জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব-(৪৯)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব-(৪৯)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ভারতবর্ষ ও ধর্ম

প্রাথমিক স্তরে সাংখ্যাদর্শনে সোজাসুজি ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়নি, যেহেতু ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রামাণ্য কোনো যুক্তি নেই বা যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণও করা যায় না। এই দর্শনে ব্যক্তি বিশেষের মুক্তাআত্মার স্বীকৃতি আছে এবং প্রাকৃতিক বিধানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সেই আত্মাকে মানুষের চেতনারও বহু উচ্চস্তরে উপলব্ধি করা সম্ভব। পরবর্তীকালে সংখ্যাদর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে, যা পতঞ্জলি দর্শনের পরিপন্থী। পতঞ্জলি দর্শনে ভক্তিযোগ দ্বারা সমাধিলাভ সম্ভব বলা হয়েছে। পতঞ্জলি দর্শনে ঈশ্বরকে কোন সংস্কার দ্বারা আবদ্ধ করা যায় না। তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বত্র বিরাজমান। তিনি সংস্কারাবদ্ধ মানুষকে চৈতন্যশক্তি দান করে মুক্তিলাভের পথে এগিয়ে যেতে আশীর্বাদ করে চলেছেন। ন্যায়সূত্রে ঈশ্বরই এই জগতের সৃষ্টিকর্তা এবং মানুষকে তার কৃতকর্মের ফল তিনিই দান করেন। বৈশেষিক দর্শনে সোজাসুজি কোথাও ঈশ্বরের উল্লেখ নেই। পূর্ব মীমাংসায় ব্রহ্মান্ডের কোনো আরম্ভ বা শেষ নেই এবং ব্রম্ভান্ডের কোনো সৃষ্টিকর্তারও প্রয়োজন নেই। ঈশ্বরও ধর্মের বাহক ও রক্ষক নন। যিনি কর্মের মধ্যে রয়েছেন- ধর্ম ও অধর্ম সবই তার। এই বিষয়ে ঈশ্বরের কোনো ভূমিকা নেই। 

‌মহর্ষি বদরায়ণ উপনিষদ অবলম্বন করে বেদান্ত সূত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদগুলির মধ্যে স্পষ্টতা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদ এবং রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও  মাধবাচার্যের দ্বৈতবাদ দর্শনই শেষ পর্যন্ত স্বীকৃত দর্শন হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। মহর্ষি শংকর ঈশ্বরকে ব্যবহারিক ও পারমার্থিক- এই দু- ভাগে দর্শন করেছেন। এই জগত পরিদৃশ্যমান এবং ঈশ্বরই তার স্রষ্টা ধারক ও সংহারক। পারমার্থিক দিক দিয়ে তিনি পরিদৃশ্যমান, এই জগৎ মিথ্যা এবং ঈশ্বরই একমাত্র সত্য ও তিনিই ব্রহ্ম- এই যুক্তিতে স্থিত থেকে স্বমত প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ব্রহ্ম নির্গুণ- এই বিচার দ্বারা তিনি অদ্বৈতবাদের প্রবক্তা। ব্রহ্মা একদিকে স্বগুণ সম্পন্ন, অপর দিকে নির্গুণও।
 রামানুজের মতে ঈশ্বরই একমাত্র সত্য, তার বাইরে আর কিছু নেই। ঈশ্বরই সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা ও ধ্বংসকর্তা। তিনি প্রকৃতি বা কর্ম দ্বারা আচ্ছন্ন নন। তিনি তার নিজের মধ্যেই আচ্ছন্ন, তার মধ্যে প্রকৃত জীবনের কোনো কালিমা নেই। তিনি সদা নির্মল। তাকে বিষ্ণু শিব নারায়ন প্রজাপতি- নানা নামে বিভূষিত করা যায়।
 মাধবাচার্যের মতে, ভগবান জীব ও পরিদৃশ্যমান প্রকৃতিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা যায়। জীব এবং প্রকৃতি ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রাধীন। চিরন্তনভাবে স্বতন্ত্র থেকেও সবই তার অংশ বিশেষ ও তাঁর দ্বারা-ই নিয়ন্ত্রিত। ঈশ্বরের সঙ্গে জীবের এবং বিশেষ কোনো বস্তুর অনু অংশের সঙ্গে অন্য বস্তুর অনুময় অংশের সম্পর্ক ও স্বাতন্ত্র্য- দুই-ই বর্তমান।

ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনস্তিত্ব বিষয়ে আলোচিত বহু দার্শনিক মতবাদের প্রতিষ্ঠা থাকলেও হিন্দুশাস্ত্রে ঈশ্বরের অস্তিত্বই সর্বশেষ দার্শনিক মতবাদ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। এই বিষয়ে প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক উদয়ানাচার্য তার বিখ্যাত কুসুমাঞ্জলি সূত্রে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছেন। তাঁর যুক্তি হল:

১। মৃত্তিকা থেকে মৃৎপাত্র যেমন বিশেষরূপ ধারণ করে এবং মৃৎপাত্রের একজন স্রষ্টা আছেন, তেমনই এই প্রকৃতিরও একজন স্রষ্টা আছেন। 
২। বাস্তব জগতে যা বিশেষভাবে একত্রিত ও স্বীকৃত বা বিধৃত তার পিছনে কোনো চৈতন্যসত্তার ক্রিয়া অবশ্যই বর্তমান। তা না হলে সৃষ্টিই অসম্ভব হত। 
৩। বস্তু বা চৈতন্যসত্তার জ্ঞান এবং এই সৃষ্টির পিছনে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্য কি- সে বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতে পারলে কার্যকারণ কোনো সংশয়ই থাকে না। ঈশ্বরই সেই পরম কারুণিক। 
৪। দুটি পরমাণুর মিলনেই অণুর সৃষ্টি। দুটি পরমাণুর মিলনের পিছনে এক পরম চৈতন্যসত্তার প্রকাশ। তিনিই ঈশ্বর। 
৫। তিনিই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুকে ধারণ করে আছেন এবং সুসংবদ্ধ রেখেছেন, কোথাও পতনের সুযোগ নেই। 
৬। তিনি মানুষকে ধীশক্তি দান করে বস্তুর ব্যবহারকে বৈচিত্র্যের ভিতর দিয়ে দেখে তাকে জানার পথ প্রশস্ত করেছেন। 
৭। তিনি ভূত-ভবিষ্যৎ বর্তমান কালনিয়ন্তা হয়ে সর্বত্র বিরাজমান, সর্বজ্ঞ, চির অপরিচ্ছন্নভাবে এই সৃষ্টির জন্মদাতা, পাল কর্তা এবং ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে তিনিই পুনর্নির্মাণ করে চলেছেন। 
৮। যা কিছু বহুরূপে বিরাজমান, তা একের মধ্যেই নিহিত এবং সেই একই পরমেশ্বর যার দ্বিতীয় সত্তা নেই। 
বাস্তববাদীদের দৃষ্টিতেও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর; ব্রহ্ম ও মায়ার যুক্ত প্রভাবে তিনি এই সৃষ্টির মধ্যে চিরবিদ্যমান। চার্বাকগণ পৃথিবীকে সর্বংসহা স্বতঃউজ্জীবনের ধাত্রী হিসেবে শুধু নয়, বহু বস্তুর মিলন ও সংযোগের মধ্যে দিয়ে এই পৃথিবীর জন্ম- এখানে ঈশ্বরের কোনো অস্তিত্ব নেই, বলে প্রমাণ করেছেন। তারা অবশ্য মানুষের চৈতন্যময় সত্তার দিকটিকে উপেক্ষা করেননি, কিন্তু তাও এই বস্তুবোধের এক বিশেষ প্রকাশ মাত্র। সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আরাম ভোগ মানুষের চিরদিনের কাম্য। এর জন্যে স্বর্গ-নরক, পাপ-পূণ্য বিচার করার কোনো যুক্তি নেই। জৈনগণের বিচারে পৃথিবীর পিছনে বস্তুর বিন্যাস ও সুসমঞ্জস্য ক্রিয়া বর্তমান- সেগুলি হল সময়, স্থানিক বিস্তার আত্মা ও বস্তু। এই বস্তুগুলির বৈচিত্র্যময় ও সুসমঞ্জস বিন্যাস থেকে ব্যাক্তি তার চৈতন্যময় সত্তাকে প্রাপ্ত হয়। তাই জীবাত্মা চৈতন্যময় সত্তায় নিত্য দীপ্যমান এবং এক এক জীবের এ বিষয়ে এক এক রকম অবস্থান এবং তারতম্য বিদ্যমান। (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments