলিয়ে সকলের নীল শাড়ি পড়া, শুধু সমুদ্রে নুলিয়াদের হাত ধরে জলের ভেতরে যাব যারা তাদের মধ্যে ক্ষমা, তনুশ্রী, সংঘমিত্রা আর আমাকে ফ্রক নিয়ে যেতে বলেছিলেন দিদিরা।

দেখলে তো, এখন স্কুলের বহু পুরোন বিশাল গেট -এর কি অবস্থা। বন্ধ হয়ে মাঠে পড়ে থাকা নীল বাসটাকে, মাঠের স্টেজে, হস্টেলের পাশের আমড়া গাছটাতেও ফেলে আসা দিনগুলো উঁকি দেয়। শীতের শেষে ঝরে যাওয়া শুকনো শাল পাতার গদি আর দোতলার বারান্দা থেকে বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে শালফল গুলো নীচে পড়তে পড়তে আজ ও বলে.. "টুউউকি......."

আমার মেয়েবেলা আজ ও ডাকে। আয় আয়। লাল মাটির দেশে আয়...লাল পাহাড়ির দেশে আয়...।

যেতে তো ইচ্ছে হয়...কিন্তু যাই কিভাবে। আজ সব দরজা বন্ধ...আজ যে সংসারের মায়াজালে নিজেকে আটকা করে ফেলেছি। তাই তো ভাবি বসে বসে..."কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া...” তাই তো এত আশা। লিখি। আমার কথাদের সুন্দর করে সাজিয়ে লিখি। নিজেই খুশি হই। কেউ ভালো বললে, আরো লিখতে ইচ্ছে হয়।

“সংসারের কোন কাজে যে হতভাগ্যের বুদ্ধি খেলে না, সে নিশ্চয়ই ভালো বই লিখিবে”-সত্যিই তো। তাই আজও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার ইচ্ছা শুধু সবাই পড়ুক-আমার ভুল ধরিয়ে দিক। ...একজনও তো পড়ছে-এটাই আমার সান্ত্বনা। আমি আজ পর্যন্ত কাউকে জোর করি নি আমার লেখা পড়ার জন্য। খুশি মনেই তারা পড়ছে।

দেখতে দেখতে হাইয়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা এসে গেল।

বিহার থেকে ডাক্তার কাকা আর বাবা আমাকে ছেড়ে দিয়ে আসতেন রিক্সায়। পরীক্ষা হল পড়েছিল ছেলেদের স্কুল কুমুদকুমারীতে। হাফ টাইম-এ ওনারা আমার জন্য ডাব-এ সন্দেশ গুলে নিয়ে এসে অপেক্ষা করতেন। আমি তো বাবা আর ডাক্তার কাকাকে দেখেই একেবারে সোজা আমার রুমে লুকিয়ে থাকতাম। ডাক্তার কাকাই আমাকে 'বাতাসী' বলে ডাকতেন। বলতেন, “তুই শাড়ি পড়েছিস? আমার তো মাথা ঘুরছে রে।”

বন্ধুদের কথায় আমি যখন বাবা/ডাক্তার কাকার আনা ডাবে সন্দেশমাখা খেতে নিচে নেমেছি, সেই ফাঁকে কুমুদকুমারীর ফার্স্ট বয় অরূপ দত্ত আমার কম্পাস বক্স নিয়ে লুকিয়ে রেখে দেয়। আমি ফিরে এসে ডেস্কে বসে দেখি আমার কম্পাস বক্স নেই। আমাদের ফার্স্ট গার্ল ক্ষমা গুপ্ত তখন হাসছে মুখ টিপে। কান্নাকাটি করাতে অরূপের কথা বলে। বলে, “তুই যেন কলকাতার কলেজে পড়িস। আর ওকে তোর অ্যাড্রেস দিয়ে রাখিস।” কি অদ্ভুত স্কুল জীবন ছিল!

তারপর হাইয়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পর জব্বলপুরে চলে যেতে হল...। মেজদার শখ ছিল আমি ঝাড়গ্রাম রাজকলেজে পড়ি। আমি ঝাড়গ্রামে থাকি- বাড়ির আর কারোর একদম শখ ছিল না।

বাবাও ঝোঁক ধরলেন যে, জব্বলপুরে সেজদা-দিদিয়ার কাছেই আমরা থাকব। বাবাও তাহলে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন।

ভালো রেজাল্টের জন্য কলকাতায় চান্স পেয়েছিলাম ভিক্টোরিয়া ও লরেটো কলেজে। কিন্তু সব নাকচ। নদার ইচ্ছে ছিল বি.ই কলেজে আর্কিটেকচার নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো...। আমারও তাই ইচ্ছে ছিল। হয়ত আজ অনেক আত্ম নির্ভরশীল হয়ে উঠতাম।

কলকাতায় কেউ না থাকার জন্য হস্টেলে রাখতে রাজি ছিলেন না বাবা। আসলে বাবা আমাকে ছেড়ে থাকতে পারতেন না। কাজেই বাই বাই করে আমার প্রিয় শহর ঝাড়গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হল... পরিযায়ী পাখীরা তো এরকম-ই হয়। আমার এর মধ্যেই তিনটে স্কুল বদলানো হয়ে গেল। বন্ধু করছি-আর তারা অতলে হারিয়ে যাচ্ছে...

(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. পড়লাম। তোমার এই লেখা পড়ে আমারও নানান স্মৃতি ভেসে আসে চোখের সামনে। তোমার লেখায় এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য যে, আমার ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি উঁকি দিয়ে গেল।

    ReplyDelete