জ্বলদর্চি

সাহিত্য/ বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

সাহিত্য  

বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়


আমি তখন দার্জিলিং -এ । আমার বয়স তখন ২৩+ মাত্র । চাকরি করতে এসেছি শ্রী রামকৃষ্ণ
উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে । সহকারী প্রধান
শিক্ষকের পদে। বলা বাহুল্য এতো অল্প বয়সে
এহেন উচ্চপদে আসীন হয়ে আমার মনে বেশ একটা গর্ব ভাবও চলে এসেছিলো ।
স্কুলটি শ্রী রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠের কর্তৃত্বের
অধীন । মঠের অধ্যক্ষ তখন স্বামী ভবেশানন্দ মহারাজ । স্বামীজী আমাদের খুবই ভালোবাসতেন। আমরাও দু বেলাই তাঁর কাছে
যেতাম। তাঁর মুখের কথা শুনে খুবই আনন্দ পেতাম। আমরা বলতে আমি ও মৃণাল কান্তি
সিংহ। আমরা একই সঙ্গে বাণীপুরে প্রশিক্ষণ
নিয়েছিলাম।আমরা একেবারে হরিহর আত্ম
ছিলাম দুই জনে ।
বয়স কম থাকায় আমরা খুবই উৎসাহের সঙ্গে
কাজ করতাম । আর অচিরেই স্থানীয় অভিভাবক
ও ছাত্র ছাত্রীদের কাছে আমরা খুবই জনপ্রিয় হয়ে
উঠেছিলাম।
একবার স্থানীয় সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বড়ুয়া সাহেব আমাকে তাঁদের স্কুলে সাহিত্য বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য
আমন্ত্রণ জানালেন । শ্রোতারা হবে নবম হতে
একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীরা । তিনটে ভাষায়
বলতে হবে বাংলা,ইংরেজি এবং নেপালি ।
আমি নেপালি ভাষায় তেমন ভাবে বলতে পারবো
না জেনে তিনি বললেন গুরুং স্যার আপনার
পাশেই থাকবেন তিনি আপনাকে সাহায্য করবেন।
অগত্যা আমি রাজি হলাম ।
বিকেলে গেলাম স্বামী ভবেশানন্দ মহারাজের
কাছে । তিনি আমাকে আশীর্বাদ করলেন।
বললেন, "  বক্তৃতা দেওয়ার সময় বিশেষ কারও
দিকে তাকাবে না । মনে মনে ভাববে তুমি সূর্য।
অন্যরা তোমার কাছে নিষ্প্রভ । ভালো হবে তোমার বক্তৃতা । কোনও চিন্তা করো না । ঠাকুর তোমাকে
আশীর্বাদ করবেন। কোনও রকম দুশ্চিন্তা করো না। সকলে তোমার বক্তৃতা বেশ মন দিয়েই শুনবে।"

কিন্তু সাহিত্য কাকে বলে কি ভাবে বোঝাবো?
খুবই চিন্তা হচ্ছিলো । আচমকা সমাধান পেয়ে
গেলাম । সেদিন হেডমাস্টার মহাশয়ের ঘরে বসে আছি। মৃণাল আর আমি ।
হঠাৎ কে যেন বাইরে হতে বলে উঠলেন,"May
I be an intruder sir?"
আমরা শশ ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। একজন
দীর্ঘাকায় ভদ্রলোক ঘরে ঢুকছেন। শ্রী রামকৃষ্ণ
B.T. কলেজের principal মেজর সেন। আর্মির মেজর ছিলেন । দুর্ঘটনায় তাঁর মুখ আর মেহের
কিছু অংশ পুড়ে গিয়েছিলো। আড়ালে সকলে
বলতো মুখ  পোড়া বলে। এ ডাকটা তাঁর খুব একটা
অপছন্দের ছিলো না । হাসতেন শুনে।
আমি কিন্তু এসব নিয়ে ভাবছিলাম না। আমি
ভাবছিলাম তাঁর কথাটি -
"May I  be an intruder sir ?"
এইতো সাহিত্যের আসল অর্থ পেলাম। 
আমি কি আপনার আনন্দে,নিরানন্দে ; সুখে,দুখে : মিলনে,
বিরহে আপনার সর্ব অবস্থায় আপনার সাথী
হতে পারি ? আমি কি আপনার সর্ব ক্ষণের সঙ্গী
হতে পারি ? সাহিত্য তো এই কাজই  করে ।
আমার মন আনন্দে ভরে উঠলো ।  বলে উঠলাম
'ইউরেকা' । আমি পেয়ে গেছি আমার সমস্যার
সমাধান ।

:"May I be an intruder upon your precious time sir ?
আমি কি আপনার মূল্যবান দময় সীমানায় অনাহুত ভাবে প্রবেশ করতে পারি?
(আমি কি আপনার উত্থানে,পতনে; জয়ে,পরাজয়;
নিদ্রায়,জাগরণে; আনন্দে,বিষাদে; সবলতায়, দুর্বলতায়; হাসি,কান্নায়; সৌভাগ্যে,দুর্ভাগ্যে ; নিরাপত্তায়,বিপন্নতায়; মিলনে,বিরহে; সম্পদে,
বিপদে; উন্নতি ও অবনতিতে আপনার সঙ্গী হতে পারি?)"

" Sure sir ,Welcome sir"

"আমি মেজর সেন । শ্রী রামকৃষ্ণ বি.টি.কলেজের
প্রিন্সিপ্যাল ।
(আমি একজন কবি তথা সাহিত্যিক)"

"আমরা আপনাকে চিনি sir । আপনাকে কে
না চেনে ? দার্জিলিং -এর সকলেই আপনাকে ভালোবাসে।"

'হাঁ এই মুখ পোড়াকে সকলেই চেনে"

                 
                                         
সাহিত্য- ২
                 
সাহিত্য শব্দটি এসেছে 'সহিত' এই শব্দের সঙ্গে 'ষ্ণ'
প্রত্যয় যুক্ত করে । কিন্তু এ ভাবে তো সাহিত্যকে ধরা যাচ্ছে না । তাই বিচার করতে হবে এই 'সহিত'
শব্দটি দিয়েই  ।
সহিত শব্দটির দুটি অর্থ ।
প্রথমটি হলো :
সংযুক্ত,সমন্বযন,বন্ধন,সংযোগ,সম্পর্ক স্থাপন,সন্নিবেশ, সান্নিধ্য, ইত্যাদি ।
দ্বিতীয়টি হলো :
সম্যক হিত যুক্ত, হিতকর,মঙ্গল জনক,শ্রেয়স্কর,
কল্যাণ কর ইত্যাদি ।

জীবনের পথ পরিক্রমা কালে মানুষ নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকে। এই সব অভিজ্ঞতা
যখন তার  ভাবনায় ও মননে মধুর এক স্বপ্ন কল্পনার সৃষ্টি করে তখন কোনো কোনো ব্যক্তি চান বাক্যের মাধ্যমে সে গুলির প্রচার করতে । তাঁরা চান হৃদয়ের এই ভাবটির একটি  রসঘন  বাঙময়
মূর্তি সাধারণ পাঠকেরাও পড়ুন জানুন  । কিন্তু ভাবের অন্যতম প্রধান বাহন তো ভাষা । তাই  ভাষা
যদি মধুর ও রসসমৃদ্ধ না হয় তবে সাধারণ পাঠক
তা চোখেও দেখবেন না ।
কনে দেখানোর সময় মা যেমন তাঁর মেয়েটিকে সুন্দর করে নানা প্রসাধন সামগ্রী দিয়ে সাজিয়ে তোলেন আর সুন্দরী করে তোলেন ঠিক তেমনি সাহিত্যিকরাও  তাঁদের রচনাটিকে ছন্দ , অলংকার ও সুললিত শব্দ প্রয়োগ করে সাজিয়ে তোলেন। এতে তাঁর মনের ভাবনাটি সুন্দর ও রূপময় হয়ে ওঠে। সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ।
সেটা তখন হয়ে ওঠে সাহিত্য । সুপ্রসাধিত এই ভাষা পাঠকের মনে আলোড়ন তোলে ।
আগের দিনে কিন্তু গদ্য সাহিত্যের তেমন চল
ছিলো না । তখন শুধু কাব্যেরই প্রচলন ছিলো।
 কিন্তু সব পাঠকই কি একই ভাবে কবির ভাবনাকে
অনুসরণ করেন ? না কখনোই নয় ।
একটি গোলাপ ফুলের উদাহরণ দেওয়া যাক। সাধারণ মানুষের কাছে এটি নেহাতই একটি ফুল
মাত্র । 
একজন দার্শনিকের কাছে এটি প্রতিভাস
মাত্র ।কোনো ফুল ই নয় । শুধু মায়া আর নেহাতই
অলীক একটি বস্তু।
 একজন লাজুক প্রেমিকের কাছে এটি তার ভীরু হৃদয়ের প্রেমের প্রতীক।গোলাপ পাঠিয়ে সে প্রেমীর কাছে তার প্রেমের বার্তাটি পৌঁছে দেয় ।
 একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর কাছে এটি একটি গোত্র মাত্র যার নাম Rasaceous । 
আর একজন কবির কাছে অতুলনীয় এর সৌন্দর্য্য।  এ হলো ফুলের রাণী।

প্রসঙ্গ ক্রমে বলতেই হয় সহযোগিতা ছাড়া সাহিত্য
সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে না । সাহিত্যের সঙ্গে সমাজ ও জীবনের সুনিবিড় একটি যোগসূত্র থাকা প্রয়োজন। সাহিত্য সমাজে কল্যাণের বার্তা দেবে।
মানুষ যেন মানুষের প্রকৃত বন্ধু হয়ে ওঠে এটাই শেখাবে । এটি সহিতের দ্বিতীয় অর্থের সঙ্গে
সামঞ্জস্য পূর্ন । সাহিত্য কখনই হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়াবে না অশ্লীলতাকে স্থান দেবে না ।

সব শেষে বলি পাঠক ও সাহিত্যিকের মধ্যে একটি
নিবিড় আত্মিক যোগ গড়ে ওঠা একান্ত দরকার।

'একাকী গায়কের নহে তো গান মিলিতে হবে দুই জনে,
গাহিবে  একজন খুলিয়া গলা আর একজন গাবে মনে,
 তটের বুকে  লাগে জলের ঢেউ তবে সে কলতান উঠে,
বাতাসে বনসভা শিহরি কাঁপে তবে সে মর্মর ফুটে,
জগতে যেথা যত রয়েছে ধ্বনি যুগল মিলিয়াছে আগে--
যেখানে প্রেম নাই,  বোবার সভা সেখানে গান নাহি
জাগে ।
                                           --রবীন্দ্রনাথ

গায়ক ও সমঝফার শ্রোতার মতোই সাহিত্যিক ও
পাঠকের মধ্যেও একটি আন্তরিক যোগাযোগ
থাকা একান্তই প্রয়োজন ।
সাহিত্যিক ও পাঠকের এই  নিবিড় ঐক্য বন্ধনের মধ্য দিয়েই সাহিত্য তার সার্থকতা লাভ করে। তার আগে নয়।

                              স মা প্ত

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments