জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব- (৫০)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম 
পর্ব- ৫০

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ভারতবর্ষ ও ধর্ম


মানদণ্ডের নিরিখে একদিকে চৈতন্যের সর্বোচ্চস্তরে মানুষ, অন্যদিকে রয়েছে 'উদ্ভিদ জগৎ', স্থাবর বস্তুজগতের যাবতীয় আবির্ভাব। গৌতমবুদ্ধ ঈশ্বরীয় কোনো সত্তায় অবিশ্বাসী ছিলেন, কারণ তা অনুমান নির্ভর। ঈশ্বর আছে কি নেই- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিরব থাকতেন। তাঁর সময়ে মানুষের নৈতিকতার দিকটি উল্লেখযোগ্যভাবে চর্চিত হত এবং নশ্বরতা, সদাপরিবর্তনশীলতা এবং আত্মার অস্তিত্বহীনতা, এই সবই বিচারের বিষয় ছিল। সুকর্ম সাধন শ্রেষ্ঠ পথ বলে বিবেচিত হত। 

  সাংখ্যদর্শনে দুটি চিরন্তন মৌলিক বা আদি বাস্তব সত্যের স্বীকৃতি আছে। একটি হল বাস্তব প্রকৃতি যা নির্জ্ঞানের সম্পদ, অপরটি পুরুষ যা সজ্ঞানের বা সচেতনতার ধন। প্রকৃতি পুরুষের সংসর্গে এসে বিশ্বসংসারের ক্রিয়ায় লিপ্ত। এই সংযোগটি কিভাবে ঘটেছে বা ঘটে- এ ব্যাপারে সাংখ্য নিরব। পতঞ্জলি দর্শন এই সংযোগের পিছনে অবিদ্যা এবং ঈশ্বরের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। যোগদর্শনের ব্যাখ্যা হল, ঈশ্বরের সংসর্গ ব্যতীত এই সংযোগ সম্ভব নয়। ন্যায় বৈশেষিক দর্শনের মত হল- ঈশ্বর এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, যার কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। কার্য-কারণ ব্যতিরেকেই পরমাণু থেকে এই পৃথিবীর সৃষ্টি, প্রতিটি জীবাত্মাই পরম সত্তার অংশ। ঈশ্বরই পৃথিবীর নিয়ন্ত্রক এবং জীবের ভালোমন্দের বিচারক। মীমাংসা সূত্রে জোর দিয়ে প্রতিপাদিত হয়েছে যে, পরমাণু থেকেই স্বতঃসঞ্চালিত এক মৌলিক কর্মবিধিই জগতকে ক্রিয়াশীল রেখেছে।

 এর পিছনে ঈশ্বরের কোনো ভূমিকা নেই। শঙ্করের মতে ব্রহ্মই জগতের কার্যকারণের নিয়ামক এবং এই মায়াময় জগতের নিয়ন্ত্রণ কর্তা। ব্রহ্মই মায়ার বন্ধনে এসে মায়াময় ভগবান বা ঈশ্বর রূপ ধরেছেন। জীব প্রকৃতির দ্বারা পরিপোষিত হয় এবং কৃতকর্মের ফল অনুযায়ী তার মুক্তি নির্ভর করে। সৃষ্টির পিছনে ঈশ্বরের কোনো উদ্দেশ্য নেই। এই সৃষ্টি তার খেলার অঙ্গ মাত্র।

  মাধবাচার্যের মতে ঈশ্বর প্রকৃতি থেকে এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। জীবের মুক্তি ঈশ্বরের করুণা ছাড়া সম্ভব নয় এবং তাকে ভজনা করেই মানুষ মুক্ত হতে পারে। 
ভারতীয় দর্শনের বিচারে মানুষের ব্যাক্তিস্বরূপ কোনোভাবেই ঈশ্বর নিরপেক্ষ নয়। যে পরমসত্তা স্বতঃপ্রতীয়মান, নির্গুণ অপরিচ্ছিন্ন নিশ্চল, নিত্যজাগ্রত অরূপসুন্দর, তিনি সৃষ্টিক্ষেত্রে বহুর ম
ধ্যে নিত্য ক্রিয়াশীল প্রত্যক্ষ ও মায়াচ্ছন্ন। তিনি জীবাত্মা দ্বারা প্রকাশমান, পুরুষ প্রকৃতি দ্বারা সত্ত্ব, রজ ও তমোগুণে আপ্লুত। সুতরাং মানুষের প্রকৃতি এই ত্রিগুণের প্রভাব দ্বারা পরিচালিত। মানুষের বাসনার অশেষত্ব তাকে সর্বদা কর্মচঞ্চল রাখে এবং ত্রিগুণের বৈশিষ্ট্যময় প্রভাবে তার আচরণিক ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রগুলি প্রকাশ পায় এবং এই অর্থেই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিও প্রাধান্য পায়। 

 বিষ্ণু ভাগবত এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে চিহ্নিত করে মানুষের নৈতিক মানদণ্ডগুলি নিরূপণ করেছেন। মহামতি চরক মানুষের সত্ত্বময়তা চিহ্নিত করে দেবতা ও উপদেবতাদের নাম ব্যবহার করেছেন:

১। ব্রহ্মচারী ব্যক্তি উদ্যমী, অত্যন্ত বুদ্ধিমান নৈতিক গুণসম্পন্ন ধর্মতত্ত্ব দার্শনিকতা ও বিজ্ঞানের আলোয় সদা প্রদীপ্ত; 
২। আর্যসত্ত্বগুণের অধিকারী ব্যক্তি যুক্তিবাদী, শাস্ত্রজ্ঞানী ক্রান্তদর্শী সংযমী নিষ্ঠাবান। তিনি কখনও আবেগ বশীভূত নন; 
৩। ঐন্দ্রিয়সত্ত্বগুণের অধিকারী ব্যক্তি উদ্যমী, আলস্যরহিত, সুবক্তা ধর্মীয় অর্থনৈতিক এবং আনন্দ-প্রসূত ক্রিয়াকর্মে নিযুক্ত থাকতে ভালোবাসেন;
৪। যমসত্ত্বগুণের অধিকারী ব্যক্তি সমদর্শী, প্রত্যুৎপন্নমতি, অন্বেষু, স্মৃতিধর এবং নৈতিক মানদন্ডে ঐশ্বর্যবান; 
৫। বরুণসত্ত্বাধিকারী ব্যক্তি শান্ত সাহসী, রুচিসম্পন্ন, চিরউদ্যমী, প্রয়োজনের বাইরে আনন্দময় জীবনের প্রতি আগ্রহী। ক্রোধ, দ্রোহ বিষয়ে অত্যন্ত বিচারশীল এবং সামাজিক ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যক্তিকে সহায়তা দান তার বিশেষ কর্তব্য; 
৬। কুবেরসত্ত্বাধিকারী ব্যক্তি সংসারী, ধর্মজীবন পালনে তৎপর, সকলকে নিয়ে সুবিচার দ্বারা পরিচালিত হতে বদ্ধপরিকর। সুকর্মে নিয়োজিত থেকে গর্ব ও অহংকারকে দূরে রেখে শুভকারী ব্যাক্তিদের প্রশংসায় ও নৈতিক ক্ষেত্রে বিচ্যুত ব্যাক্তিদের তিরস্কারে নির্দ্বিধ;
৭। গন্ধর্বসত্ত্বাধিকারী ব্যাক্তি কলাশাস্ত্র চর্চায় সদা আগ্রহী। নৃত্যগীত সহ গ্রন্থপাঠে ও শাস্ত্রজ্ঞান লাভে তৎপর। এই ব্যক্তি নারী-সাহচর্যকামী, পুষ্প প্রেমী ও  অন্য সুকুমার বৃত্তিতে বিশেষ আগ্রহী।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments